‘পেশির দৃঢ় ব্যথা, মুঠোর দৃঢ় কথা, চোখের দৃঢ় জ্বালা… ‘কবি শঙ্খ ঘোষের এই লাইন কটি ভীষণ মনে পড়ল চুঁচুড়া সারথি নাট্যদলের ‘গুলশন’ নাটকটি দেখার পর। বড় বুকে বাজে- বাজুক, কড়া নাড়ুক, তবু আমি আমার স্বত্ত্বায় থেকে অনড় থাকব, কারণ আমি মানুষ। আমার ধর্ম মানুষের পাশে থাকা, আমার ধর্ম মানবতার পাশে থাকা। আই পি টি এ গনসংগঠন দল (হুগলি শাখা) করা নাট্যকার শ্যামাকান্ত দাস গুলশন লিখতে বসে এই সম্প্রীতিরই ফুল ফোটাতে চেয়েছিলেন সমাজে, দুঃখের কথা এই যে আজো তা প্রাসঙ্গিক।
চরম একরোখা, জেদি, চূড়ান্ত মানসিক অবজ্ঞায় একেবারে জীবনের না পাওয়া যন্ত্রণা ও উন্নাসিকতা থেকে জীবনের এমন একটি সত্যানুসন্ধান ঘটিয়েছেন গুলশন নাট্যের মধ্য দিয়ে।
বরাবরই বঞ্চিত থাকেন লেখকেরা, আমরা জানতে চাইনা সেভাবে নাট্যকার কোন পরিস্থিতিতে ভাবেন- লেখেন, কেন লেখেন?
অমল আলো জার্নালে ‘কেমন দেখলাম’ বিভাগে সম্প্রতি অমল আলোতে গত ১৭ অক্টোবর ‘২১ এই নাটকের অভিনয় দেখতে বসে নাটকের কি গল্প, কে কে কেমন অভিনয় করেছেন এসব লিখতে চাইনি বরং আসুন নাট্যকার সমন্ধে দু-চার কথা আরো জেনেনি। নাট্যকার শ্যামাকান্ত দাসের জন্ম ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬, হুগলিতেই। এগারো বছরের বড় দাদা কমলাকান্ত দাস, বাবা সতীশচন্দ্র দাস। পড়াশোনা এম এ। দেশে জরুরি পরিস্থিতি। মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। (এর ছত্রছায়ায় ১৯৮৪ তে উত্তরপ্রদেশে জন্ম নেবে বজরং দল।) দিকে দিকে ধর্মীয় উন্মাদনার উন্মোচন। বিচ্ছিন্নতাবাদ বা আঞ্চলিকতাবাদ জনিত সমস্যা, বহিঃশত্রুর আক্রমণ ইত্যাদি বিভিন্ন সংকটপূর্ণ পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য সরকারের হাতে বিশেষ কিছু ক্ষমতা প্রদানের উদ্দেশ্যে জার্মানির সংবিধানের অনুসরণে আইন গৃহীত হয়েছে তখন ভারতীয় সংবিধানে। নাট্যকার এমনই এক বিছিন্ন সময়ের অমোঘ অভিঘাতে রচনা করলেন গুলশন ১৯৭৯ তে। নাটকটি প্রথম ছাপা হয় ‘গ্রুপ থিয়েটার ‘পত্রিকায় বার্ষিক শারদ সংখ্যায় ১৯৮১ সালে। প্রথম পূর্ণাঙ্গ রূপ নিয়ে ১৯৮২ তে এর মঞ্চায়ন করেন বৃশ্চিক নাট্য সংস্থা, বাঁশবেরিয়া হুগলি। ভূতনাথ চরিত্রে তাপস মুখোপাধ্যায়, নির্দেশক দীলিপ মুখোপাধ্যায়। এই নাটকটি আরো যারা করে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বরানগর লোকায়ত ১৯৮৫, বীরভূম আনন ১৯৮৬ তে অভিনয় করে। ১৯৮৫ তে চুঁচুড়া সারথি (দল প্রতিষ্ঠা ১১ নভেম্বর ১৯৮৪, কালীপুজোর দিন) এই নাটকটি একাংক হিসেবে তৈরি করে প্রথম মঞ্চস্থ করে ১০ অক্টোবর ১৯৮৫ সালে বৈঁচি বর্ধমানে, একটি একাংক নাটক প্রতিযোগিতার মঞ্চে। প্রথম মঞ্চায়নেই প্রথম স্থান অধিকার করে গুলশন। শ্রেষ্ঠ অভিনেতা সমীর সেনগুপ্ত। ১৯৯০ সালে গুলশন পাড়ি দেয় বাংলাদেশে, সাউথ এশিয়ান থিয়েটার ফেস্টিভ্যালে। পরে আরো অনেক দল নাটকটি মঞ্চে আনে। প্রতিযোগিতা মঞ্চে সকলের কাছে সারথির গুলশন আদর সমাদর সম্মান পায় সবচেয়ে বেশি ।
ইংরেজ দেশে আসার আগেই ধর্মীয় বিভাজনের শুরুয়াৎ। ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে বারংবার। ধর্মীয় বিভাজন নীতির বিরুদ্ধে মানবতার পুজারীরা লড়াই করেছে, সংগ্রাম করেছে সবসময় এবং জয় এসেছে প্রতিবারই। মানুষ ভরসা রেখেছে ভালোবাসায়, বিশ্বাসে, মনুষ্যত্বে।
১৯৮৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত সারথির ১৫২১ তম অভিনয় হয়েছে গুলশন নাটকের । আপাতত অন্তিম অভিনয় সম্পন্ন হলো অমল আলো উৎকর্ষ কেন্দ্রে। লায়লা চরিত্রে সীমা সেনগুপ্ত, ভূতনাথ চরিত্রে সমীর সেনগুপ্ত, বাড়িয়ালি চরিত্রে বিজলী পাত্র আজও একই ভাবে অভিনয় করে যাচ্ছেন শুরুর দিন থেকে । প্রথম দিকে সমীরবাবুর মেকআপ এত প্রয়োজন হতো না তবে এখনও ইব্রাহিম আলির হাতের স্পর্শে বয়স ধরা মুশকিল! আনকাট সম্পূর্ণ একাংক রূপ দিয়ে গুলশন নাটকটি দেখতে দেখতে কোথাও মনে হয়নি তেমন কোনো হাইফাই সেটের প্রয়োজন আছে। আবহ আজকের সময়ে দারুণ মানানসই। যে কোনো মঞ্চে সমাদৃত হয়েছে গুলশন। প্রসেনিয়াম সহ বিভিন্ন স্পেসেও দারুণ সাবলীল লেগেছে সকলের অভিনয়। এত ন্যাচারাল এবং পরতে পরতে ইম্পোভাইজেশন করে ভূতনাথ চরিত্র বাকি অভিনেতাদের সাথে মিলে মিশে অভিনয় করে যা এককথায় অবিশ্বাস্য। এই নাটকের জনপ্রিয়তার নিরিখে আরো বহুবছর চলবে আশা রাখছি। সুচতুর তীক্ষ্ণ সীমা সেনগুপ্তর হিন্দি এবং ইংরেজি উচ্চারণে সংলাপ এবং চরিত্রকে আত্মস্থ করবার মুন্সীয়ানা অসাধারণ লেগেছে। সাথে ৬১ বছরের যুবক (জন্ম- ১২ অগাস্ট ১৯৫৯) সমীর সেনগুপ্ত ততটাই প্রানোজ্জ্বল অভিনয় করে উপস্থিত দর্শকের ভালোবাসা পেয়েছেন। বাড়িয়ালি বিজলীকে কখনোই মনে হয়নি কোনো বাড়াবাড়ি করেছে বরং প্রয়োজন মিটিয়ে সুকৌশলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অভিনয় করেছেন। ওনার সামনের দুটি দাঁত বয়সের জন্য পড়ে গিয়ে চরিত্রকে আরো বিশ্বস্ত করে তুলেছে। সমীর সেনগুপ্তর সংলাপ বলবার ধরন, টাইমিং, কমিক সেন্সে দর্শক হেসে লুটোপুটি খেয়েছে। সঙ্গে সরিৎ ভট্টাচার্য, অভিজিৎ সেন, প্রশান্ত মাল, প্রমিত বিশ্বাস এবং বিশ্বজিৎ যথোপযুক্ত প্রয়োজন মিটিয়েছেন চরিত্রের।
এখন দেখার গুলশন কতদূর যেতে পারে সমীর সেনগুপ্তর হাত ধরে। কারণ পরবর্তী জেনারেশন কেউ সাহস করে এসে অভিনয় করতে চাইছে না এই আক্ষেপ থাকলেও সারথির গুলশন ২০০০ রজনী অতিক্রম করুক এইটুকুই চাই। ভালোবাসা দীর্ঘজীবি হোক।
১৫৩১ রাতের পরেও এমন তরতাজা নাট্য খুব কম দেখা যায়। বিশেষত সমীর সেনগুপ্তের অভিনয়কে আমরা যত্ন করে সংরক্ষণ করতে পারি।