গল্পের ছলে | কুন্তল মুখোপাধ্যায়

কোন সেই ছোটবেলায় পড়েছিলাম সারস আর শিয়াল এর পরস্পর নিমন্ত্রণ এর গল্প। সারস কে খেতে দেওয়া হলো প্রশস্ত পাত্রে, আর প্রত্তুত্তরে শিয়াল কে দেওয়া হলো জাগ এ, অতীব রুচিকর সুখাদ্য হলেও তারা কেউই তার স্বাদ আস্বাদন করতে সক্ষম হলো না, শুধুমাত্র পাত্রের রকমফেরে।

আমার আজকের অবস্থা প্রায়ই সেইরকম। সকাল দশটায় ব্রেকফাস্ট করে জয়গুরু বলে বেরিয়ে পড়লাম, আজ বাসেল থিয়েটার এর অন্দরে ঢুকবোই ঢুকবো। ব্যাঙ্কভেরিয়েন স্টপেজ এ নেমে বৌ কে ত্রিঙলে ফাউনটেইন এর সামনে বসতে বললাম, তিনি ভিক্টোরিয়া হোল্ট এর Bride of pendorric বই খুলে বসলেন, হাসি মুখে আমার অভিযানের সাফল্য কামনা করে পাঠে নিমগ্ন হলেন। আমি এগোলাম। বাসেল থিয়েটার চত্বর অনেকটা আমাদের নন্দন, রবীন্দ্র সদন, শিশিরমঞ্চ, এবং একাডেমি অফ ফাইনআর্টস এর চত্বর মিলিয়ে যেমনটি হয়, তেমনটিই ছড়ানো, পাশেই রয়েছে চার্চ, অনেকটা আমাদের সেইন্ট পলস ক্যাথেদ্রাল এর মতোই। চারপাশ জুড়েই মানুষ জনের মেলা, উন্মুক্ত নভতলে চেয়ার টেবিলে কফি বা বিয়ার পান রত মানুষ জন। আমি দুজন তরুণ কে হলের প্রবেশ পথের দিশাজানতে চাইলে, তারা সহাস্য মুখে একটা দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন, আমি বেশ কিছু স্টেজ প্রপার্টিজ কে বাঁয়ে রেখে এগিয়ে গেলাম, এবারেও আমার মনে হলো কেমন একাডেমির পেছনে বহুরূপী, নান্দীকার এর গোডাউন, মনি বা মদনের সেটের জিনিসপত্র ফেলে রাখা, সুদীপ বা সোমেনের লাইটের সরঞ্জাম রাখার ছবিটা রয়েছে একটু পরিষ্কার দৃশ্যকল্প দেখতে পাচ্ছি। যাইহোক, কাঁচের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম, রিসেপশন এর মহিলা হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। আমি আমার বাঙালি ইংরেজি তে তার কাছে আমার প্রশ্নমালা রাখলাম, তিনি ও স্বচ্ছন্দে আমাকে জানাতে লাগলেন, সেখানকার থিয়েটার এর এখনকার কথা। যেহেতু এটি মিউনিসিপ্যালিটি থিয়েটার সেহেতু সকাল ১০থেকেই ওঁদের অফিস খুলে যায়। আমি যে মঞ্চ দ্বারে গিয়েছি, সেখানে হয় অপেরা, যার রিহার্সাল শুরু বিকেলে ২টর থেকে রাত্রি ৮টা, তবে প্রয়োজনে আরো সময় দিয়েও মহড়া হয়। নতুন যে অপেরার প্রিমিয়ার এর অপেক্ষায় রয়েছে তার নাম, “Lady of the Black Night,”. উনি আমাকে একটা বুকলেট দিলেন, জার্মান ভাষায়, দুঃখের সঙ্গে জানালেন ইংরেজি তে কোনো কিছু নেই। ওর নির্দেশ মত উল্টো দিকে যেখানে থিয়েটার হয় সেখানে ঢুকে দেখি আমাদের রবীন্দ্রসদন এর থেকে সামান্য ছোট কিন্তু খুবই কোজি একটা মঞ্চ, সকাল সাড়ে এগারোটায় সেখানে চলছে লাইট শিফটিং এর কাজ, হলে শ চারেক দর্শক বসতে পারে, একটু ভালো V শেপের মত আসন গুলো সাজানো প্রয়োজনে সেগুলি শিফটিং ও করা যায়, ওখানে দূরেনমার্ট এর একটা নাটক হচ্ছে, জার্মান উচ্চারণে নামটা কি বলল, ঠিক বুঝতে পারলাম না। এরপর একটু উঁচুতে উঠে এলাম থিয়েটার ক্যাফে তে। সেখানে অবতলে প্রায় বাস্কেট বল খেলার মত একটা এম্পটি স্পেস (প্রবীর দেখলে কি খুশি হত ), তার চার পাশে ওপর থেকে অন্তত শতাধিক লাইট সৌর্স, দর্শকদের বসার জায়গা চারপাশে থাকলেও, উপর থেকে খাবার খেতে খেতে ও অভিনয় দেখা যায়। সেখানে তখন ছয় সাত জন বডি মুভমেন্ট এর রিহার্সাল করছে, আমি স তৃষ্ণ নয়নে আমার প্ৰিয় ছাত্র দেব কুমার পাল কে খুঁজলাম এমন জায়গায় তাঁরই তো থাকার কথা। ওখানকার দায়িত্বে থাকা এক মহিলা ও একজন প্রাকটিশনআর কে জিজ্ঞাসা করাতে ওঁরা আমাকে দুটো বিশাল বুক সেল্ফের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন, অন্তত শছয়েক বই আছে, আমি চিনতে পারলাম কাফকা, ক্যামু, সাত্রে, ব্রেক্ষট, বেকেট, ইবসেন, ও নীল, শেক্সপীয়ার এবং আরও কয়েকজনকে, কিন্তু হাতে নিয়ে দেখি তাঁরা এখানে জার্মান ভাষায় কথা বলছেন, আমি শ্রদ্ধা য় তাঁদের নামিয়ে রাখলাম হাত থেকে, তাঁদের যথাযত স্থানে। এরপর গেলাম পত্র পত্রিকার স্ট্যান্ডে, অসাধারণ সব নাট্যমুহূর্ত এর প্রচ্ছদ, কিন্তু সব জার্মান ভাষায়। মনে পড়লো, “water water every where, nor a drop to drink “. তাও বিনিপয়সায় দুটো বড় পুস্তিকা নিয়ে বেরোলাম (ছাদা বাঁধা বামুনের অভ্যাস তো )। দেখলাম বাসেল এবং বার্ন এ জার্মান ছাড়া সবই অচল, আর lausanne লসানে ফ্রেঞ্চ ই সম্বল। আংলে ওয়ালাদের বড়ই অসুবিধা। বাসেল থিয়েটার এর নিচের রাস্তায় নেমে, বাসেলের সব থেকে পুরোনো আইরিশ পাব, চার্ল ডিকেন্স এর উপন্যাসের নামে , Pickwick Irish pub এ বসে ফিশ এন্ড চিফ আর বার্গার খেলাম, আর বৌ এর সামান্য ভ্রূকুটি সহ অনুমোদনে বাসেল থিয়েটার এর সদস্য দের মত বিয়ার পান করলাম। একটা বিষয় বলার মত, বাসেল মিউনিসিপালিটি র অধীনে থাকা এই থিয়েটার টির আর্থিক দায় দায়িত্ব পুরোটাই সরকারের,(অনুপ্রেরণা এবং জয় শ্রীরাম এর নেপোথ্য কোনো দেখনদারী বাদ দিয়েই ), ফলে স্বাধীন স্বছন্দ ভাবে থিয়েটার এর কাজ তাঁদের মত নান্দনিক ভাবেই হতে পারছে।

ও আর একটা কথা বলতে ভুলে যাচ্ছিলাম, বাসেল থিয়েটার এর প্রাঙ্গনে আজ থেকে শুরু হলো ওঁদের ওখানকার মহিলা নাট্য জন দের নিয়ে একটি প্রদর্শনী র,১৮১৮সাল থেকে ২০২২অবধি নারী নাট্য জনদের কাজ কর্ম এর এক বর্ণাধ্য প্রদর্শনী। ছবি তুলে রেখেছি, সময় সুযোগ পেলে তা নিয়ে কিছু লেখা যাবে।