নাটক ” গল্পের মতোই ” এভাবেই থেকে যায়। সত্যিই সব এভাবে থেকে যায় ? কাহিনি (নাটক) ও নির্দেশনায় দেবব্রত ব্যানার্জী। প্রযোজনা:- বারাসাত কাল্পিক। অমল আলোতে গত ১৯ জুন, এটা নিয়ে আমার দ্বিতীয় নাটক দেখা এই স্পেসে। সঠিক ভাবে বললে, “গল্পের মতোই”পরিপূর্ণ থিয়েটার ছিল না। ছিল, থিয়েটার অন্ত প্রাণ কয়েকজন উদ্যোমি যুবক যুবতীর থিয়েটার প্রেম।বাস্তবিক, থিয়েটার বলতে যে চলমান নির্মাণটা বিধিবদ্ধ, মায়াপ্রপঞ্চ এবং মঞ্চমোহে হারিয়ে যাওয়া , হারিয়ে যেতে যেতে আলোর নির্ণিমেষ লুকোচুরিতে মোহিত হয়ে, আবহ সঙ্গীত নিয়ে চরিত্রের গভীরে যাওয়া,সেইরকম থিয়েটার এটা নয়। না হলেও ভালো লাগার অনেক নির্মাণ-বিনির্মাণ এক ঘন্টার এই নাটকটিতে ছিল। নাটকে তিন জন চরিত্র মূল।ওই তিনজনকে সাজিয়ে পরিবেশন করার জন্য আরও কয়েকটি চরিত্র ছিল। একজন কৃষক, একজন মধ্যবিত্ত কাজ হারানো যুবক, আর একজন অবাঙালি কাজ হারানো শ্রমিকের যাপন কে তুলে ধরা হয়েছে। প্রথম দুজনকে চলমান থেকে আবহমান কালে সঁপে দিয়েছেন পরিচালক। শুধুমাত্র অবাঙালি শ্রমিককে নিয়েই নাটকের পরিণতি টেনেছেন। নাটকের শুরুটা যেভাবে মুখীন করে তুলেছিল দর্শকের কৌতূহলকে, শেষটা ততটা সংগবদ্ধ হয়ে ওঠেনি। গল্পটা হঠাৎ শেষ হয়ে গেল, কিন্তু শেষ হবার কথা ছিল না। শেষমেশ কাজ হারানোর জন্য ক্ষিদে, ক্ষিদের জন্য সম্পর্কের নতুন মূল্যহীন পারিবারিক পতন , এই দিয়েই নাটক শেষ! তিনটে আখ্যান ভাগের শেষ পর্যন্ত উপসংহার বা নাটকের শেষভাগটা নিয়ে আরো ভাবনাচিন্তা করা যেতে পারে। এবং সেটা অমল আলোর মঞ্চকে মাথায় রেখেই করা যেতে পারে।এই ধরনের এ্যাক্টিং স্পেস ব্যবহারে সংলাপের উচ্চতাকে প্রাধান্য দেওয়া জরুরি কি না, আলোচনা চলতে পারে।
যমরাজ এবং চিত্রগুপ্ত এই রসায়নটার সঙ্গে বাকি তিনটি চরিত্রের বিনির্মাণগুলো পুনরায় ভাবা যেতে পারে। তিনটি চরিত্রের সংলাপই সময়ের, এবং অভিনয় ভালো লাগলেও, অভিনেতাদের কন্ঠস্বরের শৈল্পিক প্রকাশকে আরো চর্চায় নিয়ে আসলে ভালো হয়। অবাঙালি শ্রমিকের চরিত্রাভিনেতা অজয় বিশ্বাস হিন্দি ভাষায় ভালোই পারঙ্গম। অভিনেতা সম্ভাবনাময়। ছিঁচকে চোরের অভিনেতা হাতের বেরে টিভি সেট তোলা, একবার চোরবাজারে নিয়ে, পুনরায় গেরস্থের ঘরের সামনে রেখে যাওয়ার অভিনয়ে হাত দুটোর ব্যবহারকে আরো অনুশীলন করতে হবে মনে হোল।
পরিশেষে এটাই মনে হয়েছে, গুটিকয় দর্শক নিয়ে একটি ঘরোয়া মঞ্চে আলো ও আবহ ব্যবহার করে থিয়েটার করাটা অভিনেতা অভিনেত্রীদের কাছে অনুশীলন এবং নিরীক্ষা হলেও, আমার মতো থিয়েটার দর্শক সেখান থেকে রস আস্বাদনে বঞ্চিত হতে বাধ্য। আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি জানিয়েও বলছি, সামগ্রিক স্বার্থে ,”অমল আলোর” ঘরোয়া স্পেসটাতে থিয়েটারের চর্চাটা এবং অভিনয়টা চলা উচিত। নতুন অভিনেতা অভিনেত্রীরা সমৃদ্ধ হবেন এবং নাটকের নতুন দর্শক তৈরি হবে। পাশাপাশি, দেবব্রত ব্যানার্জীর মতো নাট্যকার এবং পরিচালকরা মেধা চর্চায় প্রতিনিয়ত শান দিতে পারবেন।
অশোকনগরে অমল আলোর রূপকার অভি চক্রবর্তীর এ হেন মঞ্চভাবনা অনেক নাট্যদলকেই সমৃদ্ধ করে চলেছে। এ জাতীয় মঞ্চকে এক কথায় প্রসেনিয়াম থিয়েটার এবং ইন্টিমেট থিয়েটারের ককটেল বলা যেতে পারে। দুটো মাধ্যমের অভিব্যক্তি দুই রকমের। দুই রকমের অভিব্যক্তিকে এক জায়গায় আনার ফলে, রসহানি হচ্ছে কিনা সংশ্লিষ্ট চিন্তাবিদরা ভেবে দেখতে পারেন। এই ধরনের স্পেসে অভিনয় করা মানে, একটা থিয়েটার কেন্দ্রীক জমাট আড্ডার ক্ষেত্রও যে তৈরি হয়, সেটা অস্বীকার করা যাবে না।
কোলাজ গুলো জুড়তে হবে নাট্যকার। অন্তত সমালোচনা পড়ে এমনই বোঝা গেল। লেখার মান ভীষণ পছন্দ আমার।
অমল আলোয় বসে দু বার দেখেছি, কোনবার ই পলক ফেলতে পারিনি ♥️
বাস্তবের ছাল ছাড়ানো থিয়েটারে বোধ হয় হেগেলের উল্টো দর্শন না খোঁজাই শ্রেয় পরিপূর্ণতার মান কি হবে তা বোধহয় সমালোচক ব্যক্তিগত নিরীক্ষণে মাপছেন। সামগ্রিক স্বার্থে আমার বিশ্বাস সমালোচক নাটকের অর্থ উপলব্ধিতে ব্যর্থ। চিত্রগুপ্তের প্রসঙ্গে সমালোচকের বক্তব্য প্রমাণ করে গোদা অর্থে তিনি নাটকের বহিরাবয়ব দেখেই ক্ষান্ত; গভীরতা বিচারের বিন্দুমাত্র প্রয়াস তাঁর নেই। এহেন সমালোচনা থিয়েটারের কতটা উন্নতি ঘটাবে তা নিয়ে সংশয় জাগে! ভাষা বেষ্টনীতে সমালোচনা করলেই তা বোধ হয় গ্রাহ্য হওয়া কাম্য নয়। থিয়েটার পত্রিকার কিছু দায় থেকে যায় থিয়েটারি সমালোচনার ক্ষেত্রে। সেই দিকে নজর দিলে হয়তো, পরবর্তীতে নাটকের এহেন অবান্তর কাটাছেঁড়া হবে না বলেই বিশ্বাস।
আমি গত বছর নাটকটি দেখেছিলাম এবং মুগ্ধ হয়েছি। আমার মনে হয় আপনি নাটকটির অনেক কিছুই মিস করে গেছেন। সম্ভবপর হলে আর একবার দেখুন, বুঝতে সুবিধা হবে।
নতুন সময়ের পরিচালকদের জন্য অমল আলো সবসময়েই উন্মুক্ত। আমরা একটা নির্দিষ্ট দিশা নিয়ে অমল আলো ও তাতে অভিনীত নাট্যগুলিকে সাজাতে চাইছি।
২০২০ সালের ৪ ঠা অক্টোবর প্রথম অভিনীত হয় নাটক গল্পের মতোই ( এভাবেই থেকে যায় )। তারপর ভিন্ন ভিন্ন স্পেসে পথ চলা। তারমধ্যে কিছু আমন্ত্রণমূলক ও কিছু নিজস্ব। আর প্রত্যেকবারই দৃষ্টান্ত হিসেবে রয়ে গেছে নির্দেশক দেবব্রত ব্যানার্জীর স্পেসের ব্যবহার। কখনও ওপেন এয়ার, বা কখনও ইন্টিমেট। কোনো স্পেস তথাকথিত যে ভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, ‘গল্পের মতোই…. ‘ বারবারই তাকে নতুন রূপ দিয়েছে।
আর বিগত দুই বছরে নাটক ‘গল্পের মতোই… ( এভাবেই থেকে যায় )’ এর বেশ কিছু রিভিউ পাওয়ার পর , এই রিভিউটা একটু অন্যরকম লাগলো। কোথাও যেনো মনে করিয়ে দিলো, মঞ্চ নাটকই পরিপূর্ণ থিয়েটার। ধরা পড়লো উদ্যোমি যুবক যুবতীর থিয়েটার প্রেম, কিন্তু হারিয়ে গেলো তাদের প্র্যাকটিস। গল্পটাকি হঠাৎ শেষ হয়ে গেলো ….. নাকি আশার আলো জ্বালিয়ে দিলো। কোন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আজ আমরা সবাই ….. সেই ছবি যেনো অস্পষ্ট রয়েই গেলো। আর স্পষ্ট হল থিয়েটার কেন্দ্রীক জমাট আড্ডা।
যেমনি ছবি দিয়ে তৈরি ধাঁধার খেলায় , যদি একটি ছবিও হারিয়ে যায় , তবে সেই ধাঁধা যেমন কোনো দিনই মিলবে না, এক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটেছে। তাই উপরোক্ত ‘খাটে বসে মেঝেতে নাটক ‘ আলোচনাকে নাটকের রিভিউ বলার চেয়ে , শুধুমাত্র ব্যক্তিগত মতামত বলাই শ্রেয়।
নমস্কার, সশ্রদ্ধ সম্মান জ্ঞাপন করে বলছি, একজন দর্শক হিসাবে আপনার মতামতের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আলোচনাটির উক্ত রূপক ধর্মী শিরোনামের ব্যাখ্যার যথেচ্ছ অভাব রয়েছে। আসলে আমাদের প্রত্যেকের জীবনে এমন কিছু গল্প থেকে যায়, যেগুলোকে আমরা কেউই এড়িয়ে যেতে পারি না, সেগুলো এভাবেই নিজেদের মতো করে থেকে যায় অগোচরে। এমন কিছু থেকে যাওয়া গল্প নিয়ে এই নাট্য। আপনার মতামতে আমি সমৃদ্ধ হয়েছি। আবারো দেখার আহ্বান রইল, ধন্যবাদ আপনাকে।
পুনশ্চ :- গল্পের মতোই (এভাবে থেকে যায়..) নাটকটি বিভিন্ন স্পেস অনুযায়ী তার মঞ্চসজ্জা পরিবর্তন করে থাকে এবং নাটকটিতে মোট ৮ টি চরিত্র বর্তমান ছিল, যার মধ্যে মধ্যবিত্ত কাজ হারানো যুবকের পরিবর্তে একজন শিল্পী বা অভিনেতা ছিলেন।
আসলে আপনার দেখার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট ধারণা প্রকট হয়ে চেপে বসেছে। উপন্যাসের সঙ্গে সঙ্গে যেমন নভেলা, ছোট গল্প বা মুক্ত গদ্য থাকবে। তেমন বহুযুগ ধরেই মঞ্চ নাট্যের সঙ্গে সঙ্গে ঘরোয়া আয়োজনের এইসব নাট্য প্রদর্শন আমাদের দীর্ঘদিনের পরম্পরা। জোড়াসাঁকোর থিয়েটার বইটিতে এর খোঁজ পাবেন। এছাড়াও আমাদের দেশে প্রাচীন লোকনাট্যের অভিনয় উঠোন চাতাল বারান্দায় হরবকত হতো। যা হোক…আপনার ভালো না লাগাটা ব্যক্তিগত সেটা থাকতেই পারে। আধুনিক থিয়েটার সম্পর্কে আমাদের সংযোগ বাড়াতে হবে।
আমার প্রায় সব কথাই বলে দেওয়া হয়েছে। আর যা রয়ে গেলো তার কথাও খুব তাড়াতাড়ি জানাবো। আসলে বুনতে বুনতে যাওয়া তাই সব উত্তর দেওয়া যায় না। সবটা বলে দিলে মনে হবে এতো সবাই করে তুমি কি আর করলে। এটা একটা জার্নি। যার খানিকটা অভিনেতারা তাদের মত করে জানিয়েছে। এরকম প্লটে নাটকটি কখনোই ভাগ নেই। এটাকে থিয়েট্রিকাল পারফরম্যান্স বলা যেতে পারে। তবে আপনাদের মত দর্শক থিয়েটারে প্রয়োজন… আরেকবার ভাবা যায় শুধুই কি গল্প বলে যাবো… নাকি দর্শকরা আরেকবার ভাবতে বসবে কোথায় আছি, কেনো বলছে। কিন্তু সরাসরি নয় আর্টের মাধ্যমে বলবো সরাসরি কথাতো রাজনীতি যারা করেন তারাও বলেন। বিশ্বাস করি শিল্পীরা শিল্পের মাধ্যমেই সমস্ত ভাব প্রকাশ করবেন। ধন্যবাদ অমল আলো জার্নাল কে।