অসীম দাস
যাদবপুর মন্থনের এক মহাভারত মন্থিত নাট্য নির্মাণ ইলা। যার নামের মধ্যেই রয়েছে অনেক তর্ক, রহস্য ,অভিশাপের কাহিনি। ব্যাসদেবের মহাভারতে সবচেয়ে অ-আলোচিত আড়াল করা মহাপ্রেম, প্রণয়ের মিলন। ইলা, ইল, ইরা এরা একই অঙ্গে পার্বতীর অভিশাপের পুরু-নারী।
আজকের পৃথিবীর নারী পুরুষের সেক্স বদল করার ইচ্ছেতে সরকারি সম্মতি পাওয়া না পাওয়ার ঘটনা ঘটছে আকছার। যা পুরাণ পরম্পরায় বহু আগে হয়ে আসলেও সামাজিক ভাবে স্বীকৃত নয়। আইনের বেড়াজালে দাঁড়িয়ে আমরা যতই ভাবি যে স্বাধীনতা লাভ করেছি, ইচ্ছেমত জীবনযাপন আমার নিজস্ব গণতান্ত্রিক অধিকার। বাস্তবটা বড় ভঙ্গুর, অসচ্ছলতার পর্দায় মোড়া। এ সম্মতি পাওয়া সহজসাধ্য নয় পরিবার থেকে।
ইরা কি এন্ড্রোজিনি? জানিনা? তবে ইরা হিন্দুদের এক কিংবদন্তি দেব বা দেবী। যৌন পরিবর্তনের জন্য দেবতা সমাজে পরিচিত। ইলিকে প্রধান প্রজন্ম হিসাবে বিবেচনা করা হয় চন্দ্রবংশ ভারতীয় রাজাদের বংশধর। পিতা মনু মাতা শ্রাদ বা শ্রদ্ধা। একদিন শিকারে গেলে ভুলবশত এক মায়াবি শরাভান জঙ্গলে প্রবেশ করে সে। যেখানে শিব ছাড়া অন্য পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। পার্বতীর অভিশাপে ইল পরিণত হয় নারীতে। এমনই রহস্যময় কানন যেখানে সে প্রতিবার আসে যায় নারী থেকে পুরুষে রূপান্তরিত হয় , ইচ্ছে মতো লিঙ্গ পরিবর্তন হয়, শরীরে ঋতুরজ হয়। অবশ্য তা সকলের জন্য নয়।
ঈশ্বরের এই অশেষ অনুগ্রহে ইলা উপভোগ করে জীবনের সাধ, কামনা। রূপবতী ইলার সৌন্দর্য আর যৌবনে মোহিতহয়ে গ্রহের রাজা বুধের পুত্র বুধার সঙ্গে প্রেম প্রণয়ে আবদ্ধ হয়। সেখানেও বহুপ্রেমের কাহিনি বর্নিত আছে। চন্দ্র বংশের পুত্র আর ইলার সহবাসে এক পুত্র সন্তান আসে কোল জুড়ে। পুরুরাবাস যে কিনা একদিন এই বংশের অধিপতি হবেন। পুরাণ থেকে জানা যায় ইলা বারংবার সেক্স পরিবর্তন করে তিন সন্তানের মা হয়েছিলেন। সুডুম্মা
ভোগ সর্বস্যজীবনে এমন জীবন রহস্যময় অথবা রহস্যময়ী ইলাকে হয়তো অনেকেই চাইবেন অাইডল করতে! এমন ইচ্ছে-পূরণ জীবন জানিনা কতটা সুখের তবে পৃথিবীতে এ ঘটনার উদাহরণ হিসেবে মাইকেল জ্যাকসনের কথা বলতে পারি। আমার জানা বাংলাদেশে ঋতুপর্ণ ঘোষ। সমাজ অবশ্য আড়ালে হেসেছে। ঋতুপর্ণ বড়বড় মানুষদের সঙ্গে কাজ করেছেন, একা সর্বস্ব ট্রান্সজেন্ডারদের সুখ দেখা গেছে হাতে গোনা কিছু মানুষের জীবনে। কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তবে কিনা এ যুগে কোনো হয়ত চাঁদবণিক জীবনে আসেনি যে কিনা সন্তান দিতে সক্ষম। অবশ্য এখন তো চিকিৎসা বিজ্ঞানের বদান্যতায় সেরোগেট মাদার,ভ্রূণ প্রতিস্থাপন, গর্ভ রেন্টে পাওয়া যায়। যদিও এসব সচ্ছল আর্থিক বিত্তবানের মানায়।
ইলার রূপান্তরকামী কাহিনীর কথা মহাভারত মহাকাব্যের পাশাপাশি হয়েছে বেদ-পুরাণ, মৎস্য পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ, লিঙ্গ পুরাণে উল্লেখ আছে জানতে পারলাম। সেখানে অনেক বিতর্ক জুড়ে আছে ইলার জীবনযাপনে। ইলাকে নারী হিসেবে চাননি শিব, হাসাহাসি করেছেন। পরে অবশ্য ইলার গর্ভের সন্তানকে চন্দ্র বংশের প্রথম রাজা হিসেবে বসিয়ে দেন।
সত্যি মিথ্যা, মানা না মানা এসব নিয়ে অবশ্য আমার বিন্দু মাত্র উৎসাহ নেই। আমার না-জানা মাইথলজি নিয়ে সোহম সরকার এই নাট্যের নির্দেশক তার কলম দিয়ে কেমন ক্লাসিক আঁচড় এঁকেছেন। চমৎকার লাগলেও এই ক্ষতগুলোতে অনেক প্রশ্ন চিহ্ন আছে। রেখেছেনও। আমি তা বিশ্বাস করি। ভালোবাসি কিনা জানিনা। সমকামিতায় বিশ্বাস করি কিন্তু রূপান্তর? যদিও ইলা পুরাণকামী বিষয় এটা আমার কাছে ভীষণ ইন্টারেস্টিং।
নাটক দেখতে বসে নাট্যকারের চোখ দিয়ে গভীর সন্ধান, নতুন পথের দিশা এটা আমার কাছে বেশ সুখের মনে হয়েছে। কোথাও মনোটোনাস লাগেনি। অজানাকে জানবার আগ্রহে স্থির হয়ে থাকা মানুষের ভীড়ে আমিও আপ্লুত হই ওঁদের প্রত্যেকের অভিনয়, সংগীতের দখল দেখে। সুরের আগুন ঝরালেন জয়দীপ। কি মোহমায়ায় আচ্ছন্ন করে ফেললো গোটা অমল আলোর সন্ধেটা। আরো অনেক ভালো কাজের সাথে যুক্ত হোক জয়দীপের নাম। মোট ১১ জনকে মঞ্চে হাফ সার্কেল হয়ে বসে কথকের থেকে কোরাস সংগীতে তারপর গল্পের গভীরে প্রবেশ। এ নাটকে সকলেই একই পোশাক পড়ে, সকলেই যেনো দেখতে একই রকম। যেনো মনে হবে ইলা এক ভারতীয় থিয়েটার। এখানে সবাই পুরুষ (একজন নারী অভিনেত্রী ছিল, না হলেও সমস্যা হতো না) সবাই ইলা! একই টিউনে বাঁধা, উচ্চারণেও বেশ যত্ন নেওয়া হয়েছে। রাজীবকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করলাম আমি। চুয়া চন্দন এ গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর মতো শান্ত স্নিগ্ধ একটা মায়াময় মানুষ। ভীষণ ভালো কোরিওগ্রাফি ও অভিনয় কুনালের, এছাড়া ইন্দ্রনীল, দিবেন্দু, আশিকী, দেবব্রত, সৌহার্দ্য, অনুভব এবং সোহম সহ প্রত্যেকেই গুড পার্ফরমার। শরীরকে ব্যবহার করে নাট্যের চলনে নবরসের নতুন আবর্ত নির্মাণ দেখলাম অমল আলো তে বসে গত ১৭ জুন ২০২২, এই নাটকের প্রথম অভিনয় তৃপ্তি মিত্র নাট্যগৃহে ২০ এপ্রিল ২০১৯ হয়েছিল।
অমল আলো থেকে বেরিয়ে রাস্তায় যেতে যেতে একটা প্রশ্ন ভেতরে ভেতরে সত্যমিথ্যা যাচাই করছিল। আমাদের সমাজে মেয়েরা যখন পুলিশের পোশাকে প্রশাসনের উচ্চ পদে
আসীন হন তখন তিনি আমাদের আমাদের সকলের গর্ব, অহংকার। আর একজন ছেলে যখন চোখে কাজল ঠোঁটে রঙ করেন আমরা হাসাহাসি করি, বিদ্রুপ করি — তিনি যতই গুণী হন, শ্রেষ্ঠ হন। কেন? এর উত্তর খোঁজার সময় কি আসবে, আদৌ কি আসবে সেই সময়?
দারুণ নাটক
রাজীবের বেশ কিছু এমন অন্তরঙ্গ নাট্য আছে। যা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং উপভোগ্য।
এমন নাটক লেখা হওয়া বা মঞ্চ আনা দরকার যা দেখে দর্শককেও রীতিমতো পড়াশোনা করতে হবে।
আমার তো খুব ইন্টারেস্টিং লেগেছে সাবজেক্ট।