খনন কথা | মৈনাক সেনগুপ্ত

আর্থার মিলার অনুসরণে
পূর্ণাঙ্গ নাটক

সাবেক মফস্বল শহরের একটি পুরানো বাড়ি। প্রচুর অব্যবহৃত আসবাব পাশের ঘরে ডাঁই করে রাখা আছে। বসার ঘর যেটি আমরা দেখতে পাচ্ছি সেখানেও যে কেউ দীর্ঘদিন বাস করে না বোঝাই যাচ্ছে। একটি আরাম কেদারায় বসে একটা গড়গড়ায় টান দিচ্ছে সুজিত । পরনে বাইরের পোশাক। তার সামনে একটা গোল টেবিলে একখানা আধভাঙ্গা এয়ারগান রাখা। ঘরের এককোনে একটা সাবেক সোফা ও টেবিলের পাশে একটা পুরানো কাঠের চেয়ার। সুজিতের মাথার পিছনে তাঁর বাবা সুধীররঞ্জনের একখানা বড় ছবি। সুজিত আরাম কেদারায় বসে চোখ বন্ধ করে দোল খেতে খেতে গড়গড়ায় টান দিচ্ছে। ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে তার স্ত্রী আরতি। আরতির পায়ের আওয়াজে সুজিত চোখ খোলে। কিন্তু বাকি হাবভাবের কোন পরিবর্তন হয় না।

আরতি – (অবাক হয়ে) — হুঁকো!

সুজিত – গড়গড়া, বাবা খেতে দেখ নি ।

আরতি – টান দিয়ে যাচ্ছ, ধোঁওয়া তো বেরুচ্ছে না !

সুজিত – তামাক নেই তো, স্বাভাবিক!

আরতি – তাহলে?

সুজিত – (উত্তর না দিয়ে আরও একটা টান দেয়, ধোঁওয়া ছাড়ার ভাব করে) ভেতরটা দেখে এলে ?

আরতি – দেখলাম ।

সুজিত – কিছু পেলে? কিছু সরিয়ে রাখার হলে এখনি সরিয়ে রেখে দাও ?

আরতি – তেমন কিছু নয়, দু’একটা শাড়ি খুব সুন্দর, আজকের দিনে পয়সা ফেললেও পাওয়া যাবে না।

সুজিত – রেখেছ ?

আরতি – হুম, বের করে রেখেছি ।

সুজিত – ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখ, তাড়াতাড়ি ।

আরতি – ঠিক আছে, কিন্তু

সুজিত – আবার কিন্তু কী ?

আরতি – দেরাজটা খোলা, চাবি লাগানো নেই,

সুজিত – চাবি হারিয়ে গেছিল অনেকদিন-ই

আরতি – কয়েকটা গিনি, বোধহয় —

সুজিত – ছিল (আরতি কিছু বলতে যায়) বাবার শেষদিকে তো ওগুলো ভেঙেই —

আরতি – ও ! কত দিনের স্মৃতি। তোমার সেই লোক কখন আসবে ?

সুজিত – (পকেট থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখে) যে কোন সময়ে এসে পড়বে, কোন ঠিক নেই।

আরতি – লোক ঠিকঠাক তো —

সুজিত – কী করে জানব, এই মফস্বল শহরে পুরনো জিনিস কেনাবেচার লোক পাওয়া গেছে, এই অনেক ।

আরতি – কোত্থেকে পেলে ? কোন পুরনো বন্ধুর কাছে ?

সুজিত – (হাতের মোবাইলটা তুলে) আজকাল তো সবার একটাই বন্ধু ।

আরতি – সুহাসকে ফোন করেছিলে ?

সুজিত – (ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলে)

আরতি – কী বললো ?

সুজিত – ধরে নি ।

আরতি – তাহলে তুমি ধরে নিলে কী করে, ও আসবে ?

সুজিত – দ্বিতীয়দিন ফোন করায় ওর সেক্রেটারি বলল, ‘স্যার প্রোগ্রামটা কনফার্ম করেছেন। ‘

আরতি – নিজের দাদার কাছে আসবে সেটাও প্রোগ্রাম! রাজি হলে সেক্রেটারি কনফার্ম করবে ! ছেলে না মেয়ে?

সুজিত – মানে ?

আরতি – বলছি, সুহাসের সেক্রেটারি ছেলে না মেয়ে ?

সুজিত – জানি না ।

আরতি – দু’দিন গলা শুনেও বুঝতে পার নি ?

সুজিত – বোঝার চেষ্টাও করি নি, কি হবে বুঝে?

আরতি – তুমি সত্যি পাল্টালে না ।

সুজিত – সবাই পাল্টায় না ।

আরতি – অথচ তোমার মায়ের পেটের ভাই!

সুজিত – সুহাসটা ছোটবেলায় একদম মায়ের মতো ছিল ।

আরতি – তোমার মাকে আমি বেশি দিন পাইনি, আমার বিয়ের মাস ছয়েক পরেই —

সুজিত – হুম

আরতি – আমাকে খুব ভালবাসতেন ।

সুজিত – সব কথা তোমার মনে আছে আরতি ?

আরতি – কিচ্ছু ভুলিনি ।

সুজিত – জন্ম থেকে এই বাড়িটায় বেড়ে ওঠা।

আরতি – আমিও বিয়ের পর বেশ কিছু বছর কাটিয়েছি এই শহরটায়

সুজিত – আমাদের ছোটবেলায় এই জায়গাটা পুরোপুরি শহর ছিল না ।

আরতি – এখনও নয় ।

সুজিত – কলকাতার সঙ্গে তুলনা কোরনা । রেললাইনের দু’দিকে ছোট ছোট শহরগুলোর নিজস্ব চরিত্র আছে ।

আরতি – আচ্ছা, সুহাস কি এগুলো বিক্রি করতে রাজি হবে? এসব জিনিসপত্র বিক্রি করতে রাজি হবেই বা কেন ?

সুজিত – ছোটবেলা থেকে আমার কোনো কথার বিরোধিতা করেনি ।

আরতি- ছোটবেলা থেকে নয়, ছোটবেলায়। দীর্ঘদিন তোমাদের দু’ভাইয়ের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই।

সুজিত – পয়লা বৈশাখ আর শুভ বিজয়ায় ফোন করে, কথা হয় তো —

আরতি – ব্যাস, ওইটুকু । আজ ও কোথায়, আর তুমি কোথায় । মালিগ্যান্ট ম্যালেরিয়ায় মরতে বসেছিলে, একবার আসা তো দূরের কথা, ফোন করে খবরটুকু নেয় নি।

সুজিত – আমি খবর দিই নি ।

আরতি – ও এখন মস্ত নেতা। সব শহরের সব পাড়ায় ওদের পার্টি অফিস, চাইলে খবরটা নিতে পারতো না ?

সুজিত – আমার এখনকার পাড়া, শহর বা ক’দিন আগে অবধি যে স্কুলে পড়িয়েছি, সেখানে কাউকে আমার ভাইয়ের রাজনৈতিক
পরিচয় জানাই নি ।

আরতি – তুমি ওর রাজনীতির বিরোধী বলে ?

সুজিত – স্টুডেন্ট লাইফের পর সক্রিয়ভাবে কোনো রাজনীতিই করিনি, চাকরি বাঁচাতে গেলে একটা শিক্ষক সংগঠনে নাম লেখাতে হয় বলে লেখানো। তখন যেমনটা দস্তুুর ছিল ।

আরতি – তাহলে?

সুজিত – ক্ষমতাবান মানুষদের এড়িয়ে চলি ।

আরতি – সুহাস তোমার ভাই ।

সুজিত – ক্ষমতার কোনো বাবাও থাকে না, ভাইও জন্মায় না।

আরতি – আমার একটা কথা বারবার মনে হয়, আগেও হয়েছে, আজও হচ্ছে ।

সুজিত – কী ?

আরতি – সুহাসকে যদি তখন একবার বলতাম তাহলে টুবানকে চাকরি করতে বাইরে যেতে হতো না, এখানেই কোনো একটা ব্যবস্থা করে দিত ।

(সুজিত আবার গড়গড়ার নলটা তুলে নেয়)

আরতি – আজ একবার বলে দেখব ?

সুজিত – না, সুজিত রঞ্জন চৌধুরি কখনও কারোর কাছে হাত পাতেনি —

আরতি – আমি বলব আমার দেওরকে ।

সুজিত – তারপর ? বাকি জীবনটা কৃতজ্ঞতার বোঝা মাথায় নিয়ে বাঁচতে হবে ।

(বাইরে থেকে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শোনা যায়)

আরতি – সুহাস এলো বোধহয় —

সুজিত – (তখনই মোবাইল বেজে ওঠে সুজিত ফোনে কথা বলে) বেড়িয়ে পড়েছে, এখানেই আসছে ? ও কে!

(সুজিত ফোন কেটে দেয় । আরতি ওর দিকে তাকিয়ে থাকে)

সুজিত – মেয়ে —

আরতি – মানে —

সুজিত – সুহাসের সেক্রেটারি —

(দরজায় আবার কড়া নাড়ার শব্দ হয় । আরতি দরজা খুলতে যায় । সুজিত গড়গড়ায় টান দিতে দিতে সামনে রাখা এয়ারগানটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে ।)

আরতি দরজা খুললে প্রবেশ করে অক্ষয়, চেহারা ও পোশাক দু’টোর-ই খুব বয়স হয়েছে। অক্ষয় ঢুকেই আবার একটু পিছিয়ে যায়।

অক্ষয় -(এয়ারগানটা দেখিয়ে) চলে ?

সুজিত – চলতো

অক্ষয় – (গড়গড়াটা দেখিয়ে) ওটাও বোধহয় তাই ?

সুজিত – আপনি তো বাতিল, পুরনো জিনিসের কারবার করেন ?

অক্ষয় – করতাম । আচ্ছা আমায় চিনলেন কী করে ?

সুজিত – এই সময়ে এখানে অক্ষয় কুমার দাস ছাড়া অন্য কারুর আসার কথা নয়।

অক্ষয় – বাধ্য হয়ে আসতে হলো —

সুজিত – এটাই তো আপনার কাজ !

অক্ষয় ছিল ?

সুজিত – বুঝলাম না —

অক্ষয় – এখন আর এসবের কদর কে করে ? আমাদের ছোট্ট শহরেও বড় বড় বাড়িগুলো ভেঙ্গে পায়রার খোপের মতো ফ্ল্যাট। বড় বড় পরিবারগুলো ভেঙ্গে ছোট ছোট টুকরো। আজকালকার ফার্নিচারগুলো দেখবেন এমনভাবে বানানো আট-দশ বছরের বেশি টেকে না! আর ফ্ল্যাটের রুমগুলোও দেখবেন, ঐ আট বাই দশ। এসব ফার্নিচার কিনবেই বা কে ? আর রাখবেই বা কোথায় ?

সুজিত – তাহলে আপনার ব্যবসা চলছে কী করে ?

অক্ষয় – চলছে আর কই ? বন্ধ করে দিয়েছি এক বছর ।

সুজিত – তাহলে ফোন নাম্বারটা ?

অক্ষয় – অনেক আগে আমার ছেলে ওয়েবসাইটে তুলে দিয়েছিল । ওখান থেকে দেখে লোকেরা মাঝে মাঝে ফোন টোন করে । কখনও যাই, কখনও যাই না ।

আরতি – (বিরক্ত হয়ে) তাহলে এখানে এলেন কেন ?

অক্ষয় – অনেকদিন বাড়িতে বসে আছি, ভাবলাম যাই দেখে আসি একবার ।

আরতি – মানে সময় কাটাতে ।

অক্ষয় – এটা একটা কথা হলো ম্যাডাম! এই ব্যবসাটা আর পাঁচটা ব্যবসার মতো নয়, প্রতিটি আসবাবের আলাদা আলাদা ইতিহাস আছে, গন্ধ আছে।

সুজিত – তার মানে আপনি এখানে গন্ধ শুঁকতে এসেছেন ?

অক্ষয় – এসেছিলাম হয়তো — কিন্তু আসার পরে মনে হচ্ছে, না এলে ভুলই করতাম ।

সুজিত – এমন মনে হওয়ার কারণ ?

অক্ষয় – (আরাম কেদারাটার হাতলে হাত দিয়ে) এরকম একটা জিনিস দেখলাম, এসব ব্যতিক্রম ! আজকাল আর কোথায় ?

সুজিত – (হাতটা আলতো করে সরিয়ে দিয়ে) এটা কিন্তু বিক্রি করবো না।

আরতি – তার মানে ? জিনিসপত্র কেনার জন্যই তো ওকে ডাকা

সুজিত – সব জিনিস আমি বিক্রি করবো না আরতি ।

আরতি – কোথায় রাখবে ?

সুজিত – সে দেখা যাবে ।

অক্ষয় – (গড়গড়টা দেখিয়ে) ওটাও বোধহয় বিক্রি করবেন না ।

সুজিত – ঠিক ধরেছেন ।

(অক্ষয় বেরতে যায় ।)

সুজিত – চললেন কোথায় ?

অক্ষয় – আমার তো মনে হয় আপনারাই টাইম পাস করার জন্য আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।

সুজিত – (রেগে গিয়ে) আপনার তাই মনে হল? ওরকম বদ-রসিকতা করার অভ্যেস চৌধুরি বাড়ির কারো নেই।

অক্ষয় – (দাঁড়িয়ে গিয়ে) না, তাহলে যা শুনেছিলাম, ঠিকই শুনেছিলাম —

সুজিত – কী শুনেছিলেন জানতে পারি ?

অক্ষয় – আপনার বাড়ি খুঁজে পাচ্ছিলাম না, কাছাকাছি একটা মনোহারি দোকানে খোঁজ নেওয়াতে একজন বয়স্ক দোকানদার বললেন — না থাক ।

সুজিত – কী বললো ? দেখুন, হেঁয়ালি বা রসিকতা কোনটাই আমি পছন্দ করি না ।

অক্ষয় – বলেছিলেন যে, সুজিত চৌধুরিকে এই পাড়ার পুরনো বাসিন্দা, সবাই চেনে। মানে, এই শহরে যে সব বাসিন্দা এখনও রয়ে গেছে আর কি ! পুরনো লোকজন আরকি —

সুজিত – ঠিকই বলেছেন, কিন্তু মনে রাখলো কোথায় ? কি বললো ?

অক্ষয় – বলছিলেন, আপনি নাকি এক সময়ে এই মফস্বল শহরে বেশ নেতাস্থানীয় ছিলেন। আপনার কম বয়সে —

সুজিত – (লজ্জা ও হাসি নিয়ে) ঐ আর কী, কম বয়সে যেমন হয়, পাড়ার পুজোর সেক্রেটারী –

আরতি – দূর্গা থেকে শীতলা সব ।

সুজিত – সবাই চাইত, কী আর করা যাবে !

আরতি – দু’একবার ওই কেষ্ট না বিষ্টু, ঐ ছেলেটা —

সুজিত – দূর দূর ! ওর যোগ্যতা ছিল নাকি ? চমার এক ডাকে পঞ্চাশ ষাটটা ছেলে জোগাড় হয়ে যেত ।

অক্ষয় – ওই এলাকার দাদাগোছের লোকজন যেমন হয় তেমনটা বোধহয়। যাকগে, আমি তাহলে এখন আসি।

সুজিত – যাবার আগে ভেতরের ঘরটা একবার দেখে গেলে পারতেন?

অক্ষয় – কি আছে ওখানে ?

সুজিত – কি আছে ? আপনাকে যে শুধু শুধু ডাকিনি তার প্রমাণ ।

অক্ষয় – বেশ, এদ্দূর এই বুড়ো হাড়ে এলামই যখন একবার দেখেই যাই ।

সুজিত – চা খাবেন নাকি ?

অক্ষয় – ওটাও ভিনটেজ মডেলের কেটলি?

সুজিত – (একটু হেসে ফেলে) না, না, ওটা আর টী ব্যাগ নিয়ে এসেছি। চা ছাড়া আমি বেশীক্ষণ থাকতে পারি না ।

অক্ষয় – আমার বিশেষ অভ্যেস নেই, যদি আপনাদের জন্য বানান, দেবেন না হয় — চিনি দু’চামচ ।

সুজিত – চিনি তো —

অক্ষয় – আনেন নি ? তবে থাক, আপনাদের খেতে দেখে যদি ইচ্ছে হয় তখন না হয় বাইরে গিয়ে খেয়ে আসব। (ভেতরের ঘরে চলে যায়)

সুজিত – ইন্‌ দ্যাট কেস, পয়সাটা আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবেন। এটা প্রেস্টিজের ব্যাপার। (আরতিকে) চিনি আনলে না কেন ?

আরতি – আমরা বোধহয় অক্ষয়বাবুকে চা খাওয়াবার জন্য কলকাতা থেকে এতদূর আসিনি ।

সুজিত – কতক্ষণ লাগবে, সুহাসই বা কখন আসবে ?

আরতি – খিদে পাচ্ছে।

সুজিত – পেলেই বা কী !

আরতি – সঙ্গে পরোটা -তরকারী নিয়ে এসেছি ।

সুজিত – কখন বানালে?

আরতি – সকালে উঠে । দেব —

সুজিত – সুহাস আসুক।

আরতি – ওই সব খাবার সুহাসের রুচবে ?

সুজিত – সে ওকে জিজ্ঞেস করে দেখা যাবে। অদ্দুর থেকে আসছে, বরং একটু চা-ই বানাও।

আরতি – (চা বানাতে বানাতে) তোমার কী মনে হয় ?

সুজিত – কিসের ?

আরতি – এই যে এই লোকটা, অক্ষয় না কী যেন নাম বললে, ও ওই জিনিসগুলোর দাম বুঝবে ?

সুজিত – আগে তো জিনিসগুলো দেখুক ।

আরতি – সে কথা বলিনি, লোকটাকে দেখে তো মনে হলো না অতগুলো টাকা দিয়ে জিনিসগুলো কিনতে পারে বলে ।

(ভেতর থেকে অক্ষয় বেরিয়ে আসে।)

অক্ষয় – ঠিক বলেছেন ম্যাডাম, চেহারা দেখে আন্দাজ করলে দেখবেন, বেশিরভাগ সময়ই ভুল হয়ে যাচ্ছে।

সুজিত – ( প্রচন্ড রেগে গিয়ে) আপনি আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের কথা শুনছিলেন নাকি ?

অক্ষয়- না স্যার —-

সুজিত – তাহলে ?

অক্ষয় – আসলে আপনি ওই চা খাওয়ানোর বানানোর কথা বললেন না ম্যাডামকে, তখনই আমার ভেতরটা কেমন আনচান করে। উঠল আমাকে চিনি ছাড়াই দিন ম্যাডাম, চালিয়ে নেব ।

(আরতি কী করবে বুঝতে না পেরে সুজিতের দিকে তাকায়। সুজিত ঈশারায় চা দিতে বলে। আরতি একটা কাগজের কাপে চা এগিয়ে দেয়)

অক্ষয় – (চা নিতে নিতে) স্যারের —

আরতি – (সুজিতকে চা দিতে দিতে) আপনাকে ভাবতে হবে না ।

অক্ষয় – (চেয়ারে বসে আরাম করে চায়ে চুমুক দেয়) চা পাতাটা কিন্তু চমৎকার, দারুণ ফ্লেভার। এই বয়সে নুন চিনি দিয়ে কম খাওয়াই ভালো ।

সুজিত – আপনার কাজ কী শেষ ?

অক্ষয় – কী যে বলেন স্যার, আমার পরে কত ছোকরা এই লাইনে এলো, কেউ টিকতে পারলো না। এই কারবারে তাড়াহুড়ো করেছ কী মরেছ। হয় নিজে ঠকে গেলে না হয় পার্টিকে ঠকিয়ে ফেললে।

সুজিত – আপনি কাউকে কখনও ঠকান নি?

অক্ষয় – নিজেও ঠকিনি। অন্তত জ্ঞানত নয়। প্রতিটা আসবাবের, পুরনো জিনিসের আলাদা আলাদা চরিত্র আছে সেটা বুঝতে হবে, তারপর বাজারে সেটার কদর জানে এরকম মানুষের খোঁজ রাখতে হবে। তারপর ধরুন কী রকম দাম দিলে পার্টির লস্ না হয়, আমারও কিছু থাকে, সেটা ঠিক করতে হবে ।

সুজিত – তার মানে, আপনার কাজ মনে হচ্ছে আজকের মধ্যে শেষ হবে না।

অক্ষয় – হয়ে যাবে স্যার, বেশিক্ষণ টাইম নেব না। জিনিসগুলোকে একবার করে চোখের দেখা দেখেছি, একটিবার গায়ে হাত বুলিয়ে নিই কাজটা এতক্ষণে খানিকটা এগিয়েও যেত, রাস্তায় খামোকা পুলিশ আটকে দিল ।

আরতি – (অবাক হয়ে) পুলিশ ? কেন ?

অক্ষয় – শহরে কোন নেতা না মন্ত্রী আসছেন , কিসের যেন মিটিং ছিল। গাড়ি তো ছেড়ে দিন স্যার, পায়ে হেঁটেও আসতে দিচ্ছিলনা। (কাপটা রাখে) চা টা বেশ ভালো হয়েছিল ম্যাডাম, চিনি ছাড়া মন্দ লাগলো না । আর একবার বানালে বলবেন, আমি বরং —

সুজিত – হ্যাঁ আপনি বরং ভেতরে গিয়ে তাড়াতাড়ি আপনার কাজটা সারুন।

(অক্ষয় ভেতরে যায়)

আরতি – (নিচু গলায়) এতো আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়লাম ।

সুজিত – ওরকম ফিস ফিস করে কথা বলছো কেন ?

আরতি – আড়ি পেতে শুনছে কি না !

সুজিত – ওই লোকটাকে ভয় পাবার কী আছে ? তুমি নিজের বাড়িতে বসে কথা বলছ।

আরতি – আমার শ্বশুরমশাইয়ের শ্বশুর— সুজিত – অল দ্য সেম্‌

আরতি – (নিচু গলাতেই) আমার কিন্তু সত্যি ভরসা হচ্ছে না। কতক্ষণ লোকটা এসেছে, একটা মোটামুটি এস্টিমেট এখনও পর্যন্ত দিতে পারলো না। কাজের চেয়ে বকবক বেশী করছে।

সুজিত – বললাম তো আমার হাতে অপশন বিশেষ ছিল না।

আরতি – ওই ও-এল-এক্স না কি যেন বলে না, টুবানরা জানে ।

সুজিত – প্রথমত ওসব আমি ভালো বুঝি না, দ্বিতীয়ত টাকাটা আমার প্রয়োজন আর সেটা ইমিডিয়েটলি —

আরতি – সুহাস যদি বিক্রি করতে রাজি না হয়, ওর তো টাকার প্রয়োজন নেই ।

সুজিত – টাকার প্রয়োজন কখনও কারুর ফুরোয় না ।

আরতি – যদি কোনো কারণে বেঁকে বসে, তুমি একটু বুঝিয়ে বোলো।

সুজিত – সেটা পারবো না। আজ একটা সিনেমা দেখব ভাবছিলাম !

আরতি – সিনেমা ? তুমি ? হঠাৎ ?

সুজিত – আসবার সময় একটা মলে দেখলাম অমিতাভের একটা বই চলছে ।

আরতি – হঠাৎ ?

সুজিত – ইচ্ছে হলো। একটা সময় অমিতাভের একটা বইও ছাড়তাম না। মনে হলো সব যদি ঠিকঠাক মিটে যায় তাহলে ফেরার সময় নাইট শো-এ একটা সিনেমা দেখে ফিরবো ।

আরতি – বিয়ের পর তো একটাও দেখাও নি ।

সুজিত – দেখেছিলাম, তুমি ভুলে গেছ ।

আরতি – দেখতে গেছিলাম, আদ্ধেকটা দেখেই বেরিয়ে আসতে হয়েছিল, মনে আছে?

সুজিত – স্কুল মাস্টারদের এই এক সমস্যা, সব জায়গায় ছাত্র-ছাত্রীরা হাজির ।

আরতি – হলের মধ্যে গুজগুজ ফুসফুস তারপরে ঢিপ করে প্রণাম ।

সুজিত – আসলে ওই জায়গাটা তখনও পুরোপুরি কলকাতা হয়ে ওঠেনি। সিনেমা হলের যাওয়ার কথা ভাবলে আমারই অস্বস্তি
হতো। সব জোড়ায় জোড়ায় বসে —

আরতি – তারপরে সময়ই বা কোথায় সকাল-বিকেল টিউশনি —

সুজিত – শখ করে করিনি, উপায় ছিল না। নতুন বাড়ির জন্য লোন শোধ, টুবানকে বোর্ডিং-এ টাকা পাঠানো,

আরতি – ওই একটাই শখ ছিল আমার।

সুজিত – কারণ তোমার দিদির ছেলে,

আরতি – আরও কিছু কারণ ছিল —

সুজিত – কী ?

(হঠাৎ অক্ষয় ভেতর থেকে খুব ভয় পেয়ে ছিটকে বেরিয়ে আসে ।)

সুজিত – কী হলো ?

(অক্ষয় ভেতর দিকে আঙুল দেখায়, কিছু বলতে পারে না।)

সুজিত – কী হলো বলবেন তো ?

অক্ষয় – চোখ! চোখ! দুটো চোখ —

আরতি – সে তো সবারই থাকে। সম্ভবত —

অক্ষয় – না, না সে নয় ভেতরের ঘরে ।

সুজিত – অতীতের জিনিস নিয়ে কারবার করতে গেলে ভূতে বিশ্বাস করতে হয় নাকি ?

অক্ষয়- ওসবে আমার বিশ্বাস নেই, কিন্তু দুটো অদ্ভুদ চোখ দেওয়াল থেকে ।

সুজিত – বেশ চলুন তো দেখি

সুজিত অক্ষয়কে নিয়ে জোর করেই ভেতরে ঢোকে। আরতি এক কোনে রাখা গ্রামোফোনটায় রেকর্ড চালানোর চেষ্টা করে — চলে না। সুজিত আর অক্ষয় বেরিয়ে আসে। সুজিতের হাতে একটা স্টাফ্ড প্যাঁচা ।

সুজিত – (হাসতে হাসতে) স্টোররুমের দেওয়ালে ঝোলানো ছিলো, ভুলেই গিয়েছিলাম !

অক্ষয় – এরকম বিদঘুটে জিনিস আমি আমার এতদিনের জীবনে খুব কম দেখেছি। এরকম জিনিস কেউ শখ করে বাড়িতে রাখে নাকি ?

সুজিত – (ছাদের দিকে আঙুল তুলে) ওই দেখুন

অক্ষয় – (ওপরদিকে তাকিয়ে) কী ?

সুজিত – দেখুন ছাদের একটা চটলা ওঠা, রঙ করার সময়ও ওটা বাদ দিয়ে রঙ করতে বলেছিলাম।

অক্ষয় – চটলার সঙ্গে এই প্যাঁচা-টার কী সম্পর্ক ?

সুজিত – (এয়ারগানটা তুলে নিয়ে প্যাঁচাটাকে দেখিয়ে) প্রথম যৌবনের স্মৃতি, স্টাফ্ করে রেখে দিয়েছিলাম, আজ আপনার চোখে পড়ল বলে সব আমার সামনে যেন ভেসে এলো ।

আরতি – (গ্রামোফোনটা দেখিয়ে) এটা আর সারানো যাবে না, না ?

অক্ষয় – এটাও বিক্রি করবেন না ?

আরতি – যদি সারানো যেত

অক্ষয় – যাবে বোধহয়। তবে এদিকে মিস্ত্রি নেই, কলকাতার দিকে এখনও হয়ত দু’একজন মিস্ত্রী বেঁচে-বর্তে আছে। তবে ইদানিং এগুলোর বেশ কদর হয়েছে।

আরতি – চলবে কী না ঠিক নেই, মিস্ত্রী পাওয়া যাবে কী না তারও খোঁজ নেই –তবু কদর !

অক্ষয় – ওই কিছু টাকা দিয়ে এক কোনে অল্প জায়গায় বেশ বনেদীয়ানা কিনে রাখা যায় কী না —

আরতি গ্রামোফোনটার গায়ে হাত বোলায়

অক্ষয় – এটা বিক্রি করতে হবে না ম্যাডাম। কোথায় কীভাবে সারানো যায় আমিই না হয় খোঁজ দিয়ে দেব –(প্যাঁচাটাকে দেখিয়ে)
আর ওটা স্যার ফ্রী-তে দিলেও নেব না।

সুজিত – এতদিন পরে পেলাম যখন রেখেই দি ।

অক্ষয় – কিছু মনে করবেন না স্যার, তাহলে ওটা আপাতত একটু চোখের আড়ালে রেখে আসুন। যাতে ঘরের ভেতরের আসবাবগুলোর কাছে গেলেও ওই চোখ দুটো যেন চোখে না পড়ে ।

সুজিত – বেশ, এবার কাজের কথায় আসা যাক —

অক্ষয় করুণভাবে হাত দিয়ে প্যাঁচাটাকে দেখায়

সুজিত – ওকে, ওকে ! (ভেতরে যায়)

অক্ষয় – ভেতরের ঘরে একটা হারমোনিয়াম দেখছিলাম যেন

আরতি – ভালো করে দেখেন নি, খালি বাক্সটা রয়েছে ।

সুজিত ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে। অক্ষয় ভালো করে ওর হাত দুটো দেখে নেয় ।

ক্রমশ

One thought on “খনন কথা | মৈনাক সেনগুপ্ত

Comments are closed.