কলঙ্কিনী, বিনোদিনী | সুব্রত কাঞ্জিলাল

সোনার আংটি আবার ব্যাকা! এই বাক্যটা মধ্যযুগ থেকে বাংলার ঘরে ঘরে বেশ জনপ্রিয়। কলঙ্কের কালিমা শুধুমাত্র নারী দেহ, নারী চরিত্র খুঁজে বেড়ায়। পুরুষ দেহকে ভয় পায়। যেমন পৃথিবীর মুসলমান মাত্র দাঙ্গাবাজ, মাফিয়া, খুনি মনোভাবের কি হয়! সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতি এই তত্ত্বকে কয়েকশো বছর ধরে পৃথিবীর দেশে দেশে অন্য ধর্মাবলম্বীদের বোঝাতে পেরেছে।
এদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্য করতে এসে অনবরত প্রচার করেছে, ভারতের যত কলঙ্ক সবই মুঘলদের জন্য। মুঘল যুগের আগে ভারতবর্ষ নাকি কলঙ্কহীন ছিল।
আধুনিক যুগে আজও বিনোদিনী দেবীকে নটি, দাসী আখ্যা দেওয়া হয়। এই দেশে দাস শব্দটা হাজার হাজার বছর ধরে প্রান্তিক মানুষদের বিশেষ করে শিডিউল কাস্টদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। ওরা সেবা দাস। ওরা মাঠে ময়দানে কৃষি ক্ষেত্রে শিল্প ক্ষেত্রে শ্রম দেয়। সুতরাং ওরা অন্তজ। অস্পৃশ্য। একইভাবে নটিশব্দটাও পতিতাদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।

নাট্যশালার মাতাল, উশৃংখল, ব্যাভিচারী নাট্য ব্যক্তিত্বদের নামের আগে কখনো এই ধরনের শব্দ ব্যবহার করা হয় না।
মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে বিনোদিনী দেবীকে নাট্যমঞ্চ থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল। তার নামে রঙ্গমঞ্চ নামাঙ্কিত করা যায় না। রেলস্টেশন, রাস্তার নাম রাখা হয় না। রামকৃষ্ণদেব তাঁর অভিনয় দেখে যখন বলেন, তোর চৈতন্য হোক। তার আগে যেন ওই নারীর চৈতন্য ছিল না। এইসব প্রচার করা হয়। তাকে নিয়ে বেশ কয়েকটি নাটক ,যাত্রা, সিনেমা তৈরি করা হয়। যেখানে বিনোদিনী শুধুই পতিতা। এই মেয়েটা সারাদিন চোখের জলে বুক ভাসায়। দাসির মতো পুরুষের পদলেহন করে। আরো সব মিথ্যা কলঙ্কের দাগ তাঁর দেহ মনে লাগিয়ে দেওয়া হয়।
যেমন রবীন্দ্রনাথের ছোট বৌঠান কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে বিনোদিনীকে কলঙ্কিত করা হয়েছে। প্রচার করা হয়েছিল কাদম্বরী দেবীর স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে বিনোদিনীর প্রেম ভালবাসার সম্পর্ক ছিল। স্বামীর জামার পকেট থেকে বিনোদিনীর প্রেমপত্র পাওয়ার পর, কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন। অথচ আজ পর্যন্ত এই ঘটনার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
সেযুগে নাট্যমহলে আরো সব মুখরোচক গুজব অনবরত প্রচারিত হতো। ঠাকুর বাড়ির নাট্যকার রবীন্দ্রনাথের মেজ কাকার সঙ্গে নাকি বিনোদিনীর গভীর সম্পর্ক ছিল। বিনোদিনীর জন্য বাগানবাড়ি পর্যন্ত কেনা হয়েছে। এইসব কুৎসার কারণে রবীন্দ্রনাথও কোনদিন বিনোদিনীর প্রতি নরম মনোভাব পোষণ করেননি। রবীন্দ্রনাথ যে তাঁর নাটক পাবলিক থিয়েটারে আনতে চাননি, গিরিশ বাবুদের হাতে তুলে দেওয়ার কথা ভাবতেন না, তার অন্যতম কারণ বিনোদিনী দেবী। রবীন্দ্রনাথ নাকি পতিতাদের রঙ্গমঞ্চে প্রবেশের ব্যাপারটা পছন্দ করতেন না।

কেন মাত্র চব্বিশ বছর বয়সের পর আর কোনদিন অভিনয় করতে চাননি বিনোদিনী, অথচ মৃত্যুর আগে ৭৮ বছর বয়সেও তিনি নিয়মিতভাবে থিয়েটার দেখতে আসতেন। কারা কারা তাঁকে কলঙ্কিত করার কথা ভেবেছিল, রঙ্গমঞ্চ থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র হয়েছিল, কোন পক্ষ বিনোদিনীকে কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর জন্য দায়ী করেছিল, আজ আমরা সেই কথা এখানে বলতে বসেছি।

বিনোদিনী ইংল্যান্ডে জন্মালে, তার অভিনয় দেখতে ইংল্যান্ডের রানী ছুটে আসতেন, রানী তাকে ডিনার টেবিলে আহ্বান করতেন। এইসব কথা সে সময়ের সম্ভ্রান্ত ইংরাজপুরুষরা বলতো। ইংরেজি কাগজে লেখা হতো। অন্যদিকে গিরিশ ঘোষ থেকে শুরু করে সেই সময়ের থিয়েটারের জগতের পান্ডারা বিনোদিনীর বিরুদ্ধে সব সময় কুৎসা রচনা করে চলেছিল।
বিনোদিনী দেবী বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি, সংস্কৃত ভাষায় সাবলীল ছিলেন। তিনি কবিতা রচনা করতেন। তাঁর গদ্য সাহিত্য সে যুগের নিরিখে উন্নত ছিল। অনেক পত্র-পত্রিকায় বিনোদিনী দেবীর লেখা বের হতো। নিন্দুকরা প্রচার করত, ওসব বিনোদিনীর লেখা নয়। টাকার বিনিময় অন্যদের দিয়ে লেখানো।

গিরিশ ঘোষ মশাইও বিনোদিনীর এইসব সাহিত্যকর্মের সমর্থক ছিলেন না। তাঁর লেখা প্রচারিত হোক এটা চাইতেন না। অনেক সংবাদপত্রের সাহিত্যপত্রের সম্পাদকদের বারণ করে দেওয়া হতো তারা যেন বিনোদিনীর রচনা প্রকাশ না করেন। নিজের আত্মজীবনী আমার কথা লেখার পর, বিনোদিনী চেয়েছিলেন তাঁর গুরু গিরিশ ঘোষ যেন ভূমিকা লিখে দেন।
গিরিশ ভয় পেয়েছিলেন। আত্মজীবনীতে বিনোদিনী হয়তো অনেক সত্যি কথা বলে ফেলবে। তাহলে তো সে যুগের অনেক নাট্য ব্যক্তিত্বদের চরিত্রে দাগ লেগে যাবে। কিছুতেই তিনি ভূমিকা লিখতে চাননি। যেমন যে ধনকুবের নাট্যমঞ্চ তৈরি করে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেই মঞ্চের মালিকানা এবং বিনোদিনী নামাঙ্কিত হতে দেওয়া যাবে না, এই ব্যাপারে গিরিশ ঘোষ ও অন্যদের প্রবল আপত্তি ছিল। সেই সময় থেকে গিরিশ ঘোষ এবং অন্যরা প্রতিদিন, প্রতি পদক্ষেপে বিনোদিনীকে সর্বসমক্ষে অপমান করা হতো। লাঞ্চনা করা হতো। নাটকের উল্লেখযোগ্য চরিত্র দেওয়া হতো না।

বিনোদিনীকে চিরদিনের জন্য সভ্য সমাজ থেকে বাইরে রাখবার ষড়যন্ত্র করেছিল সে সময়কার বাবুসমাজ থেকে অনেক বেশি থিয়েটারের লোকজন। এ কথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলা যায়, বিনোদিনী বিদ্বেষ ছিল সে যুগের সংগঠিত ধর্ম — এ যুগের যন্ত্রণা!
বলা হতো, বিনোদিনী ছিলেন অহংকারী। রূপের অহংকার, গুণের অহংকার, ধনী পুরুষদের বশীভূত করার উৎকট অহংকার। আরো বলা হয় তিনি নাকি অতিমাত্রায় কর্তৃত্যাভিলাশিনী ছিলেন। সব ব্যাপারে খবরদারি করতেন। বড় বেশি যশের কাঙ্গাল ছিলেন। এইসব কারণের জন্যই নাকি বিনোদিনীকে তাড়ানো হয়েছিল।
কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু হয় ১০ অথবা ১১ এপ্রিল ১৮৮৪ সালে।

দেখা যাচ্ছে যে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জামার পকেট থেকে যে চিঠি পাওয়া যাচ্ছে, ১৮৮৪ র এপ্রিল মাসের ৫ কিংবা ছয় তারিখে। সেই সময় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জাহাজের ব্যবসায় সর্বস্ব পন করেছিলেন। বিদেশি কোম্পানি ফ্লোটেল এর সঙ্গে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে তিনি প্রতিদিন নদীপথে তখনকার অবিভক্ত বাংলার সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। এই সময় তিনি কলকাতায় থাকতে পারতেন না। তাছাড়া সেদিনের কলকাতা আজকের মতো ছিল না। ধনী পরিবারগুলোর কোন ঘোড়ার গাড়ি, কাকে নিয়ে কোথায় কেন যায় উত্তর কলকাতার প্রতিটি নাগরিকের তা জানা ছিল। সেটা জানা যেত ঘোড়ার সাজ পোশাক, ঘেরাটোপের আকৃতি, ও রং ইত্যাদি দেখে। সুতরাং বিনোদিনী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সম্পর্ক লুকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না।

আরো দেখা যাচ্ছে, কাদম্বরীর মৃত্যুর জন্য বিনোদিনীকে অভিযুক্ত করে কুৎসা রটনার উৎস ঠাকুরবাড়ি নয়। সুনির্দিষ্ট ভাবে ঠাকুরবাড়ির এমন একজনও বিনোদিনীর বিরুদ্ধে কখনো একটি কথা বলেননি। ব্রাহ্মসমাজ বিরোধী, ঠাকুরবাড়ি বিরোধী, হিন্দু মৌলবাদীরাও বিনোদিনী বিরোধী প্রচার করেননি। সমস্ত কুৎসার সূতিকাগার নাট্য জগতের এবং তখনকার ঈর্ষাকাতর বাবু সাহেব বিনোদিনী বিরোধী শক্তি। এঁরা সবাই এক সময় থিয়েটার এবং বিনোদিনীর কাছের লোক ছিল। এঁরা একই সঙ্গে বিনোদিনীর বিরুদ্ধে নানারকম ষড়যন্ত্র করেছিল। যেমন বিনোদিনীর একমাত্র কন্যা শকুন্তলাকে স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে এঁরা কেউ সাহায্য করেনি। বরং বিরোধিতা করেছেন। ১৮৮২/৮৩ সালে “আমার অভিনেত্রী” জীবন লেখা যখন শুরু করেন তখন তাঁর বয়স ৬০/৬২ বছর। অর্থাৎ সাহিত্য রচনার ব্যাপ্তি তখন ৪০ বছরের উপর। এই ৪০ বছর ধরে নিশ্চয়ই কোন ভাড়াটে লেখক দিয়ে লেখা সম্ভব না। কিন্তু কুৎসাকারীরা, যুক্তির ধার ধারে না।
বিনোদিনীর পক্ষেও প্রতিবাদ করার কোন পথ ছিল না। সমকালীন সাহিত্য পত্রিকা সেই সময় বিনোদিনীর লেখা প্রকাশ করতে ইচ্ছুক ছিল না। যেটুকু প্রকাশিত হয়েছে সবই নাট্যপত্রিকায়। গিরিশ ঘোষ সম্পাদিত নাট্যমন্দির পত্রিকা ও সেই সময় কয়েক কিস্তি লেখা প্রকাশ করার পর তাও বন্ধ করে দেয়। কেন বন্ধ করলেন তার কোন সঠিক কারণ জানা যায়নি।

রঙ্গমঞ্চের অন্দরমহল এর অন্ধকার জীবনের কথা কাহিনী অথবা অশালীন রাজনীতি ও ষড়যন্ত্রের সংবাদ রবীন্দ্রনাথের পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। সুতরাং এসব বিষয়ে তাঁর কাছ থেকে কোন রকম মন্তব্য আশা করা যায় না। ১৮৮৫/৮৬ তে বিনোদিনীর বিরুদ্ধে যে কলঙ্কিত অধ্যায় রচিত হয়েছিল তার বিরুদ্ধে তখনকার থিয়েটারের জগতের কেউ রুখে দাঁড়াননি। সমকালীন সমাজও নিরব ছিল।
এটা স্বাভাবিক যে সমাজ নিন্দিতা নারীদের সম্পর্কে ধারাবাহিক অপপ্রচার এবং কাদম্বরীর আত্মহত্যার কারণ সম্পর্কে চাপা গুজব রবীন্দ্রনাথের বিনোদিনী বিরূপতা অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছিল।
সামগ্রিকভাবে ঠাকুর পরিবার এবং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তখনকার দিনের পেশাদার রঙ্গমঞ্চের নাট্য আদর্শের মৌলিক পার্থক্য ছিল। গিরিশ ঘোষের যুক্তিহীন পৌরাণিক ভক্তিবাদে রবীন্দ্রনাথের আস্থা ছিল না। বিষয় ভাবনা ও নাট্য রীতির একমুখী আতিশয্য রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করতেন না। নিষিদ্ধ সমাজের মেয়েদের নিয়ে বেলেল্লাপনা, অসামাজিক স্বেচ্ছাচারিতাকে তিনি অন্তর থেকে ঘৃণা করতেন। বিদ্যাসাগর মশাই ও এইসব ব্যাপারে গিরিশ ঘোষদের বিরুদ্ধে ছিলেন।

মনে রাখতে হবে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর গিরিশ ঘোষের পূর্বে নাটক লিখে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তবে ১৮৮১ সালে তিনি পেশাদার মঞ্চ থেকে সরে আসেন। পরিপূর্ণভাবে নিজেদের ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেন। আর বিনোদিনী বিরোধী ষড়যন্ত্র প্রকৃত অর্থে শুরু হয়েছিল ১৮৮৫/৮৬ সাল থেকে।

বিনোদিনী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিষয়টি এইরকম ছিল। তিনি ছিলেন আত্ম সচেতন, জেদি এবং একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী। সরলতা, সত্যবাদিতা, স্পষ্টবাদিতা, ছিল তাঁর চরিত্রের ভূষণ। হঠাৎ করে কারো কপোটাচরণের সম্মুখীন হলে অনেক সময় তিনি মেজাজ হারাতেন। এই কারণেই দেখা যাচ্ছে তখনকার দিনের নাটকের লোকজনদের সঙ্গে তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্বের সংঘাত ঘটতো। বলা বাহুল্য নাটকের জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত লোকজনদের মধ্যে চিরকাল অল্প মেধা, ব্যক্তিত্বহীন, মেরুদণ্ডহীনদের সংখ্যা প্রবল।

পরশ্রী কাতরতা এঁদের অঙ্গের ভূষণ। সুতরাং বিনোদিনী একলব্যের মতো সুশিক্ষিতা ছিলেন। ইংরেজি নাট্য সাহিত্য পড়ে আধুনিক থিয়েটার, ও মেকাপের কলাকৌশল রপ্ত করেছিলেন। মেকাপের বিজ্ঞান শিক্ষা দেশজ রীতিতে প্রয়োগ করতেন। বিনোদিনীর গুণপনা বিনোদিনীকে তার গণিতাবৃত্তির ক্ষুদ্র বলয়ের বাইরে নিয়ে এসেছিল। এইসব গুণপনার কারণে শত্রু ও সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ আগেই বলেছি, এইসব জগতে নিম্ন মেধা মধ্য মেধার লোকজনরা দাদাগিরি করে আসছে।

থিয়েটারের জন্য তিনি সর্বস্ব পন করেছিলেন। অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, অমৃতলাল বসু, গিরিশ ঘোষ এঁরাও থিয়েটারের জন্য অনেক কিছু করেছেন। কিন্তু কলকাতা এবং বাংলার ধনীদের মধ্যে বিনোদিনীকে দখল করবার প্রবল প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়েছিল সেই সময়। থিয়েটারের স্বার্থে বিনোদিনী পণ্য মূল্যকে ব্যবহার করার পরিকল্পনা গিরিশ ঘোষ রাই করেছিলেন। রাজস্থানের ধনী যুবক গুর্মুখ রায়ের কাছে বিনোদিনীকে বন্ধক রেখে থিয়েটার হল নির্মাণের ভাবনা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা।

অন্যদিকে বিনোদিনীকে কলঙ্কিত করবার জন্য জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে ব্যবহার করবার নোংরা ষড়যন্ত্র যারা করেছিল, তারা কি জানতেন যে, সামান্যতম অসংযম, কিংবা চারিত্রিক উশৃঙ্খলা তার কোন প্রমাণ কি কখনো জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে হাজির করতে পারা যাবে না! রবীন্দ্রনাথের এই মেজদা আজীবন বিস্ময়কর নীরবতা পালন করেছেন। আত্মপক্ষ সমর্থনে কখনো একটি বাক্য ও ব্যয় করেননি। তাঁর মৃত্যুর পরেও এই গুজব প্রচলিত ছিল।

আমরা দেখতে পাই একালের কোন কোন আধুনিক লেখক রবীন্দ্রনাথের এই মেজদাকে নিয়ে মুখরোচক কাল্পনিক গল্প তৈরি করেছেন। বাণিজ্যিক স্বার্থে যুক্তিহীন মিথ্যার বেসাতি করেছেন। মেজ বৌঠান কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরকীয়া নিয়ে সিনেমা থিয়েটার হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বিয়ের সময় কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন এসব বলা হয়েছে।
কাদম্বরী কেন অসুখী ছিলেন, এর বর্ণনা শোনা যায় না। বয়সে কাদম্বরী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের থেকে দু এক বছরের বড়। ঠাকুরবাড়ির অন্য বউদের মতো তিনি উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে আসেননি। স্বামী নাটক, ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে খুব একটা সময় দিতে পারতেন না। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অনাবিল বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। সেই সম্পর্কের সুবাদে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম কবিতা মেজ বউ ঠাকুরানকে শোনাতে যেতেন। এ ব্যাপারে অন্য বৌঠানদের তেমন একটা আগ্রহ ছিল না। গুজব রটনাকারীরা এ কথা কখনো বলে না যে রবীন্দ্রনাথের বউ এর সঙ্গে কাদম্বরী দেবীর সুসম্পর্ক ছিল।
খুব ছোটবেলায় বিনোদিনী রঙ্গমঞ্চের আলোর মধ্যে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মা এবং নিজের পেশার মধ্যে বেঁচে থাকতে তিনি চাননি। সব সময় তিনি চেষ্টা করেছেন অভিনেত্রী জীবন যাপন করতে। অভিনয় করে তিনি যা রোজগার করতেন, সেটা যথেষ্ট না থাকলেও, মাথা উঁচু করে দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করতে চেয়েছিলেন। থিয়েটার কোম্পানি বিনোদিনীকে কোনদিন তাঁর নিজের মতো করে বাঁচতে দিতে চাইনি। বিনোদিনীর লেখা থেকে জানা যায়, বেশ কয়েকবার লখনউ, এলাহাবাদ ইত্যাদি অঞ্চলে অভিনয় করতে গিয়ে, দলের লোকেরা তাঁর সঙ্গে কিরকম খারাপ ব্যবহার করেছিল। দলের সবাই দিনের বেলা নতুন দেশ দেখতে বেরিয়েছিল। মায়ের সঙ্গে ছোট্ট বিনোদিনী একটা ঘরে বন্দী হয়েছিল। কারণ ভ্রমণের জন্য তাঁদের কাছে পয়সা ছিল না। সারাদিন অভূক্ত থাকতে হয়েছিল। ঘরে বন্দি মা এবং ছোট্ট বিনোদিনীর খাবার ব্যবস্থা নাট্য কোম্পানি করেনি। দলের অন্য কেউ ও ভাবতে চায়নি।

মঞ্চের বিনোদিনীদের আমরা কোনদিন উপযুক্ত মর্যাদা দান করিনি। বঙ্গদেশের শত শত নাম জানা অজানা বিনোদিনীদের আমি খুব ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি। স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে নিজেকে এবং পেটের সন্তানকে বাঁচানোর জন্য রাতের পর রাত তাঁরা যাত্রা ও রঙ্গমঞ্চের রঙিন আলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে অভিনয় করে গেছে। অভিনয়ের পর তাঁদের জুটেছে একটু ভাত ও ডাল। সেই ভাত খেয়ে সব সময় পেট ভরানো যেত না। দিনের বেলা মুড়ি চিবিয়ে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয়েছে। কামুক পুরুষ অভিনেতাদের কামনার লালসার শিকার হতে হয়েছে।
যৌবন ফুরিয়ে যাবার আগে যক্ষা রোগে অনেকের মৃত্যু ঘটেছে। অকাল বার্ধক্য নেমে এসেছে শরীরে।

বিনোদিনী দেবীও শ্বেতী রোগে আক্রান্ত হয়ে ঘোমটা দিয়ে সকলের অলক্ষ্যে সন্ধ্যের পর থিয়েটার দেখতে আসতেন। কেউ কখনো তাঁকে একবারের জন্য হাসিমুখে কুশল প্রশ্ন করতে এগিয়ে আসতো না। যৌবন চলে যাবার পর তাঁর কোন রোজগার ছিল না। দারিদ্র্যের অন্ধকার ক্রমশ তাঁকে দম বন্ধ করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
১৯৯৯ সালে শতবর্ষের বাংলার থিয়েটার নিয়ে একটা তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলাম। সেই সময় পুরনো স্টার থিয়েটার আগুনে ঝলসে গিয়েছিল। হাতিবাগানের বিভিন্ন অঞ্চলে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম বিনোদিনীর জন্মস্থান, শেষ জীবনের বাসস্থান। কিন্তু পথচারীদের কেউ সন্ধান দিতে পারছিল না। এলাকার অধিবাসীরা কেউ বিনোদিনী দেবীর নাম পর্যন্ত শোনেনি।
আমার স্থির বিশ্বাস আজও বাংলা থিয়েটারের ২ শতাংশ নাট্যকর্মী বিনোদিনী দেবীর ‘আমার জীবনী’ বইটার সন্ধান জানেন না। বিনোদিনী দেবীর লেখাপড়া তো দূরের কথা। যারা থিয়েটারের workshop করাতে আসেন, তারাও বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস নিয়ে, রঙ্গমঞ্চের বিনোদিনীদের নিয়ে একটা কথাও বলেন না।

আমি বুঝতে পারি না, ঐতিহ্য বিস্তৃত হয়ে নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টি করা যায় কি? যাঁরা বাংলা থিয়েটারের স্থপতি, সেইসব মানুষদের কথা না জানলে, কেমন করে গড়ে উঠবে নতুন থিয়েটার?
কলঙ্কিনী বিনোদিনীরা চিরকাল পুরুষ শাসিত কলঙ্কের অন্ধকারে না খেতে পেয়ে, কঠিন রোগে ভুগতে ভুগতে হারিয়ে গেছে। যখন বেঁচে ছিলেন তাঁরা বিন্দুমাত্র মর্যাদা পাননি। যাত্রা, থিয়েটার, সিনেমার সেই সব নাম না জানা, কিংবা পরিচিত বিনোদিনীদের কথা ইতিহাস মনে রাখেনা। গবেষকরা ও তাঁদের নিয়ে উৎসাহ প্রকাশ করেন না।
সম্ভবত এই কারণেই বাংলা থিয়েটার আজ দিশাহীন।
উৎপল দত্তের ‘টিনের তলোয়ার’ ছাড়া বিশ্বাসযোগ্য আর কোন নাটক লেখা হলো না। মঞ্চস্থ হলো না। তাই মনে হয় কলঙ্কিনী বিনোদিনী?
নাকি কলঙ্কিত বাংলা থিয়েটার?

5 thoughts on “কলঙ্কিনী, বিনোদিনী | সুব্রত কাঞ্জিলাল

  1. May I simply just say what a relief to find someone who truly understands what they are discussing on the web. You definitely understand how to bring a problem to light and make it important. More and more people ought to check this out and understand this side of your story. Its surprising you arent more popular because you definitely have the gift.

Comments are closed.