নীলদিগন্ত
সংস্কৃতির শহর খড়দহ। গত ১৩ মে থেকে ১৬ মে ২০২২, এই চারদিন আলো ঝলমলে হয়ে উঠেছিল নক্ষত্র সমাবেশে। স্থান খড়দহ পৌরসভা পরিচালিত রবীন্দ্র ভবনে। আয়োজন ছিল সপ্তম বার্ষিক কনক রায় স্মৃতি ২০২২ নাট্যোৎসব, খড়দহ আহিরির। পশ্চিমবঙ্গের তেরোটি নাট্যদল এতে অংশগ্রহণ করেছিল। উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট অভিনেতা নাট্যব্যক্তিত্ব বিমল চক্রবর্তী। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভারপ্রাপ্ত কৃষিমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের প্রধান অতিথি হিসেবে আসার কথা ছিল কিন্তু অসুস্থতার কারণে আসতে পারেন নি। এছাড়া মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন খড়দহ পৌরসভার পৌরপ্রধান শ্রীমতী নীলু সরকার, পানিহাটি উপ-পৌরপ্রধান শ্রী সুভাষ চক্রবর্তী, পৌরমাতা শ্রীমতী নন্দিতা সিনহা, অভিনেত্রী ন্যান্সি রায় , ক্রীড়াব্যক্তিত্ব রঞ্জিৎ মুখার্জী সহ আরো অনেক গুণী মানুষ। এবং শেষ দিন উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির সদস্য বিজয় মুখোপাধ্যায়।
প্রথম দিন ছিল হালিশহর সানডে ক্লাবের নাটক ‘দিনের শেষে’। নাট্যকার অলোক বিশ্বাস। সামাজিক পাকেচক্রে বর্তমান সমাজে পারিবারিক মূল্যবোধ কতটা নিম্নগামী তা সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে ড: সঞ্জিত ব্যানার্জীর পরিচালনায়। দ্বিতীয় নাটক ব্যান্ডেল চারনিকের ‘বন্ধন যাক টুটে’। নাট্যকার সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়, নির্দেশক শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। মেকওভার নামক একটি কসমেটিক প্রডাক্ট যেটি কিনা একটি ট্রপিকাল ক্রীম। একটানা মহিলারা ব্যবহার করলে ত্বকের ক্যানসার হয়ে যেতে পারে। এই নিয়ে বিষয়টি শুরু হয়। এক অপরিচিত লোক বাড়িতে আসে, ঘটনাচক্রে প্রডাক্টটি লঞ্চ করতে বারন করেন তিনি এবং একটি চাকরির অফার লেটার দিয়ে চলে যান। পরে স্বামী সৈম্যবত্য অফিস থেকে বাড়ি ফেরত আসে। তার অফিসের কথা তার বউকে জানায় বৈদেহী (বউ) তার বাড়িতে ঘটনাগুলো বলে। তখন স্বামী জিজ্ঞাসা করে, তিনি কে? এখান থেকে নাটক ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে যায়। আসলে অপরিচিত লোকটা আর কেউ নন তিনি হলেন অভিমুন্য সেন। কে এই অভিমুন্য সেন? সৈম্যবত্যর বাবাকে এক শর্ততে অভিমুন্য সেন (কাকা) বাধ্য করেন এবং বলেন তার বউ এর সাথে সহবাস করে সন্তান উপহার দিতে হবে। এখানে বাবা আর ছেলের সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে। ছেলের বিপদের সময় বাবা তার পাশে সবসময় থেকেছেন। এখানেই শেষ হয় গল্প। বেশ ভালো একটি প্রযোজনা। তৃতীয় নাটক ছিল আতপুর জাগৃতির ‘যন্ত্রের যন্ত্রণা’। নাট্যকার মানিক রায়চৌধুরী, নির্দেশনা অমিত শক্তি। যন্ত্র অর্থাৎ মোবাইল যে কিভাবে সমাজ ও পরিবারের ক্ষতি করছে সেটা এই নাটকে সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে হাস্যরসের মাধ্যমে। নির্বাক অভিনয় যে কত সুন্দর হতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
দ্বিতীয় দিন প্রথমে কলকাতা স্বতন্ত্র প্রযোজনা মৈনাক সেনগুপ্তর ‘সুপ্রভাত’। নাটকটি নিয়ে পরিচালক সায়ন চক্রবর্তীকে আরো ভাবতে হবে। মূল চরিত্রের অভিনয় বেশ দূর্বল । নিষিদ্ধপল্লির এক নারীর হাহাকার, কিভাবে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার দায়িত্ব পালন আজও এই সংসারে কিছু মানুষ পালন করে যাচ্ছে সেটাই এই নাটকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। এরপর দেখা যায় অনুপ চক্রবর্তীর লেখা ‘আশ্চর্য বসন্ত’। মানব ক্লোনিং নিয়ে অসাধারণ টানটান একটি প্রযোজনা। নির্দেশ. কল্লোল মুখার্জি। বিজ্ঞান বা চিকিৎসাবিজ্ঞান আজ এতটাই উন্নত যে তাকে নির্ভর করে বিজ্ঞানীরা কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিন্ন করে নব নব আবিষ্কারের ডালি সাজিয়ে দিচ্ছে মানবসভ্যতার পথপরিক্রমায়। যুগান্তকারী এমনই অনেক আবিষ্কার যা অনেকের চোখে পাপ, অন্যায় বা অভিশাপ মনে হলেও, অনেকের কাছে তা কাঙ্খিত, হৃদয়উৎসারিত। যেমন চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাহায্যে কৃত্রিম উপায়ে সন্তানলাভ। একদিকে বিতর্কিত, অন্যদিকে কাঙ্খিত। একজন চিকিৎসক নিজের প্রেমিকার মৃত্যুর পর নিজের ভালোবাসার বস্তুকে কিভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাহায্যে একান্ত আপন করে রেখে আত্মতৃপ্তি পেতে চান। আশাহত জীবনে বিভোর সৃষ্টির মধ্যে তার ভালবাসার দীপ জ্বালিয়ে রাখতে গিয়ে অসহনীয় ও বেদনাময় বিড়ম্বনার শিকার হন, এই নাটক তা পরিলক্ষ্যণীয়। বোঝা যায় জীবন-যৌবন, ধন-মান কিছুই চিরস্থায়ী নয়। শুধু এক ‘অন্তর যাতনা’ চিরস্থায়ী হয়ে থাকে ব্যাথা-বেদনায়, সুখ-দুঃখে। তার ভালবাসার স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায় ভালোবাসার প্রতীকের প্রত্যাখ্যানে ও অবজ্ঞায়। মোহভঙ্গ হয় সৃষ্টিকর্তার। তবু তার বেদনা থেকে উৎসারিত হয় চিরন্তন ভালবাসার এক অদ্ভুত বসন্তের ছবি। হয়তো তা বিতর্কিত কিন্তু মানবিক গুণে সমৃদ্ধ। সম্পূর্ণ মনোবিজ্ঞানধর্মী। যার আবেদন চিরন্তন হৃদয়গ্রাহ্য ভালোবাসার স্মৃতি বহন করে চলে লোক থেকে লোকান্তরে।
৩য় নাটক সাইদাবাদ বহরমপুর নবীনের পূর্ণাঙ্গ নাটক ‘লজ্জাতীর্থ’। নাটক. ইন্দ্রাশিস লাহিড়ী। ১৯৯৭ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর এই নাটকের সূত্রপাত। মাদার টেরিজা মারা গিয়েছেন, সাথে একই দিনে চলে যায় এই নাটকের মূখ্য চরিত্র অন্তরা রায়বর্মন। নাটকের কেন্দ্রে রয়েছে জলি, যাকে জন্ম পরিচয় নিয়ে তৈরি হয়েছে এক জটিল আবর্ত। মাতৃত্ব অস্বীকার করা পৃথিবীর কঠিনতম কাজ। মায়ের সঙ্গে সন্তান নাড়ির টানে আবদ্ধ। তবু মেরি সে বাঁধন অস্বীকার করতে চায়। এই অস্বীকার যে কতটা কঠিন তা একজন মায়ের পক্ষেই বোঝা সম্ভব। অন্যদিকে সন্তানহীনা আরেক নারী অন্তরা, মা হবার সমস্ত সুযোগ পেয়েও মা হতে পারেনা, মাসি হয়ে যায়। দুজনেই একটু একটু করে চোখের সামনে বেড়ে উঠতে দেখে সন্তানকে, শুধু মা হতে পারেনা। কিসের ভয়ে এই অস্বীকার? সমাজ নাকি অস্তিত্ব? নাকি ভয়? নাকি লজ্জা, নাকি … অন্তরার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আশিসের মুখ থেকে আমরা জানতে পারি আরেক চরিত্র ঋত্বিকের কথা। যে “অনুশোচনা নয়, রাত গেয়ি, বাত গেয়ি” তে বিশ্বাসী। তবে হঠাৎ তার এই ভোগসর্বস্ব জীবনের নামে ‘ক্রাইম পানিশমেন্টের’ অভিশাপ, ‘সিন এবং রেট্রিবিউশনের ছায়া। অনুতাপ আর অনুশোচনা হয় তার নিত্যসঙ্গী।
৩য় দিন ছিল মোহিত সন্ধ্যা। পরপর দুটি মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের নাটক। প্রথমটি শোহন প্রযোজনা ‘হীরামন’, নির্দেশনা অনীশ ঘোষ। অসম্ভব ভালো একটি প্রযোজনা, উপস্থিত দর্শকদের মন কেড়ে নিয়েছে। নাটকে অনীশ ঘোষের অনবদ্য অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছি। মঞ্চে ব্যবহিত খাঁচার মধ্যে হীরামন পাখি, যে মানুষের মত কথা বলে। শুধুমাত্র একজনের কথার সোজা উত্তর দেয়। হীরামনের সত্যি বলা কথা অনেকের কাটা হয়ে দাঁড়ায়। বাদবাকি সকলের অভিনয় চরিত্রের দাবি মেটায়। শেষ নাটক অশোকনগর নাট্যমুখের প্রযোজনা ‘মি: রাইট’। নির্দেশনা অভি চক্রবর্তী। কাল পীড়িত। সময় পীড়িত । মেলানকোলিয়ার আবর্জনা আর টাটকা জীবনের বৈপরিত্যের মাঝে রজত এসে দাঁড়িয়ে আছে। ডান হাতের সঙ্গে বাম হাতের সাইকোলজিকাল দ্বন্দ্বের ইতিহাস প্রাচীন , বড়ই প্রাচীন। সবকিছু ভুলে বসে আমরা কি করছি বলুন তো – সভ্যতার নামে ক্ষমা চেয়ে নিজেদের সংশয়ের সাগর জলে ডুব সাঁতার দিতে দিতে ক্রমশ মূর্তিমান ভঙ্গুর হয়ে উঠছি। অসম্ভব ভালো একটি প্রযোজনা, বিরতিসহ এক ঘন্টা চল্লিশ মিনিটের টানটান নাটক থেকে দর্শককে মোহিত করে রেখেছিল।
চতুর্থ দিনের প্রথম নাটক ছিল জলপাইগুড়ি দর্পনের ‘তিন কন্যা’। নারী যুগে যুগে কিভাবে আক্রান্ত হতে হতে শেষে প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পায় তা জানতে হলে এই নাটক দেখতে হবে। প্রথম অভিনয়ের জন্য কিছু জায়গা দুর্বল লেগেছে। কতগুলো জায়গা একটু দেখে নিলে ও এডিট করলে নাটকটি আরো টানটান হতে পারে। এরপর নবদ্বীপ সায়কের ‘বন ছাউনি ‘। বেশ ভালো অভিনয় আর বার্তা বহন করেছে নাটকটি।
৩য় নাটক ‘নীলকণ্ঠ পাখির পালক’। ব্যান্ডেল দিশারী সুন্দর ভাবে তৈরি করেছেন। শিল্পীর মৌলিক সৃষ্টি কিভাবে বাজারে বিক্রি হয়ে যায় তা সুন্দর ভাবে এই নাটকে তুলে ধরা হয়েছে। তবে নাচের আরো অভ্যাস করা দরকার আছে।
উৎসবের শেষ অভিনয় আহিরির নিজস্ব বহু চর্চিত নাটক ‘চাঁদির হাট’। মূল কাহিনী শিব শৰ্মা। গ্রামের ছেলে স্বপন, মাধ্যমিকে দ্বিতীয় হওয়ায় মিডিয়া থেকে শুরু করে গ্রামের লোভী অর্থবান মানুষ ও বহুজাতিক সংস্থাগুলো বাণিজ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অসুস্থ অবস্থাতেও স্বপনকে ছাড়ে না তারা। স্বপনের দাদা তপনকে চাকরির লোভ দেখিয়ে কিনে নিতে চেষ্টা করে। স্বপনের দিদিমণি এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। সবাইকে একত্রিত করে বপন করেন নতুন সংগ্রামের বীজ। পরিচালনা অমিত চক্রবর্তী। সকলের সমবেত অভিনয় এই নাটকের প্রাণ। আগামী বছরের আশা নিয়ে যখন আহিরির স্বপ্ন দেখা শুরু তখন নতুন কোনো জীবন রঙের আলোয় মাখা থাকবে সেসব ভোরের দিনগুলি। এমন আশার কথা তো ভাবতেই পারি।
👍🏼