করবো তবে কি? | অভি চক্রবর্তী

একটা বিকেল বিকেল আলো পড়ে থাকে মঞ্চে। একটি মেয়ে কিৎকিৎ খেলছে দ্যাখা যায়।
– চু কিৎ কিৎ কিৎ থা…
– (একটা ভয়েস আসে)- এই এমন ধিঙ্গি মেয়ের কিৎকিৎ খেলা উচিৎ নয়।
– ঐ মেয়েটিকেই দ্যাখা যায় বড়শি নিয়ে পুকুরের পাড়ে বসে আছে, চুল খোলা-
– (একটা ভয়েস আসে)- খোলা চুলে এই ভরদুপুরে কেউ মাঠে যায়?
– ঐ মেয়েটিকেই দ্যাখা যায় ঘুড়ি ওড়াচ্ছে প্রাণপণে।
-(আবার সেই ভয়েস আসে)- আরে আরে দেখেছো কান্ড, বয়েসের গাছপাথর নেই, ছেলেদের সঙ্গে মেয়েছেলেটা ঘুড়ি ওড়াতে লেগেছে —

নানান ভয়েস, নানান মডিউলেশানের না না শব্দ কানে আসতে থাকে মেয়েটির। মেয়েটি চিৎকার করে বলে-

তবে আমরা কি করবো? ছেলেবেলা থেকে শুধু বারণের হরেকরকম ফিরিস্তি দিয়ে আসছেন আপনারা, বারণকে উন্মত্ত পাগলা কুকুরের মতো লেলিয়ে দিয়েছেন আমাদের পেছনে। জন্মাতে না জন্মাতেই বুঝিয়ে দিয়েছেন আমরা মেয়ে! থুড়ি জন্মানোর আগেই মানে আমি যখন পেটে তখনই রীতিমতো আমার বাবার বাড়ির লোকজনেরা মানৎ করতে লেগে পড়ে থাকতেন, যেন পেটের ভেতর একখানা আস্ত ছেলে হয়, তাদের অত্যাচারের পারদ এতোই তীব্র হয় যে মাকে বাধ্য হতে হয় ল্যাবে গিয়ে অবৈধভাবে ভ্রুণ পরীক্ষা করাতে… মা যেদিন জানলেন মেয়ে, সেদিন মা হেসেছিল একরাত ধরে, টুকরো চাঁদের দিকে তাকিয়ে, আকাশ সেদিন রাতেও ঘন নীলাকার ধারণ করেছিল। মায়ের হাসির মধ্যে লুকিয়েছিল আগত অত্যাচারের, আজীবনের বেদনার আঁকিবুকি। হাসি আর কান্না হাত ধরাধরি করে চল্লে কেমন রূপ পায় সে রাতেই, পেটের আদিম গুহার মধ্যে থেকেই জেনে গেছিলাম আমি। জেনে গেছিলাম মেয়েজন্ম ভাল নয়। মেয়েজন্মে অভিশাপ উড়ন্ত মাছের মত আঁশটে গন্ধ ছড়ায়। ঝাঁক ঝাঁকে কাক এসে বসে কার্নিশে, ছাদে… দরজায়… উঠতে বসতে মাকে বিড়ম্বনায় ফেলা হত, সামান্য গলা ছেড়ে কাঁদলেই বলা হতো, অলক্ষীর জন্ম হয়েছে ঘরে… আমি বুঝতেই পারিনি অলক্ষী যদি মেয়েরা হয় তাহলে লক্ষী কারা? ঘটা করে কোজাগরী পূর্ণিমার দিনে এরাই কেন উপোশ রেখে, আল্পনা দ্যায়, ভোগ রাধে… একদিন এমনই এক পূর্ণিমা, জ্যোৎস্নায় ছেয়ে আছে চারপাশ, বাজির ধোঁয়া সে জ্যোৎস্নাকে মলিন করেছে খানিক কিন্তু মুছে দিতে পারেনি, তুবড়ি ধরানোর অছিলায় পাড়াতুতো এক কাকু আমাকে নিয়ে গেলেন ছাদে, সেই মলিন জ্যোৎস্নায় ছুঁয়ে দিলেন আমার সদ্য হয়ে ওঠা বুক…পিষে ধরে বল্লেন, আমি যেন কারোকে না বলি!!! কি কান্না কেঁদেছিলাম জানেন তো! রাতে লুকিয়ে মাকে বল্লাম, মা আমাকেই পাঁচ কথা শুনিয়ে চেপে যেতে বল্লেন, বারবার করে বল্লেন আমি যেন কারোকে এসব না বলি- আমি যেন সাবধানে থাকি- ধিঙ্গিপনা না করি, বুকে ওড়না দিয়ে বাইরে বেরোই…

ওড়না। মেয়েদের প্রথম আশ্রয়। প্রথম প্রেমিক। বুকে চেপে রেখে মেয়েরা বোঝে আশ্রয় কি!!! আলো কি!!! ওড়না জুড়ে সমস্ত না এর বিপক্ষে হ্যাঁ লিখেছিলাম আমি… একমাত্র সেই কোজাগরি জ্যোৎস্নার দিনে সেই ওড়না আমি ছাদে গিয়ে চাঁদের সামনে ধরতাম, দেখতাম একে একে সেই ওড়নার থেকে বেরিয়ে আসছেন -ডাক্তার কাদম্বরী

বেরিয়ে আসছেন – বেগম রোকেয়া,
বেরিয়ে আসছেন – প্রীতিলতা ওয়েদ্দেদার,
বেরিয়ে আসছেন – পি টি ঊষা,
বেরিয়ে আসছেন – ঝুলন গোস্বামী।

ইতিহাস নিয়ে পড়তে আমার ভাল লাগত খুবই। এক মেয়ে হলেও পড়াশোনার জন্য বেশি খরচ বাবা- মা করতে চাননি, প্রতি জন্মদিনেই এক একটা করে গয়না গড়িয়ে রাখা হত আমার জন্য। শুনতাম নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনে এই গয়না বিয়ের সময় কাজে দেবে, শ্বশুড়বাড়ি পাঠানোর সময় নাকে গলায় কানে হাতে সাধ্যমতো দিয়ে ভরে দিতে হয় মেয়েকে। তাহলেই নাকি মেয়ে লক্ষী হয়ে যায়…তারই জন্য এসব আয়োজন। গয়নাগুলোকে আমার কেমন যেন বেরি মনে হত, হাতের চুরি বা কানের দুল, হাড় বা পায়ের মল সবই গোল গোল বেরি… ইতিহাস পড়তাম যখন চেঁচিয়ে এইসব বেড়ি খুলে যেত আমার জানলা দিয়ে ঢুকে আসতে কোজাগরী পূর্ণিমার সেই জ্যোৎস্না। মা বলত আমাকে নাকি ঐ কাকু নষ্ট করতে চেয়েছিল, আমি আসলে ঐ টুকরো অসভ্যতা, ঐ পিচ্ছিল লালসা, ঐ কাপুরুষের পদশব্দ থেকে বুঝে গিয়েছিলাম যে এ কারণেই মেয়েদেরকে না এর চক্রব্যুহের মধ্যে ফেলে রাখা হয়। সীতাকে এই নায়ের আগুনেই বারবার পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলেন তার স্বামীই স্বয়ং, সেই পবিত্রতা এখনো বহমান…পুরুষ সকলের সামনে প্রমাণ করে খুশী হয় যে তার স্ত্রী মহৎ পবিত্র আবার আড়ালে সেই স্ত্রীকেই পণ করে পাশা খেলতে পিছপা হয়না, তখন তার নাম হয় যুধিষ্ঠির। হাস্যকর লাগত এইসব মহাকাব্যের মধ্যে দিয়ে আমাদের বেড়ে ওঠার মধ্যে এসে দাঁড়ালে আমার… আমার খেলা পেত। খুব করে খেলা পেত।

চু কিত কিত কিত… চু কিত কিত কিত থা-

আমি আমার চাকরির টাকায় আমার বাড়ির ছাদে একটা কিতকিতের কোর্ট কেটে নিয়েছিলাম। সেখানে ঐ যে থা টা বলে চারাটাকে ঘরে ঢুকাতাম না- তখন আমার সমস্ত নারীত্ব দিয়ে যেন সমাজের যাবতীয় নাকে ঢুকিয়ে দিতাম ঘরে, গরাদের অন্ধকারে। আকাশে তখন চাঁদ আশীর্বাদের আলো ছড়িয়ে দিতো… মেঘ আমাকে পিওনের পোশাকে এসে সে আলো কতোবার দিয়ে গেছে…যে স্বামী বলতো বাইরের লোকেদের সামনে বেশি বেশি যেওনা সেই স্বামীই আবার তার বস এলে বলত আজকে কালো স্লিভলেস ব্লাউজের সঙ্গে রেড শিফনটা পোরো তোমায় মানায় দারুণ। আসলে বসের সঙ্গে মশকরা, তামাশায় তার পদোন্নতির সমূহ সম্ভাবনা মিলেমিশে যায়…পুরুষ বা এই পুরুষ নিয়ন্ত্রিত সমাজ বিবিধ ফন্দির মধ্যে দিয়েই আমাদেরকে চালাতে চায়, সেখানে হেডকাইটের মতো না জ্বলে থাকে, জোনাকির মতো ‘না’রা ছেয়ে থাকে…আপনাকে আমাকে যদি বাঁচতে হয়, তবে এইসব পুড়িয়ে বাঁচতে হবে, সমাজের নাক-মুখের উপর দিয়ে ভাঙা খোয়া বা চারকোল দিয়ে এঁকে দিতে হবে কিতকিতের উদ্ধত কোর্ট-

আর খেলে যেতে হবে আজীবন – মেয়েটি আবার কিতকিত খেলার ভঙ্গি করে, চু কিতকিত চু কিতিকিত ইকো হয় গোটা মঞ্চে আলো দপ দপ করে।

পছন্দসই গানের মধ্যে থেকে মেয়েটিকে দ্যাখা যায়। নানান কাজে রত।

রান্না
চাকরির জন্য প্রস্তুতি
মেয়েকে খাওয়ানো
শ্বাশুড়িকে খাওয়ানো
বাজার করা
রাতে স্বামীর সঙ্গে সঙ্গ দেওয়া
ঘুমানো….