মিনার্ভা নাট্য সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্রে আমি তখন সর্বসময়ের অস্থায়ী নাট্যকর্মী হিসেবে চাকুরিরত। কঠিন নিয়ম সরকারি তরফে। আমরা যারা সর্বসময়ের জন্য নির্বাচিত হয়েছি তারা বাইরে মানে মিনার্ভা ছাড়া বাইরে নাটকের কোনো কাজ— ওই নির্দেশনা, অভিনয় ইত্যাদি করতে পারবো না। আমার নিজের দল যাদবপুর মন্থনেও ততদিনে আমি পদত্যাগ পত্র জমা দিয়ে দিয়েছিলাম। যদিও থিয়েটারেরই এক দিদি আমায় বলেছিলেন এত ফর্মালিটির কি দরকার, কে দেখতে যাচ্ছে। তুই তো আর শো করছিস না। কিন্তু চিরকাল থিয়েটারে সৎ থাকার ব্রত নিয়ে আমি তখন ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা করে বসে আছি অথচ একটা বিষয় সব সময় আমাকে কুড়ে খেত— আমি মিনার্ভার সময় ছাড়া বাড়িতে কবিতা পড়তে ও লিখতে পারি, গান গাইতে পারি বা সংস্কৃতি চর্চার যাবতীয় যাকিছু করতে পারি কিন্তু নাটকটা করলেই বাঁধা কেন? অন্যদের কথা জানিনা কিন্তু আমার দলে তো আমি কাজ করতে পারি, না কি? এসব দিনেই খবর এল মিনার্ভা থেকে নিয়ম কিছুটা শিথিল করা হয়েছে। ব্রাত্য দা (ব্রাত্য বসু) আমাদের বাইরে কাজ করার পারমিশন দিলেন। এই মানুষটি চিরকাল-ই থিয়েটারের ভালোর জন্য নতুন ছেলে মেয়েদের উৎসাহিত করার জন্য, চেষ্টা করে গেছেন। আজও তা করে চলেছেন। কাজেই এই ঘোষণা আমাদের পালে বাতাস দিল।
এর আগেই একদিন মিনার্ভায় থাকা কালিন বন্ধু সুমন্ত আমাকে একটি নাটক শোনাতে চায়। একটি উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছে। খুবই উৎসাহে শোনার আগ্ৰহ প্রকাশ করি কারণ উপন্যাসের নাম “আগুন পাখি”। তার পর সম্পূর্ণ নাটক শোনার পর আমাদের নানা কথোপকথন চলতে থাকে এই নাট্যরূপের মঞ্চায়ন নিয়ে। কারণ সুমন্ত এর আগে কয়েকজনের কাছে এই নাটক পাঠ করে শোনায় কিন্তু সকলে উৎসাহ দিলেও এর মঞ্চায়ন আর হয় না। সুমন্ত নিজেও মিনার্ভায় থাকায় এই নাটকের আশু মঞ্চায়ন যে হবে না সেই বিষয়ে নিশ্চিত থাকে কিন্তু যে দিনই এই ঘোষণা হয় যে আমরা বাইরে কাজ করতে পারব আমি সবার আগে সুমন্ত কে প্রস্তাব দি “আগুন পাখি” নাটকটি যাদবপুর মন্থন নাট্যদল প্রযোজনা করতে চায় যদি সে নিজে নির্দেশক হিসেবে এই নাটকটি করতে রাজি থাকে। সুমন্তও কোনো ভাবনার অবকাশ না রেখে সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে যায়।
হাসান আজিজুল হকের কথা বলতে গেলে আমার পক্ষে এই মুখবন্ধটুকু না করলে তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়া, আলাপ হওয়া এবং আত্মীয়তা লাভের প্রেক্ষাপটটাই আমি বোঝাতে পারতাম না।
প্রাচীরের ছিদ্রে নামগোত্রহীন থিয়েটারের এই অতিশয় দীনকে কোন এক লহমায় তিনি কাছে টেনে নিলেন তা আমার কাছে আজও রহস্যময়।
সুমন্তর সঙ্গে যখন পাকা কথা হয়ে গেল যে যাদবপুর মন্থন আগুনপাখির নাট্যরূপ প্রযোজিত করবে তখন খুব স্বাভাবিক ভাবেই লেখকের অনুমতির জন্য আমারা কীভাবে যোগাযোগ করব সেই নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। তখন সুমন্ত সুশীল সাহা নামের একজনের ফোন নম্বর দিয়ে আমায় যোগাযোগ করতে বলল। সুশীল দা এই বঙ্গে আজিজুল সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগের আমাদের জানা তখন পর্যন্ত একমাত্র সেতু। একদিন উনি এলেন আমার বাড়িতে। বিস্তারিত জানালাম সব।উনি তো উৎফুল্ল। আমার থেকে দু’দিন সময় চেয়ে নিলেন। ঠিক দু’দিনের মাথায় সুশীল দার ফোন। ওপার থেকে বিনীত কন্ঠে বললেন “রাজিব আজিজুল দা রাজি”। “আমি বললাম তাহলে এবার?”। সুশীল দা “শুরু করে দাও”। “না মানে টাকা পয়সা, লিখিত পারমিশন?”। সুশীল দা,”আগুনপাখি যদি অভিনয় হয় তো তা লেখকের পারমিশন ছাড়া হতে পারে না। দুই বঙ্গের কেউ তাঁর পারমিশন ছাড়া এই কাজে হাত দেবে না। তোমরা যখন কাজটা করছো তখন সবাই জানবে যে এতে ওনার অনুমতি আছে”। দৃঢ় কন্ঠস্বর সুশীল দার। অতএব ছাড়পত্র এসে গেছে। শুরু হলো মহা যজ্ঞ। আগুনপাখি তৈরির ইতিহাস আজ এখানে নয় তা নিয়ে কখনো সুযোগ হলে অন্যত্র বলবো।
আগুনপাখির শো হয়ে গেছে। সুশীল দা সহ এই বঙ্গের বহু মানুষের হৃদয় তা স্পর্শ করেছে। তবু মনের মধ্যে কেমন একটা খচ খচ করছে। সুশীল দার সঙ্গে প্রায় প্রত্যহ কথা হয়। একদিন বলেই ফেললাম সাহস করে যে লেখককে দেখাতে চাই এই প্রযোজনা। কী করে সম্ভব, ইত্যাদি আলোচনা। বাংলাদেশে গিয়ে এত লোকজন নিয়ে যদি ওই দেশের কেউ আমন্ত্রণ না জানায় তাহলে আমাদের পক্ষে তা সম্ভব নয়। হঠাৎ সুশীল দা একদিন জানালেন যে আজিজুল সাহেব এই দেশে আসছেন। তার পর আরো কত কি বলে গেলেন কিছুই কানে ঢুকলো না। প্রায় অভদ্রর মতো বললাম সুশীল দা আপনি ডেট বলুন আমি সেদিনই একটা শো এর বন্দবস্ত করবো। লেখককে দেখাতে চাই আর দেখতে চাই আগুনপাখি, সাবিত্রী উপাখ্যান— এর নায়ক কে। আমার স্বপ্নের পুরুষ কে।
অতএব এল সেই নির্দিষ্ট দিন। সুশীল দা একদিন আগে লেখকের সঙ্গে আমাদের দেখা করার একটা ব্যাবস্থা করলেন। নির্দিষ্ট সময়ে আমি আর সুমন্ত গেলাম তাঁর সঙ্গে কথা বলতে। শেকসপিয়ার সরনীর কোনো এক গেস্ট হাউসে (এখন নাম মনে নেই) সুশীল দা আলাপ করালেন লেখকের সঙ্গে। শুরু হলো কথোপকথন।
বোকার মতো প্রথমেই বলে ফেললাম আচ্ছা আপনি তো অনুমতি দিয়েছেন শো টাও আমরা করে ফেলেছি। কিন্তু টাকা পয়সার কথা তো কিছু বললেন না। শুনেই এমন হাসি মাখা মুখ তুলে ধরলেন আমি জীবনে অমন সরল মুখ খুব কম দেখেছি। কেমন ভেবলে গেলাম। বললেন ছোটো ছোটো ছেলেরা সব বলে কি! তোমরা কাজ করছো আমি খুব খুশি হয়েছি। আমি তো দেখতে যাব— এত সহজ সরল মানুষও হয়? আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। সুমন্তর সঙ্গে নাট্যরূপ নিয়ে উনি বলে চলেছেন ওনার ভাবনা চিন্তার কথা। আর আমি ভাবছি সাবিত্রী উপাখ্যান— এর লেখক আগুনপাখির লেখক আমার সামনে বসে আছেন।
নাটকটি নিয়ে উনি পুঙ্খানুপুঙ্খ সব কথা বললেন আমাদের সঙ্গে। ওনার বর্ধমান থেকে রাজশাহী-এক দীর্ঘ জার্নি আমাদের সামনে তুলে ধরলেন। কথা ছিল এক ঘন্টা কথা হবে শেষ হল আড়াই ঘণ্টাতে। এই সমস্ত কথোপকথন তুলে রেখেছিলাম মোবাইল রেকর্ডারে। কিন্তু নিজেদের আলস্যের কারণে তা আর সংরক্ষণ করা হয়নি। একদিন হঠাৎ মোবাইল খারাপ হয়ে যাওয়ায় সেই অমূল্য সম্পদ সব নষ্ট হয়ে যায়। রয়েছে কিছু ছবি যা এই লেখার সঙ্গে দিলাম। এই একদিনের বাক্যালাপেই মনে হয়েছিল উনি আমার বহুদিনের পরিচিত। এটা সম্ভব হয়েছিল একান্ত ওনার আন্তরিকতায়।
এরপর আগুনপাখি শো- এর দিন উনি এলেন। দেখলেন আমাদের প্রযোজনা। মঞ্চে এলেন শো-এর শেষে। আশীর্বাদ করলেন কলাকুশলীদের সহ আমাদের সকলকে। জানালেন উনি তৃপ্ত। ব্যাস— সমগ্ৰ পৃথিবী যেন তখন আমাদের হয়ে গেল। যাবার সময় ওনার পাওয়া উপহার থেকে একটি বই আমাকে দিয়ে গেলেন। বললেন ভালো পাঠক হয়ে ওঠো। উনি ফিরে গেলেন ধীরে ধীরে— মঞ্চ অন্ধকার হয়ে গেল।
আগুনের পাখি আজ ফিরে গেছে তার নিজস্ব বাস ভবনে। রেখে গেছেন বাংলা ভাষার অমূল্য সব সাহিত্য সম্পদ। যা আপামর বাংলাভাষীর হৃদয়ের ঐশ্বর্য হয়ে থেকে যাবে যতদিন পৃথিবীতে বাংলা ভাষা থাকবে। শুধু আমার কেন যেন এতদূরে বসেও মনে হয় এক আত্মীয় বিয়োগ হলো— যিনি একলহমায় এই আত্মীয়তা স্থাপন করে দিয়েছিলেন। এই লেখায় বার বার তাঁকে ‘সাহেব’ বলে সম্বোধন করেছি। তাঁকে স্যার বা দাদা বা অন্য কিছু বলেও ডাকতে পারতাম। কিন্তু কেন জানিনা ওই দু’দিন বা তার পরেও যে দু-একবার কথা হয়েছে তাকে কোনো নামেই ডাকতে পারিনি। ভাববাক্যে সম্বোধন করেছি। আজ বুঝতে পারি তাকে কোনো নামের খাপেই ঢোকানো যায় না। কারণ ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ যার হৃদয়ের মন্ত্র তিনি হাসান আজিজুল হক হয়েই আমাদের কাছে থেকে যাবেন।
দারুণ লেখা। অনবদ্য স্মরণ।