‘ফ্যাতরা’ শব্দটির অর্থ মূল্যহীন। শব্দটি এসেছে অকেজো কলাগাছের বাখনা বা ফ্যাতরা থেকে। যাত্রা সমন্ধে একটা কথা চালু ছিল “যাত্রা দেখে ফ্যাতরা লোকে”। ফ্যাতরা অর্থ নিকৃষ্ট জন। প্রাচীনকালে যাত্রার অর্থ দেবতার লীলা বা চরিত্রের অংশবিশেষ যা তুলে ধরা হতো, জনসাধারণ জ্ঞানার্থে আয়োজিত উৎসবে। ভরত নাট্যশাস্ত্রেও যাত্রার উল্লেখ আছে। ধর্ম সম্বন্ধীয় ও পৌরাণিক বিষয় নিয়েই যাত্রা অভিনয় হতো মূলত। প্রথমে শিবযাত্রায় তারপর রামযাত্রা ও শেষে কৃষ্ণযাত্রা। একটা সময় পাঁচালী ও কীর্তনে লোকে এতো মেতে ওঠে যে যাত্রা লোপ পেতে বসেছিল। তা আবার প্রতিষ্ঠা পায় ভারতচন্দ্রের `বিদ্যাসুন্দর´ – এ।
যাত্রার উৎপত্তি কাল সঠিকভাবে জানা না গেলেও মোটামুটি ভাবে শ্রীচৈতন্যদেবের (১৪৮৬-১৫৩৩) সময় কালকেই ধরা হয়। তবে শ্রীচৈতন্যদেবের আগেও যাত্রার প্রমাণ পাওয়া যায়। যাত্রা শব্দের গুঢ় অর্থ নির্বিঘ্নে দীর্ঘপথ অতিক্রম করা। যেমন শোভাযাত্রা, রথযাত্রা, দোলযাত্রা, স্নানযাত্রা ইত্যাদি। যাত্রা শব্দটির সম্ভবত দ্রাবিড় ভাষা থেকে গৃহীত, যাত্রা অর্থে গমন বোঝায়। যাত্রা আবার ‘ইন্দো- ইউরোপীয়’ যা ধাতু থেকেই আগত, যার অর্থ গমন। এ থেকেই যাত্রা শব্দের উৎপত্তি। ইউরোপে যে সময় যে অবস্থায় ( Mysteries) মিসট্রিজ প্লে আরম্ভ হয় বাংলায়ও সে অবস্থায় যাত্রা শুরু হয় বলে অনুমান করা হয়।
আগেই বলেছি বাংলায় শ্রীচৈতন্যদেবের আগেই যাত্রা ছিল, তবে তা কেবল শক্তিবিষয়ক, কৃষ্ণযাত্রা নয়। শ্রীকৃষ্ণের রাসচক্রে গমনের ব্যাপারটাই রাসযাত্রা নামে পরিচিত বা প্রসিদ্ধ। দোলযাত্রা, রথযাত্রা, গোষ্ঠযাত্রা প্রভৃতি দেবলীলার ঘটনাগুলিকে স্মৃতিতে ধরে রাখার জন্য, কিছু মানুষ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় আসা কিছু লোককে এই ব্যাপারটা দেখানোর জন্য, একটা ধারাবাহিক চরিত্রচিত্র উপস্থিত করে। এই ব্যাপারটাই ক্রমে যাত্রা উৎসব বা যাত্রা নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যে দেব চরিত্রাংশ অতি গভীর পুজা আড়ম্বর ও ভক্তিসহ আনন্দ তরঙ্গে নাচ গানের সমন্বয়ে লোক সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় তা-ই যাত্রা।
অষ্টাদশ শতকের প্রথম থেকে কালীয়দমন যাত্রা বিশেষ প্রসার লাভ করেছিল। ভারতচন্দ্রের পরবর্তী কালে নানা কারণে বিকৃত বা নিম্নরুচি সাহিত্যর ধারাকে প্রভাবান্বিত করেছিল এবং এর অবশ্যম্ভাবী প্রভাব দেশের লোকরঞ্জন মাধ্যমের উপরও পড়েছিল। এও জানা যায় যে বিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক ফা- হিয়েন পঞ্চম শতাব্দীতে এসে এদেশে যাত্রা দেখেছিলেন। জগন্নাথের রথযাত্রা, বৌদ্ধদের বুদ্ধযাত্রা, শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা দেখলেই বোঝা যায় যে দুই দূরদেশবাসী কিভাবে এই ব্যাপারে একে অপরকে অনুসরণ করেছিল।
হিন্দু রাজাদের সময় থেকে ভারতের সর্বত্র যাত্রার সমাদর। বাংলায়ও রামযাত্রা সৃষ্টি বড় অল্প দিনের নয়। কেউ কেউ মনে করেন রামযাত্রার অনেক পরে শ্রীচৈতন্যর সময় কৃষ্ণযাত্রার সৃষ্টি। শ্রীচৈতন্য কৃষ্ণলীলায় অভিনয় করতেন। তাঁর রাধাভাব দেখে আপামর জনসাধারণ মুগ্ধ হয়ে যেতেন। সকলের সামনে তাঁর প্রেমময় অভিনয় যখন প্রদর্শিত হতো, তখন আশা করা যায় এর ভাষা ছিল বাংলা। বাস্তবিক এই সময় থেকেই বাংলা ভাষার উন্নতি ও বাংলা ভাষার প্রকৃত নাটক রচনার কালযজ্ঞ। শুরুতে যাত্রাভিনয় নাটমন্দিরেই হত। ক্রমে ক্রমে তা গৃহপ্রাঙ্গণ, চন্ডীমণ্ডপ অথবা বারোয়ারি তলায় বাঁধা আটচালার মাঝখানে মেঝের উপর অভিনীত হত। অনেকটা অ্যাম্ফিথিয়েটারে মতো। এতে দৃশ্যপটাদি পরিবর্তন করা হত না। যদিও আমরা চৈতন্যের সমসাময়িক বা অভিনীত কোনও নাটকের কোন নির্দশন পাইনি, তবু বলা যায় যে,তাঁর কৃষ্ণলীলা গীতির অভিনয় দেখে বা তার বিবরণ জেনে পরবর্তী বৈষ্ণব গ্রন্থকারগণ – নাটক রচনায় মনোযোগী হন। যেমন লোচন দাস, যদুনন্দন দাস,জগন্নাথ বল্লভ, প্রেমদাস প্রমুখ। শ্রীকৃষ্ণযাত্রায় প্রাচীন ও প্রধান অধিকারীদের মধ্যে পরমানন্দ অধিকারীর নাম সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ। তিনি ছিলেন বীরভূমের মানুষ। অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগেও বিদ্যমান ছিলেন। তারপর শ্রীদাম সুবল অধিকারীর নাম পাওয়া যায়। জিরেট গ্রামবাসী বদন অধিকারীও এদের সমসাময়িক, বাস করতেন শালিখা গ্রামে। কৃষ্ণনগরবাসী গোবিন্দ অধিকারীর একচেটিয়া অাধিপত্য ছিল বর্ধমান রাজবাড়িতে। এছাড়াও কাটোয়ার পীতাম্বর অধিকারী, বিক্রমপুরের কালাচাঁদ পাল, পাতাইহাটের প্রেমচাঁদ অধিকারী, থরকাটার প্রেমচাঁদ, বাঁকুড়ার রামজীবনপুরের আনন্দ অধিকারী, ও জয়চন্দ্র অধিকারীও ছিলেন। পরবর্তীকালে পূর্ববঙ্গের যাত্রা সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন কৃষ্ণকমল গোস্বামী। যদিও তিনি পূর্ববঙ্গের লোক ছিলেন না তবু কাজের জন্য ঢাকায় গিয়ে বিখ্যাত হন। শ্যামবাজারের নিবাসী কৃষ্ণমোহন বাবুর পৌত্র কালাচাঁদ বসুর পুত্র নবীনচন্দ্র বসু দল গঠন করেন। তিনি প্রথম মহিলা চরিত্রাভিনয়ে মহিলা নিয়োগ করেন।
দক্ষিণ বরাহনগরবাসী মধুসূদন ভট্টাচার্য যাত্রাদল গড়েন। তার `বিদ্যাসুন্দর ” যাত্রায় মালিনী সাজতো পোড়াজোড়ার নন্দাযুগী। উত্তর বরাহনগরের রামজয় মুখোপাধ্যায়ের পর অর্থাৎ তাঁর দল ভেঙে গেলে রামধন মিস্ত্রি দল গড়েন। বিদ্যাসুন্দর পালায় বিদ্যার ভূমিকায় অভিনয় করতেন সৃষ্টিধর বা ছিঁটে তাঁতি। গোপাল চন্দ্র দাস বা গোপাল উড়েও ছিলেন সমসাময়িক এক যাত্রা দলের প্রধান।প্রথমে সখের দল ও পেশাদার দল গড়েন। চন্দননগর বা চুঁচুড়া নিবাসী জনৈক সঙ্গীতজ্ঞ ব্যক্তি খ্যামটা নাচের উদ্বোধন করেন। পরে পানিহাটি নিবাসী মোহন মুখোপাধ্যায় ওই নাচ শিখে কলকাতা নাচওয়ালী মহলে শিক্ষা দিতেন। খেমটা নাচে অদ্বিতীয় ছিলেন মোহনবাবু। গোপাল উড়ের দলে মালিনী সাজতো কাশীনাথ বা কেশে। অসামান্য নৃত্য – গীত পটু কেশের তুল্য মালিনী সেসময় আর কেউই ছিল না। বাগবাজারের ঠাকুরদাস দত্তের যাত্রা দলে ব্যাঁটরা নিবাসী উমাচরণ মুখোপাধ্যায় মালিনী সাজতেন। গজার ভট্টাচার্য জমিদাররা যে যাত্রা দল গঠন করেন তাতে ব্যাঁটরা নিবাসী বৈকন্ঠ দত্ত মালিনী সাজতেন। টাকির জমিদার মুন্সি বৈকুন্ঠনাথ রায়চৌধুরী সখের যাত্রাদল গড়েছিলেন। সময়কালেই হাবরার কোনার দীননাথ চৌধুরীও সখের যাত্রা দল গড়েছিলেন। পটলডাঙ্গার নীলকমল সিংহ যে দল গড়েছিলেন তা ভেঙেই নারায়ণ দাস তাঁর নিজস্ব দল গড়েন। এর কিছুদিন পরই হাড়কাটা নিবাসী দত্ত বংশীয় কায়স্থ দুর্গাচরণ ঘড়িয়াল বা দুর্গা ঘড়েল দল গড়েন। এই দলে উল্লেখযোগ্য সুকন্ঠের অধিকারী লোকনাথ দাস এবং কাশীনাথ হালদার পরবর্তী সময় দুটো আলাদা দলের অধিকারী হন। লোকনাথ বা লোকাধোপার দলের প্রসিদ্ধি বহুদূর ছড়িয়েছিল। কালীনাথ হালদার থেকে নীলকমল সিংহ অবধি যাত্রার রং ঢং সবই এরকম ছিল। এককথায় যাত্রা অশ্লীলতার দায় এড়াতে পারত না। তা সে বেশভূষা, সংলাপ, গীত, নৃত্যের অঙ্গভঙ্গী যাই হোক না কেন।
হুগলি কলেজের অধ্যাপক মদনবাবু ওই সমস্ত অশ্লীলতা মুক্ত করে যাত্রায় প্রথম সুস্থ বাতাবরণ সৃষ্টি করতে উদ্যোগী হন। তিনি ক্রমে মদন মাস্টার নামে খ্যাত হন। তাঁর যাত্রা দলের প্রথম আসর বসে আড়িয়াদহের তারণী গাঙ্গুলীর বাড়িতে। তারপর পিল্ ব্লেথার্স কোম্পানির মুৎসুদ্দি মহেশ দাসের ঠনঠনের বাড়িতে ( বর্তমানে যা দিগম্বর মিত্রের বাড়ি) আসর বসে। মদনবাবুই প্রথম যাত্রায় জুড়ির গান শুরু করেন। মদন মাস্টারের পর দল চালাতেন তার পুত্র নবীন মাস্টার। নবীন মাস্টারের পর তার স্ত্রী দল চালাতেন। যা, ‘বউ – মাস্টারের’ দল নামে পরিচিত ছিল। কালি ও কৃষ্ণ নামে দুই ভাই অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দল চালাতেন। সমসাময়িক কালে মহেশ চক্রবর্তী ও তারকনাথ চট্টোপাধ্যায়ও দল চালাতেন। নবদ্বীপের বিখ্যাত যাত্রাদলের অধিকারী নীলমণি কুন্ডের স্ত্রীও দল চালাতেন যা ‘বউকুন্ডের যাত্রা’ নামে পরিচিত ছিল।বিখ্যাত ছাতুবাবু (আশুতোষ দেব )- র দেওয়ান ছিলেন রামচাঁদ মুখোপাধ্যায়, তিনিও যাত্রা দল করেছিলেন। উলুবেরিয়ায় ফুলেশ্বর নিবাসী আশুতোষ চক্রবর্তী সমসাময়িক কালে বোকো ও সাধু নামে দুই মুসলমান ভাইয়েরও যাত্রাদল ছিল। এছাড়াও হাবরার মাকরদহ নিবাসী বেনীমাধব পাত্র, কোনা নিবাসী গোপীনাথ দাস, বর্ধমানের ধরণীগ্রামের নীলকন্ঠ মুখোপাধ্যায়, যশোহর জেলার কালীগঞ্জ থানার অধীন রায়গ্রামের রসিকলাল চক্রবর্তীরও যাত্রাদল ছিল।
যাত্রায় সর্বপ্রথম ঐতিহাসিক বিষয় আনেন চন্ডে পাগল বা চয়ে পাগলা। যাত্রা জগতে একটি উল্লেখযোগ্য নাম। রামপ্রসাদ, ভারতচন্দ্রের সময় কেদেলী (কেন্দুলি বা কেঁদুলি কি একই? ) গ্রামের শিশুরাম অধিকারী কৃষ্ণযাত্রায় নাম করেছিলেন।আমাদের দেশের শিক্ষিত লোকেদের মধ্যে প্রথম এদেশের চারণ কবি বরিশালের মুকুন্দ দাসই নতুনভাবে লোকনাট্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। মজার ঘটনা বৈয়াকরণ – হ্যালহেডের ভাইপো Nathaniel john halhed বর্ধমান রাজবাড়ীতে যাত্রা করেছিলেন। রাজা রামমোহন রায়ের পৌত্র রামপ্রসাদ রায়ের পুত্র হরিমোহন রায়ও কলকাতায় যাত্রাদল খোলেন। অমৃতবাজার পত্রিকার শিশিরকুমার ঘোষেরও ছিল যাত্রা দল। আনুমানিক আঠারো শতকের প্রথম দিকে শিশুরাম অধিকারী প্রাচীন যাত্রার সংস্কার সাধন করেন ও নতুন যাত্রার প্রচলন করেন। তারপর একে একে পরমানন্দ অধিকারী শ্রীদাম সুবল অধিকারী, লোচন অধিকারী, গোবিন্দ অধিকারী ও পীতাম্বর অধিকারীদের পাওয়া যায়। তাঁদের বাঁধা পালা মুদ্রণের অভাবে ছাপানো যেত না, তাঁরা সেগুলি হাতছাড়া করতেন না বা কাউকে নকল করার জন্যও দিতেন না, তাই পাওয়া দুষ্কর।
উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদ পর্যন্ত ভাসান যাত্রা, কালীয় দমন যাত্রা, বিদ্যাসুন্দর যাত্রা, নিমাই সন্ন্যাস যাত্রা, নল দময়ন্তী যাত্রা তাদের সুনাম ও জনপ্রিয়তা অক্ষুন্ন রাখতে পেরেছিল। একেবারে আদি থেকে বর্তমান কাল অবধি যাত্রার কালানুক্রমিক ইতিহাস পাওয়া কঠিন, তবে অনেকেরই মতে কেঁদুলি গ্রামের ব্রাহ্মণ শিশুরাম অধিকারী যাত্রায় প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন। সখের যাত্রারও ইতিবৃত্তের আদি কোথায় তা জানা না গেলেও কিংবদন্তি কলকাতার বউবাজারের ধনী রাধারমন চট্টোপাধ্যায় এর প্রবর্তক। সখের যাত্রাদলগুলোর মধ্যে বেলতলা ও আড়িয়াদহের দল দুটিই ছিল প্রধান। এই প্রসঙ্গেই জানিয়ে রাখি ১৮৬৭ সালে গিরিশ চন্দ্র ঘোষ, নগেন্দ্রনাথ ধর, ধর্মদাস সুর ও রাধামাধব কর প্রমুখ নাট্যরসিকেরা মিলিত হয়ে সখের যাত্রা দল গঠন করেন।
অনেকে মনে করেন প্রাচীনকালে যাত্রা সূর্যোৎসবকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছিল।পরবর্তীকালে নানার কারণে বিকৃত ও নিম্নরুচি সাহিত্যের ধারাকে প্রভাবান্বিত করেছিল। যার অবশ্যম্ভাবী প্রভাব দেশের লোকরঞ্জনের মাধ্যমের ওপরও পড়েছিল। যাই হোক ভালোমন্দের মিশেলে যাত্রা আর যাই হোক না কেন, এটুকু প্রমাণিত যে যাত্রার উদ্ভব বাংলার জাতীয় জীবন থেকে। বাংলার মাটি জল হাওয়া আকাশের সঙ্গে রয়েছে তার নিবিড় অন্তরঙ্গতা। তাই যাত্রার আসর মূলত লোকসাধারণের জন্যই। এর সত্যতা প্রমাণ হয় রবীন্দ্রনাথের লেখায়। তিনি লিখেছেন, “একদিকে বসে আছেন বাড়ির বড়কর্তারা আর যাদের ডেকে আনা হয়েছে। বাকী জায়গাটা যার খুশি যেখান থেকে এসে ভরাট করেছে। থিয়েটারে এসেছিলেন পেটে সোনার চেন ঝোলানো নামজাদার দল, আর এই যাত্রার আসরে বড়োয় ছোটয় ঘেঁষাঘেঁষি।তাদের বেশিরভাগ মানুষই ভদ্দরলোকেরা যাদের বলে বাজে লোক। তেমনি আবার পালাগানটা লেখানো হয়েছে এমন সব লিখিয়ে দিয়ে যারা হাত পাকিয়েছে খাগড়া কলমে, যারা ইংরেজি কপিবুকের মকশো করেনি। এর সুর, এর নাচ এর সব গল্প বাংলাদেশের হাট মাঠ ঘাটে পয়দা করা, এর ভাষা পন্ডিত মশাই দেননি পালিশ করে।…”
যাত্রা শুধু বাংলার মাটিতেই নয়, যাত্রা নেপালেও আছে। নেপালে নেবার জাতির মধ্যে আজও যে সকল যাত্রা উৎসব প্রচলিত আছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ভৈরবযাত্রা, গাইযাত্রা, বাঁচাযাত্রা, ইন্দ্রযাত্রা, বড় ও ছোট মৎস্যেন্দ্রনাথ যাত্রাও নেতা দেবীর যাত্রাই প্রধান। বাঁচাযাত্রার বিষয়ে একটি প্রবাদ চালু আছে। সাত বছরের এক বাঁচা কন্যা নিজেকে ‘কুমারী’ বলায়, রাজা তাকে প্রতারক বলে রাজ্য থেকে বার করে দেন। ওই দিনই রাত্রে রাণী বায়ুরোগে তাড়িত হয়ে বলেন, কন্যার দেবীত্বের কথা এবং রাজা ভুল বুঝতে পেরে, সেনা পাঠিয়ে নির্বাসিতা কুলকন্যাকে ‘কুমারী’ জ্ঞানে স্বরাজ্যে ফিরিয়ে আনেন। সেই থেকে এই কন্যার উদ্দেশ্যে এক রথযাত্রা উৎসব চলে আসছে। রাজা এই উৎসব পালনের জন্য একটি জায়গীরও দিয়ে যান এবং ওই সম্পত্তির আয়েই প্রতিবছর এই যাত্রা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ওই কন্যা নেপালে অষ্টমাতৃকাজ্ঞানে পূজিত হয়। বর্তমানে এই রথযাত্রা উৎসব প্রকৃত যাত্রায় রূপান্তরিত হয়েছে।
যাত্রা সম্পর্কে কিছু লিখতে বসলে যাঁর কথা মনে পড়তে বাধ্য আজ সেই মানুষটির সম্পর্কে সামান্য কিছু কথা জানিয়ে এবারের মতো ইতি টানবো।
ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগনার পশ্চিম পাড়া একটি সুন্দর গ্রাম, যে গ্রামে অনেক কুলীন ব্রাহ্মণের মধ্যে উকিল কাশীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন। তাঁর চার পুত্র, শ্যামাকান্ত, নবকান্ত, শীতলাকান্ত ও নিশিকান্ত। নবকান্ত ছিলেন খ্যাতনামা ব্রাহ্ম বুদ্ধিজীবী । শীতলাকান্ত জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির এক কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন।তিনি লাহোরের ‘দ্য ট্রিবিউন’ পত্রিকার সম্পাদক হয়েছিলেন। নবকান্তর উৎসাহে শীতলাকান্ত ও নিশিকান্ত ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। নবকান্তই বাংলার প্রথম কুলীন ব্রাহ্মণ, যিনি ঢাকা শহরে জুতোর দোকান খুলে নিজের কৌলীন্য ত্যাগ করেছিলেন। আসা যাক আমাদের আলোচ্য মানুষ নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের কথায়। তিনি ১৮৫২ খ্রীস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। নিশিকান্ত কৈশোরে অমরচন্দ্র বিদ্যাভূষণের চতুষ্পাঠীতে সংস্কৃত শেখেন। ১৮৬৪ তে ঢাকা শহর থেকে বৃত্তিসহ এন্ট্রান্স পাস করেন। সম্ভবত তার আগেই তিনি হেমন্ত কুমারী দেবীকে বিবাহ করেন, বলা ভালো বিবাহ হয়, যে বিয়ে বাল্যবিবাহ বিরোধী দাদা নবকান্ত,পারিবারিক চাপে আটকাতে পারেননি। নিশিকান্ত কলকাতা এসে প্রেসিডেন্সি কলেজের ফার্স্ট ক্লাসে ভর্তি হন। পরিবার থেকে পাওয়া দু তিন হাজার টাকা সম্বল করে বিলেত যান ১৮৭৩ সালে। স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ – এ ডাক্তারি পড়া শুরু করেন। তবে মন টেঁকেনি, তাই ১৮৭৪ এ জার্মানির লিপজিগ শহরে চলে যান। সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক ধর্ম অধ্যয়ন করেন। চূড়ান্ত আর্থিক অভাব হওয়ায় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ছ’শো টাকা দেন। জার্মান ভাষাটা ভালো মতো শেখার ফলে সে ভাষায় বক্তৃতাও দেন। বিষয় ছিল, রামায়ণ প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের কালক্রম, পৌরাণিক সৃষ্টিতত্ত্ব , এবং খ্রিস্টান ধর্মের উপর বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব। শেষ বক্তৃতা শুনে জার্মান পাদ্রীরা প্রচন্ড ক্ষেপে যাওয়ায় তার অবস্থা খারাপ হয়ে যায় ও তিনি রাশিয়ার সেন্টপিটার্সবুর্গ এ চলে যান। তিনিই বিখ্যাত সেন্ট পিটার্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় অধ্যাপক। পরে রাহুল সংস্কৃতায়ন সেখানে কিছুদিন অধ্যাপনা করেন। আশা করা যায় তিনি রুশ পন্ডিত ভোৎলিংক – এর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। শোনা যায় তিনি নাকি ‘জারেভিচ ‘ অর্থাৎ যুবরাজের শিক্ষক পর্যন্ত হয়েছিলেন। সে দেশের কিছু গুপ্তচর রটিয়ে দেয় যে তিনি সন্ত্রাসবাদী নিহিলিস্টদের সঙ্গে মেশেন। তার ফলে তাঁকে রাশিয়া থেকে পালিয়ে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহরে যেতে হয়। জুরিখে এসে নিশিকান্ত যাত্রা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন ও গবেষণা শেষে ডক্টরেট ডিগ্রী পান।
১৮৮৩ এর ৩ মার্চ তিনি দেশে ফিরে আসেন। সম্ভবত বাঙ্গালীদের মধ্যে তিনিই প্রথম যিনি কোন ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন! তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে এবং তাঁকে কলকাতা, ঢাকা, চট্টগ্রাম, বিক্রমপুরে সম্বর্ধনা জানানো হয়। তাঁর যাত্রা বিষয়ক বইটি ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের প্রখ্যাত ট্রাবনার কোম্পানি প্রকাশ করে। ১৮৮৯ – এ ‘বঙ্গদর্শন ‘ পত্রিকায় এবং ‘লাহোরের দ্য ট্রিবিউন’ এবং মাদ্রাজে ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকায় বইয়ের সমালোচনা বেরিয়েছিল। ‘বাল্যবিবাহ নিবারণীসভা’ দ্বারা প্রকাশিত ‘মহাপাপ বাল্যবিবাহ´ পত্রিকায় এবং দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত “অবলা বান্ধব’ পত্রিকায় নিশিকান্তর বেশ কিছু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল হায়দ্রাবাদে থাকার সময় নিশিকান্ত নিজামের দরবার অভ্যন্তরে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এবং শেষ পর্যন্ত ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এই কারণে তাঁর আত্মীয় পরিজন তাঁকে পরিত্যাগ করেন।
গবেষণা গ্রন্থের তুলনায় নিশিকান্তর বইটি আকারে যথেষ্ট ছোটই, তাই বর্তমান সময়ে এই আকারের গবেষণা গ্রন্থ, গবেষককে ডক্টরেট ডিগ্রী দেবে কিনা সন্দেহ। তবে আলোচনা বড় না হলেও যথেষ্ট অর্থবহ এবং এর তিনটি অংশ আছে। প্রথম অংশে তিনি ইউরোপে, ভারতের বাংলায় জনপ্রিয় নাটকে প্রাচীনতা বিচার করেছেন, দ্বিতীয় অংশে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সংক্ষিপ্তভাবে পর্যাালোচিত হয়েছে এবং তৃতীয় অংশে আছে কৃষ্ণকমল গোস্বামীর কৃষ্ণযাত্রা, যা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
এটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায়, নিশিকান্ত যেভাবে বাংলা যাত্রা নিয়ে গবেষণা করেছিলেন, তাঁর আগে সেভাবে আর কেউই গবেষণা করেননি। অশেষ প্রতিভার অধিকারী, সাহসী ও সংস্কারমুক্ত নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণ ঘটে ১৯১০ এর ২৫ ফেব্রুয়ারি, আঠান্ন বছর বয়সে।
দারুণ গবেষণাধর্মী এই লেখা। শুভেচ্ছা রইল দাদা।
The very next time I read a blog, Hopefully it wont disappoint me just as much as this particular one. I mean, I know it was my choice to read, however I really thought youd have something interesting to say. All I hear is a bunch of crying about something that you can fix if you werent too busy seeking attention.