হিমি শর্মার জীবনে থিয়েটার হল লড়াই এর ময়দান | পর্ব -৩০

বিজয়কুমার দাস 

প্রতিবেশী ত্রিপুরা রাজ্যের মেয়ে হিমি শর্মা এখন পশ্চিমবঙ্গে বাংলা থিয়েটারের ময়দানে লড়াই চালাচ্ছে। ত্রিপুরার আমবাসায় “রূপায়ণ ” নামে একটি নাট্যদলে সেই শৈশবকালে তার প্রথম হাতেখড়ি থিয়েটারে। সে তো নিছক একটা কাকতালীয় ব্যাপার ছিল। বয়স তখন ৮ – ৯ এর চৌকাঠে। সালটা ১৯৯৭, নাটকের নাম ‘দীপ নিভে যায়’। ছোটকাকা শশিভূষণ শর্মা একটা নাটকের শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয়ের জন্য নিয়ে গিয়েছিল হিমির দাদাকে। দাদার সঙ্গে ছোট্ট হিমিও সেখানে গিয়েছিল। দাদার সঙ্গে গিয়ে নাটকের মহলা দেখত বসে বসে। সেখানে অন্য একটি শিশুশিল্পীর চরিত্রে যে মেয়েটি অভিনয় করত সে নিয়মিত না আসায় পরিচালক হিমিকে ডেকে চরিত্রটা করতে বলে। হিমি রাজি হয়ে যায়। অথচ নাটক নিয়ে তখন তার কোন ধারণাই ছিল না। পরে নাটকটির বেশ কিছু অভিনয় হয়েছিল। প্রথমে জেলাভিত্তিক পরে রাজ্যভিত্তিক প্রতিযোগিতায় নাটকটি প্রথম হয়। শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পীর পুরস্কারও পেয়ে যায় হিমি। এখানেই শেষ নয়। মাঝে কিছুটা সময় নাটক থেকে দূরে থাকলেও ২০১১ সালে আবার সে নাটকের ঘরে ফেরে। প্রথমে শ্রুতিনাটক, পরে মঞ্চনাটক।

ত্রিপুরার আমবাসাতেই বেড়ে ওঠা হিমির।সেখানকার চান্দ্রাইপাড়া হাই স্কুল থেকে দশম শ্রেণি অব্দি পড়াশুনো। আগরতলার প্রাচ্য ভারতী স্কুল থেকে বিজ্ঞানের ছাত্রী হিসাবে উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডী পেরিয়ে আগরতলা উইমেন্স কলেজে ভর্তি হলেও হিমির জীবন এখান থেকেই মোড় নিল অন্য দিকে।
ভাগ্যচক্রে তখন ত্রিপুরা থেকে কলকাতায় চলে আসতে হয়েছিল। কলকাতায় এসে নতুনভাবে নতুন বিষয় নিয়ে ডিরোজিও কলেজ থেকে স্নাতক, সরোজিনী নাইডু ফর উইমেন কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর এবং এম হোসেন টিচার ইন্সটিটিউট থেকে বি এড ডিগ্রী অর্জন করে।

কিন্তু থিয়েটার?… ত্রিপুরায় শৈশবকালে প্রথম আচমকা মঞ্চে নামা সেই মেয়েটির থিয়েটারের প্রতি ভালবাসাটা কিন্তু থেকেই গিয়েছিল। তাই অচেনা কলকাতায় এসেও থিয়েটারে জড়িয়ে গেল হিমি শর্মা। কলকাতায় ঝঙ্কার শিল্পী সংসদের হয়ে ২০১১ সালে “সেই তিমিরে” নাটকে মঞ্চে নামার সুযোগ মিলে গেল হিমির।
অবশ্য গানের প্রতিও একটা টান ছিল তার।
প্রথাগতভাবে থিয়েটার নিয়ে পড়াশুনা না থাকলেও এম. এ. তে নাটক স্পেশাল পেপার ছিল। এবং গবেষণার বিষয় ছিল ‘রবীন্দ্র সাংকেতিক নাটকে সঙ্গীতের ব্যবহার।’ হিমির কথায় – আমি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং রবীন্দ্র সঙ্গীতে বিশারদ। তাছাড়াও ভাব সঙ্গীত, নজরুল গীতি, লোকগীতি ও আধুনিক গান নিয়ে গুরুর সান্নিধ্য নিয়েছি বহুদিন।
কলকাতায় এসে হিমি ভেবেছিল, থিয়েটারে থেকেও গান গাইতে পারবে। গানের চর্চা উজ্জীবিত রাখতে থিয়েটারকে মাধ্যম করেছিল। আসলে গান আর থিয়েটার এ দুটোই তার জীবনে বেঁচে থাকার অক্সিজেন।

কথাকৃতি নাট্যদলের নিয়মিত সদস্য। হিমির গুরু পিতাসম সঞ্জীব রায়ের তত্ত্বাবধানেই সার্বিক বিকাশ। নিজের দলে সবার সঙ্গে বেঁধে বেঁধে থাকাটাই তার পছন্দ। তাই সেট, ড্রেস, রূপসজ্জা, লাইট, মিউজিক, ব্যাকস্টেজের সব কাজের পাশাপাশি দলগত নানা কাজে নিজেকে জড়িয়ে নিতে শুরু করে হিমি। প্রথম মঞ্চে নামা মেয়েটির বুকের ভিতরে ত্রিপুরার শৈশবকালের স্মৃতি তখন জ্বলজ্বল করছে । ধীরে ধীরে থিয়েটারের বাঁধনে নিজেকে বেঁধে কলকাতাকে আপন করে নিয়েছে।

করোনার কালে একটা ভয়ঙ্কর দু:সময়ের মধ্যে থেকেও থিয়েটারের ভুবন থেকে ছিটকে যাওয়ার কথা ভাবেনি। লড়াই করেছে মেরুদন্ড সোজা করে। গুরু তাকে ভরসা দিয়েছে। থিয়েটারই তার কাছে জীবনীশক্তি হয়ে উঠেছে ক্রমশ। থিয়েটারকে রুটিরুজির মাধ্যম হিসাবে বেছে নিয়ে বেঁচে থাকাটা কঠিন জেনেও হাল ছাড়েনি হিমি। অন্য দলের ডাকে যখনই অভিনয় করতে গেছে — হিমি অনুভব করেছে যে থিয়েটারে পারিশ্রমিক বাড়িয়ে দিতে বললে সেটা কখনও কখনও অপরাধ বলে বিবেচিত হয়েছে। মনে মনে কষ্ট পেয়েছে সে। ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। কিন্তু আবার গিয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়েছে চরিত্র হয়ে হিমি শর্মা।
তাই হয়ত “অনুবীক্ষণ” নাটকে মধ্যবিত্ত ঘরের সেই মেয়েটির চরিত্র তার বড় বেশি প্রিয়। যে মেয়েটি সংসারের জন্য নিজেকে উজাড় করে শুধু বাড়ির দায়িত্ব পালন করে যায়… অবশ্য “আন্তিগোনে” এবং শাহজাদা দারার মেয়ে “জহরৎউন্নিসা” এবং “আধা – আধুরে” নাটকে বড় মেয়ের চরিত্রটাও তার প্রিয় চরিত্র। অথচ থিয়েটারের কোন প্রথাগত ডিগ্রী অর্জনের সুযোগ আসেনি জীবনে। নাট্য কর্মশালায় এবং বিভিন্ন নাটকের অভিনয় করতে করতে, মহলায় নিজেকে তৈরি করে নেওয়ার শিক্ষাটাই তার অবিরত চর্চার মাধ্যম মনে করেছে।

ঝঙ্কার শিল্পী সংসদের অমরনাথ উপাধ্যায়, মহাভারত রঙ্গভূমির অতীশ চন্দ, কথাকৃতির সঞ্জীব রায়, অশোকনগর প্রতিবিম্বর পার্থসারথি রাহা, খড়দহ রসিকতার অভিজ্ঞান ভট্টাচার্য, সেন্টার স্টেজ এর স্বরূপ দাস, নবনীতা মুখার্জী, শ্রুতি ক্রিয়েশনস এর সুতপা সেনগুপ্ত, শোহন এর অনীশ ঘোষ, অশোকনগর নাট্যমুখ এর অভি চক্রবর্তী, অফিস ক্লাবের অসিত বল, চিৎপুর রঙ তামাশার সুবীর দেবনাথ এবং অবশ্যই সুমিত কুমার রায়ের মতো মানুষগুলির কাছে থিয়েটার শিক্ষার ক্ষেত্রে তার অনেক ঋণের কথা জানিয়েছে হিমি নির্দ্বিধায়।

একটা ছোট্ট আক্ষেপ মাঝে মধ্যেই হিমেল হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে মনকে অশান্ত করে তোলে ওর। বাড়ির লোকজন আজও তার থিয়েটার দেখেনি। হয়তো কোনদিন দেখবে – এই প্রত্যাশায় প্রহর গোনে সে। বাড়ির মানুষজন ভেবেছিলেন, পড়াশুনো করে একটা নিশ্চিত উপার্জনের পথে পা রাখবে হিমি । কিন্তু সব কি ইচ্ছে মত হয়?… হয় না। এই অনিশ্চিত পথে চলতে চলতে একটা শিল্পমাধ্যমকে সে ভালবেসেছে নিজের অজান্তে । সেটাই তার জীবনে চলার পথ হয়ে উঠেছে।

“সেই তিমিরে ” দিয়ে শুরু করে অনুবীক্ষণ, কৃষ্ণভামিনী, ঘোড়ামুখো পালা, ভৌতিক, অবাক জলপান, দ্রব্যগুণ, সাজাহান আজও, ডাকঘর, দেনাপাওনা, ইচ্ছাপূরণ, ধা নি সা, ফলসি চড়ার উপাখ্যান, ঠাম্মি, অধুনা আন্তিগোনে, আধা আধুরে, রূপক্রান্তি, লোহার দাম, বুদেরামের কূপে পড়া, পঞ্চ নারীর পঞ্চ কথা প্রভৃতি নাটকে বিচিত্র সব চরিত্রে অভিনয় করে ত্রিপুরার সেই মেয়েটি বঙ্গের থিয়েটারে শক্ত মাটিতে পা ফেলে এগিয়ে চলেছে দৃপ্ত পদক্ষেপে। আরো অনেক পথ সে চলতে চায়। থিয়েটারের পথে এক অক্লান্ত পথিক হয়ে পথচলাই তার উদ্দেশ্য এখন।

28 thoughts on “হিমি শর্মার জীবনে থিয়েটার হল লড়াই এর ময়দান | পর্ব -৩০

  1. ২০১৯ সালে ওকে অশোকনগর নাট্যমুখ এ দেখলাম। অভিই নিয়ে এসেছিল। ও ফিল্যান্সার অভিনেতা। কিন্তু আজ পর্যন্ত লোহার দাম নাটকে ২৪ টা শো হয়ে যাবার পর কখনোই মনে হয়নি ও দলের সদস্য নয়!ওট একটা ভালো মন আছে। ওর একটা দারুণ মিষ্টি গানের গলা আছে। মিশতে পারে। যা দিয়ে সকলের মন জয় নিমেষেই করে নিতে পারে। ওর অভিনয় মুগ্ধ করে সকলকে। ওর অভিনয় জীবন দীর্ঘ হোক।

    1. ধন্যবাদ অসীম দা। তুমি যদি এতোটা যত্ন করে আমার বিষয়টা সংযোজন করে সুন্দর করে উপস্থাপন না করাতে তবে এতো লোক আমার মতো সামান্য মানুষকে জানত কেমন করে! অসংখ্য ধন্যবাদ দাদা। আমার অযাচিত ভুল মার্জনা করো।🙏🙏🙏🙏🙏🙏🙏

    1. হিমির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল প্রসেনজিৎ বর্ধন। আমার ক্রাইসিস মোমেন্টের জরুরি বন্ধু। সে চলে গেল। হিমি রয়ে গ্যাছে। ভালোবেসে। আনন্দে। এককাট্টা হয়ে।

      1. ধন্যবাদ অভি দা আমাকে এতোটা উপযুক্ত করে তোলার জন্য। 🙏🙏🙏🙏🙏🙏🙏

    1. থিয়েটার নিয়ে এই লড়াই আসলে একটা শিল্পমাধ্যমকে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রাখার লড়াই।এদের কথা প্রাণিত করুক অন্যদের।উজ্জীবিত হোক থিয়েটার।হিমিদের লড়াই এর কথায় প্রাণিত হোক আরো অনেকে।

      1. আপনাকেও প্রণাম জানাই। এই তিরিশ পর্ব ধরে অক্লান্ত লিখে চলেছেন। ধন্যবাদ দেবনা। নাট্যের প্রতি নিখাদ প্রেম না থাকলে এ অসম্ভব।

    1. খুব শীঘ্রই সেই দিনটা আসুক এখনি যেদিন হিমি দির বাড়ির সবাই হিমি দি র অভিনয় দেখতে আসবে।

  2. সুজিত চক্রবর্ত্তী, আমবাসা, ত্রিপুরা says:

    সম্পূর্ণ লেখাটা পড়ে চোখে জল ধরে রাখতে পারলাম না, মনটা কেমন জানি আবেগে ভরে উঠলো পাশা পাশী হিমির জন্য গর্বও হচ্ছে কী নিদারুণ পরিবেশ পরিস্থিতিতে অনেক সংঘর্ষ করে সবার ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। আরও ভালো করো আরও অনেক দূর এগিয়ে যাও সততা ও সাফল্যের সহিত এই শুভ কামনা ও আশির্বাদ রইলো।

    1. আপনাকে অভিনন্দন দাদা।ভীষণ ভালো লাগছে ত্রিপুরাতে যদি এই ওয়েবজিন টা শেয়ার করা যায়,একটু চেষ্টা করবেন অনুরোধ রইলো। পাশাপাশি আপনি কি করেন আমি জানিনা তবে ত্রিপুরার বাংলা থিয়েটার নিয়ে লেখা যদি সংগ্রহ করা যায়। এই জার্নালের জন্য। আপনি আমাদের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করবেন।
      ভালো থাকবেন, প্রতি উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।

  3. হিমি আমার হিমু আদুরে। নাটকের মতন শক্ত মাধ্যমের শিল্পী। আলাপ। থেকে ঠিকরে বেরুল শেকড় বোন আর দিদির। কি রে হিমি , তুই কেমন করে ভাবছিস? আমাদের থিয়েটারের ঘর বাড়ি নয়? পরিবার নয়? আরে এটাই অবিচ্ছেদ্য রে। তুই কেন ওমনকরে ভাবছিস? এমনকরেভাব … তুই একজন যার নাম গবেষণায় দিয়েছি আমিও। কারণ তুই আমার বোন। দিদি হিসেবে আমি নিজেই তোর বন্ধু । @মৌ _২০২২.

  4. আপনাকে অভিনন্দন দাদা।ভীষণ ভালো লাগছে ত্রিপুরাতে যদি এই ওয়েবজিন টা শেয়ার করা যায়,একটু চেষ্টা করবেন অনুরোধ রইলো। পাশাপাশি আপনি কি করেন আমি জানিনা তবে ত্রিপুরার বাংলা থিয়েটার নিয়ে লেখা যদি সংগ্রহ করা যায়। এই জার্নালের জন্য। আপনি আমাদের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করবেন।
    ভালো থাকবেন, প্রতি উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।

    1. Himi has fantastic acting talents. She is a great singer also. Himi has a lot to contribute to theatre & the society at large. Keep on moving forward.

Comments are closed.