থিয়েটার এক যাপনের নাম । নিজেদের দল প্রাণের চেয়েও প্রিয় । থিয়েটার এক অভ্যাস । থিয়েটার এক জীবন । যেদিন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়-শম্ভু মিত্রদের নিজেদের তৈরি দল থেকে বিদায় নিতে বাধ্য করা হয়েছিল, কেউ কি খোঁজ রেখেছিল সেদিন ঠিক কতখানি রক্তক্ষরণ হয়েছিল তাঁদের হৃদয়ে ? যেদিন অমিয় চক্রবর্তীকে নিঃশেষ করে দিয়েছিল একদল ঈর্ষাকাতর পিশাচ আর মূর্খ রাজনৈতিক নেতারা সেদিন কতখানি অভিমান নিয়ে শেষমেশ তাঁকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয় তা কি কেউ খোঁজ নিয়েছিল ? উৎপল দত্ত এই থিয়েটারের জন্যে জেলে গিয়েছিলেন, সফদার হাসমী এই থিয়েটারের জন্যে খুন হয়েছিলেন। থিয়েটার বড় কঠিন জায়গা – এই দু’জন মানুষের বারবার সমালোচনা করলেও তাঁদের থিয়েটারের প্রতি নিষ্ঠা ও ভালবাসাকে আমি শ্রদ্ধা করি সম্মান করি, তাই তাঁদের আমি শ্রদ্ধা করি সম্মান করি ।
কতটুকু পেয়েছিলেন কেয়া চক্রবর্তী, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, অমিয় চক্রবর্তী, জোছন দস্তিদার, নীলকণ্ঠ সেনগুপ্ত, বিজন ভট্টাচার্য-রা ? যে নাট্যকর্মীরা পর্দার আড়ালেই হারিয়ে গেলেন, কুঁড়ি প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই যাঁরা ঝরে গেল – তাঁরা কতটুকু পেলেন ? কিন্তু যদি এমনটা সবাই ভাবত তাহলে থিয়েটার আর কেউ করত না । তাই আমরা আজও থিয়েটার করি স্বপ্ন দেখি লড়াই করি অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার ।
এই আবেগ অনেকেই কাছেই পাগলামি। এই আবেগ অনেকেই কাছেই ভুল। এই আবেগ অনেকের কাছেই সময় নষ্ট । শহর মফস্বল গ্রামাঞ্চল জুড়ে যে বিশাল কর্মযজ্ঞে তিল তিল করে পয়সা জমিয়ে একটা একটা নাটক মঞ্চস্থ হয়ে চলেছে, সেসব নাটকের কুশীলবদের আমি সীমান্তের সৈনিকের মতই শ্রদ্ধা করি । অনেকেই ‘বড় দল’, ‘নামী দল’, ‘সেলিব্রিটি পরিচালক’, ‘এনএসডি ফেরত পরিচালক’, ‘লিড ক্যারেক্টার’ – এসব মুখবন্ধে আকৃষ্ট হয়ে দল বাছাই করে, কেউ কেউ নিজের পুরনো দলের মুখে লাথি মেরে চলে যেতেও দু’বার ভাবে না । তাঁরা নাট্যকর্মী নয় । তাঁরা থিয়েটার করে ‘ফেমাস’ হবে বলে, ‘সেলেব’ হবে বলে, ‘সিনেমা-সিরিয়াল’ করবে বলে । তাঁদের যৌনকর্মী বললে সেই নারীদের অসম্মান করা হয় যারা রোজ নিজেদের শরীরের বিনিময়ে জীবন ধারণ করে ।
আমার মতন এমন অনেকেই আছে যারা থিয়েটার করা শুরু করেছিল অভিনয়কে ভালবেসে নাটককে ভালোবেসে । এত আবেগ শুরুতে একেবারেই ছিল না । কিন্তু যেভাবে লেবুর আচারের লেবু রসে জারিত হয়ে পূর্ণতা লাভ করে, সময়ের সাথে সাথে সেভাবেই আমাদের থিয়েটারের রসে জারিত হয়ে নাট্যকর্মী হিসেবে দীক্ষিত হওয়া। কখন যে থিয়েটার আমাদের রক্তে মিশে গিয়েছে, কখন যে থিয়েটার আমাদের মা আর ঈশ্বর হয়ে গিয়েছে, রিহার্সাল রুম হয়ে গিয়েছে সাধনার বেদী – টের পাইনি । তাই যতই ক্যামেরার সামনে অভিনয় করি, বেতারে অভিনয় করি – থিয়েটার আছে আর থাকবে থিয়েটারেই সে ভাল মতন জানি ।
রিহার্সালের দিনগুলো বড় কাছের, তার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। নিজের দলের ভালমন্দ কোনোকিছুর দায় এড়িয়ে পালিয়ে যেতে পারিনা, কারণ ছোট থেকেই বাবা কিংবা মা অসুস্থ হলে আমরা কোনোদিন পালিয়ে গিয়ে পাশের বাড়িতে থাকতে শিখিনি । চাইলেই আমার মত অনেকেই দেশে বিদেশে চাকরি করে অনায়াসে মাস মাস লাখ লাখ টাকা উপার্জন করে নিশ্চিন্তে জীবনযাপন করতেই পারত, কিন্তু আমরা তা করিনি – নিজেদের দলের জন্যে, থিয়েটারের জন্যে, পরিবারের জন্যে, মায়ের জন্যে ।
আমাদের মতন কিছু পাগল, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো, অকর্মণ্য আছে — যাদের কাছে নিজেদের দল নিজেদের পরিবার নিজেদের সন্তানের মতন, তাঁদের কাছে সেখানে সামান্যতম আঁচড় লাগার আশঙ্কাও জীবনের সবটুকু রং শুষে নিতে পারে । যারা এরকম অকর্মণ্য কুঁড়ে উচ্চাশাহীন, তারা জানে, নিজের দলের দুঃসময় আর আশঙ্কা সামনে থেকে অসহায়ের মতন দেখার চেয়ে মৃত্যুবরণ করা অনেক শান্তির ।
থিয়েটারের সাথে প্রেমের ভান অনেকেই করতে পারে, থিয়েটারকে ভালবাসার মতন বুকের পাটা খুব কম মানুষের আছে । যাদের থাকে, তাঁরা ধূপের মত নিজেরা পুড়েও থিয়েটারকে বিলিয়ে দিতে পিছপা হয় না । আমরা ঈশ্বরের আশীর্বাদ না অভিশাপ জানিনা – তবে ভাল নই, স্বাভাবিক নই, সুস্থ নই, প্র্যাকটিক্যাল নই, আমরা কল্পনাপ্রবণ, আমরা মন্থর, আমরা কুঁড়ে, আমরা অমানুষ, আমরা বাতিল।
তবু থিয়েটার থাকবে । থিয়েটারের বিলুপ্তি কিংবা দলের ভাঙ্গণ – এমন প্রলয়কাল আসার অনেক আগেই নিজের বিলুপ্তি অনেক অনেক কাম্য । কেউ বুঝুক, কেউ না বুঝুক ।