যাদবপুরের দেবরূপ সেনগুপ্ত এখন বাংলা থিয়েটারের উজ্জ্বল মুখ। নানা দলের নানা নাটকে ছোট বড় নানা চরিত্রে তাকে দেখা যায়। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরী, পারিবারিক ব্যবসা সামাল দিয়েও দেবরূপ মজে আছে থিয়েটারের নেশায়। ঘর বেঁধেছে থিয়েটারের আর এক লড়াকু অভিনেত্রী স্বাগতা সেনের সঙ্গে। আসলে থিয়েটারটা তার খানিকটা পারিবারিক ঐতিহ্য সূত্রে পাওয়া। দীপক সেনগুপ্ত ও অনুরাধা সেনগুপ্তের পুত্র দেবরূপের দাদু জীবন রায় থিয়েটারের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী উৎপল দত্তের পি এল টি নাট্যদলে অভিনয় করতেন। সেই দাদুর শিক্ষা, সাহচর্য, আদর্শে গড়ে ওঠা দেবরূপ ছেলেবেলা থেকেই একটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল পেয়ে গিয়েছিল। এক্ষেত্রে মা – বাবার সাহচর্যও ছিল তার পরম প্রাপ্তি।
দশ বছর বয়সেই কার্যত থিয়েটারে হাতেখড়ি দেবরূপের। পাড়ার থিয়েটারই সেক্ষেত্রে প্রথম সহায়ক হয়ে উঠেছিল। পাশাপাশি স্কুলের পরিবেশও। পাড়ার ও স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেই ভাড়াটে চাই, টেনিদা, ডাকঘর নাটকে মঞ্চে নামার সুযোগ। সেখান থেকেই একটা ভালবাসা জন্মেছিল থিয়েটারের প্রতি। তাই বলেকি ছোট থেকে শুধু থিয়েটারই করেছে?… না, পড়াশুনো তো ছিলই। প্রথমে রেনবো মন্টেশ্বরী স্কুল, তারপর মাধ্যমিক পর্যন্ত বেটার হাই স্কুল, পরে সেন্ট পিটারস স্কুল। স্কুল জীবনের গণ্ডি পেরিয়ে সানরাইজ কলেজে আই টি বিষয়ে পড়াশুনোর সময়েই ২০১২ সালে গ্রীণপার্কের অভিযান নাট্যদলে যুক্ত হয় অভিনয়ের সূত্রে। শুরু হয় দেবরূপের অভিনয় অভিযান। অভিযান নাট্যদলে ডঃ প্রশান্ত কুমার ঘোষ ও শ্রীমতি দেবীকা ঘোষের নির্দেশনায় “সদগতি” নাটকে অভিনয় করে প্রশংসা আদায় করে নেয় দেবরূপ। তারপর এই দলেই তপন গাঙ্গুলী রচিত “কাঁটার মুকুট” সুমিত বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত “উত্তরণ” কিংবা “একদিনের বাদশা” নাটকে বেশ কয়েকবার মঞ্চে নামার সূত্রে দেবরূপ একজন অভিনেতা হিসাবে নিজের জাত চেনায়।
থিয়েটারের জগৎটা তার ভালবাসার জগৎ হয়ে ওঠে। ২০১২ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত অভিযান নাট্যদলের বিভিন্ন প্রযোজনায় অভিনয় করে থিয়েটারের দুনিয়ায় একটা শক্ত মাটি পেয়ে যায় দেবরূপ। এরপর যাদবপুর স্পন্দন নাট্যদলের সঙ্গে যোগসূত্র গড়ে ওঠে। স্বাগতা সেন, সৈকত চক্রবর্তী, অভীক চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ ছিলেন এই দলের সঙ্গে। এখানে সৈকত চক্রবর্তী রচিত ও নির্দেশিত “আশমিল” নাটকে চন্দ্রশেখর আজাদের ভূমিকায় অভিনয় করে নজর কাড়ে। পরবর্তীতে সীতাভোগ, মৃতরিপু, চারের খোঁজে, আফতাব প্রভৃতি নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে ২০১৭ সাল পর্যন্ত। যাদবপুর স্পন্দনের পর পুষ্পক দলে। বিশিষ্ট অভিনেত্রী, নির্দেশক, নৃত্যশিল্পী আলোকপর্ণা গুহ এই দলের কর্ণধার। তাঁর নির্দেশনাতেই “এ হি কেশাভা”, “রাখো হরি আল্লা রাখা”, “মা” নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় এবং যথারীতি অভিনয় দক্ষতার প্রকাশ। “মা ” নাটকে তিনটি ভিন্ন ধরণের চরিত্রে অভিনয় করে। এই দলের ” আর্বোরীয়াল” নাটকে অভিনয়ও তার উল্লেখযোগ্য চরিত্রায়ণ। থিয়েটার পুষ্পক দলের আলোকপর্ণার নির্দেশনাতেই ডিজিটাল প্লাটফর্মে “যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ” এবং “অমল ও দইওয়ালা” তে আবার নিজের অভিনয় দক্ষতা প্রমাণ করে দেবরূপ। একই কথা বলা যায় মাচার মানুষ নাট্যদলে সুচরিতা বড়ুয়া চট্টোপাধ্যায় নির্দেশিত “অসুখ” এবং “মৃত্যুদেশ” নাটক প্রসঙ্গেও। ভবানীপুর আনন্দম নাট্যদলেও “জামগাছ ও একটি মানুষের গপ্পো” এবং “খেলা যখন” নাটকেও তার অভিনয় দর্শকের তারিফ আদায় করে নেয়। রাজডাঙা দ্যোতক দলে শুভাশিস ভট্টাচার্যের নির্দেশনায় “দ্বিখন্ডিত” এবং “রাবণ” নাটকের চরিত্র দুটিও দেবরূপের অভিনয় জীবনের মাইলফলক।
অভিনয় জীবনে দেবরূপ নাট্য প্রশিক্ষক তপন দাস, ডঃ প্রশান্ত কুমার ঘোষ, রমেন রায়চৌধুরী প্রমুখের কাছে পেয়েছে থিয়েটারে প্রশিক্ষণ। ডিজিটাল প্লাটফর্মে নির্দেশক হিসাবে নির্মাণ করেছে” Positive the found of death” নামে স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি। “আদেশ ছিলো” নামে একটি ছবিতে অভিনয় করেছে থিয়েটারে অভিনয়ের পাশাপাশি। দেবরূপ জানাল, থিয়েটারে সব ধরণের চরিত্রই তার পছন্দ। অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রিয় অভিনেতা। তাই সব চরিত্র করার আগে ভাবি, তিনি এই চরিত্রে অভিনয় করলে কীভাবে করতেন.. সেই ভাবনার সূত্র ধরেই নাটকের ছোট – বড় সব চরিত্র নির্মাণ করে মঞ্চে নামি। এভাবেই অব্যাহত দেবরূপের থিয়েটার অভিযান। এই অভিযানে আরো অনেক অনেক চরিত্রের প্রতীক্ষায় সে প্রতিদিন প্রহর গোনে।