অবিসংবাদিত নাট্যকার মন্মথ রায় | সংকলন- অসীম দাস

বাংলা থিয়েটারে প্রথম একাঙ্কের জনক মন্মথ রায় বাঙালি হৃদয়ে চিরপরিচিত নাট্যকার। সেই সময়ের নাট্যকারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নাটক লিখেছেন তিনি। প্রায় ৩০০টি নাটক, তার মধ্যে দু’শোর বেশি একাঙ্ক। যদিও ‘মুক্তির ডাক’ লিখেই নাট্যকার হিসেবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। মন্মথ রায়ের জন্ম শতবর্ষ পেরিয়ে এসেছি তাও অনেক বছর তবু আজ এবং আগামীকালও বাঙালি নাট্যমননে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তিনি। বলা যেতে পারে সোনার চামচ মুখে নিয়েই জন্মেছিলেন তিনি। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় টাঙ্গাইলের গালাগ্রামে মন্মথ রায়ের জন্ম। দিনটা ছিল ১৬ জুন ১৮৯৯, বাবা দেবেন্দ্রগতি ও মা সরোজিনী দেবীর পাঁচ সন্তানের একমাত্র পুত্র, রায় পরিবারের দুলাল। দাদামশায়ের দেওয়া নাম মন্মথ ১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ নাটকের ধ্রুব চরিত্রে জীবনের প্রথম মঞ্চে পা রাখে ছোট বয়সে। যখন ছ’বছর বয়স তখন ম্যালেরিয়া অসুখে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য বালুরঘাটে সপরিবারে চলে আসেন তাঁরা। স্কুলের পড়াশুনা গৌরি পালের পাঠশালায় শুরু হলেও শেষ হয় এই বঙ্গে। পশ্চিম দিনাজপুর বালুরঘাট বিদ্যালয়ে পুনরায় ভর্তি এবং ১৯১৭ সালে এই বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাশ করেন। এর মধ্যেই ১৯০৮ সালে লিখে ফেলেন দু ‘পাতার নাটক ‘রাণী দূর্গাবতী’। জীবনের প্রথম লেখা নাটক। রবি ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটকে অমল হয়ে অবতীর্ণ হন ১৯১৩ সালে বালুরঘাট হাইস্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে।  চোখের সামনে দেখেছেন বঙ্গভঙ্গ, উত্তাল সারাদেশ, বৃটিশের অত্যাচারে অতিষ্ট ভারতবাসী তথা সমগ্র বাঙালি। বাবা দেবেন্দ্রগতি বালুরঘাটের মাহীনগর গ্রামে একটি জমিদারি এস্টেটের ম্যানেজার ছিলেন। আর মা সরোজিনী ছিলেন ধর্মপরায়ণা ও বিদ্যানুরাগী। দেবেন্দ্রগতি সেটা জানতেন। তাই স্ত্রীকে উপহার দিতেন নানা রকম বই। সরোজিনীর রান্নাঘরে একটি খাতা রাখা থাকত, সেটিতে রান্নার অবসরে তিনি কবিতা লিখতেন। মা-ই ছিলেন মন্মথর লেখার অনুপ্রেরণা।

পড়াশুনায় বরাবর ভাল ছাত্র। বাবার কাছে ইচ্ছে প্রকাশ করলেন ‘আইন’ নিয়ে পড়াশুনা করবেন। সেদিন অমত করেননি বাবা দেবেন্দ্রগতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে এম.এ. পড়ার পর আইন বিষয়ে স্নাতক হন। কিছুদিন বালুরঘাটে ওকালতি পরে সমবায় আন্দোলনে জড়িয়ে পরেন মন্মথ এবং ওকালতি ছেড়ে শিক্ষকতা বৃত্তি গ্রহণ করেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে সরাসরি যোগাযোগ না থাকলেও প্রতিবাদ-এর যন্ত্রণা তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াত প্রতি মুহূর্তে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.এ. পড়ার সময় (১৯২২) থেকেই নাটক রচনায় উৎসাহী হয়ে ওঠেন এবং লেখেন জীবনের প্রথম পঞ্চাঙ্ক ঐতিহাসিক নাটক “বঙ্গে মুসলমান” (রচনাকাল ১৯২০)। প্রথম অভিনয় হয়েছিল বালুরঘাট নাট্যমন্দিরে (১৯২৬ এ মঞ্চ প্রতিষ্ঠা) । বক্তিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয়ের ঘটনা অবলম্বনে রচিত এ নাটকের মূল প্রেরণা ছিল দেশপ্রেম। নির্দেশনার পাশাপাশি অভিনয়ও করেছিলেন সেদিন। রাত দশটায় শুরু হয় অভিনয় শেষ হতে দিনের আলো ফুটে গিয়েছিল, তখন প্রেক্ষাগৃহ প্রায় দর্শকশূন্য। রাতভোর নাটক প্রদর্শন, দর্শক বিরক্ত, এত বড় লেখা নাটক! শেষ হয় না কিছুতেই! এই অভিজ্ঞতা পরবর্তী জীবনে তাঁর কাজে লেগেছে। একসময় এই নাট্যমন্দির মঞ্চের সম্পাদক ছিলেন তিনি।

নাট্যকার মন্মথর ঝুলিতে পূর্ণাঙ্গ নাটকের তুলনায় একাঙ্ক নাটকের সংখ্যাই বেশি। চলচ্চিত্রের জন্য কাহিনি ও চিত্রনাট্য লেখাতে তাঁর ছিল সমান দক্ষতা। তাঁর লেখা বহু নাটক গ্রামোফোনেও রেকর্ড করা হয়েছে দেশ স্বাধীন হবার পর শিক্ষকতা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের প্রচার প্রযোজক পদে নিযুক্ত ছিলেন প্রায় ১২ বছর। এর পর আকাশবাণী কলকাতার পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রযোজক থাকেন কয়েক বছর (১৯৫৮-৬১)। মুখ্যমন্ত্রী তখন ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়, তাঁর আহ্বানে ঘনিষ্ঠ বন্ধু পঙ্কজ মল্লিকের সহযোগিতায় লোকরঞ্জন শাখার বিশেষ আধিকারিক পদে আসীন হন। এই সমস্ত দায়িত্বপূর্ণ পদে কাজ করার সময় দেশের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, ভৌগলিক পরিচয় সম্যকভাবে লাভ করেন। ফলে সেখান থেকেই তিনি পান নিত্য নতুন নাটক রচনার প্রেরণা। ছাত্রাবস্থা থেকে আমৃত্যু আত্মমগ্ন ছিলেন নাট্য রচনায়। সেই সব নাটকে তাঁর দেশপ্রেম, দেশের ইতিহাস মানব সমাজ ও সংস্কৃতির নিপুণ ছবি ফুটে ওঠে। নাটকের চরিত্র রূপায়ণে, সংলাপ রচনায় তাঁর দক্ষতা ছিল লক্ষণীয়। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ‘বাংলা নাট্যশালাকে হাত ধরে ধ্রুপদী থেকে আধুনিকে পৌঁছে দিয়েছেন’ মন্মথ রায়।

বর্তমান সমাজের বিষময় ব্যাধিগুলি তিনি বারংবার তুলে ধরেছেন তাঁর নাটকের মধ্যে। স্বাধীনতা-পূর্ব এবং স্বাধীনতা-উত্তর ভারত তথা বাংলায় মহাজন, জমিদার, মিলমালিক, অসাধু ব্যবসায়ী প্রভৃতির অমানুষী শোষণ ও নির্মম প্রবঞ্চনা প্রকাশ পেয়েছে মন্মথ রায়ের নাটকে। তাঁর গঠনমূলক, সমাজকল্যাণময় দৃষ্টি সজাগ ও সচেতন থেকেছে চিরকাল। জগন্নাথ হলের আবাসিকদের জন্য ১৯২৩ সালে মন্মথ রায় রচনা করেন ‘অম্বা’ নামের নাটকটি। তবে এই নাটক অভিনীত হয়নি, ১৯২৩ সালে তিনি ‘দেবদাসী’ নামে অপর একটি নাটক রচনা করেন। এই নাটকে তিনি বিজয়াদিত্য চরিত্রে অভিনয় করেন। এই ১৯২৩ সালে ২৫ ডিসেম্বর স্টার থিয়েটারে অহীন্দ্র চৌধুরীর পরিচালনায় ‘অম্বা’ নাটকটি মুক্তির ডাক’ নামে অভিনীত হয়। মুক্তির ডাক’ মন্মথ রায়কে দর্শক সাধারণের সমক্ষে নাট্যকার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়। ‘মুক্তির ডাক’ নাটকের অভিনয় মন্মথ রায়ের নিকট বিপরীত বার্তা বয়ে আনে, তিনি নাটকটির অভিনয় কালে নানান বিরূপ মন্তব্য শোনেন। এর ফলে তিনি আর নাটক রচনা না করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

১৯২৩ সালেই মন্মথ রায়ের জীবনে এক স্মরণীয় ঘটনা ঘটে। তিনি এই বছর বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন তপোবালা দেবীর সাথে। মন্মথ রায় প্রণীত ‘মন্মথ নাট্য সমগ্র’ তৃতীয় খন্ডে তাঁরই সৃষ্টি ১৯২৩ সালে রচিত একাঙ্ক অনু নাটক ‘নেতাজী আসছেন ‘, ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত নাট্যটি অশোকনগর নাট্যমুখ স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষপূর্তিতে গত ১৫ অগাস্ট অমল আলো তে এই নাট্যটি মঞ্চস্থ করে। অভি চক্রবর্তীর নির্দেশনায়। একটা মানুষ খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে কলকাতার একটি বাড়িতে ছদ্মবেশ ধরে ঢুকে পড়েন। যে বাড়িতে একসময় নেতাজীর পায়ের ধুলো পড়েছিল। বাড়ির নাম নেতাজী কুটীর। বাড়ির গৃহকর্তা নেতাজীর আদর্শে বিশ্বাসী তাই তাঁদের পরিবারের সবাই বিশ্বাস করেন একদিন নেতাজী ফিরে আসবেন। এই লোকটিই নেতাজী। এই অন্ধবিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়ে লোকটিকে আদর আপ্যায়ন করে। লোকটি একসময় তাঁদের ভুল ভাঙিয়ে চলে যান। আত্মবিশ্বাসী মানুষ আজও স্বপ্ন দেখেন তিনি আসবেন, একদিন না একদিন তিনি ফিরে আসবেন। অসাধারণ এই ছোট্ট একাঙ্ক লিখেছেন কত বছর আগে যা আজও আমাদের বিশ্বাসকে টলাতে পারেনি ‘মন্মথ রায় নাট্য গ্রন্থাবলী’ ১ম খন্ড (একাঙ্ক) পাঠ করে কাজী নজরুল ইসলাম নাট্যকারকে চিঠি লিখলেন (৪.৭.১৯২৭) – “একবুক কাদা ভেঙ্গে পথ চলে এক দীঘি পদ্ম দেখলে দুচোখে আনন্দ যেমন ধরে না, তেমনি আনন্দ দুচোখ ভরে পান করেছি আপনার লেখায়” ।

বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি নাট্যগবেষক ও সাহিত্য সমালোচক ড. অজিতকুমার ঘােষ নাট্যকার মন্মথ রায় সম্পর্কে বলেছেন, “তিনি কখনও আঘাতে কঠোর, কখনও বা ভবিষ্যতের সােনালি স্বপ্নে বিভাের, কিন্তু তাহার উদ্দেশ্য সর্বত্র একসমাজের পরিপূর্ণ মুক্তি ও সর্বাঙ্গীন কল্যাণ।” ১৯২৭ সালে পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত তাঁর নাটক ‘চাঁদ সওদাগর’ প্রথম প্রকাশিত হয়। নাটকটি পৌরাণিক হলেও এতে আধুনিক জীবন-সমস্যা প্রতিফলিত হয়েছে। চাঁদ সদাগর’-এর পরবর্তী নাটক ‘দেবাসুর’- এও (১৯২৮) পৌরাণিক পটভূমিকে আশ্রয় করেও রাজনৈতিক চেতনারই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন মন্মথ রায়। লক্ষণীয় যে, সেযুগে সাধারণত সমকালীন পরাধীন ভারতের যন্ত্রণাকে বাণীরূপ দিতে নাট্যকাররা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটই বেছে নিতেন। কিন্তু মন্মথ রায় ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতের পরিবর্তে গ্রহণ করেছেন পৌরাণিক প্রেক্ষাপট। এ প্রসঙ্গে নাট্যকার জানিয়েছেন,- “আমি প্রথমে ঐতিহাসিক নাটকের পথে না গিয়ে পৌরাণিক নাটকের আবরণে সমসাময়িক চিন্তাকে প্রকাশ করার ব্রত গ্রহণ করলাম।”

পরে তিনি মহুয়া (১৯২৯) ও সাবিত্রী (১৯৩১) লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মন্মথ রায় ধর্মঘট (১৯৫৩), সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৯৫৮), অমৃত অতীত (১৯৬০), লালন ফকির (১৯৬৯) ইত্যাদি নাটক রচনা করেন। পাবলিক থিয়েটারে মঞ্চস্থ তাঁর নাটকগুলির মধ্যে অশোক (১৯৩৩), খনা (১৯৩৫), মীর কাশিম (১৯৩৮) ও জীবনটাই নাটক (১৯৫৩) উল্লেখযোগ্য। ১৯৭১ সালে তিনি রচনা করেন আমি মুজিব নই।

ইংরেজ প্রণীত নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মন্মথ রায়ের ১৯৩০ সালে রচিত নাটক ‘কারাগার’ নিষিদ্ধ হয়েছিল পঞ্চাশের দশকে। ১৮৭৬-এর নাট্য-নিয়ন্ত্রণ আইন প্রয়ােগ করে ‘কারাগার’-এর অভিনয় নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয়। স্বাধীনতা-পূর্বকালে যে নাটকটি মন্মথ রায়কে সর্বাধিক সাফল্য ও জনপ্রিয়তা এনে দেয়, সেটি হল ‘কারাগার’। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ ডিসেম্বর কলকাতার মনমােহন থিয়েটারে প্রথম অভিনীত হয় ‘কারাগার’। এ নাটকের নাট্যদ্বন্দ্বে রয়েছে প্রধান দুই প্রতিপক্ষ একদিকে অত্যাচারী রাজা কংস, অন্যদিকে বসুদেবের নেতৃত্বাধীন যাদবকুল। অর্থাৎ এই নাটকেরও মূল কাঠামাে পরিকল্পনায় রয়েছে পৌরাণিক প্রেক্ষাপট। কিন্তু এ নাটকেও অন্তর্লক্ষণে অনুসৃত হয়েছে। সমকালীন দেশ-ইতিহাসের সত্য। ‘কারাগার’-এর কংস চরিত্র বহুলাংশে অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকের প্রতিরূপ এবং অহিংসার আদর্শে বিশ্বাসী বসুদেব চরিত্রে পড়েছে গান্ধীজীর ছায়া। নাট্যকার স্বয়ং জানিয়েছেন—”দেশে তখন রাজশক্তির বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে আইন অমান্য আন্দোলন চলছিল। দলে দলে লোক কারাবরণ করছিল।… এই পটভূমিকায় মহাভারতে বর্ণিত কংস-কারাগারের কথা আমার মনে এসেছিল। যে কারাগারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল সেই কারাগারেই আজ উদিত হবে আমাদের জাতীয় জীবনের স্বাধীনতা সূর্য।” এখানে পুরাণের কংস-কারাগারই যেন রূপান্তরিত হয়ে গেছে ব্রিটিশ-শাসিত ভারত কারাগারে। শাসক- শক্তির সমস্ত দমন-পীড়ন নিষ্ফল করে একদিন মুক্তি আসবেই—এই সত্য যেন উদ্ভাসিত হয়েছে।

১৯৬৩ তে আবার নাটকে কন্ঠরোধ। এবার জোছন দস্তিদারের ‘অমর ভিয়েতনাম’। পুলিস কর্তৃপক্ষ যে নাটক ঠিক করে দেবেন একমাত্র সেই নাটকটি মঞ্চস্থ হবে। সরকারের এই ফতোয়া নীরবে মেনে নেয়নি শিল্পী, নাট্যকার, সাহিত্যিকরা। পশ্চিমবঙ্গ নাট্যানুষ্ঠান বিলের প্রতিবাদে ক্রান্তি শিল্পী সংঘ এগিয়ে এসেছিল সক্রিয় প্রতিরোধে। অগণতান্ত্রিক এই বিল প্রত্যাহারের আন্দোলনে সেদিন নেতৃত্ব নিয়েছিলেন মন্মথ রায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে কলকাতায় জাপানি বােমার ভয়ে তখন প্রায় জনশূন্য। ফলে সাধারণ নাট্যশালার পক্ষে সেদিন ছিল ঘোর দুর্দিন। জীবিকার তাগিদে মন্মথ রায়কেও সরকারি চাকরি নিতে হয় এবং কিছুদিন বােম্বের (বর্তমান মুম্বই) চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে যুক্ত হন। নাট্যজগতে তার পুনঃপ্রবেশ ১৯৫২-তে ‘মহাভারতী’ নাটকের মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ মন্মথ রায়ের নাট্যকার জীবনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় স্বাধীনতা-উত্তরকালে। স্বভাবতই এই পর্বের নাটকে স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরব ঘােষণা এবং স্থবির সমাজের সংস্কারসাধন করে নতুন সমাজ গঠনের স্বপ্নরচনাই নাট্যকারের লক্ষ্য। তাঁর কথায় — ” দ্বিতীয় পর্বে আমার পরবর্তী (মহাভারতীর পরবর্তী) নাটকগুলি রাজনৈতিক এবং সামাজিক ভাবধারার সঙ্গে অধিকতর যুক্ত না হয়ে পারেনি, কারণ যুগমানসকে উপেক্ষা করা নাট্যকারের ধর্ম নয়।”

পশ্চিমবঙ্গের বহু নাট্যদল তাঁর নাটক প্রযোজনা করেছেন বিভিন্ন সময়ে এমন কি বহুরূপীও মন্মথ রায়ের ‘ধর্মঘট’ নাটকটি প্রযোজনা করে ১৯৫৩ তে। ছাতা কারখানা শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ হবার কাহিনী নিয়ে মন্মথ রায়ের এই নাটকে অভিনয় করেন শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র। খ্যাতনামা নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য ‘ধর্মঘট’ দেখে প্রশংসাপত্রে লিখেছেন ” বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জীবনে নাট্যকার মন্মথ রায়ের অবদান বহু বিচিত্র – জাতীয় জীবনে নাট্য শিল্পের এক দুর্লভ সম্পদ”। এই সম্পদময় আদ্যপ্রান্ত নাটুকে মানুষটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডি. এল. রায় রিডার নিযুক্ত ছিলেন তিন বছর। দেশ-বিদেশ থেকে পেয়েছেন বহু সম্মান ও পুরস্কার। রবীন্দ্রভারতী ও উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডি.লিট উপাধিতে সম্মানিত করেছে। ‘তারাস শেভচেঙ্কো’ নাটকের জন্য সোভিয়েত ল্যান্ড নেহেরু পুরস্কারও পেয়েছেন।

নাট্যকার হিসাবে মন্মথ রায়ের দৃষ্টিভঙ্গির পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যাবে ১৯৬৯-এ পশ্চিমবঙ্গ সঙ্গীত-নাট্য আকাডেমির পুরস্কার লাভের পর তাঁ অমূল্য ভাষণে বলেছেন — ” আমি আমার সব রচনাতেই লক্ষ্য রেখেছি মানুষের সংগ্রামী জীবন এবং মানুষের আত্মিক উন্নয়ন। আমি মনে করি, এই যুগসন্ধিক্ষণে আজ যখন আমাদের জাতীয় লক্ষ্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, আমাদের নাটকেরও লক্ষ্য হওয়া উচিত, সেই মহাজীবন প্রতিষ্ঠার জন্য জমি তৈরি করা আমাদের দায়িত্ব ।… আমি মনে করি যে সব সাহিত্যই প্রচার, যদিও সব প্রচার সাহিত্য নয়, রসোত্তীর্ণ হওয়াই বড়ো কথা।” ২৮ জানুয়ারি ১৯৭০ সালের ‘শিল্পী সংসদ’র তৎকালীন সভাপতি মহানায়ক উত্তমকুমার মন্মথ রায় কে একটি চিঠিতে লিখলেন— “কেন্দ্রীয় সঙ্গীত একাডেমি আপনাকে পুরস্কৃত করিয়া ধন্য হইয়াছে। বাংলা মঞ্চ এবং বাংলা দেশের অভিনেতা অভিনেত্রী আপনার এই সম্মানে গৌরব বোধ করে। শিল্পী সংসদ আপনার এই সম্মান লাভে আনন্দিত “।

‘ভাণ্ডার’ ও ‘বসুন্ধরা’ পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন তিনি। মন্মথ রায়ের তত্ত্বাবধানে বালুরঘাটে প্রথমে এডওয়ার্ড মেমোরিয়াল ক্লাব, নাট্যমন্দির নামে মঞ্চ ও ত্রিতীর্থের ‘গোবিন্দ অঙ্গন’ প্রতিষ্ঠা পায় তাঁর পূর্ণ সহযোগিতায়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সর্বোচ্চ নাট্য সম্মান প্রথম ‘দীনবন্ধু পুরস্কার’ (১৯৮৪) পান মন্মথ রায়। ১৯৮৭ তে স্থাপিত পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাডেমির প্রথম সভাপতি ছিলেন মৃত্যুর শেষদিন পর্যন্ত। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। প্রয়াণ ২৬ আগস্ট ১৯৮৮। তাঁর স্মরণে যেমন বালুরঘাট পুরসভা প্রতিবছরের মতো এবছরও ১২১ তম জন্মবার্ষিকী পালন করেছে বালুরঘাটের রথতলায় অবস্থিত প্রয়াত এই নাট্যকারের বাস ভবনে। স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিশিষ্ট নাট্যকার, একাঙ্ক নাটকের জনক মন্মথ রায়ের নামে বালুরঘাট শহরের মূল জনপদের একটি রাস্তার নামকরণে পথিকের মুখে মুখে আজও ফেরে, তেমনই নাট্য ইতিহাসে তাঁর নাম অবিসংবাদিত হয়ে থাকবে থিয়েটারভূমিতে।

5 thoughts on “অবিসংবাদিত নাট্যকার মন্মথ রায় | সংকলন- অসীম দাস

  1. খুব ভালো লাগলো লেখাটা পড়ে… শ্রদ্ধেয় নাট্যকার “মন্মথ রায়” এর নাম আমরা হয়তো অনেকেই জানি, কিন্তু ওনার জীবন সংগ্রাম ও সৃজনশীলতা সম্পর্কে ধারণা তেমন ভাবে ছিল না… এই লেখা পড়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম। অসীম দাস কে নিরন্তর শুভ কামনা জানাই 🙏🙏🙏

  2. অসাধারণ, অনবদ্য একটি তথ্য সমৃদ্ধ লেখা। লেখাটি পড়ে ঋদ্ধ হলাম। 🙏🌹🙏

  3. Monmatho roy সম্বন্ধে অনেক কিছু জানলাম। অনেক ধন্যবাদ অসীম বাবু কে।

  4. ওনার লেখা নাটকে অভিনয় করতে পেরে ধন্য হয়েছি🙏

Comments are closed.