দীপা ব্রহ্ম
আমরা যাঁরা নাগরিক মানুষজন, তাদের একটা ছক বাঁধা জীবন। আমাদের বেড়ে ওঠার মধ্যেই সেই বাঁধাধরা নিয়মের পথ ঘুরে ফেরে। একটি শিশুর জন্মের আগে থেকেই চলতে থাকে নানা অনুক্রম। তাকে কোন মাধ্যমে দেওয়া হবে তার তোড়জোড়। বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রে উলটে ছবিও দেখা যায়, যা বাবা-মাকে নাজেহাল করে ছাড়ে। কিন্তু যেটা বলার কথা তা হল — এই কলম লিখতে গিয়ে বারবারই আমি দেখেছি, লোকসংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত মানুষগুলিকে কখনোই আমরা সেই চেনা সূত্রে বেঁধে ফেলতে পারি না। আমার চেনা আবর্তের প্রশ্ন বারবারই অচেনা আবর্তে ঘুরে ফেরে সেই স্বাধীন, স্বতঃস্ফূর্ত ইচ্ছার গহীন আলপনায়। তাই এবার যখন পুতুল নাচ নিয়ে সেইসব মাটির মানুষদের সঙ্গে কথা বললাম, প্রত্যক্ষ করলাম এ শিল্পে তাঁদের সংযুক্তি দামাল নদীর মতো, অনিত্য, স্বাভাবিক।
দক্ষিণ ২৪ পরগণায় এ রাজ্যে পুতুল নাচের একটা ঐতিহ্য বহন করছে। শোনা যায়, কাকতাড়ুয়ার ধারণা থেকে এই অঞ্চলে এই নাচের উৎপত্তি। প্রায় ১৫০ বছর আগে, উঠোনে বসে শিশুদের প্রাঞ্জল করে গল্প বলতেন জনৈক বয়স্ক ব্যক্তি। তাঁর বলার মধ্যে এতটাই নাটকীয়তা ছিল, শিশুরা হা করে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতো। এভাবেই কাঠিতে দড়ি দিয়ে টেনে টেনে আঁতুর ঘরে জন্ম নেওয়া আজকের হেঁটে চলে বেড়ানো পুতুলদের।
জয়নগর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরত্বে মায়া হাউরি গ্রামে সত্যনারায়ণ পুতুল নাট্য সংস্থা রয়েছে। এই সংগঠনের কর্ণধার নিরাপদ মন্ডল। দক্ষিণ ২৪ পরগণার সাবেক পুতুল নাচ প্রদর্শন করেন। দীর্ঘদিন আগে আমি যখন ওঁদের বাড়িতে যাই ওই গ্রামে তখন বিদ্যুৎ ছিল না, এখন অবশ্য সে অসুবিধা নেই। মনে আছে দাওয়াতে সাজানো বড় বড় পুতুলের সারি। ভাই, বাবা, জ্যাঠামশাই সবাই মিলে তখন সবেদা গাছের নিচে কালো কাপড় টাঙিয়ে পুতুল নাচ দেখিয়েছিলেন। ওঁর ভাই পর্দার ওপারে একটি পুতুলের সঙ্গে নিজের আত্মাকে মিশিয়ে কিভাবে যে আমাদের নাচ দেখিয়ে আনন্দ দিয়েছিলেন তা সত্যি ভোলার নয়। সেই কাঠের ভারি পুতুলটিকে তার মতো করে সে নাচাচ্ছিল। এখন নিজের সুবিধার জন্য এই ভারি কাঠের বদলে তারা থার্মোকল ব্যবহার করে পুতুল বানান।
পুতুলের হাতের চলাচলেও কিছু পরিবর্তন এনেছে নিরাপদ। আগে যেমন লাইভ
মিউজিক হতো, এখন সেই যন্ত্রগুলিই বাজিয়ে রেকর্ড করে নানা জায়গায় রেকর্ডিং বাজিয়ে পুতুল নাচ দেখান নিরাপদ। নিরাপদ স্বপ্নপূরণের জন্য জীবন মন্ডলের হাট বলে একটি জায়গায় পুতুল নাচ শেখানোর ডেরা তৈরি করেছেন। এখানে বিনা পারিশ্রমিকে তিনি শিশুদের পুতুল বানানো, পুতুল নাচ শেখানোর কাজ করে চলেছেন। প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব সুরেশ দত্তের আশীর্বাদ ধন্য নিরাপদ। তাঁরই প্রচেষ্টায় নেপাল, লাওস, মায়ানমার, ইন্দোনেশিয়ায় তাঁর জেলার দল এই পুতুল নাচ প্রদর্শন করে এসেছে। বাঙ্কাবেড়িয়া, দক্ষিণ বারাসাত, সুভাষগ্রাম, সরিষা, বাজারবেড়িয়া, ঠাকুরপুকুর ইত্যাদি অঞ্চলে বহু ঐতিহ্যবাহী ডাঙের পুতুলনাচের দল রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে মূলত তিন ধরনের পুতুল নাচ হয়। ডাঙের পুতুল, তারের পুতুল আর বেনিপুতুল। আদি এই তিন ধারা থেকে পরবর্তী ছায়াপুতুলও এখন এখানে প্রচলিত হয়েছে।
বর্তমান প্রজন্মের অপরশিল্পী প্রবীর সিনহা জানালেন শিশুদের নিয়ে তিনি কাজ করতে পছন্দ করেন। বিদ্যালয়ের সহপাঠক্রমিক বিষয়গুলির মধ্যে পুতুলনাচও জায়গা করে নিয়েছে। শিশুরা সহজেই তাদের পড়াশোনা করতে পারছে যখনই তাদের বইয়ের কালো হরফগুলি পুতুল হয়ে তাদের সামনে তাদের সঙ্গে কথা বলছে। প্রবীর এ ধরনের কাজও করে চলেছেন। তিনিও পদ্মশ্রী সুরেশ দত্তরই ছাত্র। অপর পুতুলনাচ শিল্পী জগমোহন মন্ডলের বাড়ি মেদিনীপুরে হলেও, এই শিল্পকে ভালোবেসে সে এখন দক্ষিণ ২৪ পরগণার বাসিন্দা।
দক্ষিণ ২৪ পরগণা ছাড়া নদিয়ায় যে পুতুল নাচ রয়েছে তাও বেশ ঐতিহ্যশালী। নদিয়ার হাঁসখালির মুরাগাছা অঞ্চলে দুলাল বৈরাগীর পুতুলনাচের মধ্যে বাংলাদেশের একটি প্রভাব রয়েছে। জলের শোলাকে শুকিয়ে, তাকে কালো সুতো দিয়ে সেলাই করে পুতুল বানাতেন তিনি। তারপর সেই পুতুলকে জামা পরিয়ে তার দিয়ে নাচাতেন। এই অঞ্চলে অনেককাল আগে সনাতনী তারের পুতুল নাচের চল ছিল। আধুনিক টিভি, ভিডিও, মোবাইলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আজ এই ঐতিহ্যমণ্ডিত শিল্প মাধ্যমটি সীমিত হয়ে এসেছে। তবু বগুলা অঞ্চলের সুশান্ত হালদারের মতো মানুষ চেয়েছিলেন সারা জেলার পুতুল নাচিয়েদের একটি সংগঠন তৈরি করতে যেখানে তাঁরা মিলিত হয়ে এই মাধ্যমটিকে সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। তবে তিনি গত হয়েছেন।
এই অঞ্চলের নীলকান্ত চক্রবর্তী, সতীশ সমাদ্দার, নেপাল চক্রবর্তীর নাম পুতুল নাচের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। তাঁদের প্রচেষ্টাকে রূপ দিতে এগিয়ে এসেছেন নিরাপদর মতো শিল্পীরা। নানা জায়গায় পুতুলের সমাহারে একটা মিউজিয়াম তিনি বানাতে চান। এই নাচের যে ইতিহাস, তাকে মুদ্রিত করার কাজ তিনি করে চলেছেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এটাই পরমপ্রাপ্তি। তাঁর রকম রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা পুতুল নাচকে যেমন সমৃদ্ধ করছে, তেমনই আট থেকে আশি বছরের আবাল বৃদ্ধ বণিতা তাঁর এই প্রদর্শনে আনন্দ পাচ্ছে। এই গতিময়তার মধ্যেও মানসিক প্রশান্তিতে আমরা সবাই ঋদ্ধ। তাঁর এই দুরূহ কাজের সাফল্য কামনা করি।
পুতুল নাচের ইতিকথা জানতে পারলাম আপনার লেখায়। এমন একটা শিল্পের ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন অসাধারণ।