গান্ধারী: কেমন দেখলাম – সমীর ভট্টাচার্য্য

সর্বমান্য সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাকাব্য মহাভারত। মহাভারতের এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে মহত্বপূর্ণ চরিত্র গান্ধারী। দীর্ঘ সময়ের বিরাট অংশকে মাত্র ৪৫ মিনিটের আয়তনে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন শুদ্ধস্বত্ত্ব ঘোষ, তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক ‘গান্ধারী’-তে। সেই নাট্য প্রযোজনার যাত্রা শুরু ২৯ জুন ২০১৯, তৃপ্তি মিত্র সভাগৃহ থেকে, বহু সমাদৃত ‘জাহান্নামের সমাচার’-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনে।

৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, প্রাচ্য ও অশোকনগর নাট্যমুখ-এর যৌথ উদ্যোগে ওইদিন সেমিনার এবং অশোকনগর নাট্যমুখ-এর প্রযোজনায়  সংস্থার নিজস্ব পারফরম্যান্স স্পেস ‘অমল আলো উৎকর্ষ কেন্দ্রে’ অনুষ্ঠিত হয় ‘গান্ধারী’-র ২৩তম প্রদর্শন। স্বনামধন্য নির্দেশক সত্যব্রত রাউতের বলিষ্ঠ নির্দেশনায় গান্ধারীর ভূমিকায় (বলতে গেলে একক) অতীব প্রশংসনীয় অভিনয় করে সমস্ত দর্শকের মনে গভীর শ্রদ্ধার জায়গা করে নিয়েছেন দলের নির্দেশক-অভিনেত্রী সঙ্গীতা চক্রবর্তী।

এই নাটকে উঠে এসেছে পুরাণবর্ণিত সর্বকালের অন্যতম ভয়াবহতম যুদ্ধ, মহাভারতের কুরুক্ষেত্র ময়দান এবং যুদ্ধের পরবর্তী অধ্যায়।

স্বামী ধৃতরাষ্ট্র পুত্রস্নেহে অন্ধ হলেও স্বেচ্ছান্ধ দিব্যদর্শী মহীয়সী মহারানি গান্ধারী বরাবরই অবাধ্য পুত্র দুর্যোধনকে শাসন করবার চেষ্টা করেছেন। তাঁকে ধর্মের পথে ফিরিয়ে আনবার প্রয়াস করেছেন, কারণ, দিব্যদর্শী গান্ধারী আগে থেকেই ভবিষ্যৎ ঘটনা সম্পর্কে অবগত ছিলেন এবং জানতেন শতপুত্রের বীরগতির যন্ত্রণা তিনি সইতে পারবেন না। কিন্তু তাঁর সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর সকলের পরামর্শ তাচ্ছিল্য করে চলে যান সৈন্য সাজাতে। কোনওভাবেই যুদ্ধ প্রতিরোধ করা যায়নি।

সেই যুদ্ধে একে একে যুযুৎসু, দুঃশাসন, দুঃসহ, দুঃশল, দুর্মুখ, বিবিংশতি, বিকর্ণ থেকে শুরু করে কনকাঙ্গদ, কুণ্ডজ, চিত্রকের মতো এক-এক করে পুত্রের মৃত্যুসংবাদ সহ‌্য করেছেন গান্ধারী জননী; অথচ সঞ্জয়ের কাছে কর্ণের মর্মান্তিক মৃত্যুর খবরে গান্ধারী আর্তনাদ করে ভেঙে পড়েন। কর্ণের মৃত্যুর পর দীর্ঘদর্শিনী তাঁর নাড়িছেঁড়া ধন অন্তিম পুত্র দুর্যোধনের ওপর মৃত্যুর দীর্ঘ ছায়া ঢেকে আসতে দেখে উন্মাদ হয়ে যান। যুদ্ধের শেষলগ্নে পৌঁছে মৃত্যুর প্রায় কাছে পৌঁছে যাওয়া শেষ ও শততম পুত্র দুর্যোধনের প্রতি পুত্রস্নেহে দুর্বল হয়ে পড়েন গান্ধারী। মনে হয় বিদুর রাজা হলে হয়তো কুরুক্ষেত্র হত না।

চারিদিকে রক্তনদী বাইছে, মৃতদের সম্পূর্ণ দেহও নেই। মুণ্ডহীন, ধড়হীন, হস্ত-পদ বিহীন, গলিত-দলিত-স্খলিত মাংসের ভয়াবহ চেহারা। জীবনে যারা শত্রু ছিল, মৃত্যুতে কেমন যেন সব এক হয়ে গেছে। কে কার কোলে, কে কার ঘাড়ে, অঙ্গহীন, বস্ত্রহীন, প্রাণহীন যেন সব বালকের দল খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়েছে। শতপুত্র আর শত-সহস্র মৃতের অবশেষের মধ্যে দুর্বল বৃদ্ধা মাত্র একটা লাঠি হাতে চারিদিকে ভিড় করা শবদলের পাহারায় বসে মনস্তাপে ভেঙে পড়েছেন। দিব্যদর্শিনী-ধর্মাচারিণী-প্রতিশোধোন্মত্তা মনস্তাপে ভেঙে পড়েছেন— ‘কী প্রতিশোধই না চেয়েছি সেদিন! শতপুত্রের মৃত্যু চিৎকার, শত শত সৈন্যদলের ধ্বংসের হাহাকার— হে রাজন, তোমার কর্ণে কি পৌঁছায়নি!’

আবার কখনও অন্ধ পতির প্রতি অনুযোগে ফুঁসছেন গান্ধারী— রাজা হলে ক্ষত্রিয়ের গর্ভে, অথচ কখনও যুদ্ধ করলে না। তোমার শরীরে মত্তহস্তির বল। শুধুমাত্র যুদ্ধান্তে একবার তোমার ক্রোধ দেখেছিলাম। ভীমসেনকে হত্যা করবার জন্য আকুল ছিলে, কারণ জ্যেষ্ঠপুত্র দুর্যোধনকে অন্যায় সমরে হত্যা করেছে সে। ব‌্যস ওই একবার। তারপর! রাজা দশরথ শব্দভেদী বাণ চালাতে পারতেন, অর্জুনও তা পারত; ক্ষত্রিয়ত্বের এত গর্ব ছিল তোমার, কই তুমি তো কখনও শেখার চেষ্টা করোনি! অতঃপর দুই নারী, পুরুষের যুদ্ধে দুই ভাগ্যহীনা সারা জীবনের তপস্যা এবং ধর্মরক্ষার ফলে, কুলধ্বংসী ভয়ানক আগুনের তাপে ডুবে গেছ শোকের সমুদ্রে।

নাট্যের অন্তিম মুহূর্তে সন্তানদের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েন গান্ধারী, এই ধ্বংসলীলার জন্য কৃষ্ণকে দায়ী করেন তিনি৷ কৃষ্ণ তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু পুত্রশোকে কাতর গান্ধারী কোনও কথাই মানতে চাননি৷ কারণ গান্ধারীর স্থির বিশ্বাস ছিল, কৃষ্ণ চাইলেই এই যুদ্ধ আটকাতে পারতেন৷ শক্তি থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধ নিবারণ না করায় গান্ধারী কৃষ্ণকে এই বলে অভিশাপ দেন— ‘তুমিও পুত্র, বন্ধু ও স্বজন হারিয়ে বনের মধ্যে খুব কষ্টে নিহত হবে এবং যাদব নারীগণও কুরু ও পাণ্ডবপক্ষীয় নারীদের মত কাঁদবে৷’

গান্ধারীর চরিত্রে অভিনয়কালে সঙ্গীতা চক্রবর্তী চেহারায়-আচরণে মহাভারতের গান্ধারীর সেই ভাবনা, দুঃখ, যন্ত্রণা, মনের জ্বালার অনুভবের অভিক্ষেপণ এমন আশ্চর্যভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যে, এমন মর্মস্পর্শী অভিনয়ে দর্শক সম্মোহিত হয়ে যেন মহাভারতের গান্ধারীর জীবনকেই অনুভব করেছেন। প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ দর্শক বাদাম হাতে ‘থ’ বসে দেখেছেন ওই অভিনয়, ভেঙে মুখে নেবার অবকাশও পাননি।

সঙ্গীতা চক্রবর্তীর সঙ্গে কোরাস অভিনয়ে সৌমেন্দু হালদার, ঝুমুর ঘোষ, অর্পিতা পাল, স্মৃতিলতা মণ্ডল, মল্লার কুণ্ডু, অভিষেক গুহ প্রমুখ সহ-অভিনেতা এবং কৃষ্ণের ভূমিকায় শাশ্বতী দাসের অভিনয়ের নিপুণতা দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।

গান্ধারীর নেপথ্যে শুভদীপ গুহর আবহ, অদ্রীশকুমার রায়ের মঞ্চ, সুদীপ সান্যালের আলো এবং শাশ্বতী দাসের কোরিওগ্রাফিও যথেষ্ট প্রশংসনীয়। এ নাটকের সামগ্রিক পরিকল্পনায় ছিলেন অভি চক্রবর্তী।

One thought on “গান্ধারী: কেমন দেখলাম – সমীর ভট্টাচার্য্য

Comments are closed.