সীতাংশু খাটুয়া খুব দ্রুত বাংলা নাট্যে উঠে আসা একটি নাম। তিনি সাহিত্যচর্চায় নিবিড় এবং এক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট গতিশীল একথা সহজেই অনুমেয় কারণ নিজস্ব দল গড়িয়া কৃষ্টি তৈরির পর থেকেই একের পর এক কালজয়ী বাংলা সাহিত্যকে তিনি মঞ্চে এনেছেন এবং আনছেন। এক্ষেত্রে সাহিত্যমূল্যই তার কাজের নক্ষত্র। সাফল্য বা ব্যর্থতার নক্ষত্রখচিত আকাশ। পেশায় অধ্যাপক সীতাংশু তার সাহিত্য-মগ্ন মনকে বড়ো সযত্নে মঞ্চে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে চলেছেন… আমরা যারা শূন্য দশক থেকে বাংলা থিয়েটার দ্যাখা এবং কিঞ্চিৎ তারসঙ্গে বসবাস শুরু করেছি তারা দেখেছি মূলত সাহিত্যের গহ্বর থেকেই গত আড়াই দশক বাংলা নাট্যে একের পর এক মহৎ এবং দিশা- নির্ধারক কাজ হয়েছে এবং তা নানান নব্য ভাষ্যের যোগানও দিয়েছে। ‘তিস্তা পারের বৃত্তান্ত’, ‘শেষ রূপকথা’, ‘ফ্যাতাড়ু’ সহ এমন বহু নাম আমরা বলতে পারি অনর্গল। এখানে আমি ব্রাত্য বসুর মৌলিক নাটককেও স্বাভাবিকভাবেই সাহিত্য মনে করি, যদিও শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় বা বিভূতিভূষণেও এমনকি রবীন্দ্রনাথেও তার সাফল্য প্রশ্নাতীত। কৌশিক সেনের প্রথম দিকের কাজের কাব্য নাটকের ধারাবাহিক পরিবেশনাকেও এই যাত্রাপথের দীপ্ত অক্ষর মনে হয়।
ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি উপন্যাস থেকে নাট্যনির্মাণে এক বিস্তৃত পরিধির মধ্যে অবিরাম যাতায়াত করা যায় আবার উপন্যাসকে হুবহু অনুসরণ করে মঞ্চে আনার ক্ষেত্রে খানিক সমস্যাও তৈরি হয়। এই পারা, না-পারার মধ্যেকার ধূসর জগতে আসমুদ্র হিমাচলের মতো ধূ-ধূ নিরালা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নিজের সঙ্গে নিজের মোলাকাত হয় নির্মাতার, তিনি তখন অভিশাপের মত দিশাহারা হয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন লক্ষের দিকে। অনন্তের দিকে… তখন তার আর ‘কোথাও যাবার নেই, কিচ্ছু করার নেই।’
যদিও সমালোচক আমি নই বা সমালোচনার ছদ্মবেশে কোনো প্রযোজনা সম্পর্কে নিন্দা বা স্তুতি করার পূর্বনির্ধারিত অথবা ব্যক্তিগত অভীপ্সা নিয়ে আমি এ লেখায় মনোনিবেশ এবং প্রবেশ করছিনা। সম্প্রতি সমরেশ মজুমদারের কালজয়ী উপন্যাস ‘গর্ভধারিনী’র নাট্যরূপ তথা মঞ্চায়ন দ্যাখার সুযোগ হয়েছিল আমার। সেই দ্যাখারই কিছু অভিঘাত বা প্রতিক্রিয়া যা সহজে এবং আকস্মিক আমার মধ্যে নাট্যের ছাত্র হিসেবে তৈরি হয়েছিল, তা নিয়েই এই প্রতিবেদনের ঘরবাড়ি তৈরির চেষ্টা করব।
প্রথমেই বলা দরকার, নাট্যে দ্যাখানো হয়েছে স্থানিকভাবে দুটি অংশ নগর এবং পাহাড়ঘেরা উত্তরবঙ্গ। মঞ্চনির্মাতা এবং নির্দেশকের কাছে আমার বিনীত প্রশ্ন, কোভিড পরবর্তীকালে থিয়েটার যখন নানা প্রয়োজনীয় কারণেই সংকুচিত হচ্ছে তখন এই বিপুল ব্যায়ের বড় মঞ্চ নির্মাণে আমাদের বড় পরিধির কাজ দ্যাখার মন তারা তৈরি করে দিচ্ছেন ঠিকই কিন্তু মঞ্চের পিছনে যে অসমতল উচ্চতা তৈরি করা হয়েছে তা এতো সমতল সিঁড়ির মতো ধাপকাটা মসৃণ কেন? সামান্য এবড়ো-খেবড়ো , চড়াই-উতড়াই সেখানে ব্যবহার করা যেত বড় অনায়াসেই… সেটি হলনা। ফলে পর্বতের গহ্বর তৈরি হলনা, মনে হল যেন দেয়ালের মাঝে দরজা-আলা একটু ছোট্ট কুটির। পর্বতাংশের অভিনয়ের সময় পর্বতের পাদদেশের মসৃণ মেঝেও চোখে বড় বাঁধার সৃষ্টি করে। সামান্য কিছু রস্ট্রাম্প বা অসমতলিক ক্ষেত্র ব্যবহার করে এই স্থানিক এবং সামতলিক পরিবর্তন বড় প্রয়োজন ছিল এই নির্মাণে, তাহলে পাহাড়ি অংশের অভিনেতাদের অভিনয় তাদের চলা, বলা এবং সংঘর্ষ -প্রতিসংঘর্ষ, নেশা- পেশা, ধর্ম- আচার, যৌনতা- বিচ্ছিনতা আরো জোরালো ও প্রবল বিশ্বাস্য হত বলেই আমার মনে হয়। এই বিষয়টা একটু যদি ভেবে দ্যাখেন নির্দেশক এবং মঞ্চপরিকল্পক। আলোক ভাবনা এবং প্রয়োগ যথাযথ। নীল কৌশিকের মঞ্চের এই বিভ্রম সৌমেন চক্রবর্তী তার আলোর রং-তুলি সহকারে কাটানোর চেষ্টা করেছেন আপ্রাণ। সাইক্লোরামার ব্যবহারে নানান ছবি তৈরি করেছে। সূর্যোদয় থেকে তুষারপাত সবই যুক্তিগ্রাহ্যভাবে মন ছুঁয়েছে। কিন্তু সারাক্ষণই মঞ্চে একটি সাদা পর্দার উন্মুক্ত থাকা তাকে অনেকক্ষেত্রেই বাধাপ্রাপ্ত করেছে বা তাকে কিছু Common Light Design এর Help নিতে হয়েছে। প্রোজেকশানে দৃশ্যাংশ ব্যবহার যথোপযুক্ত এবং বাস্তবানুগ। মনে হয় যেন উপন্যাস সচল হয়ে পাঠকের সামনে তার পৃষ্ঠা উল্টে দিচ্ছে, নিজে নিজেই। এক্ষেত্রে অভিজ্ঞান এবং অভিজিত যথাযথ কাজ করেছেন। তবে প্রোজেকশান যখন চলমান তখন মঞ্চের স্পেসে কিছু উপাদান এবং অভিনয়ের সংশ্লেষ ঘটিয়ে তাকে এই চিত্রমালার সঙ্গে মেলানো যায় কিনা সেটা নিয়ে আরেকটু পরিচালক এবং তার এই গুণী এবং উদ্ভাবনী ভাবনায় পরিপুর্ণ টিম ভাবতে পারেন। তিলোত্তমা শিল্পে তিনি খুব স্বাভাবিকভাবেই অনেক উপকরণ ব্যবহার করেছেন আমার শুধু মনে হয়েছে, মিশানো আরো মিহি আরো শৈল্পিক হলে চোখের আরাম হত। সেটুকুই উল্লেখ্য অথবা এক নির্মাণকাজকে আরেক নির্মাণকর্মীর দেখতে গিয়ে যেটুকু চোখে লাগা তা ধরিয়ে দেওয়া…
এসবের ভাবনা এবং ভাবনার পরিকল্পিত প্রকাশ মানুষভেদে চিন্তাভেদে বদলে যেতে পারে, সেই বদলই বাংলা থিয়েটারকে বা যেকোনো চলমান শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখে বলে আমার সুদৃঢ় বিশ্বাস। আর এই বদল যাদের উপস্থিতিতে গড়ে ওঠে তারা হলেন অভিনেতা। গান্ধর্বীর অভিনয় তার মঞ্চ-উপস্থিতি, তার নাগরিক ঠাঁট- বাট থেকে ধীরে ধীরে পাহাড়ি আদিবাসীদের সঙ্গে মিলেমিশে যাওয়ার এই দুস্তর জার্নি, দু’চোখে তাকিয়ে দ্যাখবার মতো… আমি ব্যক্তিগতভাবে তার অভিনয় প্রথম দেখলাম এবং সরাসরি বিহ্বল হয়ে পড়লাম… একবারও তিনি নির্মিত চরিত্রের থেকে বিচ্যুত হননি আবার ঐ নির্মাণের মধ্যেই নিজস্ব আবেগকে, নিজস্ব পারা- না পারাকে সংহত রেখে তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। অভিনেত্রী হিসেবে যে জৌলুসের, যে শিক্ষার তিনি অধিকারী তাকে সযত্নে বাঁচিয়ে রাখলে এই অভিনেত্রী বাংলা থিয়েটারে অনেক কিছু করবেন, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। কাজল শম্ভ, ঋক, সপ্তর্ষী, আম্রপালি, প্রবীর, মিঠু, ইন্দ্রনীল এরা বেশ কিছু বছর ধরে শক্তহাতেই যখন সুযোগ পেয়েছেন নিজস্ব চরিত্রায়নের পাল তুলে দিয়েছেন। মহাসমুদ্রে পাড়ি দেবার জন্য সদা প্রস্তুত নট তারা। ঋকের একটা নিজস্ব ম্যানারিজম আছে, যা আমি ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘টিনের তলোয়ার’ এ দেখেছি এখানেও তিনি সেটা বুদ্ধিমত্ত্বার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন তবে ঋককে ভাবতে হবে সব চরিত্রের মধ্যেই তিনি এই স্বোপার্জিত ম্যানারিজম নিয়ে প্রবেশ করবেন নাকি চরিত্রানুসারে আরো তীব্রভাবে নতুন কিছু আবিস্কারের দিকে নজর দেবেন। এই ভাবনা এবং তার প্রয়োগ নিয়ে কাজ করাই একজন অভিনেতার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অশোক মুখোপাধ্যায় তার প্রসঙ্গ অভিনয় বইতে বলেছিলেন যে আমরা তো ম্যাকবেথকে ছুঁতে পাচ্ছিনা তাই ম্যাকবেথকে আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনের মাঝে টেনে নামাচ্ছি’ ঋক কোনো চরিত্রই এখন অব্দি টেনে নামাননি কিন্তু নানান চরিত্রে নিজস্ব তেজস্বিতার ক্রমাগত প্রয়োগে সচেতন থাকতে হবে আরো, আত্মতেজকে কীভাবে অন্যের চরিত্রের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করা যায় তা নিয়েও আশাকরি আরো ভাববেন তিনি। প্রবীর যথাযথ। তার কোরিওগ্রাফির জায়গাগুলি আরেকটু তীক্ষ্ম হলে ভাল হয়। তবে পাহাড়ি দৃশ্যে সকলকে আরো সৎ এবং বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে হবে। আরো সাবলীল হয়ে ওঠা জরুরি। কারণ এই জীবন আমাদের যাপিত জীবন নয়, বরং তার থেকে দুর্গম গিরি প্রান্তর মরু দূরে ফলে মাঝেমাঝেই নাট্য দেখতে গিয়ে এই প্রতিবেদকের মনে হয়েছে, পাহাড়ি জীবনের অংশটা খানিকটা সাজানো, আলংকারিক। কাজল শম্ভুর অভিনয় কোরিওগ্রাফি ভাল, আরো ভাল তিনি করতে পারেন… নিশ্চয়ই। অভিনয় যত এগোবে তত এসব ঘটতে শুরু করবে। মাটি- পাহাড়- ঝোরা- ঝরনার মুখোমুখি হবেন তিনিও। আম্রপালি সম্পর্কেও একই কথা বলা চলে। তিনি ক্ষমতাবান অভিনেত্রী নিশ্চয়ই তিনি আরো পথ এই নাট্যের সঙ্গে চলতে চলতেই হয়ে উঠবেন অভিনীতিব্য চরিত্রের প্রতি আরো নিষ্ঠাবান আর যুক্তিগ্রাহ্য সংযোগকারী। আরো একটি চরিত্রকে আমার অসামান্য লেগেছে তিনি হলেন অভিজ্ঞান খাটুয়া। কতোটা নির্লিপ্ত থেকে একটা সহজ অভিনয়কে বার করে আনা যায় তা অভিজ্ঞানকে না দেখলে আন্দাজ করা মুশকিল। প্রিয় বান্ধবীর পরপুরুষের সঙ্গে প্রেম, অন্য ধর্মে চলে যাওয়া এবং বিয়ে, বন্ধুর মৃত্যু, আরেক বন্ধুর প্রেম লাম্পট্য নেশা বারেবারে মেজাজ হারানো… অন্য আরেক বন্ধুর আকস্মিক মৃত্যু এবং সর্বোপরি এসবের মধ্যেও দিন বদলের স্বপ্নভঙ্গের মধ্যে যে তীব্র বেদনা তিনি নীলকন্ঠের মতো ধারণ করলেন তা আক্ষরিক অর্থেই ঈর্ষনীয় এবং আলোর মত গতিশীল কিন্তু নীরব। তাকে দেখলে মাঝেমাঝে মনে হয়েছে কান্না দিয়ে মূর্তি তৈরি করেছেন পরিচালক।
উপন্যাস নিয়ে বা এ নাট্যের কাহিনি নিয়ে আর নতুন করে কিছু বলার নেই। একটু পড়ুয়া বাঙালি মাত্রই এ উপন্যাসে মগ্ন বিভোর হয়েছেন। নগর-স্বাচ্ছন্দ্য ভুলে বিপ্লবের রোম্যান্টিক পতাকা হাতে নিয়ে ছোট ছোট ডেরায় গিয়ে চিকচিকে চোখে সমাজ বদলের যে স্বপ্ন এককালে বাংলার ঘরে ঘরে মানুষেরা দেখেছিল, এ উপাখ্যান তা নিয়েই। সেখানে উত্তরবঙ্গের উপস্থিতি অনিবার্য এবং সমরেশ মজুমদার হলে তো সেই বর্ণনা আমাদের এক অন্য জগতে নিয়ে যায়… উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্তের ডি-ক্লাসড হবার বাসনা তথা উচ্চাকাঙ্খা এবং সরাসরি ব্যর্থ হলেও নগর আর প্রথাগত অশিক্ষিত অনামী নামের সঙ্গমে যে সন্তান আসছে তাই এ নাট্যের, এ সময়ের, এ স্বপ্নের একমাত্র ভবিষ্যত। মন্ত্রীকে সরাসরি গুলি চালিয়ে দেবার মতো নির্ভেজাল সাহস হয়তো আমাদের আর নেই কিন্তু ঘেরাও করবার মতো কন্ঠটুকুও কি নেই? ঠিকঠাক প্রশ্ন করবার জন্য যে জাঢ্য দরকার হয় তাও কি ফুরিয়ে গ্যালো ভিতর ভিতর…? বিশুদ্ধ ভয় দিয়ে ঘেরাও হয়ে থাকা বাঙালি যদি এইসব নাট্যের মধ্যে দিয়ে সামান্য দেশলাই জ্বালানোর সাহস অর্জন করে পুনরায় সেটুকুই প্রাপ্তি।
নাটক যদি সেই সামান্য মনবদলে আগুন লাগিয়ে দিনবদলের দাবানলে পরিণত করে দিতে পারে তবেই এ নাট্যের সাফল্য।
অনেক অনেক ধন্যবাদ এমন একটি প্রতিবেদন পেয়ে। আমরা চেষ্টা করছি।