There is a violence in me, but I don’t walk around looking for trouble.’ – Harold Pinter. বুকভরা তীব্র প্রত্যয় নিয়ে ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যমের সামনে অকপটে এ কথা যিনি উচ্চারণ করতে পারেন, তিনি হ্যারল্ড পিন্টার, যাঁকে বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যব্যক্তিত্ব অভিধায় ভূষিত করলেও অত্যুক্তি হবে না। সারা পৃথিবীবাসীর কাছে তিনি একজন নোবেলজয়ী নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা এবং কবি। এককথায়, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এবং যুদ্ধ-পরবর্তীকালীন ব্রিটিশ থিয়েটারের উজ্জীবনের অন্যতম প্রধান কাণ্ডারী ছিলেন হ্যারল্ড পিন্টার। মানুষের দৈনন্দিন যাপনের মধ্যে নিহিত থাকা ত্রাসজনিত নৈঃশব্দের মধ্যেই জাগতিক কোলাহলের উৎসকে খুঁজে পাওয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টাই তাঁকে তাঁর প্রজন্মের অন্যতম একজন শক্তিশালী নাট্যকাররূপে চিহ্নিত করেছে।
১৯৩০ সাল। সময়টা তখন সত্যিই বড় অস্থির। ঠিক একবছর আগেই ১৯২৯ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রীটে শতাব্দীর বৃহত্তম ধ্বস নেমেছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সুতীব্র অভিঘাতে দারিদ্র্য এবং বেকারত্বের ধাক্কায় ধুঁকছে সারা বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের অর্থনীতি। ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশে মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে বেশ কিছু স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী। বিশেষত, অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানীতে নাৎসী বাহিনীর উত্থান শুরু হয়েছে। ভার্সাই সন্ধির ক্ষতচিহ্ন বুকে নিয়ে ফুঁসছে জার্মানী। লোকের মুখে মুখে ফিরছে থার্ড রাইখের নাম। অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলি যথা ইথিওপিয়া, চায়না এবং পোল্যান্ড বারবার সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। চীনের স্বৈরাচারী কুয়ো-মিন তাং সরকারের বিরুদ্ধে মাও জে দং-এর নেতৃত্বাধীন কম্যুনিস্ট পার্টির বিরোধ ক্রমশ প্রকাশ্যে এসেছে। সারা বিশ্ব কুখ্যাত ‘লং মার্চ’-এর সংবাদ পেয়ে গেছে।
এত কিছুর মধ্যেও বিশ্ব জুড়ে শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নতুন নতুন দিশা দেখাচ্ছেন প্রতিভাধর শিল্পী-সাহিত্যিক এবং বিজ্ঞানীর দল। ১৯৩০-এর মার্চ মাসে আমেরিকার স্প্রিংফিল্ড-এ বিশ্বের প্রথম হিমায়িত খাদ্যদ্রব্য (Frozen Food) বিক্রি হয়েছে। ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’-এর ডামাডোলের মধ্যেও প্যারিস ও অন্যত্র জায়গায় স্যুরিয়ালিজম, লেট কিউবিজম, সিম্বলিস্ট প্রভৃত ভাবনাসমৃদ্ধ আধুনিক চিত্রের বিকাশ ঘটছে। শতাব্দীর সর্বোচ্চ অট্টালিকা হিসাবে আর কয়েকমাস পরেই চিহ্নিত হতে চলেছে আমেরিকার এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং। ওয়ার্নার ব্রাদার্স-এর উদ্যোগে বিশ্বের প্রথম পূর্ণ-স্ববাক ও পূর্ণ রঙীন ছায়াছবি “Song of the Flame’ মুক্তি পেতে চলেছে। ঠিক এইরকম একটি যুগসন্ধিকালে ১৯৩০ সালের ১০ অক্টোবর ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের ইস্ট লণ্ডনের হ্যাকনি শহরে, অত্যন্ত সম্মানীয় অথচ একেবারেই নিম্ন-মধ্যবিত্ত, এক ইহুদী দর্জি পরিবারে হ্যারল্ড পিন্টারের জন্ম।
ভারতের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির ছবিটা উল্লেখ করলে পিন্টারের জন্মলগ্নের ধরতাইটুকু পেতে কিছু সুবিধা হয়। ব্রিটিশশাসিত ভারতে তখন ইংরেজবিরোধী প্রচার ও আন্দোলন দিনে দিনে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে। লন্ডনে প্রথম গোলটেবিল বৈঠকের প্রস্তুতি চলছে। জহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে ডিসেম্বর, ১৯২৯ থেকে পূর্ণ স্বরাজের দাবী জোরদার হয়ে উঠেছে। সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। মাত্র ছ’মাস আগেই মাস্টারদা সূর্য সেন, গণেশ ঘোষ এবং লোকনাথ বাউলের নেতৃত্বে ৪৫ জন সশস্ত্র বিপ্লবীর একটি দল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করেছে। তাঁদের উদ্যোগে বহুকাল যাবৎ ব্রিটিশ অধীনে থাকা জালালাবাদ পাহাড়ের দখল নিয়ে সেখানে স্বাধীন ভারত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পিন্টারের জন্মের মাত্র সাত মাস আগে ১৯৩০ সালের মার্চ মাসে গান্ধীজীর নেতৃত্বে গুজরাটের সবরমতী আশ্রম থেকে ডান্ডি পর্যন্ত ২৬ দিনের অভিযান চালিয়ে ‘লবণ সত্যাগ্রহ’ পালন করা হয়েছে। সারা দেশব্যাপী বিদেশী দ্রব্য বয়কটের মাধ্যমে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছে। এই অবস্থায় সুভাষ চন্দ্র বসু সদ্য সদ্য কলকাতার মেয়র পদে অভিষিক্ত হয়েছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই ৯ বছরের বালক পিন্টারকে কর্নওয়ালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বিশ্বযুদ্ধের শেষে, ১৪ বছর বয়সে, পিন্টার পুনরায় লন্ডনে ফিরে আসেন এবং স্থানীয় গ্রামার স্কুলে ভর্তি হন। সেখানের পাট চুকিয়ে ভর্তি হলেন লন্ডন অ্যাকাডেমী অফ ড্রামাটিক আর্ট-এ। কিন্তু শিক্ষাপদ্ধতি পছন্দ না হওয়ায় মাত্র দু’বছর বাদেই সে প্রতিষ্ঠান ছেড়ে ভর্তি হন সেন্ট্রাল স্কুল অফ স্পীচ অ্যান্ড ড্রামায়। এখানেও খুব অল্প সময়ের জন্য পড়াশোনা করেন পিন্টার। ১৯৫০ থেকে ১৯৫২ এই দু’বছর পিন্টার লন্ডনের শেক্সপীয়ার ট্রুপ-এর সঙ্গে আয়ারল্যান্ডে ঘুরে ঘুরে অভিনয় করেছিলেন। – পরবর্তীকালে, ডেভিড ব্যারন ছদ্মনামে প্রভিন্সিয়াল রেপার্টরি থিয়েটারেও প্রায় চার বছর অভিনয় করেছিলেন তিনি। এই সময়কালে বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনেতা বা নির্দেশক হিসেবে কাজ করলেও নাট্যকার হওয়ার কথা ভাবেন নি তখনো। নাট্যকাররূপে তাঁর উত্থান আরও পরে ১৯৫৭ সালে। প্রথম রচিত নাটক ‘দ্য রুম’। ১৯৫৭ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে তিরিশটিরও বেশি নাটক লিখেছেন হ্যারল্ড পিন্টার। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘দ্য বার্থডে পার্টি’ (১৯৫৮), ‘দ্য ডাম্ব ওয়েটার’ এবং ‘দ্য কেয়ারটেকার’ (১৯৬০), ‘দ্য হোমকামিং’ (১৯৬৫), ‘সাইলেন্স’ (১৯৬৯), ‘ওল্ড টাইম্স’ (১৯৭১), ‘নো ম্যানস্ ল্যান্ড’ (১৯৭৫), ‘বিট্রেয়াল’ (১৯৭৮), ‘ওয়ান ফর দ্য রোড’ (১৯৮৪), ‘মাউন্টেন ল্যাঙ্গোয়েজ’ (১৯৮৮), ‘মুনলাইট’ (১৯৯৩), “অ্যাশেজ টু অ্যাশেজ’ (১৯৯৬), ‘সেলিব্রেশন’ (২০০০) প্রভৃতি। লিখেছেন বেশ ছায়াছবির চিত্রনাট্য যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘গো বিটুইন’ (১৯৬৯), ‘দ্য ফ্রেঞ্চ লেফটেন্যান্টস্ ওম্যান’ (১৯৮২) এবং ‘দ্য কমফর্ট অফ স্ট্রেঞ্জারস্’ (১৯৮৩)। এছাড়াও ‘আ নাইট আউট’ (১৯৫৯), নাইট স্কুল’ (১৯৬০), টী পার্টি’ (১৯৬৫) এবং ‘দ্য বেসমেন্ট’ (১৯৬৭) এর মত কিছু টেলিনাটকও লিখেছেন তিনি। নিজের লেখা নাটক ছাড়াও রবার্ট শ’-র ‘দ্য ম্যান ইন দ্য গ্লাস বুথ (১৯৬৭), জেমস জয়েস-এর ‘এক্সাইলস্ (১৯৭০), সাইমন গ্রে-র ‘বাটুলি’ (১৯৭১)সহ প্রায় সবকটি নাটক ছাড়াও ‘এনগেজড়’ (১৯৭৫), ‘দ্য রিয়ার কলাম’ (১৯৭৮), ‘ক্লোজ অফ প্লে’ (১৯৭৯), ‘কোয়ার্টারমাইন্স টার্মস’ (১৯৮১) এবং আরও বহু নাটকের নির্দেশনার দায়িত্ব পালন করেছিলেন পিন্টার।
১৯৫৬ সালে পিন্টার বিয়ে করেন অভিনেত্রী ভিভিয়ান মার্চেন্টকে। সেই বৈবাহিকজীবন স্থায়ী হয়েছিল ২৪ বছর। পরবর্তীকালে, ১৯৭৫ সালে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ নাটকটি চলাকালীন পিন্টার লেডি অ্যান্টোনিয়া ফ্রেশার নামের একজন জীবনীকার তথা ইতিহাসবিদের প্রেমে পড়েন। অ্যান্টোনিয়া তখন ছিলেন হাগ ফ্রেশার নামের রাজনীতিবিদের স্ত্রী। ১৯৮০ সালে পিন্টার অ্যান্টোনিয়াকে বিয়ে করেন। ২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে, রুটিন মেডিক্যাল চেক-আপ করার সময় তাঁর গ্রাসনালীতে ক্যানসার ধরা পড়ে। ২০০২-এর জানুয়ারি মাসে, চিকিৎসা চলাকালীন অবস্থাতেও পিন্টার ছোট একটি কমিক স্কেচ ‘প্রেস কনফারেন্স’-এ অভিনয় করেছিলেন। অবশেষে, ২০০৬ সালে তিনি পুরোদমে অভিনেতারূপে মঞ্চে ফিরে আসেন স্যামুয়েল বেকেট-এর একক নাটক ‘ক্র্যাপ’স লাস্ট টেপ’-এ। ২০০৫ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেনহ্যারল্ড পিন্টার। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তখন তিনি রীতিমত অসুস্থ। নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে স্টকহোমে সুইডিশ অ্যাকাডেমির সমীপে উপস্থিত থাকতে পারেন নি। কিন্তু হুইলচেয়ারে বসেই পুরস্কারের প্রাপ্তিস্বীকার করে বক্তব্য রেখেছিলেন। তাঁর বক্তব্যের ভিডিওটি রেকর্ড করে পুরস্কার প্রদান মঞ্চে দেখানো হয়েছিল। ২০০৮ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর, ৭৮ বছর বয়সে পিন্টারের মৃত্যু হয়।
পিন্টার জন্মেছিলেন যুদ্ধের পরিমন্ডলে। এক অস্থির সময়ের পটভূমিতে। যুদ্ধের ভয়াবহতা, অর্থনৈতিক মন্দার কুফল আর ইউরোপীয় দেশগুলির উপনিবেশ দখলের লড়াই তাঁকে শৈশব থেকেই তাড়া করে বেড়িয়েছে। জন্মলগ্ন থেকেই যিনি দেখছেন যে, সারা বিশ্ব যেন এক ফুটন্ত কড়াইয়ের ওপর বসে আছে, স্বাভাবিকভাবে সেই মানুষটির নাট্যভাবনা বা সৃজনশীলতায় বারবার এই অস্থিরতার প্রভাব পড়বেই। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে, নাট্যকার হিসেবে কতকটা স্যামুয়েল বেকেটের মতই, পিন্টারও সমসাময়িক সামাজিক অবক্ষয়, স্থানীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাগুলিকে তাঁর নাটকের উপজীব্য করে তুলেছিলেন। কিন্তু আশির দশকে উপনীত হয়ে তিনি নিজেই বামপন্থী রাজনীতির আদর্শের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন এবং তৎকালীন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব, স্বেচ্ছাচারিতা ও যুদ্ধবিরোধী মানসিকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। তাঁর এই সময়ের রচনাগুলিতে একাধিকবার শ্রমজীবী মানুষের যন্ত্রণা ও সংগ্রামের ইতিবৃত্ত প্রতিফলিত হয়েছে। হয়তো সেইকারণেই শতাব্দীর আরও এক অন্যতম সেরা নাট্যব্যক্তিত্ব, পিন্টারের ফ্রেন্ড, ফিলজফার অ্যান্ড গাইড, নোবেলজয়ী নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেট-এর সঙ্গে প্রায় একই সারিতে উচ্চারিত হয় হ্যারল্ড পিন্টারের নাম।
ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যমের কাছে পিন্টার বরাবরই ছিলেন বদ-মেজাজী, একরোখা ব্যক্তিত্ব। তাঁর নাটক বারবার নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে। কিন্তু তা নিয়ে পিন্টারের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না। একথা সত্যি যে, পিন্টার ছিলেন স্পষ্টবক্তা। কবি, অভিনেতা, নির্দেশক, প্রবন্ধকার, নাট্যকার বা চিত্রনাট্যকার যে ভূমিকাতেই থাকুন না কেন, ঘরে-বাইরে খোলাখুলিভাবে তিনি সরকারের দমন-পীড়ন নীতি বা সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে বহুবার জনসমক্ষে সরব হয়েছেন। সমসাময়িক নাট্যনির্দেশক এবং চিত্রপরিচালকেরা তাঁর এই চরিত্রের সঙ্গে বিলক্ষণ পরিচিত ছিলেন। পিন্টারের সত্তরতম জন্মদিবস উপলক্ষ্যে একটি বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানে এসে পরিচালক রিচার্ড এইর বলেছিলেন, ‘He was sometimes pugnacious and occasionally splenetic but just as often droll and generous particularly to – actors, directors and a rare quality this other writers’ আমেরিকার ইরাক-নীতি নিয়ে তিনি স্পষ্টভাষায় বলেছেন, “The United States had not only lied to justify waging war against Iraq, but that it had also supported and in many cases endangered every right-wing military dictatorship.” পিন্টারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর অধিকাংশ রচনাতেই স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে। যদিও তাঁর অনেক রচনারই মূল উপজীব্য ছিল মানবচরিত্রের রহস্য উন্মোচন, ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের কথাও বারবার উঠে এসেছে তাঁর লেখায়।
পিন্টারের নাট্যভাষা ছিল সহজ-সরল, কখনো বা যৌনতাময়। কিন্তু অন্ধকার জগতের কথা বলতে গিয়েও আলোর ঝলকের মত তাঁর সংলাপে উঠে এসেছে মজাদার ছড়ার মত পংক্তি যা তাঁকে আর পাঁচজন নাট্যকারের থেকে স্বতন্ত্র করে রেখেছিল। তাঁর রচনাশৈলীর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য বা লিটারারি ম্যানারিজম্’ ছিল সংলাপের মধ্যে বুনে দেওয়া এক অনন্য অন্তঃপ্রবাহী স্তব্ধতা। বস্তুত, পিন্টারের নাটকে স্তব্ধতার প্রকাশ ঘটেছে তিনটি ভিন্ন আকারে। কোন একটি চরিত্রের মনোভাব ও আচরণের আমূল পরিবর্তনকে চিহ্নিত করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে দীর্ঘতম স্তব্ধতা যা পাঠ্যাংশে চিহ্নিত হয়েছে ‘Silence’ হিসাবে। নাট্যক্রিয়ায় কোন বিশেষ সঙ্কটকে বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে মাঝারিমাপের স্তব্ধতা যা তিনি সূচিত করেছেন ‘Pause’ রূপে এবং সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত স্তব্ধতাকে তিনি বুঝিয়েছেন তিনটি ডট চিহ্নের (‘…’) মাধ্যমে। এই স্তব্ধতার চিত্রকল্প এতটাই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল যে, ইংরাজি ভাষার ভাণ্ডারে ‘Pinteresque’ নামে একটি নতুন পরিভাষার জন্ম হয়। শব্দটির অর্থ কোন অজানা ত্রাসের ইঙ্গিতবাহী বেমানান নিস্তব্ধতা। অক্সফোর্ড ডিকশনারিতেও লেখা হল ‘His characters are often ordinary, unimportant people who find it – difficult to communicate properly with each other, and his plays combine humour with an atmosphere of danger and unhappiness. The word Pinteresque is sometimes used to describe these qualities’. পিন্টার নিজে অবশ্য এই নৈঃশব্দের প্রয়োগ সম্পর্কে, হয়তো কিছুটা মজা করেই বলেছেন, ‘Those silences have achieved such significance that they have overwhelmed the bloody plays which I find a bloody pain in the arse’.
পিন্টারের নাটকে যবনিকার উত্তোলন ঘটত সাদামাটা বাস্তব ও ঘরোয়া জীবনের কোন ঘটনাকে উপজীব্য করে। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সেই ছোট্ট ঘটনার মধ্যে নিহিত থাকা নিষ্ঠুর সত্যের প্রকাশ ঘটত বড় আচম্বিতে। ধারালো সংলাপের সুতীব্র আঘাতে দর্শকমন কখন যেন ক্ষতবিক্ষত হতে শুরু করত। সাধারণ দর্শক থেকে শুরু করে বিদগ্ধ সমালোচকের ভাবনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলত তাঁর সংলাপ। পিন্টার নিজে সচরাচর তাঁর নিজের নাটকের অন্তর্নিহিত অর্থের ব্যাখা দেওয়া পছন্দ করতেন না। তবে কোন এক দুর্লভ মুহূর্তে পিন্টার একবার বলে ফেলেছিলেন, ‘A character on stage who can present no convincing argument or information as to his past experience, his present behavior or his aspirations, nor give a comprehensive analysis of his motives, is as legitimate and as worthy of attention as one who, alarmingly, can do all these things’.
শৈশব থেকেই একজন একনিষ্ঠ পাঠক হিসেবে পরিচিত ছিলেন পিন্টার। সেই বয়সেই পড়ে ফেলেছিলেন ডস্টয়েভস্কি, কাফকা, এলিয়ট, লরেন্স, উফ এবং হেমিংওয়ে। তাঁর বন্ধুভাগ্য ছিল রীতিমত ঈর্ষণীয়। হেনরী উলফ, মিক্ গোল্ডস্টেইন প্রমুখ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাঁর আজীবন বন্ধুত্ব ছিল। PEN, Amnesty International প্রভৃতি লেখকগোষ্ঠীর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন এবং সেই সুবাদে ১৯৮৮ সালে তিনি এবং তাঁর অ্যান্টোনিয়া The 20 June Group নামে বামপন্থী চিন্তাধারার বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী গঠন করেন যেখানে জন মর্টিমার, মেলভিন ব্র্যাগ, মার্গারেট ড্যাবল এবং সলমন রুশদির মত ব্যক্তিত্বরা যুক্ত ছিলেন। এক বস্তুত, হেনরি উল্ফের অনুরোধেই জীবনের প্রথম নাট্যরচনায় হাত দেন তিনি। বিমূর্তভাবনায় সমৃদ্ধ নাট্যনির্মাণের ক্ষেত্রে পিন্টারের নাম বেকেট ও আয়োনেস্কোর সঙ্গে একসারিতে উচ্চারিত হলেও পিন্টার মূখ্যত ছিলেন রাজনৈতিক নাটককার। অবশ্য সৃজনশীলতার ঝোঁকে পরবর্তীকালে রাজনৈতিক নাটক ছাড়াও ‘মুনলাইট’ বা ‘সেলিব্রেশন’-এর মত অরাজনৈতিক নাটকও লিখেছেন।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে আজীবন সরব ছিলেন পিন্টার। ২০০৫ সালে, অসুস্থ অবস্থায় হুইলচেয়ারে বসে হাঁটু পর্যন্ত কম্বলে ঢেকে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিস্বীকার বক্তৃতা দেওয়ার সময়েও তদানীন্তন আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিকে সরাসরি আক্রমণ করেছিলেন এই ভাষায় ‘The United States supported and in many cases engendered every rightwing military dictatorship in the world after the end of the second world war, শুধু এটুকু বলেই ক্ষান্ত হননি, ভুরি ভুরি উদাহরণ দিয়ে তাঁর বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
থিয়েটার বিশ্বকে নতুন নাট্যভাষা প্রদান করেছেন হ্যারল্ড পিন্টার। যুদ্ধোত্তরকালে তাঁর দেখানো পথেই হেঁটেছে ব্রিটিশ থিয়েটার। ব্রিটিশ মিডিয়ার কাছে বারবার বিতর্কিত হয়েও নিজের ইডিওলজির পথ থেকে বিচ্যুত হন নি কখনো। সমকালীন থিয়েটারে তাঁর কাজের পুনর্মূল্যায়ন কিছুটা হলেও এখনো অনেক কিছু বাকি আছে। বাংলার থিয়েটারেও তার নাট্যভাবনা নিয়ে কাজ করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। আশা রাখি, আজকের প্রজন্ম হ্যারল্ড পিন্টারকে নিয়ে আরও বেশি করে ভাববে। তাঁর দেখানো পথেই হয়তো উন্মোচিত হবে থিয়েটারের নতুন দিগন্ত।