২০১৮ তে জীবনের শেষ সিনেমাটি বানিয়েছিলেন। ছবির নাম the image book. ১৯৬০ সালের প্রথম ছবি ছিল breathless.ষাট থেকে আশির দশক ছিল তাঁর সৃষ্টিশীল দশক। পৃথিবীর সিনেমা প্রেমীদের কাছে অবশ্যই সৃষ্টিশীল ছবি যাঁরা দেখতে চান সেইসব মানুষদের কাছে তিনি ছিলেন, আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর অন্যতম কারণ তিনি ছিলেন বেপরোয়া, একেবারে অন্যরকম, প্রতিবাদী শিল্পী। সিনেমা শিল্পের যাবতীয় ব্যাকরণ, যাবতীয় ধারনা ভেঙ্গে দিয়ে ছিলেন। তাঁর ছবিতে ধরা বাধা গল্প থাকতো না। তিনি ক্যামেরাকে আশ্রয় করে প্রবন্ধ রচনা করতে ন। চরিত্রগুলো অনবরত যুক্তি তর্ক আর বিশ্লেষণের ঝড় তুলত।
স্বাভাবিকভাবেই তিনি প্রযোজক সংগ্রহ করতে পারতেন না। তাঁর ছবি বাণিজ্য করে না। মুনাফা অর্জন করে না। সমাজতন্ত্রের প্রচার করে। মার্কসবাদের সামাজিক অর্থনৈতিক দার্শনিক ব্যাখ্যা করে। ধণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার পোস্টমর্টেম করে। সুতরাং এইরকম একজন চলচ্চিত্র পরিচালককে লক্ষ লক্ষ টাকার ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে এসে বলবে, এই নাও শিল্পী তুমি একটি সিনেমা তৈরি কর। এটাতো হতে পারে না।
আমরা সবাই জানি যে, সিনেমার একটি বাণিজ্যিক দিক রয়েছে। এই গণমাধ্যমটি এতটাই শক্তিশালী যে প্রতিটি দেশের সরকার এবং পুঁজিবাদের সমাজের মাতব্বররা এই শিল্পটাকে কুক্ষিগত করে রেখেছে। সিনেমা এমন এক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মাধ্যম যেখান থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা তৈরি হয়। এক একটি ছোট ছোট দেশের বাৎসরিক বাজেটের অংক থেকে অনেক বেশি পরিমাণ মুনাফা এক একটি সিনেমা থেকে পাওয়া যেতে পারে। অবশ্যই সেই সিনেমাটিকে মনোরঞ্জনের সিনেমা হতে হবে। এমন একটা প্যাকেজ তৈরি করতে হবে যা মদের ব্যবসার থেকে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। এই কারণেই বুনুয়েল সাহেব বলতেন, ক্যামেরা কে বেশ করে আফিম খাইয়ে রেখেছে ওরা। তাই ক্যামেরা সত্যি কথা বলে না। সিনেমা যদি সত্যি কথা বলতে পারতো, তাহলে ধণতান্ত্রিক সময় ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যেত।
ফরাসী দেশের এই মানুষটি godard জীবনের শুরু থেকেই এইসব বিষয়গুলোকে এড়িয়ে চলা শুরু করেছিলেন। শুটিং এর আগে তাঁর হাতে সুচারু ভাবে লেখা কোন চিত্রনাট্য এর খাতা থাকত না। দুটি কাগজে তিনি তাঁর মতো করে ছবির আইডিয়া লিখে রাখতেন। কি কি শট নেওয়া হবে, কোন কোন দৃশ্যবস্তুকে গ্রহণ করা হবে এইসব ভাবনাগুলো তাঁর মাথায় থাকত। চিত্রনাট্যের গুরুত্ব, অপরিহার্যতা তিনি স্বীকার করতেন না। এই রকম কথা আমাদের ঋত্বিক ঘটক মশাই ও বলতেন। চিত্রনাট্যের নিজস্ব কোন শক্তিশালী ভূমিকা নেই। ওটা পরিচালকের মস্তিষ্কে বসবাস করে।
প্রথম ছবি নির্মাণ করার সময় একটা ক্যামেরা ভাড়া করতে পেরেছিলেন। ক্যামেরাকে স্থাপন করবার জন্য কোন ট্রাই পয়েট তাঁর ছিল না। শহরের রাস্তার রাস্তায় ঘুরে, ন্যাচারাল আলোতে ঘটমান জীবনের ছবি তুলতেন। অনেক সময় তাঁর ছবিতে নির্দিষ্ট পেশাদার অভিনেতা অভিনেত্রীও থাকতো না। নিজেই ছবির সম্পাদনা করতেন। কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে অপারেট করতে গিয়ে অনেক সময় ছবিতে কম্পন এসে গিয়েছিল। কারণ তিনি হাঁটতে হাঁটতে শট নিচ্ছেন। ট্রলি বা ক্রেন ভাড়া করতে পারেন নি। টাকার অভাবে তাঁর ছবিতে অনেক সময় পালিশ থাকতো না। আমরা যাকে বলি কালার কারেক্শন, সাউন্ড করেকশন এইসব দিকগুলো অবহেলিত থাকতো।
পরবর্তীকালে এই মানুষটিকে অনুসরণ করে ইউরোপে একদল তরুণ চলচ্চিত্র শিল্পী এসেছিলেন যাদেরকে বলা হতো অভাগা আন্দোলনের প্রজন্ম। এদের ছবিতে ফ্রেম এর মধ্যে অনেক সময় বুম ঢুকে পড়তো। অবাঞ্ছিত শব্দ, অবাঞ্ছিত অবজেক্ট থেকে যেত। এরা এই সবগুলো থেকে সতর্ক থাকতেন না। এরা বলতেন, আমরা দর্শকদের বোঝাতে চাই, ছবিতে যা দেখছো সেটাই বাস্তব। পরিচালকের দ্বারা সাজানো গোছানো কোন দৃশ্য নয়। আমরা সিনেমার মধ্যে কোনরকম ইলুয়েশন, কোনরকম অবাস্তব স্বপ্ন গুঁজে দিতে চাই না। বাস্তবের পৃথিবীতে অতি বাস্তব করে তুলতে চাই না। প্রত্যক্ষ বাস্তবকে উলঙ্গ ভাবে ব্যবহার করতে চাই। দর্শককে বলা হত, তুমি যা দেখছো সেটা রঙিন জগত নয়। বাস্তবের বিভ্রম নয়। তুমি সিনেমা দেখছো। এখানে পরিচালক তার নিজস্ব কিছু কথা বলতে চাইছেন। তুমি ছবি দেখার পর ভাবো, তর্ক কর। বিতর্কের ঝড় তোলো। তোমার মতামত আরোপ করো। মনোরঞ্জনের আয়োজন ঘটিয়ে যেসব বাণিজ্যিক ছবি তৈরি হয়, সেটা মিথ্যার জগত। বাস্তবের থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে ওইসব সিনেমা। দর্শককে বিভ্রান্ত করে। বাস্তব সত্যকে অস্বীকার করে।
এটাই হলো মার্কসবাদীদের দর্শন।
Godard সাহেব ছিলেন ওইসব বাস্তববাদী তরুণ তুর্কি চলচ্চিত্রকারদের পথপ্রদর্শক। প্রচলিত কালচারের ধারণাটাকে তিনি তাঁর ছবিতে উল্টে দিচ্ছেন। তিনি বলছেন যারা দেহ বিক্রি করে তারাই কি পতিতা? যারা রাষ্ট্রের কাছে নিজেদের মেধা, বুদ্ধি বিবেক বিক্রি করেন তাহলে তারা কি? তিনি বলছেন, রাষ্ট্র বেশ্যাবৃত্তির জন্য লাইসেন্স প্রদান করে। রাষ্ট্র সভ্য মানুষকে নেশার বস্তু যুগিয়ে দেয়। রাষ্ট্র হল অপরাধী তৈরি করবার একটা কারখানা। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে কেন্দ্র করে অসংখ্য বাণিজ্যিক সিনেমা তৈরি হয়েছে দেশে দেশে। ওই সব সিনেমা থেকে আমরা পাই জাতীয়তাবাদের আবেগ, বীরত্বের গরিমা, এবং যুদ্ধের বীভৎসতা জনিত ভয় এবং আতঙ্ক। গদার এর বাইরে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে বস্তুগতভাবে দেখাতে চাইলেন। আবেগহীন ভাবে ভাবাতে চাইলেন। ভয় কিংবা বীরত্ব ব্যাপারটাকে তিনি গুরুত্ব দিলেন না। স্বল্প পরিসরে গদারকে নিয়ে আলোচনা করা অসম্ভব। ফেলিনি, ট্রুফ, বার্গম্যান, আন্তনিয়নি, প্রমূখ বিশ্ব বরেণ্য চলচ্চিত্রকারদের পাশে গদার নিজের পৃথক বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। চলচ্চিত্র শিল্প নিয়ে আলোচনা করতে বসলে গদারকে বাদ দিলে সেই আলোচনা সম্পূর্ণ হওয়ার নয়। দীপ্ত কন্ঠে তিনি তাঁর ছবিতে বলছেন, we are all all all living more or less in a state of prostitution.
সত্যজিৎ রায়ের মতো আরো অনেকে বলেছেন, গদার এর সিনেমা, পরিচালকদের জন্য। ইউরোপের শিক্ষিত দর্শকদের জন্য। ভারতবর্ষের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর অশিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিতদের জন্য নয়। জার্মান রাষ্ট্র ব্যক্তিত্ব ব্রেখট সাহেবের থিয়েটার সম্পর্কে একই কথা বলে গেছেন উৎপল দত্ত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্য যেমন হাতে গোনা সাহিত্য প্রেমীদের কাছে প্রয়োজনীয় মনে হয়। মানিক সাহিত্য আজও জনপ্রিয় হতে পারে না কারণ আমাদের অশিক্ষা। জনপ্রিয় সিনেমা, গল্প, উপন্যাস, নাটকের বাণিজ্যিক প্রচারের পেছনে আমরা দৌঁড়াই। কর্পোরেট মিডিয়া, কর্পোরেট লবি আমাদের রুচি, শিক্ষা, বোধ, চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করে। এই কারণেই ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন এর সিনেমা জনপ্রিয় হতে পারে না। সত্যজিৎ রায় ও সেই অর্থে জনপ্রিয় নন। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ছবি এদেশে প্রদর্শিত হয় না। আগে বিদেশে নাম করে এলে, পুরস্কার নিয়ে এলে মুখে হাসি দেখা যায়।
সত্যজিৎ রায় ইতালির পরিচালক দেসিকার ছবি বাই সাইকেল থিপ দেখে নিও রিলিজমের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ছিলেন। ভারতীয় দর্শকদের কথা ভেবে তিনি বলতেন, এখানে সিনেমা করতে গেলে আমাকে গল্পের আশ্রয় নিতে হবে। নাটকের আশ্রয় নিতে হবে। সেন্টিমেন্ট আর বুদ্ধিদীপ্ত প্রকাশ কৌশলের মধ্যে দিয়ে দর্শকের মন জয় করতে হবে। সেই কারণেই তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্রকারদের নির্দেশ করেছিলেন, গদার আমাদের কাছে অহংকার। তবে এই দেশে তাঁকে অনুসরণ করলে ভুল হয়ে যাবে। চলচ্চিত্রের তরুণ প্রজন্মের কাছে কয়েকটি কথা বলতে হবে। একটা সিনেমা বানিয়ে ফেলা আজকের দিনে খুব একটা হাঙ্গামার ব্যাপার নয়। কিন্তু কেন ক্যামেরা কে গ্রহণ করবেন, ক্যামেরা দিয়ে কি বলতে চাইছেন, কাদের জন্য আপনার সিনেমা তৈরি হবে এইসব কথাগুলো সবার আগে পরিষ্কার হওয়া দরকার। তারপর যে কথাটা বলতে হবে, একটা সিনেমা নির্মাণ করতে গেলে টেকনোলজি ও অনেক রকম যন্ত্রের সাহায্য নিতে হয়। আপনারা জেনে রাখুন, শুধুমাত্র একটা ক্যামেরা আশ্রয় করে পৃথিবীতে অসংখ্য সিনেমা তৈরি হয়েছে যার মূল্য অসীম। বড় বড় উৎসবে সেইসব চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়েছে। জয় করে নিতে পেরেছে রসিক মানুষদের। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও অর্জন করেছে। গদার এইসব অন্য ধারার চলচ্চিত্রকারদের পথিকৃৎ। ক্যামেরা সম্পর্কে গদার বলছেন, ক্যামেরা তো শুধু একটা অবিকল প্রতিরূপ নির্মাণের যন্ত্র নয়, সিনেমা হচ্ছে শিল্প ও জীবনের মাঝখানে একটা কিছু।