নীলদিগন্ত
গত ১৮ থেকে ২০ মার্চ, গোবরডাঙ্গা শিল্পায়ন স্টুডিও থিয়েটার ও গোবরডাঙ্গা সংস্কৃতি কেন্দ্রে মহা সাড়ম্বরে গোবরডাঙ্গা কথাপ্রসঙ্গের নাট্য উৎসব ২০২২ অনুষ্ঠিত হলো। শুভ সূচনা করেন পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্রের প্রশাসনিক আধিকারিক অভিজিৎ চট্ট্যোপাধ্যায়, সঙ্গে ছিলেন আশিস চট্ট্যোপাধ্যায়, আশিস দাস, শ্যামল দত্তর মতো বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্বরা । উপস্থিত ছিলেন গোবরডাঙা পৌরসভার নবনির্বাচিত পৌরপ্রধান শঙ্কর দত্ত। তিনি বলেন গোবরডাঙ্গার সংস্কৃতি বিকাশের লক্ষ্যে পৌর টাউন হলকে আরো ব্যবহার উপযোগী করে তোলা হবে।
১৮ মার্চ প্রথম পর্যায়ে শুভ দোলপূর্ণিমা উপলক্ষে গোধুলী বেলায় গোবরডাঙ্গা কথাপ্রসঙ্গ আয়োজন করেছিল বসন্ত উৎসব। নাচ গান ও কবিতা সমন্বয়ে এই উৎসব গোবরডাঙ্গার বুকে এক নজির তৈরি করল। অনুষ্ঠানে সংগীতের মাধ্যমে মানুষের মন জয় করল আঁকন মজুমদার, শিল্পী সেন ও তন্ময় সাহা। নৃত্যের তালে তালে মন ভরিয়ে দিল মেদিয়া আঙ্গিক ও নৃত্যম্ বলম্ এর শিল্পীবৃন্দ। কথা যখন কবিতা হয়ে ওঠে, তখনই তো হয় প্রাণের উৎসব। এই প্রাণের বসন্ত উৎসবে কবিতা পাঠ করল সম্পৃক্তা গুহ। প্রথম পর্যায়ের অনুষ্ঠানে সুমধুর কন্ঠে সঞ্চালনা করলেন আস্তিক মজুমদার ও অনিমা দাস।
দ্বিতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানের শুরুতে সঙ্গীত পরিবেশন করেন দীপা ব্রহ্ম। মঞ্চে উপবিষ্ট সকল গুণীজনদের উত্তরীয় পরিয়ে ও স্মারক সম্মানে সম্মানিত করা হয়। মূল্যবান বক্তব্য রাখেন মঞ্চে উপবিষ্ট সকল আতিথিবর্গ। এরপর দুখানি নাটক মঞ্চস্থ হয়। প্রথম নাটক বারাসাত জনস্বর প্রযোজিত নাটক “হিজিবিজি প্রা: লি:”। নাটক ও নির্দেশনা প্রলয়। বেকারত্ব আর বুদ্ধিকে পুঁজি করে দুই বন্ধুর লোক কাবু করা ও মানুষের মননকে নিয়ে খেলার নাটক। নির্দেশক প্রলয়ের কথায়- — লু সুন এর পাগলের ডায়েরি ২০১৮ তে করার পর আবার ২০২১ এর ফেব্রুয়ারিতে হিজিবিজি প্রাইভেট লিমিটেড করার ভাবনা মাথায় আসে। চারপাশে ঘটে চলা অনেক ঘটনার, অনেক রি- অ্যাকশান এর অ্যাকশন এই নাট্য। ভাবনার শুরু থেকেই আমি একটা বিষয়ে খুব পরিষ্কার ছিলাম। সেটা হচ্ছে নাটক এবং নাট্যের ভাষা হবে অত্যন্ত সহজ, যা একটা বিরাট সংখ্যক দর্শকের কাছে সহজে পৌঁছতে আমাদের সাহায্য করবে। দ্বিতীয়ত আমাদের লক্ষ্য যেহেতু বর্তমান ভারতবর্ষের নগ্ন ফ্যাসিবাদী শক্তিকে প্রকাশ্যে আঘাত করা,তার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা, যেখানে বক্তব্যই প্রধান এবং মুখ্য, সেখানে নাট্যের চলনে ব্রেখট এর alienation আমাদের প্রধান অস্ত্র হওয়া উচিৎ। তৃতীয়ত রাষ্ট্র যখন তার দাঁত নখ বার করে, নাগরিকের চোখে চোখ রেখে তার শোষণ যন্ত্র কায়েম করতে মত্ত হয়ে যায়, তখন একজন থিয়েটার কর্মী হিসাবে সরাসরি কথা বলা, বা আঘাত হানার চেষ্টাই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে বলেই আমাদের মনে হয়েছে। এরকম আরো অসংখ্য ভাবনা, যুক্তি তর্ক,আলোচনা থেকেই এই নাটক ও নাট্যের জন্ম। রাজু ও পল্লবের অভিনয় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।
দ্বিতীয় নাটক গোবরডাঙ্গা কথাপ্রসঙ্গের “বন্ধ দরজা”, নির্দেশনা ও সামগ্রিক পরিকল্পনায় বিকাশ বিশ্বাস। বন্ধ দরজা নাটকটি দর্শকদের মনে সাড়া ফেলে দিয়েছে। একজন সৎ মানুষের মস্তিস্ক বিভ্রম অথবা তার জীবনের সততার বিড়ম্বনার গল্প এই নাটকে প্রতিফলিত হয়েছে। অভিনয় এই নাটকের মূল সম্পদ, প্রত্যেক অভিনেতার অভিনয় দক্ষতা দর্শকদের মাতিয়ে রেখেছিল। বিশেষ করে নীলাঞ্জন ভৌমিক অনবদ্য। দীর্ঘদিনের নাট্য পরিচালনায় অভিজ্ঞ নির্দেশক বিকাশ বিশ্বাসের এই নাটকটি অত্যন্ত সময়োপযোগী কাজ।
১৯ মার্চ সন্ধ্যায় গোবরডাঙা সংস্কৃতি কেন্দ্রে দুখানি নাটক মঞ্চস্থ হয়। প্রথম নাটক পরিবেশন করে ঠাকুরনগর অনুরঞ্জন, নাটক “যা তারা পারে না”। নির্দেশনায় ছিলেন মিন্টু মজুমদার। এইদিন উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক ইন্দ্রজিৎ আইচ, তাঁকে সম্বর্ধনা জানানোর পর শুরু হয় দ্বিতীয় নাটক বসিরহাট কিংশুকের “ময়নামতীর ইতিকথা” নির্দেশক মুকুন্দ চক্রবর্তী।
তৃতীয় দিন ২০ মার্চ সন্ধ্যায়ও দুখানি নাটক মঞ্চস্থ হয়। এ দিনের প্রথম নাটক ছিল আয়োজক সংস্থা কথাপ্রসঙ্গের “বন্ধ দরজা”,
দ্বিতীয় নাটক গোবরডাঙা মৃদঙ্গমের “ছায়াকৃত”, নির্দেশনায় ছিলেন অসমের বিখ্যাত নির্দেশক কুশল ডেকা। নাচ, গান, নাটকের আড্ডা, প্রচুর দর্শকের সমাবেশে, আন্তরিকতায় নাট্য উৎসব প্রাণ পেয়েছে। সংস্থার কর্ণধার বিকাশ বিশ্বাস জানান, কথাপ্রসঙ্গ দীর্ঘ কুড়ি বছরের বেশি সময় ধরে নাটকের বিভিন্ন আঙ্গিকে কাজ করে চলেছে, নাট্য উৎসব এর মধ্যে অন্যতম কর্মসূচি। কথাপ্রসঙ্গ বিগত দিনে জাতীয় নাট্য উৎসবেরও আয়োজন করেছে। কোভিড পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগলেও আমাদের মননে ও জীবনে নাট্য চর্চা কখনো থেমে থাকেনি। কথাপ্রসঙ্গের এই কর্মকান্ডের সফলতার পিছনে অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা, আদর ও প্রশ্রয়। থিয়েটার বেঁচে থাকবে থিয়েটারের শক্তিতে।