নৈহাটি সেমন্তী নাট্য সংস্থার একটি বহু অভিনীত নাটক কাল বিড়ম্বনা। সময়কে বঞ্চনা করে যে শ্রেষ্ঠ হওয়ার শিরোপা পেতে চায় তাকেই দুঃসময় বলে। আদৌ কি সময়কে কেউ বঞ্চিত করতে পারে নাকি নিজেই সময়ের পাকে চক্রে পড়ে বঞ্চিত হয়। নতুন এক নাট্যকার জ্যোতি মুখোপাধ্যায়ের কলমে সময় এসে ধরা দেয় আজকের সময়ের বাঁধনে। যে দেশপ্রেমের বাঁধনে আষ্ঠেপৃষ্ঠে আমরা জড়িয়ে যাই। মানবিক মুখ বধির হয়ে যায়। কালের চাকায় সততার মূল্য কতটা? সময় কি তবে অসৎ মানুষের দালালি করবে? সময় কি তবে আজীবন চোখে দেখেও কথা বলবেনা? তাকেই অসময় বলে? তবে এখন কোন সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা ? চারিদিকে অসৎ মানুষের বাস, অন্যায়কারীদের উৎপীড়ন, ধর্মে ধর্মে হানাহানি। ধর্ষণ কান্ড এক তুচ্ছ ঘটনা। আজও জাতের নামে মানুষকে নিরাশ্রয় করে সমাজের আরেক শ্রেণির মানুষ! বিস্ময়ের ডংকা বাজে চারিদিকে। কেউ তা শুনতে পায় কেউ পায় না। মানুষ তাহলে আর কবে নিজের সততার কথা বলতে পারবে? কবে আর স্বপ্ন দেখবে সবুজ সুন্দর ভারতের, কবে আর গেয়ে উঠবে সাম্যের গান! এমনই হাজার প্রশ্ন মনে জাগে কাল বিড়ম্বনা দেখে।
স্বাধীন ভারতের এক প্রবীণা মধ্যবিত্ত পরিবারের মায়ের। যার স্বামী একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। দেশের জন্য বলি দিয়েছেন নিজের জীবন। তাই মাসির শরীরে আজও দেশপ্রেমের শুদ্ধ হাওয়া বইছে। যে হাওয়ায় সমাজকে দেখতে চান সৎ ও সুন্দর। মাসির একমাত্র সন্তান তাও বিদেশে থাকে। আমরা নাটকে মাসি বলেই জানি। তার স্বপ্নে প্রতিরাতে আসা বিপ্লবী ক্ষুদিরাম তাকে মাসি বলে আবার দিনরাতের দেখভালের জন্য আয়া রাধারও ডাকে মাসি বলে । কারণ ক্ষুদিরামের অকাল মৃত্যু মাসি কিছুতেই মানতে পারেনি মন থেকে। মানুষ এত নিষ্ঠুর যে একটা আঠারো বয়সের তরতাজা যুবককে ফাঁসির কাঠে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। আজকের সন্ত্রাসী, লুঠেরা, ফেরেববাজদের অপরাধ, ধংষণকারীদের আচরণ, গরু, কয়লা চোরদের অপরাধ থেকে কি ক্ষুদিরামের অন্যায় বেশি ? মাসি এসব কাকে বলবে? এসব প্রতিবাদের বীজ কার মনে বপন করবে? বৃদ্ধা মাসিকে ডাক্তার চিকিৎসা করছে ঠিকই কিন্তু মাসির মনে যে দেশহিতৈষী মনোভাবের উদয় হয়েছে তা কে বুঝবে? কাকে সে এই বিদ্রোহের কথা জানাবে? কে বিশ্বাস করবে ক্ষুদিরামের সাথে যে প্রতি রাতে মাসির কথা হয়! চারিদিকে এত অনাচারের খবরে মাসি যেনো আরও একরোখা জিদ্দি আর অসুস্থ হতে থাকে। ডাক্তারের চিকিৎসায় কাছে মাসি সুস্থ হলেও রাধার কাছে যেনো মানসিক ভাবে বাড়াবাড়ি ধরা পরে। এসব নিয়ে বড়ই চিন্তিত রাধা। মাসির কিছু হয়ে গেলে তার কিভাবে চলবে! মাসি যে তার একমাত্র আশ্রয়দাতা। রাধার লড়াই তাই মাসিকে যেভাবেই হোক সুস্থ করতে হবে, ভালো রাখতে হবে। রাধাকে বাঁচতে হবে সুস্থ ভাবে। সেও যে বড় অসহায়। রাস্তায় সে মাথা উঁচু করে একা চলতে পারেনা। হিংস্র আগুনের মতো লেলিহান দৃষ্টিতে ভাগাড়ের শেয়ালগুলো ছিঁড়ে খেতে চায় তাকে। আত্মমর্যাদার সাথে বাঁচার কি অধিকার নেই রাধাদের? কে রুখে দাঁড়াবে এইসব অমানবিক পাষন্ডদের বিরুদ্ধে? সেও কি বন্দী হতে চেয়েছে? চায়নি। মাসি দিনকে দিন আরো মানসিক অসুস্থ হতে থাকে। যতবার মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ক্ষুদিরাম বেড়িয়ে এসে অসুস্থ সমাজের জন্য বিদ্রোহ করতে চায় ততই মাসি বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এই কঠিন সময়ে তাই মাসি ক্ষুদিরামকে নিয়ে প্রগতিবাদের লড়াই লড়তে চায়।
গল্পের প্রতিটি দৃশ্যে নাটকীয় মোচড় থাকলেও আলো সেভাবে মায়াময় করে তুলতে পারেনি দর্শকের চোখে। অযত্নের ছাপ আছে মঞ্চ ভাবনাতেও। মাসির তো অর্থের অভাব নেই তবে কি অন্যভাবে মঞ্চ নির্মাণ করা যেতো না! ঘরের মাঝ দেয়াল জুড়ে বিপ্লবীদের ছবি টাঙানো। জ্বলজ্বল করছে আলো এসে পড়াতে। দীর্ঘদিনের লড়াকু অভিনেত্রী রূপা মুখার্জির মাসি চরিত্রের অভিনয় সে-সব গ্লানি ধুয়েমুছে দিয়েছে। তবে যে কটি দৃশ্যান্তর নাট্যে আমরা দেখি তা বড় বেদনাদায়ক। মঞ্চ সজ্জার পরিবর্তন ও কলাকুশলীদের প্রস্থান ও প্রবেশ নিয়ে রীতিমতো চোখে লেগেছে। মুহূর্তেই বিশ্বাস ভেঙে গেছে । নির্দেশক অলোক মিশ্রকে একটু নজর দিতে অনুরোধ করছি। যদি শুধু মাসিই ক্ষুদিরামকে দেখতে পায় তবে খাটের তলায় ক্ষুদিরামের লুকনোর কি দরকার। যেমন আমরা একটি সঞ্জয় দত্তর হিন্দি সিনেমা ‘লাগে রহো মুন্না ভাই’ তে দেখা যায় শুধু মুন্নাভাই গান্ধীজীর সাথে কথা বলছেন। উনি দেখতে পেলেও আর কেউ দেখতে পাচ্ছেন না। যে সততা থেকে মাসির মনে বিদ্রোহের ঝড় ওঠে, সুস্থ সমাজ গড়ার লক্ষ্যে ক্ষুদিরাম হোক তার হাতিয়ার। তাহলেই পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী।
রাধার চরিত্রে মেঘবালিকা ঘোষের একাকিত্বের অভিনয় দিয়ে যন্ত্রণার আগুন বুঝিয়েছেন। বাকি কোরাসে থাকা সকলেই পরিচালকের দাবি মিটিয়েছে। আর একবার ভাববেন পরিচালক মাসিকে কুঁজো না করে সোজা হয়ে চলতে দেখলে ভালো লাগবে।
সেমন্তী প্রযোজিত কাল বিড়ম্বনা প্রথম অভিনয় হয় শোহন নাট্যোৎসবে ১৬.০৩. ২০১৯ মিনার্ভায়। গত ১৪ মার্চ ২০২২ শিশির মঞ্চে ৫৫ তম অভিনয় সম্পন্ন হলো পশ্চিমবঙ্গ সরকার আয়োজিত নাট্যমেলায়। সেমন্তী এগিয়ে চলুক তার বহমান পথেই কালের বিড়ম্বনার সব বাঁধা কাটিয়ে।