অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। বড়ো বড়ো জলের কণা। বর্ষা এসে গেল। মাটি ভিজে, গাছ ভিজে, মনও ভিজে। মনের গহিন তারে কোথায় যেন বেজে চলেছে একটা টানা সুর। ওই বৃষ্টির মতোই লাগামছাড়া, নিয়মহারা সেই সুর। এজন্যই বোধহয় মাটির সঙ্গে মাটির কাছের মানুষগুলির এত মিল। প্রকৃতির বেমক্কা চলনেই তাঁদের হাত কেঁপে ওঠে। একটা নির্জীব যন্ত্রে তাঁরা নিমেষে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে ফেলেন। বৃষ্টির সঙ্গে টগর ফুলের একটা সম্পর্ক আছে, তেমনই বৃষ্টির মতোই অগোছালো দোতারাশিল্পী টগর অধিকারী। কত বছর আগে তাঁর সম্পর্কে জেনেছিলাম। সেই তবে থেকেই আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন টগর।
সারিন্দা বাজায় সাউদ সদাগর
বাঁশি বাজায় চোর
ব্যানা বাজায় ত্যানা পেন্দা
দোতারা হারামখোর।
সমাজে এইসব শিল্পীর স্থান নিয়ে একসময় এই ছড়া কাটা। যদিও প্রান্তিক মানুষদের কাছে তাঁরা খুবই আদরের ছিলেন। আসলে তাঁরা এতই গরিব, সমাজে মাথা তুলে দাঁড়ানো তাঁদের পক্ষে অসুবিধার ছিল। তবে ওই যে কিছু মানুষ স্থান-কাল মানেন না। বরং স্থান-কালই তাঁদের দ্বারা চিহ্নিত হয়। তেমনই টগর অধিকারীর নাম দোতারা বাদনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ৪টি তারের এই যন্ত্রের মধ্যমণি ২টি তার। তাই এই নাম। টগর অধিকারী জীবনে যতদিন বেঁচে ছিলেন, রাজার মতো বাজিয়েছেন। উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া, চটকা বাজানোয় তাঁর দোতারায় ছিল মাটির মূর্ছনা। সুরেন বাসুনিয়ার কাছে তাঁর শাস্ত্রীয় সংগীতশিক্ষা। ঢোলক, তবলা বাদনেও তিনি দক্ষ ছিলেন। দোতারা তো অনেক শিল্পীই বাজান, কিন্তু বাজনার অভিঘাতের বৈশিষ্ট্য এক-একজনের এক-একরকম।
টগর অধিকারী বহু খ্যাত মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন, তাঁদের প্রশংসাও কুড়িয়েছেন। শচীন দেববর্মন, পণ্ডিত রবিশংকর, সলিল চৌধুরী, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃথ্বীরাজ কাপুর, মুলকরাজ আনন্দ, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সুধী প্রধান — এঁদের মতো মানুষজন ছাড়াও বহু বিশিষ্টজনের তিনি তারিফ পেয়েছেন। এমনই ছিল তাঁর দোতারার জোর। কিন্তু যে কথাটা বলা হল না, তিনি ছিলেন অন্ধ, শারীরিকভাবে। আর মানসিকভাবে ছিলেন দোতারায় অন্ধ। আফসোস আমাদের, এমন মানুষের নজির প্রজন্ম ধরে রাখতে এমন একজন বিরাট মাপের মানুষকে বোধহয় সময়ের স্কেলে বাঁধা যায়নি। তবে শিল্পীর ভাস তাঁর জীবনকালে ছড়ায় না। এ তো শিল্পজগতের ‘মিথ’। আজ এই সময়ে এসে অনলাইন দোতারা বাজানোর কর্মশালাও হচ্ছে। কিন্তু টগর তাঁর সুঘ্রাণ ছড়িয়ে ঝুপ করে মাটিতে পড়ে গেলেন।
কথা বললাম আজকের একজন বিশিষ্ট দোতারাশিল্পী ধীরেন মিশ্রর সঙ্গে। ঢাকায় ছিল তাঁর আদি নিবাস। পরিবারে যাত্রাগান পরিবেশন করতেন সবাই। নিজের মামার কাছেই তাঁর দোতারা শিক্ষা। তিনি জানালেন, ‘কত প্রোগ্রাম করি, কত শিল্পীর সঙ্গে বাজাই, কিন্তু মনে হয় যেন সুরের মুর্ছনা নিয়ে দুপুরেই আটকে রয়েছি, বিকেল আর আসছে না।’ ধীরেন মিশ্রর এই জীবনবোধই প্রমাণ করে, একজন প্রকৃত শিল্পীর গভীরতা কোথায়! বর্তমান দোতারা শিল্পীদের প্রসঙ্গে তাঁর ভাবনায় জানালেন, ‘ভাবের ভান করলে এই যন্ত্রকেই অপমান করা হবে।’ তাঁর কথা ধার করে বলি, গান ও বাজনা যেন স্বামী-স্ত্রী। তাদের মধুর মিলনেই সৃষ্টি হয় সুরের ঝরনা। ‘সঠিক ভাব ছাড়া বাজনা কখনোই মনে ধাক্কা দিতে পারবে না। নিজের চোখের জল দিয়ে অন্যকে কাঁদানো সম্ভব, তবে সেটি কুম্ভীরাশ্রু নয়, নোনতা খাঁটি জল হওয়া চাই।’
ধীরেন মিশ্রর ‘বাদন’ গানকে যেমন পূর্ণতা দেয়, আলাদা করে সে নিজেও একটা চরিত্র হয়ে ওঠে। বড়ো মিষ্টি, মন-ছোঁয়া। দোতারা বাদনশিল্পীর সংখ্যা এ বাংলায় যথেষ্ট নয়। তাই বর্তমানে ধীরেনবাবু একটি বিদ্যালয় গড়েছেন, যেখানে তিনি তাঁর ঘরানার বৈশিষ্ট্য আজকের প্রজন্মের হাতে তুলে দিচ্ছেন। অমর পাল, গোষ্ঠগোপালের মতো মানুষজনের সঙ্গে তিনি বাজিয়েছেন। এখন তাঁর মতো বহু শিল্পীকে সরকারি সাহায্য অক্সিজেন জোগাচ্ছে। ধীরেন মিশ্রর মতো বহু শিল্পীই যন্ত্রটিকে ভালোবেসে বাজিয়ে চলেছেন। তাই বলতেই পারা যায়, টগর অধিকারীর সেই ঐতিহ্য আজও বেজে চলেছে বাংলার জনপদের প্রতিটি ধুলোকণার ছন্দে ছন্দে।