প্রবন্ধ, ইতিহাস, রাজনীতি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, স্ল্যাং, যৌনতা, অজাচার এবং আরও বিভিন্ন বিষয় অভিনবত্বে বৈচিত্র্যের অতীব বিস্ময়কর গদ্যের স্রষ্টা এবং বাংলা গদ্যের প্রথাগত ধারা থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী গদ্য প্রযুক্তির প্রবর্তক ; লব্ধপ্রতিষ্ঠ বিতর্কিত এবং দুর্দান্ত প্রতাপ লেখকের নাম – অজিত রায়। যাঁকে কলকাতার তথাকথিত কবি-লেখকেরা আদৌ মেনে নিতে পারেননি! কেননা তিনি যা জানতেন, দেখতেন বা উপলব্ধি করতেন— তাই- ই তিনি লিখতেন। তথাকথিত কবি-লেখকদের মত যে তিনি কোন ঝোলাঝুলি ব্যবহার করতেন না! এ’যুগের সবদিক থেকে উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘যোজন ভাইরাস’ সহ ২৮টি উপন্যাস রচয়িতা এবং কমপক্ষে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৫৭ টি। আমৃত্যু সম্পাদনা করে গেছেন এক ভিন্ন মেজাজের ভিন্ন স্বাদের পত্রিকা ‘শহর’।
কথা সাহিত্যিক অজিত রায় দীর্ঘ চল্লিশ বছরেরও অধিক সাহিত্য সাধনায় নিমগ্ন থেকেছেন। আটের দশকে কবিতারই হাত ধরে তাঁর সাহিত্যে প্রবেশ। ১৯৮৩ সালে ‘অথচ প্রকাশনী’ থেকে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়- ‘অকবিতা’। অবশ্য সাহিত্যের প্রতি প্রেম ছিল তাঁর ছোট বয়স থেকেই। ছাত্র জীবনে স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে মিলে ‘অনন্যা’ নামের একটি কবিতা প্রকাশ করেন তিনি। প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর, আটের দশকের সম্ভাবনাময় তরুণ কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন অজিত । আটের দশকেই ১৯৮৬ সালে ‘আটজন অহংকারী’ নামে একটি কবিতা সংকলনে, প্রতিষ্ঠিত কবিদের পাশাপাশি অজিত রায় এর আটটি কবিতাও স্থান পায়। যে কবিতাগুলি সমালোচক এবং পাঠক মহলে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। আটের দশকে বিভিন্ন নামি দামি পত্র-পত্রিকায় অজিতের অসংখ্য কবিতা প্রকাশিত হবার পরও কবিতা থেকে সম্পূর্ণ সরে গিয়ে, গতানুগতিক সাহিত্যের ভাষা থেকে বেরিয়ে অন্যরকম কাজ করতে চেয়ে অজিত নিজেকে কেবলমাত্র গদ্যসাহিত্যেই কেন্দ্রায়িত করে নিয়েছেন। কবিতাকে ছেড়ে গদ্য সাহিত্যকে আশ্রয় করে নিলেও প্রতিটি ছোট-বড় গদ্যে তাঁর কাব্যিকভাবকল্পই অনুভাবিত হয়।
অজিত রায়ের রচনার বহুমাত্রিক চরিত্র এবং স্বীয় বৈশিষ্ট্যের স্বতন্ত্র স্বকীয়তা বাংলা গদ্য সাহিত্যের ব্যতিক্রমী স্রষ্টা আটের দশক থেকেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এক নাগাড়ে নিষ্ঠার সাথে লিখে গিয়েছেন – ‘তাঁইশ’, ‘মাস্টার’, ‘অরন্তুদ’, ‘একটি গরুর গল্প’, ‘সংবিত্তি’, ‘অনার্য সাহিত্য’, ‘শিলাদিত্য’, ‘পরাভব’, ‘সন্ধিজীবক’, ‘কৌরব’, ‘গোধূলি মন’, ‘কয়লা সোনা সোনাম্যাডাম ও কালাসোনা’, ‘মায়ের শ্রাদ্ধ’র মতো অসংখ্য ছোট গল্প। কিন্তু কেবল উপন্যাসেই মনোযোগী হয়ে ওঠার কারণ, ২০১৯ সালে ন’টি গল্প নিয়ে ‘বাছাই গল্প’ নামে আজ পর্যন্ত একটি মাত্র গল্পগ্রন্থ ছাড়া, আর কোনও গল্পগ্রন্থ তাঁর প্রকাশিত হয়নি। ১৯৮৮ সালে প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয় ‘দোগলা চরিত’। তাঁর প্রথম উপন্যাস বা প্রথম দিকের লেখায় সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের প্রভাব থেকে গেলেও, ১৯৮৮ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত এই চার বছরের তাঁর নিজের নিবিড় অধ্যয়নের প্রক্রিয়ায় তা সহজেই কাটিয়ে ওঠার পর; ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাস ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’। ধানবাদের দৈনিক হিন্দি সমাচার পত্র ‘আওয়াজ’ এ নিয়মিত লেখালেখি করতেন, এরই মাঝে ১৯৯৬ সালে লিখলেন ধানবাদের ইতিহাস নিয়ে ‘ধানবাদ ইতিবৃত্তি’। এই উপন্যাস ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হবার পর ধানবাদ জনসমাজে প্রবল ঝড় তুলে দেয়। সেই ঝড়ের আঁচ অজিতের ব্যক্তিগত জীবনেও এসে পড়ে। সাহিত্যের অন্যতম এই সৃষ্টির জন্য অজিত রায়ের উপর আত্মঘাতী হামলাও হয় এবং তিনমাস ঘরছাড়া হয়ে থাকতে হয় তাঁকে। অন্যতম এই সৃষ্টির জন্য অজিত রায়কে তাঁর অ্যাকাউন্টেন্টের চাকরিটিও খোয়াতে হয়েছিল। স্বভাবতই আর্থিক দুরবস্থার শিকার হন অজিত । তিন মাস ঘরে বসে থাকবার পর সাহিত্যকেই একমাত্র রুজিরুটি হিসেবে বেছে নিয়ে ফুল টাইমার হয়ে লেখালেখির জগতে নিজেকে মনোনিবেশ করেন । তারপর ২৫ বছর আর ফিরে তাকাননি কোন দিকে। আমৃত্যু থেমে থাকেনি তাঁর কলম। প্রভাব কাটিয়ে উঠবার জন্য বহুভাষিক টেস্কটের পূর্বে ১৯৯৭ এ পরীক্ষামূলক একটি গদ্য সৃষ্টির অভিজ্ঞতা প্রকাশিত হয় – ‘পাপরাৎজি’।
অজিত রায়ের সাহিত্যের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধকে ভেঙেচুরে দেওয়া। যার কারণে বরাবর নিন্দিতও হয়েছেন তিনি। অজিত রায়ের খোলামেলা লেখার সামনে পাঠক ইতস্তত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর ব্যতিক্রমী কাজকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় থাকে না। পাঠক তাঁর সাহসের নিন্দা করুন অথবা প্রশংসা, তাঁর সৃষ্টিকে এড়িয়ে যাওয়াটাও মুশকিল।
যে শিক্ষিত সম্প্রদায় সত্যি কি তা’ জানে, বোঝে কিন্তু জীবনকে বরণ করে নিতে কুন্ঠা বোধকরে, মনের গোপনে লোকচক্ষুর আড়ালে, যে সত্যের জন্য লজ্জায় মাথা নত করে নেয়; বাইরে জনসমাজের মাঝে তা স্বীকার করবার সাহস রাখেনা, সে কেমন করে সমাজের মাঝে সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে– এমনই মনোভাব পোষণ করে ১৯৯৮ সালে অজিত রায় পাঠকদের এক নতুন গদ্য ভাষাকে প্রত্যক্ষ করিয়েছেন তাঁর ‘যোজন ভাইরাস’ বা ‘জোখিম কোরকাপ’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে। সভ্য মানুষের ভিতর লুকিয়ে থাকা পাশবিক চরিত্রগুলিকে যেভাবে তুলে ধরেছেন তিনি, তাতে সত্যিই চমকে উঠতে হয়। মানব অস্তিত্বের তার সাবকনশাস্ এর অন্ধকার দিকটাকে মাথায় রেখে, মনস্তাত্ত্বিক প্রস্থানকে কেন্দ্র করে রচিত এই উপন্যাসে; মানব জীবনের যৌন আকাঙ্খার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতে গিয়ে কখনও হোঁচট খায়নি তাঁর কলম। বরং বলা যায় এই উপন্যাস পড়লে পাঠক একটি তুরীয় বিন্দুকে স্পর্শ করবে।
‘মায়ামঘর’, ‘হিরান্য রেতাঃ’, ‘ম্যাওড়া জোন’ , ‘কারগিল হাসিলের দিনগুলি’, ‘পাগলনামা’ ‘পাতিনাওয়েসিস’, ‘ধান কাঠের তয়খানা’, ‘দামুন্ডা চারের কালীক পুরাণ’, ‘ঘামলা ঘাট’ এর মতো ২৮ টি উপন্যাস লিখে গিয়েছেন অজিত এবং ২৮ টি উপন্যাসই তাঁর নিজস্ব গদ্য ভাষার নির্মাণ ও বিনির্মাণ। মানুষ তাঁর সৃষ্টি গ্রহণ করবেন কিনা, তাই নিয়ে কখনো ভাবেনওনি তিনি। কেবল অনর্গল লিখে গিয়েছেন সৃষ্টির আনন্দে। সত্যের সাহসে। বলা ভালো, উপন্যাস থেকে শুরু করে কবিতা, ছোট গল্প, আত্মজীবনী, প্রবন্ধ, চলচ্চিত্র পটকথা, গবেষণাধর্মী রচনা, সম্পাদনা এবং অনুবাদ সাহিত্যে ভাষার রহস্যকে নতুন করে চিনতে শিখিয়েছেন তথা বহুবিধ সাহিত্যতাত্ত্বিক প্রকল্পে সর্বদা অগ্রণী ভূমিকা নিভিয়েছেন অজিত রায়।
অনুবাদ সাহিত্যর মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত লেখক রমেশ চন্দ্র শাহ্ বিরোচিত ‘কিসসা গুলাম’ এর ২০০০ সালে অজিত অনূদিত মনস্তাত্ত্বিক অন্তর দ্বন্দ্বের জটিলতার কাহিনী ‘দাস কাহিনী’। দুই ব্যতিক্রমী ভাবনা ও ভাষা নিয়ে ১৯৯৭ সালে থেকে আমৃত্যু সম্পাদনা করেছেন ‘শহর’ পত্রিকা। ৪৬ টিরও অধিক সম্পাদিত পত্রিকা সংখ্যায়, পত্রিকার চরিত্র থেকে কখনো কোনোও বিচ্যুত হয়নি। ভিন্ন ধারার লেখালেখি নিয়েই প্রকাশিত হয়েছে শহর। এমন এমন বিষয় নিয়ে সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে, যা নিয়ে আলোচনা সাধারণত এড়িয়ে যাওয়া হয়। বাংলা সাহিত্যের তথাকথিত মূলধারার বাইরে যে বিকল্পধারা সাহিত্য তার ইতিহাস রচনা ‘শহর’ পত্রিকার সংখ্যাগুলির মূল্যায়ন ছাড়া অসম্পূর্ণ। অজিত রায়ের সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে ১৯৯৯ ‘হাংরি সাক্ষাৎকার মালা’, ২০০৫ ‘ছোটলোকের শব্দলোক’, ২০০৮ ‘ধানবাদের বাংলা কবিতা’ প্রমুখ। গবেষণামূলক– ২০০৭ থেকে ২০০৯ তিন খন্ডে ‘ধানবাদের বিশিষ্ট বাঙালি’, ২০০৯ ‘ঝাড়খন্ডে নেতাজী সুভাষ’, ২০০৫ ‘ছোটলোকের শব্দলোক’ ২০১২ ‘বাংলা স্ল্যাং সমুচর ঠিকুজি কুষ্টি’।
অথচ সাহিত্যের এমন স্রষ্টার জীবন অতিবাহিত হয়েছে কেবলই অভাব দুর্বিসহ কষ্ট এবং অসহনীয় যন্ত্রণার সাগর সাঁতরে …
যে ধানবাদ শহর একসময় বাংলার সীমানার মধ্যেই ছিল, যেখানে বহুসংখ্যক বাঙালির বসবাস ছিল। মানভূম আন্দোলনের সময় থেকে বাংলার সাথে ধানবাদ শহরের দূরত্ব তৈরি হয় এবং বিহারের অন্তর্ভুক্ত হয় ধানবাদ। বর্তমানে ঝাড়খন্ডের অন্তর্গত আমার মত’ই সেই ধানবাদের ভূমিপুত্র অজিত রায়। যেখানে আমার জন্ম তৎকালীন বিহারের ধানবাদ সেন্দ্রাকোলিয়ারীতে এবং আমার থেকে আট বছরের অনুজ অজিত রায়ের জন্ম ধানবাদ শহরের সি এফ আর আই কলোনিতে ১৯৬২ সালের ১৫ জানুয়ারি। ধানবাদ উভয়ের জন্মভূমি হবার কারণে আন্তরিক ব্যক্তিগত আলাপচারিতা এবং বন্ধুত্বও ছিল ভিন্ন মাপের। রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি হাসিল করবার পর আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন অজিত। লম্বা রোগা পাতলা সুঠাম চেহারার কঠিন ব্যক্তিত্ববাদী মানুষটির ভেতরে সাহিত্য সৃষ্টির এক অজিব শক্তি লুকিয়ে ছিল, যা দেখে ধানবাদ ইউনিভার্সিটি তে এম এ পড়বার সময়কালীন অজিতের প্রেমে বিভোর হয়ে যায় ভিনভাষী গিরিডি নিবাসী ঝাড়খণ্ডী তন্বী প্রেরণা । উভয়ের মাঝে ধীরে ধীরে নিবিড় প্রেম সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং পরবর্তীকালে প্রেরণার সাথেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন অজিত। চাকরি করেন ধানবাদে একটি কয়লা মার্চেন্ট অফিসের অ্যাকাউন্টেন্ট হিসাবে আর প্রেরণা একটি বিউটি পার্লার পরিচালনা করে দুজনের জীবন চলছিল। বাংলা হিন্দি এবং ইংরেজিতে নিপুণ অভিজ্ঞতা থাকার কারণে ধানবাদের আইনজীবীরাও তাঁর কাছে তাদের আইনি বয়ান লেখাবার জন্য আসতেন। কালে কালে জন্ম হয় কন্যা সন্তানের। বড় ভালোবেসে আদরে নাম রাখেন -স্নেহা। ১৯৯৬ সালে রচনা করেন ‘ধানবাদ ইতিবৃত্তি’ আর তারপরেই হাসিখুশি সুখের জীবনে ঘটে যায় এক অনর্থ। পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত জীবন অভাবনীয় দুঃখ অসহায়তা আর্থিক অস্বচ্ছলতায় ভেঙে পড়ে চলমান জীবন। এমত অবস্থায় ১৯৯৬ সালেই পরিচয় হয় তৎকালীন ধানবাদ স্বাক্ষরতা আন্দোলনের সচিব কাশীনাথ চট্টোপাধ্যায় এর সাথে। শ্রী চট্টোপাধ্যায়ের কাছে অজিত রায়ের যাতায়াত হতে থাকে এবং স্বাক্ষরতা আন্দোলনের উপর একাধিক গদ্য রচনা করেন। শ্রী চট্টোপাধ্যায় সর্বতোভাবে অজিতের পাশে দাঁড়ান। উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। অজিত ধীরে ধীরে লেখার দুনিয়ায় সম্পূর্ণ ব্যস্ত হয়ে পড়েন আর প্রেরণা বিউটি পার্লারের কাজ করে সংসারের খরচ চালায়। এভাবেই অভাবের মধ্যেও সংসারে স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কিন্তু ১৯৯৮ সালে প্রেরণা হঠাৎ করে বড়লোক হবার স্বপ্ন দেখে, আর অজিত এমন হঠাৎ করে ধনী হওয়া থেকে দূরে থাকতে চায়। বিরোধ করে একটা নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হয় প্রেরণা আর তখন থেকেই শুরু হয় মতবিরোধ, ঝগড়া অশান্তি। তার মাঝেই কন্যা স্নেহা বড় হতে থাকে। এই অশান্তির মাঝেই তিন খন্ডে লিখে শেষ করেন ‘ধানবাদের বিশিষ্ট বাঙালি’। অজিত কন্যা স্নেহা বড় হয়ে ওঠে এবং মায়ের সাথেই অজিত রায়ের প্রতি দুর্ব্যবহার করতে থাকে। এমনকি বাবাকে থাপ্পর এবং শারীরিক প্রহার করতেও দ্বিধা দ্ব্যর্থতা নেই স্নেহার। অজিত রায় কে লেখালেখি থেকে বিরত থেকে আর্থিক উপার্জনের উপায় খুঁজতে চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। কিন্তু অজিত সমস্ত রকম অত্যাচার সহ্য করে সৃষ্টির মাঝেই নিজেকে অধিক ব্যস্ত করে চলেন।
ভারত জ্ঞান বিজ্ঞান সমিতি দ্বারা পন্ডিত ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম বার্ষিকীর আমন্ত্রণে ২০২০ র ২৯ সেপ্টেম্বর শ্রী চট্টোপাধ্যায় এবং অজিত রায় কার্মাটারের উদ্দেশ্যে রওনা হন। জামতাড়া থেকে দুমকা চলে আসেন ভারত সেবা আশ্রম অনাথ শিশু স্কুলে, দু’জনে ওখানেই থেকে যান। ওই সময় অজিত রায়ের স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন, প্রতি দিন রাতে অজিত রায় কন্যার কাছে ফোন করে স্ত্রীর অসুস্থতার খবর নিতে থাকেন আর কন্যা তার সাথে প্রতিনিয়ত দুর্ব্যবহার করতে থাকে। ফিরে আসেন অজিত। প্রেরণার শরীর ধীরে ধীরে খারাপের দিকে যেতে থাকে। অজিত ধানবাদ ফিরে আসেন। লাগাতার স্নেহার দুর্ব্যবহার স্ত্রীর অসুস্থতা আর এমন অভাবের তাড়নায় অজিত কিমকর্তব্যবিমূঢ় ফেসবুকের শরণাপন্ন হয়ে বন্ধুদের কাছে সাহায্যের হাত বাড়ান। কোন উপায় না দেখে পুত্রী স্নেহাকে জ্ঞান বিজ্ঞান মঞ্চের কার্যালয়ে রেখে, তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে রাঁচিতে রওনা হন। শ্রী চট্টোপাধ্যায় রাঁচিতে তাঁর স্ত্রীকে আর এম সি এইচ হাসপাতালে ভর্তি, অজিতের থাকবার এবং স্ত্রীর চিকিৎসার সমস্ত ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু হাজার প্রচেষ্টায়ও প্রেরণাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। আবার নিঃসঙ্গ ধানবাদ ফিরে আসেন অজিত। প্রেরণাকে হারানোর যন্ত্রণায় এবং দিন- প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে স্নেহের বিরোধ, স্নেহার অনুশাসনহীন দুর্ব্যবহারে নেশার শিকার হন, অজিত ধীরে ধীরে অসুস্থ হতে থাকেন।
সবথেকে আশ্চর্যজনক ঘটনা ২০ ডিসেম্বর ২০২১ অজিত রায়ের মৃত্যুর দু’ঘণ্টা আগেও স্নেহাকে বলতে শোনা যায়, “তোমার যেখানে ইচ্ছা, সেখানে গিয়ে মরো, বাড়িতে মোরো না…”!
কিন্তু অজিত কোন অবস্থাতেই পত্নী এবং স্নেহার বিরোধ এবং দুর্ব্যবহারের কথা সার্বজনীন করতে চাননি। অজিত রায়ের সম্পত্তি বলতে চাকুরী জীবনের একটি কম্পিউটার, চারটি এলোমনিয়ামের থালা, দুটি গ্লাস, একটি ভাঙা কাঠের চৌকি, দু’জোড়া প্যান্ট শার্ট, একটা বারমুডা একটা গেঞ্জি। সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন দম বন্ধ হয়ে আসা, গুদামের মতো ছোট্ট একটি ঘরে। সব থেকে দুঃখের বিষয়, অজিতের শবযাত্রায় শ্মশান ঘাটে একটিও বিশিষ্ট বাঙালিদের যেতে দেখা যায় নি। বারবার এমন প্রশ্ন কুঁড়ে কুঁড়ে খায় — আপামর পাঠক সমাজ, অজিত রায়ের লেখা কখনও উদযাপন করেননি। মৃত্যুতে ফেসবুকে ক্ষণিক শোকপ্রকাশ দেখেছি। বইমেলায় শোকসভা করতে দেখেছি কিন্তু একশোটি পুস্তকালোচনায় অজিত রায়ের কথা আর নজরে পড়েনি। বাংলা ভাষার অন্যরকম গদ্য লেখক অজিত রায়দের মতো লেখকদের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। এত অভাব, নির্যাতন বিরোধ যন্ত্রণার ভেতর থেকেও সমস্ত ইন্দ্রিয়কে জয় করে যে মানুষেরা নিরন্তর কেবল সৃষ্টির সাধনায় নিমগ্ন থেকে যাবেন, এমন প্রজ্ঞা সম্পন্ন প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী লেখকেরা এরকম একলা কেন হয়ে যান! বারবার এমন প্রশ্ন কুঁড়ে কুঁড়ে খায় — অজিত রায়ের এমন অকাল মৃত্যু কি স্বাভাবিক মৃত্যু ? না কি হত্যা?