একটি পুনর্কথিত গল্প: থিয়েটারের কিছু অলস চিন্তা – বিজয় টেন্ডুলকার

কি এমন যা নাটককে যথার্থরূপে চিহ্নিত করে?

এই প্রশ্ন নতুন নয়। বোধহয় লক্ষাধিকবারেরও বেশি এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করা হয়েছে এবং উত্তরও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তবুও যেকোনো স্তরে থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি মানুষের কাছেই এটি আজও সবথেকে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন।

এই প্রশ্নের উত্তর কৌশল।

একটি নাটককে মঞ্চস্থ করা, প্রদর্শন করা, দেখা এবং উপভোগ করার জন্য কৌশল প্রয়োজন। অ্যাবসার্ড থিয়েটারেরও নিজস্ব কৌশল রয়েছে। এমনকি লোকনাট্য যেগুলি খোলা মাঠে অনুশীলনের সময় নিজেকে অনেকটা স্বাধীন মনে হয়, তারও কিছু নিজস্ব রীতি-নীতি আছে। সেগুলিকে কখনোই হালকাভাবে নেওয়া বা নির্বোধের মতো তাচ্ছিল্য করা যায় না। কাজ করার আগে আপনাকে নীতি এবং কৌশলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
নাটক হল পুনর্কথিত গল্প।

পুনর্কথিত বলা হচ্ছে এই কারণেই যে এই সব গল্পগুলিই আগে বলা হয়ে গেছে। কেউ না কেউ মূল গল্পগুলিকে মানানসইভাবে জুড়ে দিয়েছে আটষট্টি অথবা ঊনসত্তর নম্বর সূত্রে, আমার এই মুহূর্তে ঠিক সূত্রের নম্বর টা মনে পড়ছে না। ভাগ্য, অভিশাপ, সম্পর্ক, দুঃখ-যন্ত্রনা, মানুষের ইচ্ছে ইত্যাদি। আপনি যেকোনো একটি পরিস্থিতি কল্পনা করলেই জানতে পারবেন যে এটি আগেই পঁয়ত্রিশ অথবা ঊনত্রিশ নম্বর সূত্রে রয়েছে।

অত্যন্ত হতাশাজনক হলেও এটিই সত্যি। সবকিছুই প্রাচীন। মূলত বলতে গেলে এই সবকিছুই কোনো না কোনো রূপে আগে থেকেই রয়েছে। যুক্তিসঙ্গতভাবে বললে, বলা ভালো প্রায় সবকিছুই। সাম্প্রতিককালের প্রতিটি নাটক বা একজন মানুষ যে নাটকগুলির কথা কল্পনা করতে পারে, তার প্রতিটিই এক-একটি পুনর্কথিত গল্প।
সময়কাল বর্তমান বা ভবিষ্যৎ- দুইই হতে পারে। কেউ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সম্পর্কে আলোচনা করতে পারে। আবার কেউ প্রযুক্তির যুগ, মহাকাশ এমনকি নিউট্রন সম্পর্কেও আলোচনা করতে পারে, কিন্তু মূল গল্পগুলি সেই পুরোনোই থাকবে বা আমার মনে হবে আমি সেগুলি আগে শুনেছি।

যদি আপনি একটি গল্প বলতে চান, তাহলে আপনাকে সেটি ভালো করে বলতে হবে। কিন্তু আপনি যদি এমন একটি গল্প বলেন যেটি পূর্বে বলা হয়েছে, তাহলে আপনাকে অধিক যত্নশীল হতে হবে।

সেই গল্পকে নতুন রূপ দিতে হবে আপনাকে।

দর্শককে মূল গল্পের সঙ্গে নয় বরং আপনি যেভাবে গল্পটিকে বলছেন, সেই ধরণটির সঙ্গে একাত্ম করতে হবে। সেই ধরণটিই তখন গুরুত্ব পাবে। তার শৈলী, ভঙ্গিমা, বিরতি, শুরু, শেষ এবং গোটা কাঠামোটি।

আপনাকে নিখুঁত হতে হবে। এর থেকে কোনো পরিত্রাণ নেই। ধরুন আপনি একটি গল্প বলছেন, একটি পুরোনো গল্প। যেটি ইতিপূর্বে বলা হয়েছে এবং অনেকেই সেটি শুনেছে। এবার আপনি যদি নিখুঁত না হন, তাহলে দর্শক মাঝপথেই ঘুমিয়ে পড়বে। আর নাহলে সেই পুরোনো বস্তাপচা জিনিসের একঘেয়ে আড়ষ্টতা নিয়েই তারা বাড়ি ফিরবে।

এক্ষেত্রে দুরকম মত হতে পারে। কৌশল খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে থিয়েটারে– আমাদের থিয়েটারে।

কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন আমাদের বলতে হবে বা বলা ভালো নতুনভাবে বলতে হবে একটি গল্পকে?

কি এমন প্রয়োজনীয়তা? কি এমন তাড়না? কি হবে যদি আমরা গল্প বলা বা পুনরায় বলা বন্ধ করে দিই?

বিশেষত, থিয়েটারে একটি গল্পকে বলা যথেষ্ট কঠিন কাজ। তার জন্য শক্তি, সময় এবং অর্থ– তিনটিই প্রয়োজন এবং সেটি একজন ব্যক্তির নয়, একটি গোটা দলের যারা আগে থেকেই অন্যান্য বিষয়ে ব্যস্ত এবং আচ্ছন্ন।

আমরা থিয়েটার কেন করি?

হয়তো অর্থের প্রয়োজনে। দিনশেষে রুজি-রুটির ব্যবস্থা তো করতেই হবে সবাইকে। প্রত্যেকের নিজের জন্য এবং তার পরিবারের জন্য অর্থের প্রয়োজন। প্রত্যেককেই সঞ্চয় করতে হবে, খরচ করতে হবে দু-একটি বিলাসিতার উপকরণের নিমিত্তে।

কিন্তু সেগুলির জন্য অনেক সহজতর বা বলা ভালো কম ঝুঁকিপূর্ণ পথ রয়েছে। এমন অনেক পেশা আছে যেখানে স্বল্প পরিশ্রমে অধিক উপার্জন হয়। যে পেশা স্থায়িত্ব দেয়। আপনি ৬ ঘন্টা কাজ করে মাইনের খাম হাতে পেতে পারেন বা বেআইনি মদের ব্যবসার মতো পেশায় পুলিশকে সামান্য ঘুষ দিয়ে বসে বসে দিনে চার-পাঁচ হাজার টাকা রোজগার করতে পারেন যদি আপনার কৌশল জানা থাকে। চোরাচালানও এই ধরণের পেশার অন্তর্গত। এমনকি রাজনীতিও একটি মূল্যবান বিবেচ্য বিষয় হতে পারে।

তাহলে কেন থিয়েটার করেন, যা আপনাকে অস্থিতিশীল করে তোলে এবং বারংবার আঘাতের মাধ্যমে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েও পরিবর্তে খুব সামান্য অর্থের জোগান দেয়?

সম্ভবত খ্যাতির জন্য। আপনি নামডাক করতে পারেন। আপনাকে সবাই জানতে পারে। আপনি প্রচারের আলোয় থাকেন। আপনি হয়ে উঠতে পারে সকলের পরিচিত মুখ।

এখানেও আমার মনে হয় বিতর্ক শেষ হবে না। ফিল্ম তুলনামূলক আরও প্রতিশ্রুতিশীল মাধ্যম। টি.ভি ও রয়েছে। টি.ভি তে যে কেউ রাতারাতি স্টার হয়ে যেতে পারেন। এমনকি যারা স্টার হয়ে উঠতে পারেন না, তাদেরকেও নাম এনে দেয় সিনেমা। রাস্তায় সবাই আপনাকে চিনতে পারে। আপনাকে দেখতে ভিড় জমায়। আপনি কমেডিয়ান, খলনায়ক, পার্শ্বচরিত্র বা যদি স্টান্টম্যানও হন, তাহলেও আপনার অনুরাগীরা আপনাকে চিঠি লিখবে। এমনকি একজন সংবাদ পাঠক বা টিভির সঞ্চালককেও মানুষ সহজেই রাস্তায় বা বাসে চিনে নেয় এবং সম্মান জানায়।

তাহলে কেন থিয়েটার? কেন নাটক লিখে সেগুলি মঞ্চস্থ করবেন?

ব্যর্থ হওয়ার, নেতিবাচক সমালোচনা পাওয়ার, উপেক্ষিত হওয়ার, দর্শকেরা সন্তুষ্ট না হলে তাদের থেকে অশ্রাব্য গালিগালাজ ভেসে আসার চিরস্থায়ী সম্ভাবনা― নাম বা খ্যাতি পাওয়ার জন্য এই বিশাল অগ্নিপরীক্ষা কি সত্যিই যথার্থ?

তাছাড়া টাকা বা খ্যাতির জন্যেও কি কেউ অর্থহীন ভাবে একটা গল্প বলতে পারে? যেভাবে একজন কায়িক শ্রম করে, হিসাবরক্ষণ করে বা সেলাইয়ের কাজ করে?
কখনোই না। একজন তার গল্পের মাধ্যমে কিছু না কিছু প্রকাশ করে। সেটা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত দুইই হতে পারে।

যদি কেউ নিজেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে যে সে কি প্রকাশ করতে চায়, তাহলে পুরো ব্যাপারটাই এলোমেলো হয়ে যাবে। যদি তার কাছে নতুন কিছু প্রকাশ করার মতো না থাকে, তাহলে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে যাবে। এক অর্থে, কেউ যখন গল্প বলে, তখন সে নিজেকেই প্রকাশ করে। এটি একপ্রকার নিজেকে, নিজের ভেতরকে প্রদর্শন করা। চাইলে বা না চাইলেও গল্প বলা একপ্রকার আদান-প্রদান ব্যবস্থা গড়ে তোলে।

আপনি কিছু যদি অনুভব করেন বা অনুভব নাও করেন, তাহলেও আপনি কিছু না কিছু প্রকাশ করেন।

দর্শকের ক্ষেত্রেও তাই।

তারা থিয়েটারে কেন আসেন, অগ্রিম টিকিট বুক করেন এবং নিজের সামর্থ্যের উর্দ্ধে গিয়ে পুনরায় নাটক দেখতে আসেন? বিনোদন লাভের জন্য। তাদের দৈনন্দিন উদ্বেগ এবং দুশ্চিন্তা ভুলে থাকার জন্য। প্রাত্যহিক কার্যকলাপের একঘেয়েমিকে ভেঙে দেওয়ার জন্য। একটু উত্তেজনার জন্য।

কিছু পাওয়ার জন্য।

তারা স্বেচ্ছায় এবং উৎসাহের সঙ্গে থিয়েটারে গ্রাহকের ভূমিকা পালন করে। এবারে আরো পরিষ্কারভাবে দেখা যেতে পারে।

থিয়েটার অন্য যেকোনো কিছুর ঊর্ধ্বে আদান-প্রদানের জন্য। থিয়েটার মানে আদান-প্রদান।

আমরা গল্পের মাধ্যমে আদান-প্রদান চালাই। সেই পুরোনো গল্পগুলোরই সঙ্গে জুড়ে দিই কিছু নতুন এবং সমসাময়িক বিষয়বস্তু। আমাদের বিষয়বস্তু। আমাদের গল্পবলার ধরণ সেই সমসাময়িক বিষয়বস্তুর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠে।

থিয়েটার তার দলগত বৈশিষ্ট্য নিয়েও এই পর্যায়ে ব্যক্তিগত হয়ে ওঠে। থিয়েটারটা আপনার হতে হবে নাহলে সেটি কখনো থিয়েটার হয়ে উঠতে পারবে না। থিয়েটার সর্বসাধারণের হতে পারেনা।

থিয়েটার নিজেই একটি শব্দ। একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক নাটক এর ভালো উদাহরণ হতে পারে। এই নাটকগুলি দর্শকদের উদ্বুদ্ধ করে যথার্থ সময়ে হৃদয় দিয়ে স্লোগান ধ্বনি এবং উৎসাহ প্রদানে। নাটকটি যে বার্তা বহন করছে, দর্শক আগে থেকেই সেটির প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করেছে এবং তারা সাগ্রহে এসেছে সেটি থেকে অনুপ্রাণিত হতে এবং তার কিছু অংশের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য। এখানে ইতিমধ্যেই একটি আদান-প্রদানের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এবার নাটক তার আশানুরূপ কাজ করলে বাকি কাজ দর্শকই করে দেয়। অভিনেতা এবং দর্শক- উভয়ের কাছেই এটি একটি রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। তারা সম্পূর্ন সন্তুষ্টি নিয়েই প্রেক্ষাগৃহ ত্যাগ করেন। আমি এমন কাউকে খুব কমই দেখেছি যারা এই ধরণের নাটক দেখে পরিবর্তিত হয়েছেন। সাধারণত, যারা ওই নির্দিষ্ট নাটকটির চিন্তাধারার সঙ্গে একমত নন, তারা এই ধরণের নাটক দেখতে আসেন না। তারা নিজস্ব ইচ্ছা অনুযায়ী, নিজস্ব চিন্তাধারার নাটক পছন্দ করেন। এমন কিছু মানুষও প্রেক্ষাগৃহে থাকতে পারেন যারা কেবল নিরপেক্ষ দর্শক। তারাও হয়তো চারপাশের উত্তেজনায় রোমাঞ্চিত হয়ে সচেতন ভাবেই অংশগ্রহণ করেছিযেন স্লোগান ধ্বনি অথবা করতালিতে। তবে আমার অভিজ্ঞতা বলে নাটক শেষ হওয়ার কয়েক মুহূর্ত পরেই তারা তাদের নিরপেক্ষ অবস্থানে ফিরে আসেন। নাটকের প্রভাব হয়তো ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যায় কিন্তু তাদের স্মৃতিতে তা রয়েই যায়। নাটক, তা যেকোনো ধরণেরই হোক, কদাচিৎ কারো মননে-মস্তিষ্কে আঘাত করে তার চিন্তাধারার এক মজবুত এবং দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তনের দিকে তাকে নিয়ে যায়– সেটি রাজনৈতিক বা অন্য কিছুও হতে পারে।

এমন কোনো পরিবর্তন ঘটলেও, তা আকস্মিক এবং সাময়িক। কেউ এটিকে অতিমাত্রিক রূপেও বর্ণনা করতে পারেন। খুব সম্ভবত থিয়েটার পরিবর্তনের নিশ্চিত পরিবহন মাধ্যম রূপে গণ্য হয় না, যদিও থিয়েটারের পরিবর্তন-বিমুখ হওয়ারও প্রয়োজন হয় না। থিয়েটারের প্রয়োজনীয়তা আদান-প্রদান, একতা, কিছুটা উত্তেজনা এবং এর একটি নিজস্ব অভিজ্ঞতায়। একটি ভরসযোগ্য অভিজ্ঞতা, যা আমাদের বর্তমান অস্তিত্বের বেড়ে চলা অত্যাবশ্যক চাহিদার মোকাবিলা করতে সাহায্য করে। থিয়েটার যেন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় ক্রমবর্ধমান বিভ্রান্তিকর প্রকৃতিকে।
তারপর আসে বাকি যা কিছু।

অনুবাদ: সৌমেন্দু হালদার
ঋণ: পঞ্চম বৈদিক ২৫ (‘নাথবতী অনাথবৎ’-এর প্রথম মঞ্চায়ন উপলক্ষে প্রকাশিত পত্রিকা থেকে লেখাটির নির্বাচিত অংশ পুনঃপ্রকাশিত হয়)