জীবনকে চিনেছে নতুন করে সোহম | পর্ব – ২৯

বিজয়কুমার দাস 

বেলঘরিয়ার ছেলে সোহম। নব্বই দশকে তার বেড়ে ওঠা। তখন পাড়ায় পাড়ায় সংস্কৃতি চর্চার একটা রেওয়াজ ছিল। এলাকার মানুষকে নিয়ে কিছু সংগঠন অথবা কিছু সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ নানা ধরণের অনুষ্ঠান করতো। তাতে যোগ দিত সব বয়সের মানুষ।সোহম সরকারের পাড়ায় রবীন্দ্র – নজরুল জয়ন্তী হতো। সেখানে নাটকও হতো। পাড়ার ছেলেমেয়েরাই নাটকে অংশ নিত। সোহমও সেই নাটকে অভিনয় করতে গিয়ে প্রথম মঞ্চে নেমেছিল। কিন্তু সোহম কি তখন জানত, এই মঞ্চ আর নাটক তার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যাবে?…
না জানলেও জড়িয়ে গেল। শঙ্করলাল সরকার আর অর্চনা সরকারের ছেলে সোহম হয়ে উঠল বাংলা থিয়েটারের উজ্জ্বল সম্ভাবনার দীপ্ত মুখ।

২০১০-১১ সাল থেকে সে গ্রুপ থিয়েটারের নির্ভরযোগ্য অভিনেতা।
পড়াশুনো বেলঘরিয়াতেই। হরদয়াল নাগ আদর্শ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ শেষ করে ভৈরব গাঙ্গুলি কলেজ থেকে বাণিজ্যের স্নাতক সোহম বাণিজ্যের পথে না হেঁটে উঠে গেল থিয়েটারের মঞ্চে। বাণিজ্যটা তার শিক্ষাগত যোগ্যতার একটা মাপকাঠি হয়েই থেকে গেল।ঝুঁকে পড়ল থিয়েটারের দিকে।
অবশ্য বয়স যখন সবেমাত্র ন’ বছর তখন (১৯৯৫ সাল) রবি ঠাকুরের “একান্নবর্তী ” তে প্রথম অভিনয়। সে তো ছিল নেহাৎ শখ করে।কিন্তু পরবর্তীতে অভিনয় শুরু করল সোহম থিয়েটারকে ভালবেসে। এই মাধ্যমটার প্রতি কোথাও একটা গোপন ভালবাসা জমেছিল হয়তো।
কিন্তু কেন থিয়েটারে?… সে প্রশ্নের উত্তরে সোহম বলে, “এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর সত্যিই জানি না। হয়তো কোনদিন এর উত্তর পাব।সেই খোঁজই চলছে।”…

এখন শুধুই থিয়েটারে অভিনয় নয়, গ্রুপ থিয়েটার করতে এসে সে অনুভব করেছে আগে একজন নাট্যকর্মী হয়ে উঠতে হয়। তাই দলের সব কাজেই হাত লাগায়। এভাবেই তার থিয়েটার যাপন।
থিয়েটারের প্রথাগত ডিগ্রী তার পকেটে নেই।তবে বিভিন্ন কর্মশালায় যোগ দিয়ে থিয়েটারের পাঠ নিয়েছে। আক্ষেপ একটা আছে। ২০১৩ সালে মিনার্ভা রেপার্টারি থিয়েটারের অভিনেতা নির্বাচন কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেও চূড়ান্ত পর্বে বাদ পড়ে যায়।কিন্তু হাল ছাড়েনি সোহম। ছাড়েনি থিয়েটার।কারণ তার মনে হয়, থিয়েটার তাকে আত্মবিশ্বাসী করেছে। নিজেকে চিনতে শিখিয়েছে। ব্যক্তিত্ব গঠনে সহায়ক ভূমিকা নিয়েছে।

থিয়েটারের পাশাপাশি একটা অন্যরকম কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে।আসলে থিয়েটারকে রুটিরুজির মাধ্যম হিসাবে বেছে নিয়ে বেঁচে থাকা সহজ নয়, এই বোধ থেকেই অন্য কাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা। মৌহারি ও স্যাস পাবলিশার্স প্রকাশনায় সহকারী হিসাবে নিজেকে যুক্ত রেখেছে থিয়েটারে অভিনয়ের পাশাপাশি।

থিয়েটারের জন্য কি নিজেকে তৈরি করতে হয়?… এমন প্রশ্নে একটুও না ভেবে দক্ষ ব্যাটসম্যানের মতো কঠিন বল ট্যাকেল করার দক্ষতায় সে বলে, মানুষ হিসাবে আসলে আগে তৈরি হতে হয়। একজন মানুষ যে চারপাশটা দেখে, জীবনটাকে প্রতি মুহূর্তে বাইরে থেকে এবং ভেতর থেকে দেখে, নিজের সমাজটাকে দেখে, রাজনীতি ও সময়কে দেখে – এই দেখাটাই আসল চর্চা। এটা নিরন্তর একটা শেখা। অবশ্য এই থিয়েটারের পথে বিচরণের ক্ষেত্রে মা – বাবা তার কাছে প্রাণিত শক্তি। সাহস জুগিয়েছেন তাঁরাই।

যাদবপুর মন্থন দলের সঙ্গে তার প্রাণের যোগ।এই দল প্রতি বছর “সামসারা”নামে থিয়েটারের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিষয়ভিত্তিক কর্মশালা করে থাকে। অতিমারি পরিস্থিতিতেও প্রতিপার্থিব মাধ্যমে এই কর্মশালা হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন প্রশিক্ষকের কাছে থিয়েটার শিখেছে সোহম।
শুন মনসা কথা, ছেদবিন্দু, আগুনপাখি, দু-ছক্কা পাঁচ, অর্ধেক আকাশ, সিংহাসনের ক্ষয়রোগ, সওদাগরের নৌকা, যুগপুরুষ, অ-সুখ, ইলা, মোকাম্মেলের অমিতাভ, নক্সীকাঁথার মাঠ, ত্রিকাল, অদভূত প্রভৃতি নাটকে নানা ধরণের চরিত্রে অভিনয় করেছে।এর মধ্যে নান্দীমুখ দলে সিংহাসনের ক্ষয়রোগ, সংসৃতি দলে সওদাগরের নৌকা, শ্রীমদ রাজচন্দ্র মিশনে যুগপুরুষ, মাচার মানুষ দলে অ-সুখ নাটকে এবং বাকি নাটক যাদবপুর মন্থনের প্রযোজনায়। যাদবপুর মন্থন দলে রাজীব বর্ধন সহ অন্যান্য দলে সুমন্ত রায়, অর্পণ গড়াই, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, অশোক চট্টোপাধ্যায়, জনার্দন ঘোষ, রাজেশ যোশি, সন্দীপ চট্টোপাধ্যায়, সুচরিতা বড়ুয়া চট্টোপাধ্যায় প্রমুখকে পেয়েছেন পরিচালক হিসাবে।
সোহম সরকার দীর্ঘ একটা সময় থিয়েটারে থেকেও বলতে পারে, শিখছি। অবিরত শিখছি। থিয়েটারেও শিক্ষার শেষ নেই।

7 thoughts on “জীবনকে চিনেছে নতুন করে সোহম | পর্ব – ২৯

  1. লড়াই জারি থাক সোহমের মত থিয়েটারের সৈনিকদের।অমল আলোয় উদ্ভাসিত এই মুখগুলি হয়ে উঠুক থিয়েটারের আগামী দিনের দায়বদ্ধ থিয়েটারকর্মীর মুখ। জয় হোক এইসব মুখগুলির।

  2. অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই অমল আলো জার্নাল তথা অশোকনগর নাট্যমুখকে এবং বিজয় দা কে এমন প্রেরণা জোগানোর জন্য।

    1. আমাদের পক্ষ থেকে অনেক অনেক ভালোবাসা সোহম। আমাদের কাছে সারপ্রাইজ ছিল। এ সংখ্যায় ফোকাসে কে আসছেন! এক চেনা মুখ যখন মঞ্চের আলোয় দেখি বড় অচেনা লাগে। তোমার যে কটি অভিনয় দেখেছি এবং তোমার সাথে একটা ছোট্ট কাজ করতে গিয়ে দেখেছি চরিত্রের মধ্যে কিভাবে সংযম করো। পাশাপাশি তোমার লেখার হাত ভারি চমৎকার। অলম আলোর জন্য নাটক বিষয় বই নিয়ে আলোচনা লিখে আমাদের দিও। ভালো থেকো। আরো উন্নতি হোক থিয়েটারে তোমার।ভালোবাসা নিও।

Comments are closed.