জীবনানন্দের এই কবিতার লাইন দিয়েই শুরু করলাম আমার আজকের প্রবন্ধ। গম্ভীরা একটি বিস্তৃত লোকজ আঙ্গিক। এই গম্ভীরার মধ্যে রয়েছে মুখোশ নাচ, রয়েছে সংগীত, লোকনাট্য। মালদা জেলার জনপদে মিশে আছে এই গম্ভীরা। শিব এই গম্ভীরার মূল পূজ্য দেবতা। কিন্তু এই শিব নিতান্ত সাধারণ চাষী পরিবারের স্থানীয় দেবতা। গোটা চৈত্র-বৈশাখ জুড়ে মালদার নানান স্থানে নানান সময়ে গম্ভীরার পালা চলে। গম্ভীরার নাচ কাঠের মুখোশ পড়ে হয়। কালি, নরসিংহ, বুড়োবুড়ি নানান ঢঙের মুখোশে শিল্পীরা নৃত্য করেন।
লোকনাটক গম্ভীরা পরিবেশিত হয় কয়েকটি পর্যায়ে। মুখপাদ দিয়ে শুরু করে বন্দনা, তারপর ডুয়েট – চারইয়ারি, পালাবন্দি গান, খবর বা রিপোর্ট। শিব বা নানার ( দাদামশাই) কাছে জনসাধারণ তাঁদের প্রাত্যহিক অভাব -অনুযোগ- অভিযোগ তুলে ধরেন। ঘটে যাওয়া অসংখ্য অঘটনের কারণ শিবরূপী অভিনেতাকে বিশ্লেষণ করতে হয়। আবার শিব বা নানার সঙ্গে ঠাট্টাতামাশাও চলে। ঠিক – ঠিক প্রতুত্তর না দিতে পারলে শিব আসর ছেড়ে পালিয়েও যান।
গম্ভীরা একটি প্রতিবাদী লোকনাট্য। এ নাটকে জনসাধারণ অকুতোভয়। নেতা, মন্ত্রী, আমলা, হুজুর, সান্ত্রি, প্রধান, মুখিয়া, মালিক সবার যে কোনো কুকর্ম নিয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠেন শিল্পীরা। মটরবাবুর গম্ভীরার আসরে তাই অতীতে বোম পড়ার ঘটনাও ঘটে।দোকারি চৌধুরী, শেঠ বা বিশু পন্ডিতের মতো গম্ভীরার শিল্পীরা তাই অমর হয়ে রয়েছেন।
এখন মালদা অঞ্চলে প্রায় আঠেরোটির মতো গম্ভীরার দল রয়েছে। জানালেন গোপীনাথ শেঠের যোগ্য উত্তরসূরি ও কুতুবপুর গম্ভীরা দলের পালাকার ও নির্দেশক প্রশান্ত শেঠ। মটরবাবুদের গম্ভীরার জনপ্রিয়তা কেন এত বেশি ছিল, সেই খোঁজে তার শিল্পীমন বারবার অতীত হাতড়ে চলেছে।
প্রশান্তবাবুর আক্ষেপ, সেইসব অনুষ্ঠান সেইভাবে সংরক্ষিত হয়নি। তবে একজন মুক্তমনা মানুষ হিসেবে তিনি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সুচারুভাবে খুব যত্ন সহকারে গম্ভীরা পরিবেশন করেন। এখন যাঁরা গম্ভীরার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন,তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, তাঁরা যেন এই শিল্পমাধ্যমটিকে ভালোবেসে কাজ করে যান। তাঁর কাছেই শুনলাম,গম্ভীরার `লালন´ পুরস্কার পেয়েছেন দোকড়ি চৌধুরী ও বিশু পন্ডিত। এই অমূল্য লোকজ আঙ্গিকটির নিজস্ব গন্ধ বজায় রাখার পক্ষপাতি অন্য এক গম্ভীরা শিল্পী বাবুল মন্ডল। তাঁর মতে, ফরমাইশি পাঁচিলের মধ্যে থাকলে এই শিল্প মাধ্যমটির শিল্পগুণ হারাবে। তিনি বিশ্বাস করেন, পথ যদি সঠিক থাকে, মানুষ অবশ্যই তাঁদের গম্ভীরা দেখে আনন্দ পাবে। দু’হাত তুলে তাঁদের আশীর্বাদও করবেন।
অমোঘ নিয়মেই গম্ভীরার বিষয়বস্তু পরিবর্তন কেউ আটকাতে পারবে না। তবে সস্তা রংতামাশার চেকনাই এই গম্ভীরাকে হারিয়ে যেতে না দিয়ে বাবুল মন্ডল, প্রশান্ত শেঠরা নানান আধুনিক সরঞ্জামের মাধ্যমে তাঁদের উপস্থাপনাকে সংরক্ষণ করে চলেছেন। ‘গম্ভীরা সংস্কৃতির মৃত্যু নাই ‘ – শিল্পী দোকড়ি চৌধুরীর এই প্রত্যয়ই বলে দেয় – গম্ভীরা থাকবে গম্ভীরাতেই।
আহা!