ভূমিকা
স্ত্রাউস একটি ঘটনার উল্লেখ করছেন, যে ঘটনাটি ১৯০৫ সালে আমেরিকার জুনি (Zuni) ইন্ডিয়ানদের সম্পর্কে রিপোর্টে লিখেছিলেন স্টিভেনসন। একটি বয়ঃসন্ধিকালের বালক এক বারো বছরের বালিকার হাত ধরেছিল একদিন। মুহূর্তের মধ্যে বালিকাটির স্নায়বিক খিঁচুনি দেখা দেয়। জুনি ইন্ডিয়ানদের মধ্যে তখন নিয়ম ছিল জাদুবিদ্যার অধিকারী বলে কাউকে চিহ্নিত করা হলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। অতএব ছেলেটিকে নিয়ে বিচার শুরু হল।
প্রথমবারের বিচারে ছেলেটি জানাল যে তার শিক্ষকেরা তাকে দুটি গাছের শিকড় দিয়েছেন। সেই শিকড়ের একটিতে মেয়েদের উন্মাদ করে দেওয়া যায়, অন্যটিতে তাদের উন্মাদনা সুস্থ করে দেওয়া যায়। ছেলেটিকে যখন সেই শিকড় আনতে বলা হল, সে নিয়ে এল। সঙ্গে সে এক বিচিত্র এবং জটিল কাণ্ডকারখানা করে-টরে প্রথম শিকড়টি নিজে খেল। খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে যেন সম্মোহিত এবং উন্মত্ত এমন ভাব করল কিছুক্ষণ। তারপরে দ্বিতীয় গাছের শিকড়টি খেয়ে সে সুস্থ হয়ে যাওয়াও দেখাল। এরপরে সে মেয়েটিকে দ্বিতীয় গাছের শিকড়টি খেতে দিল। মেয়েটি খাবার পরে ছেলেটি ঘোষণা করল মেয়েটি এবারে সুস্থ হয়ে গেছে। সেদিন রাত হয়ে গেছে বলে এরপরের বিচার স্থগিত রাখা হল। যে যার ঘরে ফিরে গেল।
গণ্ডগোল করল ছেলেটি আবার। সে রাতারাতি পালাল। তাকে ধরেও আনা হল। এবারে যখন ধরা হল তার আগের বয়ান বিচারকেরা কিন্তু মানতে চাইল না। এবারে ছেলেটি নতুন বয়ান বানাল। সে বলল তার আত্মীয়-স্বজন এবং পূর্বজরা বহুযুগ ধরেই জাদুবিদ্যা জানে। বিপুল তাদের জ্ঞানের ভাণ্ডার। সে চাইলেই বেড়াল হয়ে যেতে পারে। চাইলেই মুখভর্তি করে ক্যাকটাসের কাঁটা নিয়ে দুটি শিশু, তিনটি মেয়ে এবং দুটি ছেলেকে হত্যা করতে পারে কাঁটা ছুড়ে। এইসব সে পারে যেহেতু তাদের পরিবারে জাদুশক্তি আছে, যে জাদুশক্তি আবার এসেছে তাদের কাছে রাখা এক পাখির পালক থেকে। এইবারে আরেকটু বাড়াবাড়ি করে বলে ফেলে যে সেই পালক গাঁথা আছে তাদের ঘরের দেওয়ালে।
বিচারকেরা তাকে চেপে ধরতে সে অনেক ইনিয়ে-বিনিয়ে কাটাতে চাইলেও শেষে দেওয়াল ভাঙতে শুরু করতে বাধ্য হয়। দেড়খানা মত দেওয়াল ভেঙে হতোদ্যম হয়ে পড়ে। বলে দু’বছর আগে দেওয়ালে গাঁথা হয়েছিল বলে তখন মনে পড়ছে না। কিন্তু বিচারকদের চাপে বাধ্য হয় বাকিটাও ভাঙতে। এমন ভাঙতে ভাঙতে ঘণ্টাখানেক পরে দেওয়ালে সত্যিই সে একটি পালক পায়। উৎফুল্ল হয়ে বিচারকদের দেয় প্রমাণ হিসেবে। এবারে তাকে খোলা প্রাঙ্গণে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সে তার গল্পটা আবার বলে। এবারেও আরও নতুন কিছু বিষয় যোগ করে। এটা যতবার সে গল্পটা বলেছে ততবারই করেছে। স্থানাভাবে সম্পূর্ণ কাহিনিটিকে এখানে আনা গেল না, ফলত বহু তাৎপর্যপূর্ণ মনস্তাত্বিক বিষয় এখানে ঠাঁই পেল না। যাই হোক, শেষত সে দুঃখের সঙ্গে জানায় তার যাদুশক্তি আর নেই। এবারে বিচারকেরা তাকে মুক্তি দেয়।
এই ঘটনাটিকে এখানে আনার কারণ হল এখানে একটি কাঠামো ক্রমোন্নতির লক্ষণ আছে। ছেলেটি যতবারই ঘটনাটি বলছে ততবারই নতুন কিছু না কিছু যুক্ত করছে। খানিকটা উপস্থিত বুদ্ধিতে, খানিকটা আবেগে, যা আবার তাকে বিপদেও ফেলে দিতে পারে। ছেলেটি কি আগাগোড়া মিথ্যে বলছিল? কাহিনিগুলো কেমন করে তৈরি হচ্ছিল? এ সম্পর্কে স্ত্রাউস তাঁর মতামত জানিয়েছিলেন। প্রথমত ছেলেটির সামনে একটি ভয়াবহ পরিণতি ছিল, তা হল মৃত্যুদণ্ডের। তাহলে সে প্রথমেই মেয়েটির হাত ধরেছে এ কথা অস্বীকার করল না কেন? অস্বীকার করলে তার প্রতি যে শত্রুতা সে আরও যেত বেড়ে। তার বিচারকেরা, সে অস্বীকার করবে এমন পরিস্থিতিতে বিচার করতে বসেইনি। বরং তারা বসেছিল এমন একটি বিষয়কে বুঝতে যা সাধারণভাবে তাদের বোধগম্যতার বাইরে। হাত ধরলে স্নায়বিক খিঁচুনি হবে কেন তা তারা জানেই না। দুটোর মধ্যেকার সম্পর্ককে বোঝা তাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল। এবারে ছেলেটির কাছেও এর কার্য-কারণ পরিষ্কার নয়। সুতরাং তার পক্ষে জাদুশক্তি আছে মেনে নেওয়াটা প্রাথমিকভাবে সহজ রাস্তা। জাদুশক্তি বলে যে একটা বিষয় হয় তা তারও কৌমস্মৃতিতে (গল্পগাছা ইত্যাদির মাধ্যমে) রয়েইছে। বাকিদেরও রয়েছে বলেই মৃত্যুদণ্ডের আইন ছিল। এবারে সে একেই কাজে লাগাতে শুরু করল। সেই প্রক্রিয়ায় ক্রমাগত নিজেকে এবং কাহিনিকে বাড়াতে বাড়াতে এক অস্বাভাবিক নায়কত্ব তৈরি করল নিজের। সেখানে প্রাণ ইত্যাদি তুচ্ছ, বরং নায়ক হবার (ট্র্যাজিক হলেও) উন্মাদনা অনেক বেশিই। এভাবেই একটি কাঠামোকে কেন্দ্র করে আরও জটিল থেকে জটিলতর কাঠামো নির্মিত হতে পারে।
একে যদি এই জাদুবিদ্যার প্রেক্ষিত থেকে সরিয়ে এনে ভাষা অথবা নাট্যচর্চার পরিসরে এনে ফেলি তাহলে সে বিষয়ে কাঠামো সংক্রান্ত একটি ধারণাও বানানো যায়। সোজা কথায় প্রথমে ভাষা তৈরি হয়, তার পরে আসে তার ব্যাকরণ। এবং লক্ষ্য করলে দেখা যায় ব্যাকরণ তৈরি হবার সময়টা ভাষার ক্ষেত্রে সামাজিক গোলমালের সময়। ঋগ্বৈদিক ভাষা, যাকে আমরা এখন ছান্দস বলে চিহ্নিত করি, তা যখন আর বোঝা সম্ভব হচ্ছে না সবটা, তখনই এল তার সংস্কারের সময়। পাণিনিদের হাত ধরে ব্যাকরণ এল, এল সংস্কৃত ভাষা। কথাটা লেখার কারণ হল, নাট্যের শাস্ত্রও তখনই তৈরি হয় যখন নাট্য সংক্রান্ত ধারণা প্রাচীন সমাজ তৈরির সময়কাল থেকে এগোতে এগোতে এমন জায়গায় এসে যায়, যেখানে তাকে বাঁধার আশু প্রয়োজন দেখা দেয়। এই বাঁধন কখনও তাকে উন্নত করার কাজেও যেমন লাগতে পারে, তেমনই শাসনের নির্দিষ্ট প্রয়োজন মেটাতে, শাসনের বিরোধে তার ব্যবহার কমাতেও লাগতে পারে।
ভাষায় শব্দার্থের ক্ষেত্রে যেমন, আজ যদি কেউ সমসাময়িক অভিধানের পাশাপাশিই হরিচরণের বঙ্গীয় শব্দকোষ-কে রাখেন, অবাক হয়ে যাবেন শব্দার্থ কেমনভাবে আজকের অভিধানগুলোতে এত কমে গেল দেখে! আবার কলিম খানের বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ দেখলে আর এক দফা অবাক হবেন শব্দার্থের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থের সম্প্রসারণ এবং একটি শব্দকে অনুসরণ করেই পাওয়া বিচিত্র ভাবনার সমাহার দেখলে। এই যে একদিকে কমছে, এই কমাকে আজকের আভিধানিক শাসন বলছে আসলে ‘কেজো’ করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। যাতে হাজারো অর্থের ভিড়ে মানুষের সময় নষ্ট না হয়, বাণিজ্য ইত্যাদিতে স্পষ্টাস্পষ্টি ব্যবহার করা চলে ইত্যাদি যুক্তিতে চারিদিক সরগরম। অন্যদিকটা হচ্ছে, একটি শব্দের একাধিক অর্থ হারিয়ে যাওয়া মানে সভ্যতা এবং সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ চিহ্নসকল হারিয়ে যাওয়া। বিচিত্র ভাবনার যে বিচিত্র পরিসর সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করে তাকে ভেঙে একরৈখিক নির্মাণের দিকে চলে যাওয়া, যা শাসনের আহ্লাদের বিষয়, কিন্তু শাসিতের তত আহ্লাদের কারণ নয়। নাট্যের প্রসঙ্গেও তা আমাদের মনে রাখার প্রয়োজন।
নাট্যশাস্ত্র, অত্যন্ত মূল্যবান একটি আয়োজন আমাদের প্রাচীন নাট্যচর্চা থেকে আধুনিক নাট্যচর্চার জন্য। নাট্যশাস্ত্র, নাট্যের আগে জন্মায়নি। তার আগের যা কিছু তার আবছা যে চেহারা তাকে খানিক স্পষ্ট করার দায় আমাদের আছে। তার সঙ্গে নাট্যশাস্ত্রের পরবর্তী নাট্য সংক্রান্ত যে শাস্ত্র সকলের ধারা তাকেও জানার প্রয়োজন আছে। তার মধ্যেও নানা বৈচিত্র্য থেকে সমাজ পরিসর সব ছাপ রেখে গিয়েছে। অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-ধর্মনৈতিক দ্বন্দ্বগুলোও রয়েছে। পাশ্চাত্যের মত আমাদের তথাকথিত নন্দনতত্ত্ব নেই। আছে অলঙ্কারশাস্ত্র। সেই সূত্রেই আবার প্রয়োজন অলঙ্কারশাস্ত্রগুলি সংক্রান্ত ধারণাও খানিক স্পষ্ট করার।
আমার এই কাজ, পূর্ববর্তী এবং সমসাময়িক বহু কাজের কাছে ঋণী। কার্য-সমাপ্তিতে সেসকল সূত্রোল্লেখ অবশ্যই করব। আপাতত এ কথাই বলার যে এ কাজের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র নাট্যশাস্ত্র সংক্রান্ত সাধারণ জানা বিষয়গুলিকেই একত্র করা, সংক্ষেপিত করা নয়। এর আরেকটি উদ্দেশ্য হল বর্তমান সময়ে একে ব্যবহার করতে গেলে এর মূলগত বিষয়টিকে করায়ত্ত করার প্রচেষ্টা। অবশ্যই সে চেষ্টা প্রথাগতের সন্তুষ্টির থেকে হয়তো খানিক দূরেই যাবে। এ বিষয় বলার কথা এই যে, প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা-দীক্ষার ছাপের বাইরে থেকেই আমার কাজ করা। সে কাজের ভাল যদি কিছু থাকে সব বাঙালির তথা মানুষের এবং অবশ্যই নাট্যচর্চাকারীদের। আর ত্রুটি যা কিছু তার জন্য আমার মূর্খতাই নিতান্ত দায়ী। সে দায় বহুকাল কাঁধে বইছি বলে এখন দু’কানকাটা, হাট-বাজারের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে অসুবিধে হয় না।
প্রাগ্-নাট্যশাস্ত্র
আজ যখন আমরা প্রেক্ষাগৃহে নাটক দেখতে যাই তখন তাকে সচরাচর থিয়েটার বলি। প্রেক্ষাগৃহ শব্দটি এবং Theatre Hall একই বিষয় কী না, নাটক এবং থিয়েটার একই বিষয় কী না এ সব কথা চট করে মাথায় আসে না। যাঁরা এ সব নিয়ে খানিক চর্চা করেন তাঁরা জানবেন প্রেক্ষাগৃহ বললেই Theatre Hall নাও বোঝাতে পারে। ‘নাটক’ শব্দটি প্রাচীনকালে একপ্রকার রূপক বোঝাতে ব্যবহৃত হত। সামগ্রিক ভাবে নানা প্রকার রূপক অভিনীত ও অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রক্রিয়াটিকে ‘নাট্য’ বলা হত। এমন ভাবে চলতে চলতে তিনি বা তাঁরা আচার্য ভরত-এর নামে খ্যাত নাট্যশাস্ত্রের সন্ধানও পেয়ে থাকেন। এই উপমহাদেশে নাট্যচর্চাকারীরা এর জন্য কেউ কেউ গর্ববোধও করেন। শুধুমাত্র গ্রীস বা পরের দিকে রোম-ই নয় আমাদেরও নাট্য বস্তুটি প্রাচীন। সে গর্বের কথা মাথায় রেখেই আরেকটি সঙ্গত প্রশ্নের কাছে এসে আমাদের দাঁড়াতে হয়। নাট্যশাস্ত্র তো সংস্কৃত নাট্যের ব্যাকরণ বিশেষ, সে তো নাট্যের আগে সৃষ্টি হতে পারে না। যেমন ভাষা সৃষ্টি হওয়ার আগে কোনো ব্যাকরণই জন্মায় না। তাহলে আরো প্রাচীনে নাট্য কেমন ছিল বা কী তার উৎস?
আমাদের দেশে এই জাতীয় অনুসন্ধান ব্যাপক গুরুতর হয়ে ওঠে ব্রিটিশরা ভারত শাসন শুরু করার পর থেকে। আর সে অনুসন্ধানের কেন্দ্রে থাকে তৎকালীন উত্তর-পশ্চিম থেকে উত্তর ভারত; কারণ অন্যান্য অঞ্চলের প্রাচীন তথ্যাদির অভাব। কেন এমন হল তার ব্যাখ্যায় এখনই যাব না। কিন্তু এটুকু বলার যে ঐ সময়কালেই ব্রিটিশ থেকে নানা ইউরোপিয় পণ্ডিতদের এ বিষয় উৎসাহ বেড়ে চলে। তাঁরা নানা বিষয়ের বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন: বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের সহায়তায়। ম্যাক্সমুলার বা সিলভ্যাঁ লেভি জাতীয় বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেছেন এই উপমহাদেশে নাট্যের উৎপত্তিসূত্র রয়েছে ঋগ্বেদ-এই। তাঁরা ঋগ্বেদের সংবাদুসূক্তগুলির উল্লেখ করেন এ প্রসঙ্গে। যথা যম-যমী, ১০.১০; সরমা- পণি, ১.১০৮; পুরুরবা-উর্বশী, ১০.৯৫ ইত্যাদি ) যে কথােপকথন আছে, তা থেকেই নাটকের ধারণা জন্মেছিল বলে এঁরা মত পােষণ করেন।
যম-যমীসূক্তে যম এবং যমী দুজনেই দেবতা। এ সূক্তের ঋষিও তাঁরাই। কামাতুরা যমী ভ্রাতা যমকে বলছেন,
যমী- এই নির্জন দ্বীপে আমি তােমার সহবাসে অভিলাষিণী।
যম- ভুমি সহােদরা ভগ্নী, সুতরাং অগম্যা। এ-স্থান নির্জন নয়, দেবগণ সর্বত্র দেখছেন।
যমী- পত্নী যেমন পতির নিকট তেমন আমি তােমার নিকট স্বদেহ অর্পণ করি। রথচক্রদ্বয়ের ন্যায় এস আমরা এক কার্যে প্রবৃত্ত হই। যম- তুমি অপরের সঙ্গে এই কার্যে প্রবৃত্ত হও।
যমী- দ্যূলোক ভূলােক স্ত্রী-পুরুষবৎ সম্বন্ধযুক্ত। যমী ভ্রাতা যমের আশ্রয় গ্রহণ করুক।
যম- ভবিষ্যতে এমন যুগ আসবে, যখন ভ্রাতা-ভগ্নী সহবাস করবে। এখন আমা- ভিন্ন পুরুষান্তরকে পতিত্বে বরণ কর।
যমী- সে কিসের ভ্রাতা যে থাকতে ভগ্নী অনাথা হয়? আমি কামনায় মূর্ছিত হয়ে তােমার অনুনয় করছি। তােমার ও আমার শরীর মিলিয়ে দাও।
যম- ভগ্নীতে যে ব্যক্তি উপগত হয়, তাকে পাপী বলে।
যমী- হায়, তুমি নিতান্ত দুর্বল পুরুষ। রজ্জু যেমন অশ্বকে, লতা যেমন বৃক্ষকে বেষ্টন করে তেমন অন্য নারী তােমাকে আলিঙ্গন করে, অথচ তুমি আমার প্রতি বিমুখ।
যম- অন্য পুরুষ তােমাকে আলিঙ্গন করুক, তাহার মন তুমি হরণ কর, সে তােমার মন হরণ করুক।
এই একটি সূক্তকেই যদি আমরা লক্ষ্য করি দেখব এখানে এক ঘোর নৈতিক সংকট উপস্থিত হয়েছে। ভ্রাতা ও ভগিনীর মধ্যে যৌনতাকে কেন্দ্র করে। এর এক ধরণের ব্যাখ্যা আছে যা জ্যোতির্বিদ্যার সঙ্গে জড়িত। যম ও যমীর আদি অর্থ দিবা ও রাত্র বলে অভিমত পোষণ করেছেন। দিবা আর রাত্রির মিলন হয় না এমন একটা অর্থ সামনে রাখতে ইচ্ছুক এই ব্যাখ্যাকারেরা। যে সময়কার এই সব ব্যাখ্যাকার তাঁদের পক্ষে সরাসরি একটি সামাজিক সমস্যা এবং যুগান্তরের আলোচনা করা সম্ভব ছিল না। একদিকে ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতা অন্যদিকে তাঁদের নিজস্ব দেশের সব ভাল বোধহই হয়তো বাধা দিয়েছে আদপ অর্থটিকে গ্রহণ করতে।
অথচ সে অর্থের মধ্যেই রয়েছে যুগান্তরের পরিচ্ছন্ন সংকেত। ভাই-বোনের যৌন সম্পর্ক নানা দেশে নানা কালে নানা চেহারা গ্রহণ করেছে। মিশরের ফারাওদের যেমন বিশুদ্ধ রক্তের খাতিরে বোনকে বিয়ে করতে হত। আবার প্রাগৈতিহাসিক কালে মানুষের গোষ্ঠীর মধ্যেকার সম্পর্কগুলো আজকের মতই সব ছিল না। গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহ থেকে গোষ্ঠীর বাইরে বিবাহ নানা প্রকার বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে চলেছে মানব যৌনতা। শুধু গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহ চালু থাকলে একটা সময় আসবে যখন যাকেই বিবাহ করা হবে সে কোনো না কোনো আত্মীয়তার সম্পর্কে সম্পর্কিত। কোনো কোনো গোষ্ঠী আজ-ও মনে করে এইভাবেই তাদের রক্তের বিশুদ্ধতা বজায় রাখা যায়। তার বাইরে গেলে পরিণামে হিংসা অবধি এসে দাঁড়ায়। অতএব যে মানব গোষ্ঠী বেদাদি সৃষ্টি করছে তাদের মধ্যে এই এই যম-যমী সূক্তটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি নিদর্শন সামাজিক প্রেক্ষিত বদলানোর। দেবতার ভয় থেকে পাপ ইত্যাদি সরাসরি এসে দাঁড়াচ্ছে এই সংবাদ সূত্রের সংলাপে।
এরই বিপরীতে রাখা চলে ঋগবেদের এই দশম মণ্ডলেরই অন্তর্ভূক্ত পণি ও সরমা সংবাদকে।
“৭। (পণিদিগের উক্তি)-হে সরমা! আমাদিগের এই ধন পর্বতদ্বারা রক্ষিত, ইহা গাভী, অশ্ব ও অন্যান্য সম্পত্তিতে পরিপূর্ণ। যাহারা উত্তম রূপ রক্ষা করিতে পারে, এতাদৃশ পণিগণ সেই ধন রক্ষা করিতেছে। তুমি গাভীর শব্দ শুনিয়া এই স্থানে আসিয়াছ, কিন্তু তোমার বৃথাই আসা হইয়াছে।
৮। (সরমার উক্তি) -অযাস্য ঋষি, অঙ্গিরার সন্তানগণ এবং নবগুগণ, সোমপাণে, উৎসাহিত হইয়া আসিবেন; তাঁহারা এই বহু পরিমাণ গাভী ভাগ করিয়া লইবেন; হে পণিগণ! তখন তোমাদিগকে এপ্রকার দর্পের উক্তি ত্যাগ করিতে হইবে।
৯। (পণিগণের উক্তি) -হে সরমা! দেবতারা ভয় প্রদর্শন করিয়া তোমাকে এই স্থানে পাঠাইয়াছেন, সেই নিমিত্তই তুমি আসিয়াছ। তোমাকে আমরা ভগিনীস্বরূপে পরিগ্রহ করিতেছি, তুমি আর ফিরিয়া যাইও না। হে সুন্দরি! তোমাকে এই গোধনের ভাগ দিতেছি।
১০। (সরমার উক্তি)—আমি ভ্রাতৃ-ভগিনীসংক্রান্ত কোন কথা বুঝতে পারিনা।…”
পণি বা দস্যু বলে যাঁদের পরিচয় ঋগ্বেদে তাঁদের কাছে সরমাকে পাঠিয়েছিলেন ইন্দ্র দূতী হিসেবে। অথবা ভয় দেখিয়ে গো ধন কেড়ে আনতে। সেখানে সরমাকে স্পষ্টই পণিরা বলছে যে দেবতারা তাঁকে ভয় দেখিয়ে পাঠিয়েছেন। ভয় নেই। তাঁরা সুন্দরী সরমাকে ভগিনী হিসেবে গ্রহণ করছেন। ভগিনী শব্দটির মধ্যে ভগ বা যোনি শব্দটি বর্তমান রয়েছে। তাছাড়া শব্দার্থও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকে বহুক্ষেত্রেই। নাট্যশাস্ত্রে ‘ভগিনী’-র অর্থ নির্দিষ্টভাবে বড় দিদি। আবার মনুস্মৃতি অন্যের স্ত্রী অথবা অনাত্মীয়া নারীকে ভবতী, সুভগে অথবা ভগিনী বলে সম্বোধন করতে বলছে। অনাত্মীয় নারী বা পরস্ত্রী-কে এই সম্বোধনের মধ্যে সুভগে, ভগিনী এ সব অর্থ এক নয়।
এ কথাগুলো বলার কারণ, পণিরা ভগিনী বলতে এখানে ‘বোন’ অর্থ যদি বুঝিয়ে থাকে তাহলে সুন্দরী বিশেষণটি অহেতুক। দ্বিতীয়ত, সরমা ভ্রাতৃ-ভগিনী সংক্রান্ত কথা বুঝতে পারেন না বলে এড়িয়ে যাওয়াও কৌতুহলজনক। আমরা কী অনুমান করতে পারি সরমা যেহেতু সে অর্থে যমী’র মতই তথাকথিত ইন্দো-ইউরোপিয়ান বা ইন্দো-ইরানিয়ান নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ না, সুতরাং এখানেও কাছাকাছি দুটি সমাজে নর-নারী সম্পর্কের বিবর্তন আমরা দেখছি?
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দশম মণ্ডল ঋগ্বেদে প্রক্ষিপ্ত। সেখানেই আবার সংবাদ-সূক্তগুলি পাওয়া যাচ্ছে। তার মধ্যে সামাজিক বিধি-নিয়ম প্রদর্শন থেকে দেবতার ক্ষমতা জ্ঞাপন নানা বিষয় রয়েছে। এগুলি আচমকাই ঋগ্বেদে এল কেমন করে যদি তার আগে এমন সংলাপাদির উৎপত্তি না হয়? তাছাড়া একটি গোষ্ঠীর যজ্ঞাদি দেবার্চনার মন্ত্র ইত্যাদির মধ্যে সংবাদ-সূক্তগুলি আলাদা থাকলে খাপছাড়াই থাকে। তাহলে কী এগুলি কোনো না কোনো যজ্ঞের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল, যার যজ্ঞাংশ পরে অপসৃত হয়ে কাহিনী অংশই থেকে যায়? এই কাহিনী অংশ যেভাবে সংলাপাকারে সজ্জিত তাতে নাট্যক্রীড়ার লক্ষ্মণ অবশ্যই আছে। সেই নাট্যক্রীড়া সম্ভবত গোষ্ঠীজীবনে তখনই প্রচলিত ছিল। কালে কালে যজ্ঞের অন্তর্ভূক্তও হয়েছে এর কিছু অংশ। যেমন সোমযজ্ঞে সোমবিক্রেতার অংশটি।
বৈদিক যাগ-যজ্ঞের মধ্যে সোমযজ্ঞ ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে বেশ গুরুতরই ছিল। অনুষ্ঠানগুলি জটিল, অনেক ঋত্বিকের আবশ্যকতা আছে। তবুও দু-তিন প্রজন্মের মধ্যে ব্রাহ্মণ বংশে সোমযজ্ঞ না হলে তা সে বংশের নিন্দার বিষয় ছিল। যাই হোক, আমাদের আলোচনার স্বার্থে আমরা শুধু লক্ষ্য রাখবো সোমযজ্ঞের নাট্যাংশের দিকে। আমরা মনে রাখব যে সোমযজ্ঞ একদিনে সম্পন্ন হত তা ঐকাহিক যজ্ঞ। আর দুই থেকে বারোদিনের যজ্ঞ অহীন নামে পরিচিত। তার থেকেও বেশীদিনের যজ্ঞ হলে তাকে সত্র বলা হত। কোনো কোনো সত্র আবার বছরভরও চলতো। ঐকাহিক বা একদিনের সোমযাগদের সচরাচর জ্যোতিষ্টোম বলা হত। তার মধ্যে অগ্নিষ্টোম ইত্যাদি যজ্ঞ পড়তো। শুধু অগ্নিষ্টোমেই ষোলোজন ঋত্বিক ছাড়াও আরো দশজনের প্রয়োজন হত চমসাহুতির জন্য। এঁরা ঋত্বিক না হলেও সহকারী। অর্থাৎ একটি একদিনের যজ্ঞে লাগছে ছাব্বিশজনকে, যাঁরা নিজ নিজ কাজ সম্পর্কে যথাযথভাবে দক্ষ এবং দায়িত্বশীল। তাছাড়াও এই একদিনের যজ্ঞ করার জন্য কিন্তু পাঁচদিনের আয়োজন প্রয়োজন।
এই যজ্ঞে সামগীতকারীর দল থাকেন। বিশিষ্ট মন্ত্রোচ্চারণবিদ ঋগ্বেদীর দল থাকবেন। অর্থাৎ বাচিকের একটি অংশ এখানেই পাচ্ছি আমরা। যজমানের ঘরে নয়, দুটি দেবযজনবেদী এখানে গ্রামের বাইরে প্রস্তুত হচ্ছে। নির্দিষ্ট পোষাক থেকে চোখে কাজল দেওয়া সব রকমের আহার্যের কাজও এই যজ্ঞের বিবরণে পাওয়া যাবে। এই কথাগুলো এখানে লেখার কারণ হচ্ছে এই জাতীয় যজ্ঞের বিবরণ থেকেই আমরা খানিক অনুমান করতে পারি রীতি-নীতির যে ব্যবস্থা হয়েছে তার মধ্যে নাট্যের যাবতীয় উপাদান তখনই মজুদ। শুধু তাই নয়, অগ্নিষ্টোমের প্রস্তুতির দ্বিতীয় দিনেই হবে সোম কেন্দ্র করে নাট্যটি। এবারে তার বর্ণনা দিই।
অগ্নিষ্টোমের প্রস্তুতির দ্বিতীয় দিন শুরু হয় প্রায়ণীয় ইষ্টিযাগ দিয়ে। প্রায়ণ কথাটির অর্থ আরম্ভ। এই যাগের পর সােমক্রয়। যজ্ঞশালার বাইরে সােমবিক্রেতা সােম নিয়ে বসে থাকে, তার থেকে সোম কিনতে হয়। ততদিনে, সােমলতা দুপ্প্রাপ্য হয়ে গেছে ; পর্বত থেকে এনে যজ্ঞের জন্য বিক্রি একদলের ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অগ্নিষ্টোম জাতীয় যজ্ঞের সোম-ও এই ব্যবসায়ীদের থেকে কিনে নাট্যাংশটি সাজানো হয়।
সাজানো সােমবিক্রেতা যজ্ঞশালার বাইরে বসে সোমলতা বেচতো। এই সােম কেনার এক কাহিনী আছে। সােম এক কালে গন্ধর্বদের নিকট ছিলেন ; দেবতারা কৌশল করে সেই সোম এনেছিলেন। গন্ধর্বেরা স্ত্রী-প্রিয়। দেবগণ কুমারী বাগ্দেবীকে গন্ধর্বদের কাছে পাঠিয়ে দেন। তিনি গন্ধর্বদের ভুলিয়ে সােম নিয়ে আসেন এবং নিজেও পালিয়ে আসেন। সােমক্রয় অনুষ্ঠানে সেই ঘটনার অভিনয় হয়। ঋত্বিকদের সঙ্গে যজমান একটি ছােট বাছুর নিয়ে সােমবিক্রেতার কাছে উপস্থিত হন। ঐ সােমবিক্রেতা গন্ধর্বস্থানীয় এবং বাছুরটি বাগ্দেবী। কিছুক্ষণ দর-দস্তুর করিয়া বাছুরটিকে মূল্যস্বরূপ দিয়ে সােম কেনা হয়। সােম হস্তগত হলে হঠাৎ লাঠি বের করে সােমবিক্রেতাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং বাছুরটি কেড়ে নেওয়া হয়। সােমও গেল, বাগদেবীকেও সে পেল না। যজমান সােমলতা কাপড়ে জড়িয়ে মাথায় করে নিয়ে গরুর গাড়িতে তুলে দেন। যজমান এবং অধ্বর্যু গাড়ীর উপর বসে থাকেন ; হােতা ঋগ্ মন্ত্র আওড়াতে থাকেন এবং সুব্রহ্মণ্যা নামক ঋত্বিক গাড়ী চালাইয়া প্রাগবংশশালা ঘুরে ভিতরে উপস্থিত হন। সেখানে গাড়ী থেকে সােম নামিয়ে ঐষ্টিক বেদির পূর্ব দিকে আহবনীয়ের পাশে কাষ্ঠাসনে রেখে দেওয়া হয়।
লক্ষ্য করলে দেখা যায় সরমা-পণি সূক্তের কিছু ছায়া এই সোম ক্রয়ের নাট্যে রয়েছে। আবার নাট্যটি যজ্ঞের অন্তর্ভূক্ত গুরুতর কাজ বলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। একটি জনসমাজে যদি নাট্যাভিনয়ের কোনো প্রস্তুতি না থাকে তাহলে যজ্ঞের মত একটি গুরুতর বিষয়, যা বিশ্বাস অনুসারে হয় শুভ ফল দায়ক নয় ধ্বংসকারক, তাতে তা অঙ্গীভূত হতে পারে না। মন্ত্রোচ্চারণ, গীতের সুরের মতই নির্দিষ্ট পন্থায় অভিনীত না হলে দেবতার অভিশাপের আশঙ্কা বিশ্বাসীর থাকবেই। অতএব এই সকল ভূমিকায় যাঁরা অবতীর্ণ হতেন তাঁরা বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষিত ছিলেন নিশ্চয়ই।
এই সোমযাগ কতটা গুরুতর তা বোঝানোর জন্য আরেকটি প্রাচীন কাহিনীর এখানে অবতারণা করছি। এ কাহিনী কৃষ্ণ-যজুর্বেদের অংশ। ইন্দ্র, ত্বষ্টার পুত্রকে হত্যা করে। সেই পুত্র বিশ্বরূপ দেবতা এবং অসুরদের পুরোহিত ছিল। বিশ্বরূপ অসুরদের পক্ষে এই সন্দেহে ইন্দ্র তাকে হত্যা করে। হতপুত্র ত্বষ্টা ইন্দ্রহীন সােমবাগ করতে আরভ করে ; তাতে ইন্দ্র এসে সােম আহুতি প্রার্থনা করলে ত্বষ্টা পুত্রহন্তারক বলে তাকে আহান করেনি জানায়।
ইন্দ্র বলপূর্বক সােম পান করে, ত্বষ্টা তার অবশিষ্ট সােম গ্রহণ করে ‘ইন্দ্রশত্রু বর্ধিত হােক’ এ মন্ত্রে আহতি প্রদান কর়ে। কিন্তু স্বরের ব্যতিক্রম ঘটায় ইন্দ্র যার ঘাতক,এ অর্থ থেকে বৃত্রের জন্ম হয়। লক্ষ্যণীয় স্বরের ব্যতিক্রমে জন্মেই বৃত্রের মৃত্যু এবং ঘাতক নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ বাচিক তখনই বিপুল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ কাহিনীর বাকী অংশ এখানে খুব প্রাসঙ্গিক নয়। যাগ-যজ্ঞে উচ্চারণ থেকে পালনীয় রীতি-নীতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা জানানোর জন্যই এ অংশকে এখানে আনা। অর্থাৎ যাকে আজ আমরা Ritual Drama হিসেবে জানি, সেই ধরণটি এই উপমহাদেশের নাট্যোৎপত্তির ক্ষেত্রে বেশ প্রাসঙ্গিক।
এর বাইরেও কিছু মতামত আছে। ডঃ পিশেল যেমন মনে করেছেন পুতুলনাচ থেকে এসেছে সংস্কৃত নাটক। সূত্রধার এবং স্থাপক শব্দদুটি এসেছে পুতুলনাচ থেকে। মহাভারতেও পুতুলনাচের উল্লেখ আছে। যিনি পুতুল নাচান তিনি সূত্রধার, যিনি পুতুলকে যথাস্থানে স্থাপন করেন তিনি স্থাপক। রাজশেখরের ‘বালরামায়ণ’ পঞ্চমাঙ্কের একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন পিশেল। সেই অঙ্কে অসুর (দানব) ময়-এর সুযোগ্য শিষ্য বিশারদ সীতা এবং সিন্দুরিকা নামে দুটি পুতুল বা পুত্তলি নির্মাণ করেন। সীতা নামের পুতুলটির মুখের মধ্যে ময়না বা তোতা-র মতন কোনো পাখি স্থাপন করেন যে প্রাকৃতে কাব্যও বলতে পারে। রাবণ এই পুতুলটিকেই প্রথমে সীতা বলে বোধ করে। তারপরে তার ভুল ভাঙলেও নিজের বিনোদনের জন্য পুতুলদুটিকেও নিয়ে যায় লঙ্কায়। গুণাঢ্যর বৃহৎকথা থেকে সোমদেবের কথাসরিতসাগর ইত্যাদি নানা সূত্রের উল্লেখ করেছেন পিশেল পুতুল সংক্রান্ত ভারতীয় ধারাটি কত প্রাচীন তা বোঝানোর জন্য। এবং মহাভারতে পুতুল নাচিয়ে হিসেবে সূত্রপ্রোত শব্দটি এবং রাজশেখরে একই কাজের জন্য ব্যবহৃত সূত্রধার শব্দটিকে ব্যবহার করেছেন। এই সকল জায়গা থেকে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন পুতুলনাচ থেকে এসেছে সংস্কৃত নাটক।
সমস্যা হচ্ছে সূত্রধার শব্দটির অজস্র অর্থ আছে। সূত্রধার, কাঠের কাজ থেকে পাথরের কাজ নানা কাজের বিশেষজ্ঞ। সুতো দিয়ে পরিমাপ করা অত্যন্ত প্রাচীন বিষয়। নাট্যশাস্ত্রের দিকেও যদি আমরা দেখি তাহলে দেখা যাচ্ছে তার দ্বিতীয় অধ্যায়ে রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাথমিকভাবে স্থান-পরিস্কার, মাটি পরীক্ষা থেকে ভিত-স্থাপন এ সবও সূত্রধারেরই কাজ। অর্থাৎ একদিক থেকে দেখতে গেলে সূত্রধার সব কাজেরই কাজী। আবার সূত্র কথাটিও ভারতীয় সাহিত্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সূত্রসাহিত্য অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ শাখা। সেখানে অতি সংক্ষেপে মন্ত্রাদির সংরক্ষণ হয়। আবার নীতিগত বা অনুশাসনগত বিষয় থাকে, যেমন বৌদ্ধ বা জৈনদের ক্ষেত্রে। ইন্দ্রের উপাধিও সূত্রধার। আবার পৈতে পরা ব্যক্তিকেও সূত্রধার বলা চলে। অর্থাৎ শুধুমাত্র সূত্রধার শব্দটি দিয়েই যদি পুতুলনাচের সঙ্গে সংস্কৃত নাট্যের সম্পর্ক তৈরী করতে হয় সে বড়ই কষ্টসাধ্য কল্পনা হয়ে ওঠে। তাছাড়া আমরা আগেও দেখিয়েছি নাট্যের উপাদান সমূহ যাগ-যজ্ঞে ক্রিয়া করছে অনেক আগে থেকেই। তার আরেক অর্থ হল সমাজে এ সকল উপস্থিত রয়েছে। দক্ষ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। সুতরাং শুধুমাত্র পুতুলনাচ থেকে এত কিছু আসার কোনো কারণ নেই।
এ ছাড়াও আরেকটি অভিমত আছে, ওয়েবারের অভিমত। তিনি প্রথম ভারতীয় নাট্যে গ্রীক প্রভাবের কথা বলেন, যবনী আর যবনিকা (পর্দা) শব্দদুটিকে লক্ষ্য করে। সঙ্গে আছে সংস্কৃত নাটকে গ্রীক নাটকের মত অভিজ্ঞানের বা স্মারক-চিহ্নের ব্যবহার (যেমন অভিজ্ঞান-শকুন্তলম রূপকে)। গ্রীক নাট্যে পর্দার ব্যবহার নেই। আবার নাট্যশাস্ত্র যবনদের একটি উপজাতি হিসেবে চিহ্নিত করছে যাদের নাট্যে উপস্থাপন করতে হলে গাত্রবর্ণ লালচে হলুদ রঙে রাঙাতে হবে। চন্দ্রগুপ্র মৌর্যের সময়কালে পাটলিপুত্রে কিছু গ্রীক নাটক অভিনীত হবার কথা জানা যায়। আলেক্সান্ডার ভারতীয় উপমহাদেশ আক্রমণ করতে আসার আগেও পারস্যের সূত্রে এই উপমহাদেশের সঙ্গে গ্রীকদের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। বাণিজ্য এবং জ্ঞান-ভাণ্ডার বিনিময় হওয়া স্বাভাবিকই।
কিন্তু কুশীলব, শৈলূষ, নট ইত্যাদি শব্দের আরো প্রাচীন উল্লেখ, বেদাদির সংবাদ-সূত্রগুলি, পাণিনি উল্লিখিত নটসূত্র ইত্যাদি নাট্যের পূর্ব উপস্থিতি প্রমাণ করে। যে কোনো জাতি বা উপজাতিই তার নিজস্ব সংস্কৃতি যখন নির্মাণ করেছে, প্রাচীন সময়, তখন সে নানা ধরণের নকল করার কার্যক্রম ধরেই এগিয়েছে। জাদুবিশ্বাস থেকে আত্মরক্ষা (নানা বর্ণবৈচিত্র্যে শিকার ইত্যাদির সময় নিজেকে সজ্জিত করা) এমন নানা কাজে এই অনুকরণ ব্যবহার করেছে। সেখান থেকে অন্য মানুষের অনুকরণ করাটি স্বাভাবিকও। এর বাইরেও বলা চলে যবন শব্দের অর্থ শুধু গ্রীক ধরে নিলে ছান্দস (বিশেষ করে ঋগ্বৈদিক ভাষা থেকে) সংস্কৃত পর্যায় অবধিও শব্দার্থ বহুভাবে পাল্টাতে থেকেছে। অপরকে চিহ্নিত করার জন্য শব্দ অপরের সঙ্গে পরিচিত হবার পরিমাণের উপর নির্ভর করে। স্বল্প পরিচয়ে যাদের একশ্রেণীতে ফেলা চলে, পরিচয় গভীর হলে তাদের পার্থক্যও নজরে আসে, নতুন শব্দ জন্মায়। গ্রীকরা আলেক্সান্ডারের আগে অবধিও ইন্ডিকা বলে যাকে চিনতো তার ভৌগলিক সীমা আলেক্সান্ডার আসার পরে আর এক থাকেনি। অর্থাৎ শুধুমাত্র শব্দ নির্ভর করেই নিশ্চিত প্রমাণে পৌঁছোনো দুষ্কর। এবং এও বলাই বাহুল্য যে গ্রীক নাট্য যদি সংস্কৃত নাট্যকে প্রভাবিত করে থাকে তাহলে গ্রীক নাট্যও প্রভাবিত হবার কথা। যা হোক সে ভিন্ন আলোচনার বিষয়। আপাতত এটুকুই বলা চলে এ সম্পর্কে যথেষ্ট প্রমাণ এখনো নেই।
সচরাচর সংস্কৃত নাট্যের উৎপত্তিকেই সাধারণভাবে উপমহাদেশীয় নাট্যোৎপত্তিরূপে গণ্য করার রীতি আমাদের রয়েছে। কিন্তু সে রীতির বাইরেও কিছু কথা থেকে যায়। এই বিরাট উপমহাদেশে সংস্কৃত ভাষাভাষী ছাড়াও যাঁরা ছিলেন তাঁদের নাট্য ঐতিহ্য কেমন, এ কথা আজ যদি আমরা বুঝতে চাই, তাহলে প্রথমেই ঐতিহাসিক উপাদানের অপ্রতুলতা নজরে পড়বে। তার অর্থই এই নয় যে আর কোনো নাট্যরীতি প্রচলিত ছিল না কোথাও! নাট্যের যে প্রথাগত সংজ্ঞায়ন হয়ে আছে তার সমস্যার জন্যও হতে পারে আমরা আরো নানা নাট্যকে চিহ্নিত করতে পারছি না। সংস্কৃত নাট্যের বৈভব যেমন আমাদের আদৃত সম্পদ তেমনই বাকী উপমহাদেশের বাকী বাসিন্দাদের সংস্কৃতিও আদরণীয়। আপাতত এই আশা করা যে একদিন আমরা আরো সমৃদ্ধির সন্ধান পাব।
খুব ভালো লেখা, পুরাণ ইতিহাস ঘেটে এই পরিশ্রম সার্থক হয় যখন নাট্যের ছেলে মেয়েরা সে পাঠ প্রকৃত অর্থে গ্রহণ করেন।
চলুক লেখা। একদিন সে সন্ধান পাবো এই আশায় আগামী সংখ্যার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
প্রণাম।
ধন্যবাদ বন্ধু অসীম। আমার সাধ্যমত সে চেষ্টা চালিয়ে যাব।