প্রথমেই দ্বিধাহীন ভাবে বলতে হয়, বিগত দশ বছরেরও কমবেশি সময় ধরে, বাংলা নাটকের উৎকৃষ্টতা, গুণমান, বিষয় নির্বাচন তদুপরি, মেধাসম্পন্ন প্রযোজনায় শহরতলী মফস্বলের থিয়েটার চর্চার ধার ও ভার প্রায় অনির্বচনীয়। দ্বিমত থাকতেই পারে তবুও, গত দশ বছরের মধ্যে বেশ কয়েকটি পূর্ণাঙ্গ প্রযোজনা তার সম্মোহনী ক্ষমতায় প্রবল বেগে দর্শক সমাদৃত হচ্ছে বারেবারে।
উদাহরণ স্বরুপ বলা চলে বেলঘরিয়া অভিমুখের কোজাগরী, গয়েশপুর সংলাপের চৈতন্য, বেলঘরিয়া রূপতাপসের এলা এখন, শান্তিপুর সাংস্কৃতিকের রক্ত উপাখ্যান, কল্যানী কলামন্ডলমের রক্তাক্ত ঝরোখা, ইত্যাদি প্রভৃতি। পালকে নতুন সংযোজন মালদা থিয়েটার প্ল্যাটফর্মের জাগরণ পালা।
ভাগ্যিস থিয়েটার প্ল্যাটফর্মের নির্দেশক এবং কর্ণধার, সুব্রত পাল ময়াশয় ফোনে বারংবার অনুরোধ করেছিলেন নাটকটি দেখার জন্য। না দেখলে এ জন্মের অমূল্য রতন প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হতাম অবশ্যই। নাট্য বিষয়, বাংলার ঘরে ঘরে প্রচলিত প্রাচীন লোকজ পাঁচালী মনসামঙ্গল কাব্যের আধারে বিরচিত জাগরণ পালা। নাটকটি লিখেছেন কৌশিক রায় চৌধুরী। নির্দেশনায় সুব্রত পাল।
এট্টুস কূটকচালি করে নেওয়া জরুরী। প্রাচীন বলা মাত্রই বান্ধবদের ধন্দের ফের লাগতে পারে। কতটা প্রাচীন মনসামঙ্গল কাব্য? মহাভারত রামায়নের কাল ? ধন্দ কাটিয়ে নেওয়াই ভালো। না হে পাঠক, শুধুমাত্র দেবদেবীর অনুষঙ্গ এবং, স্বর্গের অংশটিকে ধরে নিলে অতি প্রাচীনতার অবস্থানটি হয়তো অবলোকিত হবে কিন্তু, কাব্যের পটভূমি ক্ষণে ক্ষণে নদীনালা বেয়ে যে পথে বেহুলার ভেলা ভেসেছে, তাতে করে নেতাধোপানির ঘাটই বলি আর, গাঙুরে ভাসমান লখিন্দরের ভেলাই বলি না কেন, পূরাণ কথন মানচিত্রের সাথে কোথাও মিল পাওয়া যায় না। আধুনিক মানচিত্রে নেতাধোপানির ঘাট বলতে বুঝি নামখানার যে নদীটিতে ঢাউস নৌকায় ভেসেল পারাপার হয়। গাঙুরের অবস্থানও লুপ্ত প্রায়। কথিত আছে, সপ্তগ্রামের ধারে সরস্বতী নদীতে ভাসিয়ে ছিল ভেলা, ত্রিবেনী সঙ্গম হয়ে বহুপথ ঘুরে নেতাধোপানির ঘাটে ভেড়ে ভেলাটি। তার মানে দাঁড়ালো, এটি নিতান্তই বাংলার একটি লোকজ গাঁথা যা, আনুমানিক বারোশ শতকের কিছুটা আগেপিছে রচিত হয়।ধন্দটি কাটালাম তার মূল কারণই হলো– “কালকেউটের ফনায় নাচছে লখিন্দরের স্মৃতি। বেহুলা কখনো বিধবা হয় না এটা বাংলার রীতি।
ভেসে যায় ভেলা এবেলা ওবেলা একই শবদেহ নিয়ে
আগেও মরেছি আবার মরব প্রেমের দিব্যি দিয়ে..”
(জাতিস্মর, কবীর সুমন)
অর্থাৎ, সময়কালের প্রেক্ষাপটে হাজারো বেহুলার নিদারুণ জীবনের আখ্যানটি অযত্নে কথিত হয়েছে মনসামঙ্গল কাব্যে। সযত্নে তাকে কলমের জোরে যুগপোযোগী করেছিলেন প্রয়াত নাট্যকার কৌশিক রায় চৌধুরী। নির্দেশক সুব্রত পাল কৃষ্টিময় মেধার জোরে প্রযোজনাটিকে আলঙ্কারিক করে তুলেছেন কঠিনতম অধ্যাবসায়ের সাধনায়। শুরুতেই অসাধারণ একটি মঞ্চ নির্মাণ যা, কল্পসত্তাকে নিয়ে চলে যায় বাংলার আল আঙিনার পথে প্রান্তরে এলিয়ে থাকা অর্ধ প্রাচীন সময় কালের আদরে চাদরে মাখা ছবিতে। লাল ঝালরে মোড়া নানান মাপের রস্ট্রামগুলো যুগযুগান্তের পটাকৃতি যেন। পেছনে, উপর থেকে ঝোলানো ঢাউস ত্রিশুলটি শিবসেবক অহঙ্কারী চাঁদ বেনের প্রভূত আস্ফালনের অসাধারণ প্রতীক। মঞ্চের দুপাশে, একটু আগে পিছে, গায়ে গা লাগোয়া কতগুলো ত্রিশুল যার, শরীর রয়েছে সাপের মতো আঁকাবাঁকা। আরো আশ্চর্যের বিষয়, মঞ্চে যখনই স্বল্প আলো কিংবা, নাটকের পরিভাষায় মুড এফেক্ট তৈরি হচ্ছে, তখনই মনে হচ্ছে ত্রিশুলগুলো ঘিরে অজস্র সাপ ফনা তুলে কিলবিল করছে! বাহা রে মঞ্চ নির্মাণকারের ক্যারিশমা! এমন জাদুময় ভাবনা ইয়ৎকালে, জীবিতকালে খুব একটা চোখে পড়েনি।
কোনটা ছেড়ে যে কোনটা বলি! গানের দল, কোরিওগ্রাফি, প্রত্যেকটি চরিত্রের অভিনয়, যেন তালবাদ্যের হতবাক করে দেওয়া সুরমূর্ছনা! প্রায় ছত্রিশটি চরিত্র নানান সময়ে, নানান মুডে তাদের অসামান্যতা উপহার দিয়ে গেলেন আজকের সন্ধ্যায়। যেহেতু, পাঁচালীর মতো তার নাটুকে কথন সেহেতু, মাঝেমাঝে বেশ খানিকটা একঘেয়ে লাগলেও, একটি পরিশীলিত পরিশুদ্ধ পরিশ্রমসাধ্য প্রযোজনা যা কিনা, দর্শককূলের রোমহর্ষণ ঘটায় মূহুর্মূহু। তবুও বলি, বাঁধুনির বাঁধন শক্ত রাখতে হলে আরও কিছুটা কমিয়ে নেওয়া যায় কিনা নির্দেশক কে ভাবতে অনুরোধ করছি। নাটকের শেষে মাননীয় সুব্রত বাবু বড় করুণ গলায় বললেন, করোনার আগে নির্মাণ হলেও করোনার কারণে খুব একটা মঞ্চায়ন হয়নি। মাত্র সাতটি মঞ্চায়ন হয়েছে। হয়তো খুব বেশী দশটি মঞ্চায়নের পর নাটকটি থেমে যেতে বাধ্য। কেই বা দেবে শো!
কথাটা শুনে বুকটা টনটনিয়ে উঠলো। অনুরোধ করি সুব্রত বাবু, কষ্ট করে হলেও জাগরণ পালা চালিয়ে যান। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে এই মূহুর্তে এ প্রযোজনার আবশ্যকতা কতখানি প্রয়োজন প্রেক্ষাগৃহে বসেই উপলব্ধি করেছি। এমন নান্দনিক ভাবনায় মনসামঙ্গল কাব্য কতখানি মূর্ত হয়ে উঠেছে তা, ঢের বুঝতে পেরেছি ক্ষণে ক্ষণে। পরিশেষে আমার প্রিয় ফেসবুক বন্ধুদের বলি, যারা প্রতিনিয়ত বলে থাকেন বাংলা নাটকের মান নিম্নমুখী, তারা একটিবার মালদা থিয়েটার প্ল্যাটফর্মের জাগরণ পালা দেখুন। হলফ করে বলতে পারি, চমৎকৃত হবেন, শিহরিত হবেন, সজীব নিঃশ্বাস নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। আবারও বলি, ভাগ্যিস সুব্রত বাবু ফোনে আবদারটি করেছিলেন! তা নাহলে এমন একটি মনোময় নাট্যসন্ধা থেকে বঞ্চিত হতাম। ধন্যবাদ দেবো কল্যানী নাট্যচর্চা কেন্দ্র ও তার কর্ণধার কিশোর সেনগুপ্তকে। এমন একটি প্রযোজনা দেখার সুযোগ করে দেবার জন্য আপনি ও আপনার দলের কাছে ঋণী হয়ে রইলাম।