কত রঙ্গ দেখি কলকেতায় | নীলা বন্দ্যোপাধ্যায়, পর্ব – ১৩

আগে যা ঘটেছিল 

কালীমতী তরুলতাকে রাখতে অস্বীকার করলে ননীমাধব তাকে নিয়ে আসে সোনাগাছির মানদার কাছে। তরু প্রথমে কোথায় এসেছে ধরতে না পারলেও পরে বুঝতে পেরে পালাতে যায়। ধরাও পড়ে তরুলতা। এমন সময় দুজন সার্ভেয়ার আসে সোনাগাছির মানদাসুন্দরীর বাড়িতে। সার্ভেয়ার দুজন জানায় এ পাড়ার বহু বাড়ির মালিকানা নাকি জোড়াসাঁকোতে। সংসার যাপনের আর অভিনেত্রী হবার স্বপ্ন নিয়ে সে এসেছিল কলকাতায়। অথচ তাঁর ঠাঁই হলো বেবুশ্যে পল্লিতে। অবিশ্যি সেখান থেকেই সকলে অভিনেত্রী হয়। সকলেই কী? নাকি এ বাড়ির মালিকানা যে জোড়াসাঁকোতে সেখানে চলছে তখন অন্য অভিনয়ের ধারা!

আজকের পর্ব 

বিকেল তিনটে থেকে ১৪ নং লোয়ার সার্কুলার রোডের বাড়ির সামনে জুড়িগাড়ি প্রস্তুত। এবাড়ির কর্তা গিন্নি যাবেন জোড়াসাঁকোর ছয় নম্বর বাড়িতে। ঐটেই তাঁদের আসল বাড়ি, তাঁরা ও বাড়ির মেজো কর্তা, মেজো গিন্নি। এই কর্তা গিন্নি বম্বে, বিলেত ঘুরে আসা ইস্তক জোড়াসাঁকোর বাড়ির বাইরে থাকছেন। বাবামশায়ের তেমনই নির্দেশ। কখনও ৫০ পার্ক স্ট্রিট, কখনও ১৪ নম্বর লোয়ার সার্কুলার রোড আবার কখনও বির্জি রোডের বাড়িতে। অতি আধুনিক কর্তা গিন্নির মনোভাবের সঙ্গে ও বাড়ির সকলে মানিয়ে নিতে পারেনা। বিশেষত স্বাধীনচেতা মেজো গিন্নিকে নিয়ে অনেকেরই আপত্তি। তবে মুখে তা কেউই প্রকাশ করেনা। ক্ষোভ, দুঃখ, যন্ত্রণা, বিরক্তি ইত্যাদির সোচ্চার প্রকাশে তাঁদের আভিজাত্য খর্ব হয়। ও বাড়ির মেয়ে বউরা আর পাঁচটা বাঙালি বাড়ির মেয়েদের মতো উচ্চকিতে মনের ভাব প্রকাশ করেনা, হাহা করে হেসে গাল গল্প করেনা, রান্নাঘর, পতিসেবা, ঠাকুর পুজো, বাচ্ছা মানুষ করা অথবা হরিনাম সংকীর্তনে দিন কাটায় না। তাঁরা লেখা-পড়া, গান-বাজনা, সেলাই-ফোঁড়াই, কাব্য সাহিত্য, ইংরাজি বিজ্ঞান শেখে। রীতিমতো চর্চা করে অধিগত বিদ্যার। তারা উদোম গায়ে শাড়ি জড়ায় না, সিঁথেতে চওড়া করে সিঁদুর লেপে না, চুলে গুছি বেনি বেঁধে তা ঘোমটায় ঢেকে দেয়না, পুরুষ মানুষ দেখলে এক হাত জিভ কাটে না। এরা পেটিকোট, জ্যাকেট পরে, পায়ে জুতো পরে, মাথায় ঘোমটার বালাই নেই পুরুষদের সঙ্গে গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে যায় অথবা বৈঠক খানায় আড্ডা মারে। এই নাকি আধুনিকতা। গোঁড়া হিঁদুরা তাই ব্রেহ্মদের গাল দেয় উদয়াস্ত। যত না তাদের পুজো আচ্চার ধরন নিয়ে আপত্তি সমাজের তার চেয়ে বেশি এদের বেপরোয়া মনোভাবে আপত্তি। এদের দেখে বহু হিন্দু বাড়ির ছেলে মেয়েরাও এমন অনাসৃষ্টির জীবন কাটায় বলে চিন্তিত সমাজ। এই তো ৬ জোড়াসাঁকোর ৬ নং বাড়ির লাগোয়া ৫ নং বাড়ি তো হিন্দু, তারাও কমতি কিসে। বিশেষত এ দু বাড়ির মেয়েদের আধুনিকতার নামে বেপরোয়া আচরণ সহ্য হয়না অনেকেরই। এই দুবাড়িতে স্বাধীনচেতা মেয়ের সংখ্যা ক্রমে বেড়েই চলেছে।

তবু এ দু’বাড়ির অনেক মেয়েরাই ৬নং বাড়ির মেজো বৌয়ের সঙ্গে তেমন খাপ খাওয়াতে পারেনা। হতে পারে মেজো গিন্নির অতিরিক্ত ব্যক্তিত্ব আর বিলেত ঘুরে এসে একটু বেশি আত্মবিশ্বাস তাকে উন্নাসিক করে তুলেছে। সকলে বলে মেজো গিন্নি ন’ননদকে ছাড়া আর কোনও মেয়েকেই মানুষ বলে গণ্য করেননা।
ন’ননদ বোধহয় তার চেয়েও বেশি আত্মবিশ্বাসী আর অহঙ্কারী। তেমনই সুন্দরী। কাঁচা সোনার মতো গায়ের রঙ, তাই গায়ের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে নাম দিয়েছিলেন তাঁর মা। এই ননদখানি দিনরাত দরজা বন্ধ করে ডুবে আছে নিজের কাব্য সাহিত্য নিয়ে। নিজের কন্যা সন্তানটিকে পর্যন্ত একবারও কোলে করেন না। দিনান্তে ঘর থেকে বেরিয়ে কারও আচরণের, সাজগোজের এতটুকু এদিক ওদিক দেখলে বলতে ছাড়েন না। তাই ও বাড়িতে ন’ননদ থাকলে মেজো গিন্নি নিজের প্রসাধনের একটু বেশিই যত্ন নেন।

এই আজ যেমন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটু একটু করে নিজেকে সাজিয়ে তুলছিলেন তিনি। দাসী মাথায় বিলিতি কায়দার বান বেঁধে দিয়েছে। সেই খোঁপায় পান্নার হেড গিয়ার লাগিয়েও দিয়েছে, কানে পান্নার আর সোনার ভারি দুল, গলা জোড়া সীতা হার বিছে হার পরেনা মেজো গিন্নি। তাঁর পছন্দ গয়না লম্বা বিলিতি চেন, আজ তাতে লাগিয়েছেন পান্না আর সোনার ভারি পেন্ডেন্ট। হাতে পান্নারই ব্রেসলেট। ভিক্টোরিয়ান স্টাইল জুয়েলারি পছন্দ তাঁর, একটু ভারি কিন্তু জরোয়ার ব্যবহৃত বেশি এমন গয়না। তাই বৌ বাজারের স্যাকরাকে নিজে হাতে এঁকে এসব গয়না গড়িয়েছেন। স্যাকরা ঠিক মতো পারেনি বলে কতবার যে ভেঙে গড়িয়েছেন তিনি। আজকাল সে স্যাকরাও বুঝে গেছে কেমন গয়না তাঁর চাই। আজ দু হাতে চারটি পান্নার আঙটি পরবেন বলে গয়নার বাক্স ঘাঁটলেন। মাত্র তিনটি পাওয়াতে এক হাতেই সবকটা পরে ডান হাত খালি রাখলেন। পান্না সবুজ জ্যাকেটের সঙ্গে দুধে আলতা মাদ্রাজি সিল্কে পান্নার ব্রোচ লাগিয়ে, পার্সি কায়দায় পরেছেন আজ মেজোগিন্নি। এমন শাড়ি বম্বেতে গিয়ে পরতে শিখেছেন তিনি। চোখে ঘন কালো কাজল, ঠোঁটে লাল পানের ছোপ। পায়ে ভেলভেটের জুতো। কপালে টিপের বালাই নেই। নিজেকে খানিক আয়নার সামনে দেখলেন, আর কিছু বাকি আছে কিনা। সাজ সম্পূর্ণ হয়েছে নিশ্চিন্ত হতেই আয়নার লাগোয়া দেরাজ থেকে ফরাসি সুগন্ধের ট্রেটিকে টেনে আনলেন। হরেক কিসিমের সুগন্ধের মাঝে কাঁচের মেয়েমানুষের আকৃতির একটা বোতল টেনে নিয়ে ঢাকাটি খুলে তার গন্ধ নিলেন। তারপর তর্জনী দিয়ে বোতলের মুখ চেপে তিনবার সে বোতল উলট পালট করলেন। তারপর ঈষৎ দুমড়ে থাকা চাঁপার কলির মতো আঙুলটি নিয়ে দুকানের পাশে ফরাসি এসেন্স লাগালেন যত্ন করে, আজ ন’ননদের চেয়ে কম সুন্দর লাগছে না এই ভেবে আয়নার দিকে তাকিয়ে বক্র হাসি দিলেন তিনি। ঠিক যেমন অতিরিক্ত প্রস্তুত প্রতিযোগী, প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হওয়ার আগে হাসে।

সাজগোজ করে সদরে এলেন তিনি। জুড়িগাড়িতে উঠতে যাবেন এমন সময় একটা ফিটনে চেপে মিসেস থমসন যাচ্ছিলেন। মেমসাহেব মেজগিন্নিকে দেখে ফিটনের গতি কমালেন। তারপর জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললেন
” Hello, Mrs. Tagore, How are you!”
মেম সাহেবের মতোই পাক্কা ইংরেজি উচ্চারণে জবাব দিলেন মেজো গিন্নি
“Hello,I am fine, thank you, What about you!”
“I am fine too. You look very beautiful today, are you going to attend any party now?”

” Thank you for your compliment Mrs Thomson, No I’m not going attend any party! I am going to my in-laws house”

“Oh Jorasanko! Is there any festival in Jorasanko today?”

মেজো গিন্নি মেমসাহেবের কথায় হেসে ফেলেন তারপর উত্তর দেন
“Every day there are some festivals in Jorasanko, but today there is no special festival.”

মেম সাহেবও এবার মেজোগিন্নির কথায় হেসে ফেলে তারপর বলে

“Let me know if there is any drama performance organized in Jorasanko. I saw the ‘Balmiki Pratibha’ there, it was amazing, ”

“I will definitely invite you. It would be great if I could talk about these for a long time, but I have to go today, I’m getting late.

“Oh sure Mrs Tagore, Have a nice day”

মেম সাহেবের গাড়ি ছেড়ে দিলে মেজোকত্তা বাইরে আসেন। কোচোয়ান দরজা খুলে দেয় জুড়িগাড়ির। নিজে উঠে হাত বাড়িয়ে দেন স্ত্রী’র দিকে। মেজো গিন্নি ভাবেন একদিন এই গাড়িতে ওঠা নিয়ে কি ঝামেলাই না পোহাতে হয়েছে ও বাড়িতে। মেয়েমানুষরা নাকি গাড়িতে ওঠেনা। মেজোকর্তা শোনেননি সেসব কথা। বম্বে যাওয়ার জাহাজে চড়ার আগে বাড়ির দোরগোড়া থেকে গাড়িতে উঠিয়ে ছিলেন মেজোগিন্নিকে। মেজোকর্তা না থাকলে এই কলকেতার বাইরের বৃহৎ দুনিয়াটা জানাই হতোনা মেজ গিন্নির। সেসব দিন মাঝে মাঝে মনে পড়ে। এবড়ো খেবড়ো পাথর থেকে কুঁদে কুঁদে এমন নিখুঁত পাথরের মুর্তি তাকে মেজো কর্তাই করে তুলেছেন। বিলতি আদব কায়দা, নানান ভাষা, জড়তাহীনতা রপ্ত করেছে মেজো বৌ। অস্বীকার করার উপায় নেই, মানতে না চাইলেও তার প্রভাব ও বাড়িতে সকলের মধ্যেই পড়েছে। মেয়ে পুরুষ সকলেই। সেজো দেবরটি তো মেজ গিন্নির অন্ধ ভক্ত, তাঁরা খুব বন্ধুও। কেবল মেজোগিন্নি তাঁর ছাপ ফেলতে পারেনি আধ পাগলী, আলাভোলা সেজো বৌ’টির ওপর। সাজে, পোশাকে, চলনে বলনে সেজ বৌয়ের বিস্তর পরিবর্তন হয়েছে, আধুনিকা হয়েছে সে। মনটাকে বাপের বাড়ির মতোই মধ্যবিত্ত মতোই রেখে দিয়েছে সে, কেউ বদলাতে পারেনি ওঁকে। বাড়ির সেরা ছেলে সেজ ঠাকুর পো, কি বউ হবার কথা ছিল, আর কি হয়েছে! এ বিয়েতে মেজো কর্তা গিন্নি দুজনেরই প্রবল আপত্তি ছিল। বাড়ির কর্মচারীর মেয়ে সেজ বৌ। কখনও খাপ খায়! বাবামশায় শোনেননি। কর্তা মাকে আর্জি জানাতে গেছিল মেজ বৌ। ভেবেছিলেন শান্ত নির্বিবাদ শাশুড়িকে বোঝাতে সক্ষম হবেন তিনি। উনি সব শুনে বলেছিলেন
” তোমার আপত্তি কি কেবল কর্মচারীর মেয়ের সঙ্গে বিয়েটা নিয়ে নাকি সেজো খোকার বে’তেই আপত্তি তোমার”

মেজ গিন্নি কিছুক্ষণ চুপ থাকে। শাশুড়ির ঈঙ্গিত তাঁর মতো বুদ্ধিমতী মেয়ের বুঝতে অসুবিধে হয়না। তারপর বলে
” আপত্তি আমার নয়, আপনার মেজো ছেলের। তিনি ভাইকে অতিরিক্ত ভালোবাসেন কিনা। এমন স্বল্প শিক্ষিত, গেঁয়ো মেয়েকে ভাইয়ের পাশে মানায় না বলে মনে হয়েছে তার”
কর্তা মা তাকিয়ায় আধশোয়া হন, তারপর বলেন
” মেজো খোকা যদি তোমায় তৈয়ের করে এমন সৌখিন বানাতে পারে, তবে এ বাড়ির সকলে মিলে তাকেও পারবে। তুমি যাও এখন আমার বিশ্রামের সময়”

সেদিনের পর থেকে শাশুড়ি যতদিন বেঁচে ছিলেন প্রণাম বিনিময় ছাড়া আর বাক্যালাপ হয়নি মেজো গিন্নির। মাঝখানে চোদ্দটি বছর কেটে গেছে। তবু অপমানের কাঁটাটা বুকের মধ্যে খচ খচ করে বাজে মাঝে মাঝে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে পার্ক স্ট্রিট থেকে জোড়াসাঁকোর দিকে এগোচ্ছিলো মেজ গিন্নি। মেজো কর্তার কথায় ভাবনায় ছেদ পড়ে মেজো গিন্নির।
” কি বলছিলো মেমসাহেব?”
“বলছিলো ও বাড়িতে নাটক হলে ওকে আবার ডাকতে। গত বছর ছোট ঠাকুরপোর ‘বাল্মিকী প্রতিভা’ দেখতে লেডি ল্যান্সডাউনের সঙ্গে এসেছিলেন মিসেস থমসন, আমি আমন্ত্রণ করেছিলুম ”
মেজো কর্তা বলেন
” দিব্য নাটক লিখতে শিখেছে ছোট ভাইটা আমার। কেমন সুন্দর লিখেছিলো বলো। আর আমাদের ছোট্ট প্রতিভা কেমন পাট করলে তাতে! আমি তো অবাক হয়ে গেছি! বঙ্কিমবাবু তো বঙ্গ দর্শন কাগজে এ নাটকের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ”
মেজোগিন্নি বলেন ” বঙ্কিমবাবু আগের অভিনয়টিতে এসেছিলেন, মিসেস ল্যান্সডাউনের বেলায় নয়, তবে ছোট ঠাকুরপোর নাটক সেজ ঠাকুরপোর মত সরেস নয়। সকলের মনে দাগ কাটবে কিনা জানিনা”
“আমি এতোসব বুঝিনা মেজ বৌ। তবে এ বুঝি সেজ ভাইটির প্রতি তোমার পক্ষপাত একটু বেশিই”
কথাগুলো বলে হাহা করে হেসে ওঠেন মেজ কর্তা। স্বামী স্ত্রী কথা বলতে বলতে গাড়ি এগোতে থাকে সার্কুলার রোড ধরে। এমন সময় কোচয়ান আচমকা গাড়ি থামায়। কর্তা ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করেন
“গাড়ি থামালে কেন কোচয়ান?”
” আজ্ঞে কর্তা গাড়ির সামনে এক গাদা জল যাত্রী এসে পড়েছে”
মেজো গিন্নি জানতে চান জল যাত্রীর মানে কী। কোচয়ান উত্তর দেয়
“আজ্ঞে এই শ্রাবণ মাসে সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের কালীঘাটের মন্দিরে পুজো দিয়ে, গঙ্গা থেকে জল ভরে সব তারকেশ্বরের মন্দিরে হেঁটে শিবের পুজো দিতে যায় কর্তা মা, তাদের কে জলযাত্রী বলে। মেজোকর্তা সবশুনে বলে ওঠেন “ডিসগাস্টিং ”
মেজোগিন্নি সব শুনে গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখে আকাশ ঘন কালো হয়ে রয়েছে। এক খন্ড মেঘ এমন ভাবে ঝুলে রয়েছে যে টোকা মারলেই হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামবে। তার মাঝখান দিয়ে কাঁধে বাঁক নিয়ে একদল লোক উন্মত্তের মতো “ব্যোম ব্যোম তারক ব্যোম” বলে ছুটে চলেছে। সার্কুলার রোড পুরো আটকানো। গাড়ি অপেক্ষা করে ওদের সরার জন্য।

এদিকে ৬নং জোড়াসাঁকোর বাড়ির তিনতলার ছাদ বাগানের পাঁচিলে হেলান দিয়ে জুড়িগাড়ির অপেক্ষা করছে সেজো কর্তা। সে বাগানেই কর্তার সামনে দিয়ে কতবার ঘুরে যায় সেজোগিন্নি। কর্তার হুঁশ নেই। এ বাগান সেজো গিন্নির নিজের হাতে বানানো, নাম দিয়েছেন ‘নন্দন কানন’। বিয়ের পর তিনতলার আধখানি জুড়ে সে এ বাগান রচেছে। ছাদের উপর পাম গাছের সারি, বেল, জুঁই গন্ধরাজে সে ভরিয়ে ফেলেছে। রোজ পাখিতে, প্রজাতিতে ভরে থাকে বাগানখানি। আজ যদিও পাখি নেই একখানাও। আকাশ জুড়ে ভীষণ কালো মেঘ করে আছে বলেই হয়তো। সেজো কর্তা আজ বাড়িতেই আছেন। সাধারণত এ সময় তিনি বাড়ি থাকেন না। সেজগিন্নি কর্তার মনের তল পায়না। কোনও কালেই পায়নি। লোকে বলে সে মন পড়ে থাকে হয় পার্ক স্ট্রিটে নয় থিয়েটার পাড়ায়। সত্য মিথ্যা জানেনা সে, আজকাল আর জানার চেষ্টাও করেনা। হঠাৎ দূরে ব্যোম ব্যোম আওয়াজ শুনে ছাদের পাঁচিল থেকে উঁকি মারে সেজ গিন্নি। জল যাত্রীরা চলেছে বোধহয়, এ বাড়ি থেকে রাস্তা দেখা যায়না । ছেলেবেলায় বাঁক কাঁধে জলযাত্রীদের যাওয়া দেখতে কি মজাটাই না লাগতো। আজকাল দেখার উপায় নেই। বিরাট বাড়িটা ছেলেবেলার সব কিছু ঢেকে দেয়। সেজোগিন্নি হঠাৎ মাথার দিকে চেয়ে দেখে বিরাট একটা কালো মেঘ মাথার ওপর ঝুলে আছে। এই দিনেও নিশীথের অন্ধকার ডেকে এনেছে। চোখের সামনে আর কোথাও সেজ কর্তাকে দেখতে পায়না সে। হাতে একটা খুরপি নিয়ে গাছের গোড়া কোপাতে বসে। হঠাৎ মনে পড়ে যায়
ন’ননদের লেখা “বসন্ত উৎসব ” নাটকের গান। এ নাটকে সে লীলার ভূমিকায় অভিনয় করে খুব নাম করেছিল। সে গান ধরে

” চন্দ্র সূর্য তারা শূন্য মেঘান্ধ নিশীথ চেয়ে
দূরভেদ্য অন্ধকারে হৃদয় রয়েছে ছেয়ে”

ভারি উদাত্ত কন্ঠ সেজো গিন্নির। দোতলার ঘর থেকে শুনতে পায় ছোট দেবরটি। সে সেজ বউঠানকে নতুন বউঠান বলে সম্বোধন করে। নতুন বউঠানের গান শুনতে নন্দনকাননের দিকে হাঁটা দেয় ছোটকর্তা। ছোট কর্তার জুতোর মচমচ আর সেজো গিন্নির গানকে ছাপিয়ে যায় জুড়িগাড়ির ঘন্টার আর ঘোড়ার খুড়ের আওয়াজ। ১৪ নম্বর লোয়ার সার্কুলার রোড থেকে গাড়ি এসে থামে ৬ নং জোড়াসাঁকোতে। সে গাড়ির পেছন পেছন সরকার বাহাদুরের দুজন সার্ভেয়ার ঢুকতে যায়, এ বাড়িতে দরোয়ান বাধা দেয়

” কেয়া চাইয়ে, কিউ অন্দর যা রাহে হো?”
সার্ভেয়ার দুজন ঘাবড়ে একশেষ। একজন বলে
” দরোয়ান হামলোগ সোনাগাছি থেকে সার্ভে করে সিধে আতা হ্যায়। ইস বাড়িমে দরকার হ্যায়। দেখা করেগা”

দরোয়ান উলটে জানতে চায়
” ক্যায়া দরকার হ্যায়”
“ট্যাক্স- ফ্যাক্স অনেক ব্যাপার হ্যায়রে বাবা, তুম নেহি বুঝেগা। হামলোগোকো ঘুষতে দাও। নয়তো সরকার মশাইকে বুলাও”

ক্রমশ…

62 thoughts on “কত রঙ্গ দেখি কলকেতায় | নীলা বন্দ্যোপাধ্যায়, পর্ব – ১৩

  1. অনবদ্য লেখনী। গদ্য ও তথ্যের ঠাসা সমন্বয়।

    1. ধীরে ধীরে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে লেখক ঢুকে পরছেন এবার। আরো অনেক অজানা ইতিহাসের জট খুলবে ক্রমশ।
      আমরা অপেক্ষায় থাকলাম সেই সব কথা জানতে। পরম মুগ্ধতায় প্রতিক্ষায় চেয়ে রইলাম পরবর্তী লেখার দিকে।

    2. অনবদ্য। পুরো সিনেমার মত দেখছি।

    3. অনবদ্য রচনা ,খুব খুব ভালো।

      1. অতীতের সোনালী মায়াময় দিনগুলি কি সুন্দর করে উন্মোচিত হচ্ছে তোমার লেখনীতে… ভালোবাসা আর শুভেচ্ছা জানাই আগ্রহ বজায় রাখার নিরলস প্রচেষ্টা জারি রাখার জন্য ❤️💐👌

  2. এক কথায় “অসাধারণ”. অপূর্ব তরতরে লেখনী। অসীম প্রত্যাশা রইল

  3. খুব ভালো লাগছে পড়তে

  4. আজকে খানিক জোড়াসাঁকোর সদরে পা রাখা হলো। এ লেখা যে ধীরে ধীরে সোনার খনি হয়ে উঠছে তা আগাম জানান দেয়।

  5. প্রতি পর্বে ভালোলাগা ক্রমবর্ধমান।

  6. দুরন্ত এগোচ্ছে…. অসাধারণ বুনট!

Comments are closed.