কত রঙ্গ দেখি কলকেতায় | পর্ব-৭

আগে যা ঘটেছিল 

জোড়াসাঁকোর পাঁচ নম্বর ও ছয় নম্বর বাড়ির মাঝামাঝি ঘোড়ার গাড়িখানা দাঁড় করায় গোলাপসুন্দরী বিনোদিনী ছিলো সে গাড়িতে, ওরা গোলাপের বাড়ি যাচ্ছিলো। বিনোদিনী অবাক হয়, কিসের আশায় দাঁড়িয়ে আছে ওরা এখানে! এই মাসিকের রক্তমাখা অবস্থায় গোলাপের ঘেন্না করছে না! গোলাপ নিজেও হয়তো জানেনা কার আশায়, কিসের আশায় দাঁড়িয়ে। সে আশা গোলাপের পুরলো কিনা জানা নেই, তবে দেখা হলো অসম্ভব সুদর্শন এক যুবা পুরুষের সঙ্গে। যাঁর নাম এতোদিন শুনেছে, লেখা পড়েছে এই চাক্ষুষ দেখা হলো। বিনোদিনীর গুরুত্ব হারানোর ভয় প্রবল। ঠুনকো মান অপমান বোধও। যুবকটি কেবল গোলাপের সঙ্গে গল্প করে মেনে নিতে পারেনা বিনোদিনী। গোলাপকে বিশ্রী অপমান করে। গোলাপ আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো বিনোদিনীকে তার বাড়ি। সে অপমানের পর মানা করে দেয়। গোলাপকে বাড়ির দোরগোড়ায় ছেড়ে ফিরে যাচ্ছিলো বিনোদিনী। গোলাপসুন্দরীর একরত্তি মেয়েকে দেখে কেমন যেন সমস্ত রাগ জল হয়ে যায়। খানিক রাস্তা এসে কোথাও মেঠাই না পেয়ে ফুলেরতোড়া হাতে গোলাপের বাড়ির দিকে আবার এগোয়।

নীলা বন্দ্যোপাধ্যায়

পর্ব ৭

ছেড়ে চলে যাওয়ার চেয়ে চলে গিয়ে ফিরে আসা ঢেরবেশি শক্ত। ফিরে আসতে আসতে হেরে যাওয়ার অনুভূতিটুকু প্রবল হয়ে ওঠে, মনে হয় চলে যাওয়া যায় মাথা উঁচু করে কিন্তু ফিরে আসতে হয় মাথা নুইয়ে। কিন্তু যাঁর মনের শক্তি প্রবল তার কাছে যাওয়া আসা দুটোই অনায়াস।

বিনোদিনীরও ফিরে আসতে দ্বিধা হয়না। ছুটন্ত গাড়িতে বসে বিনোদিনী ভাবে গোলাপসুন্দরী তো নিজেই তাকে আজ যেতে মানা করলে। সেই তো একরকম অপমানই, তবু ফিরে যাচ্ছে কেন বিনোদিনী, কিসের আশায়! মাঝে মাঝে সে নিজেকেই চিনতে পারেনা। ভাবে তারও কি মায়ের মতো মাথার ব্যামো হলো। বিনির মাও কখন কি করে তার ঠিক ঠিকানা নেই। দোষই বা দেয় কীসে মাকে, বিনোদিনীর ফুটফুটে ছোটভাইখানা মায়ের চক্ষের সামনে মরে গেলো, কেউ কিছু করতে পারলেনা। সন্তান হারালে মায়ের মাথার যে ঠিক থাকেনা। পুরুষমানুষ সে কথা বুঝবেনা। তার মায়েরও তারপর থেকেই কিছু ঠিক নেই। যখন ভালো থাকে তার মায়ের মতো মানুষ পাওয়া ভার। বায়ু চাগাড় দিলে মায়ের চন্ডালের রাগ। বিনোদিনীর মায়ের ওই হুট করে রেগে ওঠার ব্যামো পেয়েছে। লোকে ভুল বোঝে। বলে এ নাকি বিনোদের দেমাক। শরৎ বাবু, শরৎ চন্দ্র ঘোষ বিনোদিনীর প্রথম নাট্যগুরু অব্দি বলেছেন —

” বিনি তোর সব ভালো, নাচতে পারিস, গাইতে পারিস, আক্টো করিস এতো ভালো, এমন অপ্সরার মতো রূপ, তবু তোর আত্মপ্রেম তোকে বেশিদূর যেতে দেবেনা। এ লাইনে টিকে থাকার লড়াইটা অভিনয় শিক্ষার চেয়ে কম দরকারী নয়, টিকে থাকতে গেলে গুণের সঙে বিনয় লাগে, তোর নেই।”

এরা কেউ বোঝেনা সবটা বিনোদিনীর হাতে নেই। মাথা গরম হলে তার কি যে হয়, কি যে বলে ও নিজেও জানেনা।

সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে গাড়ি আবার এসে পৌঁছয় গোলাপের বাড়ির সামনে। বিনোদ গাড়ি থেকে নামার আগেই সদরদরজা খুলে বেরিয়ে আসে এক মহিলা। মোটা, খালি গায়ে ডুরে কাপড়, মাথায় চুড়ো করে খোঁপা বাঁধা। খেঁদা নাক, কুতকুতে এক জোড়া চোখ। এই ভোরবেলাতেও জর্দা পান ঠোসা মুখে। সদর থেকে বকবক করতে করতে কি যেন খুঁজে চলে মাথা নিচু করে।
” কতবার কয়েচি, খুকি একা একা বাইরে যেওনিকো। মা বেইরেচে, ফিরেও আসবে। তাও সেই মা কখুন ফিরবে, মা কখুন ফিরবে, রাত নেই দিন নেই সেই এগ বায়না। ঠায় সদরগোড়ায় ডাঁইরে থাকবে। তুই এখেনে ডাঁড়ালে কি মা আগে ফিরবে ”

কথা বলার এবং খোঁজার তাড়সে সে সামনে যে মস্ত একখানা গাড়ি আর আস্ত একখানা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে খেয়াল করেনা। শুকরের মতো ঘোঁত ঘোঁত করে চলতে চলতে বিনোদিনীর প্রায় ঘাড়ে উঠে পড়ছিলো। বিনোদিনী চিৎকার করে ওঠে –
” আরে মাসি দেখবে তো সামনে কেউ আচে কিনা”
মেয়েমানুষটি বোকার মতো হেসে একহাত জিভ বের করে। তারপর বিনোদিনীর দিকে চেয়ে উচ্চস্বরে চিৎকার করে ওঠে
” মা গো মা খেন্তির কী সইভাগ্য গো। সামনে নটী বিনোদিনী গো।”
বিনোদিনী বিরক্ত হয়। তার এই সময়ে এ সমস্ত বোকা উচ্ছ্বাস ভালো লাগছে না। তাকে থামিয়ে বলে –
“আঃ ভেতরে গিয়ে গোলাপ দিদিকে বলো বিনোদিনী এয়েচে।”

খেন্তি আবার উচ্চস্বরে বলতে থাকে

” আমার কি সে উপায় আচে গা। খুকি গলার সোনার হার হাইরেচে। সে হার না খুঁজে আমি ভেতরে যেতে পারবুনি গা। কতবার কয়েচি, এই কলকেতা শহর যাগা ভালো নয় খুকি একা বাইরে এসোনি। শুনবে না, মা বেরুলেই ঠায় সদরে দাঁইরে থাকবে। কখুন কোন গোরা পল্টন এয়ে খুলে নে গেচে গলা থেঙে। কাল শুনিচি এ রাস্তা দে ছোট লাট গেচে, তারাও নে যেতে পারে। গরীবের গলায় দামী হার কেনে, আমার বউয়ের গলায় থাক কেনে এই ভেবে। কিন্তু খেন্তির সে কতা কেউ শুনবে কেনে। বলবে খুকিকে দ্যাক শোনের ভার তোর, কি ভাবে তাও হাইরে যায়, যেখেন থেকে পারিস খুঁজে নে আয়। কোত্থেকে খুঁজবো যদি ধর কাবলেরা নে নেয় ত্যাখুন তো… ”

বিনোদিনী বোঝে এর ওপর ভরসা করে দাঁড়িয়ে থাকলে দিন কাবার হয়ে যাবে গোলাপের ঘরে ঢোকার আগেই। খেন্তি বকবক করতে থাকে বিনোদ তার মধ্যেই দোর খুলে ভেতরে ঢোকে। ভেতরে ঢুকে বিনোদিনী অবাক হয়ে যায়। ছোট্ট এক চিলতে উঠোন তার পিছনে একতলা দালান কোঠা। উঠোন থেকে আরম্ভ করে বাড়ির সর্বত্র পাদুকা চিহ্ন আর নানা নকশার খড়ি মাটির আল্পনা। দালানে পা দিতেই থমকে যায় বিনোদিনী গোলাপ আর একটা কচি কণ্ঠ গাইছে

” চিকনকালা গলায় মালা বাজন নূপুর পায়”,
বিনোদিনী মোহিত হয়ে কয়েক মুহূর্ত শোনে তারপর কন্ঠস্বর অনুসরণ করে এগিয়ে যায়। দেখে বিরাট সিংহাসনের সামনে একঢাল কোঁকড়াচুল এলো করে বসে গোলাপ গান গাইছে আর মালা গাঁথছে। পাশে গোলাপসুন্দরীর একচিলতে মেয়েও মায়ের মতো পট্ট বস্ত্র ধারণ করে হাত জোড় করে বসে গান গাইছে। সারা ঘর ম-ম করছে চন্দন গন্ধে। প্রথমে বিনোদিনী একটু অবাক হয়। এই মাসিক অবস্থাতে ঠাকুর পুজো করছে গোলাপ! পরে মনে পড়ে সে শুনেছে বাউল বৈষ্ণবদের নানান গুহ্য সাধনা থাকে, সেখেনে নাকী মাসিকের রক্ত অবধি পান করে তারা, গান গাইতে আর ক্ষতি কী! যদিও এ কথার সত্য অসত্য জানা নেই তার। গান শেষ হলে বিনোদিনীকে চোখে পড়ে গোলাপের মেয়ের। সে চোখ পিটপিট করে বিনোদিনীকে খানিক দেখে মায়ের পিঠে কচি কচি হাত দিয়ে ঠেলা মারে। গোলাপ পেছন ফিরে বিনোদিনীকে দেখে অবাক হয়! সে আশা করেনি বিনোদিনী ফিরে আসবে। কিন্তু গোলাপের মধ্যে রাগ, দুঃখ,অপমান সমস্ত কিছু গোপন করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা। তাই আজও বিষ্ময়টুকু অনায়াসে গোপন করে গোলাপ।
” বিনি! আয় বোস, হয়ে গেছে। মালা কখানা গলায় পরিয়ে উঠছি। ”

বিনোদিনীর হাতে গোলাপের গোছা কখানা দেখে গোলাপসুন্দরী জিজ্ঞেস করে
” শ্রী কৃষ্ণের পায়ে দিবি! দে দিয়ে দি”

বিনোদিনী গোলাপের গোছা দেয়না। বলে
“কৃষ্ণের পায়ে তো গোলাপসুন্দরী নিবেদিত আমি গোলাপ কখানা রাই কমলিনীকে দেব বলে নিয়ে এয়েচি।”

গোলাপসুন্দরীর একরত্তি মেয়ের দিকে গোলাপের তোড়াগুলো এগিয়ে দেয়।
” এই নাও রাই কমলিনী তোমার এগুলো”

উপহার পেয়ে গোলাপসুন্দরীর এক চিলতে মেয়ের মুখে স্বর্গীয় হাসি ফুটে ওঠে। গোলাপের মুখেও ছড়িয়ে পড়ে সে হাসির রেশ। মেয়েটি বলে –

” তুমি কি করে জানলে আমার মা আমাকে রাই কমলিনী বলে ডাকে!”

বিনোদিনী নিচু হয়ে কোলে তুলে নেয় পট্ট বস্ত্র পরা একচিলতে মেয়েটাকে
” বাঃরে জানবো না! আমাদের নাম যে এক!”
বাচ্ছাটি অবাক হয় ” তোমার নামও রাই কমলিনী! তোমার মা তোমাকে রাই, কমি, কমলিনী আমার বলে আদর করে!”

” না আমার নাম রাই কমলিনী নয়, বিনোদিনী। আমার মা আমাকে বিনি বলে ডাকে”
মেয়েটির মুখ এবার ম্লান হয়
” তবে তো তোমার আমার আলাদা নাম, কইলে যে এক নাম! কৃষ্ণের সমুখে মিথ্যে কইতে নেই জানো, পাপ হয় মিথ্যেকতা কইলে! ”

বিনোদিনী হেসে ওঠে খুব জোর। তারপর বলে
” আমি মিথ্যে কতা কইনি গো। বড় হলেই বুঝবে তুমি, তোমার গানের গলাখানা কি মিঠে গো। একদম চিনির মতো। তা রাই কমলিনী তোমার গোলাপ পছন্দ হয়েছে!”

” আমার মায়ের নাম গোলাপ, তুমি জানো?”
বিনোদিনী খুব জোর হেসে ওঠে
তারপর বলে –
“কেবল আমি কেন, দুনিয়া শুদ্ধু লোক তোমার মায়ের নাম জানে। তাই তো তোমায় গোলাপগুচ্ছ দিলুম।”

কমি বিনোদের গলাখানা জড়িয়ে ধরে। সে আলিঙ্গনে ফিরে আসার জন্য যেটুকু খচখচানি ছিলো মনে সব জুড়িয়ে যায়। ইতিমধ্যে গোলাপের ঠাকুরঘরের কাজ শেষ হয়
” গোলাপ বলে- চ বিনি ও ঘরে বসবি চ”

গোলাপের সঙ্গে বিনোদিনী একটি ঘরে ঢোকে। ঢুকে অবাক হয়ে যায়। ঘর ভর্তি নানারকম বই। বিনোদিনীও বই পড়ে। কিন্তু তা বলে এতো বই তার নেই। একটু আগেই উগ্র ব্যবহার করা বিনোদিনীর ফিরে আসাতে গোলাপ অবাক হয় কিন্তু মুখে কিছু বলেনা। বরং তাকে যত্ন করে বসায়। বিনোদিনী বলে
” তোমার বাড়ি খুব সুন্দর, গুচনো, কখুন করো এতো কিচু! ”

গোলাপ বিনোদকে বোঝার চেষ্টা করে। তার এই একচিলতে ভাড়া বাড়ি বিনোদিনীর কিসে সুন্দর লাগতে পারে! লোকমুখে শুনেছে বিনোদিনী নাকী পেল্লায় বাড়ি বানিয়েছে। গোলাপ বলে –

“সুন্দর আর কি, এই তো ছোট্ট একখানা বাড়ি। আমাদের মা মেয়ের এতেই চলে যায় বেশ”

বিনোদিনী গোলাপের বইয়ে হাত বুলোতে বুলোতে বলে –
” বাড়ি কি আর ঘর দে হয় না বাড়ির মাপ দে হয়। তোমার বাড়িটায় কি সুন্দর চন্নন গন্দ, পুরোতন বই আর ছোট শিশুর গন্ধ গোলাপ দিদি”

“আচ্ছা ওসব কতা বাদদে কি খাবি বল? ঠাকুরের মোহনভোগ আচে, দুটো ঘিয়ের নুচি ভেজে দিই”

বিনোদিনী গোলাপের কথা যেন শুনেও শোনেনা, জানলার কাছে উঠে যায়, তারপর জানতে চায়
” সামনে ছাতিম গাচ আচে বুঝি? ”
গোলাপ জবাব দেয়
“না, হাসনুহানা, কেটে দেব, বড্ড সাপ আসে।”
বিনোদিনী একেবারে গোলাপের মুখোমুখি দাঁড়ায় তারপর গোলাপের গা শোঁকে
” তোমার গায়ে এখন টাটকা রক্ত আর চন্দনের গন্দ, আমার গায়ে হাসনুহানার গন্দ না? বড্ড সাপ আসে, আমায় দেখলেই তাদের ফনা উটে যায়”

কথা কখানা বলেই বিনোদিনী খিল খিল করে হেসে ওঠে। গোলাপের বিশ্রী লাগে এই রসিকতা। কিন্তু বাড়িতে অতিথি এলে তার সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করাই রীতি। গোলাপ জবাব না দিয়ে বিনোদিনীর জন্য খাবার আনতে বেরিয়ে যায়। বিনোদিনী দেখে সে যে ঘরে বসে আছে তার দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে গোলাপের মেয়ে। বিনোদিনী হাতছানি দিয়ে ডাকতেই এক ছুটে এসে বসে পড়ে তার কোলে। বিনোদিনী জানতে চায়
“তুমি পুজোর কাপড় বদলাওনি কেন! যাও এ বস্ত্র পরে থাকতে নেই”

গোলাপের মেয়ে বিনোদিনীর হাতের কাঁকন নাড়তে নাড়তে বলে
” খেন্তিমাসি এসে বদলে দেবে, আমি নিজে পারি নে কো। তুমি খুব সুন্দর, গালে একটু হাত দেব তোমার?”

এ জীবনে বিনোদিনীকে কম মানুষ সুন্দর বলেনি। কিন্তু এই মুহূর্তে বিনোদিনীর বিশ্বাস হয় সত্যি সে খুব সুন্দর মানুষ। বিনোদিনী নিচু হয়ে গাল বাড়িয়ে দেয় কমির দিকে। কমি তার ছোট্ট হাত দিয়ে বিনির গাল ছোঁয়। তারপর কমি জানতে চায়

” তোমার মায়ের নাম কী গোলাপ?”
বিনোদিনী জানতে চায় কমি কেন এ প্রশ্ন করছে। উত্তরে কমি জানায়

“বাঃরে তুমি বললে যে তোমার আর আমার নাম এক, তবে তো মায়ের নামও এক হবে। তোমার বাবা কি বিলেতে থাকে? আমার বাবা থাকে সেখেনে, আমার বে দেবে বলে সেখেন থেকে লাল টুকটুকে গোরা সাহেব আনতে গেছে। তোমার বাবাও কি তাই গেছে? তোমার বাপের নাম কী?

বিনোদিনী এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারেনা। ও নিজেও জানেনা বাপের নাম কী। বেবুশ্যে পাড়ার অর্ধেক ছেলে-মেয়ে বাবার নাম জানেনা। তবে ও পাড়ার সকলে বলে বিনোদিনীর বাপ খুব বড় বংশের কেউ হবে। তাইতেই ওর এতো বুদ্ধি, রূপ, রুচি। বিনোদিনীর এসব ভাবনায় ছেদ পড়ে আবার কচি গলার আওয়াজে।
” আচ্ছা তোমার মা তোমায় বাড়িতে ফেলে থেটার করতে যায়? তুমি তখন কার কাচে থাকো খেন্তি মাসির কাচে? তোমার কান্না পায়? আমার খুব কান্না পায়। রাত হয়ে গেলে যখন জাগতে রহো বলে চিৎকার হয়, খুব ভয় করে। তোমার করে?”

বিনোদিনী কমিকে বুকে জড়িয়ে ধরে। তারপর মুখ ধরে খুব আদর করে। কমির মুখ বিনোদিনীর লালায় আর চোখের জলে ভরে ওঠে। ঠিক তখনই গোলাপ ঘরে ঢোকে। বিনোদিনীর পিঠে আলতো করে হাত দেয়। অপ্রস্তুত বিনোদিনী তাড়াতাড়ি চোখের জল সামলাতে চায়। গোলাপ বিনোদিনীর মাথাটা টেনে নেয় নিজের কোলে?

“কাঁদ বিনি, চোখ মুছিসনে। কাঁদলে চোখের জলে জ্বালা জুড়োয়।”

বিনোদিনী তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নেয়। আলোয়ানটা মাথায় ঢাকে তারপর বলে

“আজ চলি। সেই কোন রাত গঙ্গার পাড়ে এসেছি, সেই থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছি। তোমার গাড়িখানা ছাড়িনি, কোচওয়ানেরো ক্লান্ত লাগছে”

গোলাপ বিনোদিনীর হাত ধরে বসায়।
” আমি গাড়ি ছেড়ে দিইচি। স্নানঘরে যা, গঙ্গা তো নাইলি না। এখানে নেয়ে আয়। আমার শাড়ি, জ্যাকেট সব দিয়ে এয়েচি সেখেনে, পরে আয়।”

বিনোদিনী গোলাপের কথায় অন্যথা করেনা। তার আজ কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বাড়িতে ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না। বরং দুটো ছোট্ট হাতের স্পর্শ বারংবার পেতে ইচ্ছে হচ্ছিলো।

বিনোদিনী স্নানঘরে ঢোকে। সেখানেও কপ্পুর আর চন্দন মেশানো মিষ্টি গন্ধ পায়। দেখে বিরাট তামার গামলায় টলটলে জল। স্নানঘরের টালির ফাঁক দিয়ে সে পাত্রে একটুকরো সূর্যের আলো পড়ছে। বিনোদিনী সে পাত্রে উঁকি মারে। নিজের মুখের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। নিজেই জলে টোকা দিয়ে সে ছবি ভেঙে দেয়। সেই গামলার সামনে দাঁড়িয়ে বিবস্ত্র হয় বিনোদিনী। দেখে মাত্র বিশ বছরের যুবতী শরীরে পেটের মধ্যে সাদা ফাটা ফাটা দাগ। আজকাল থ্যাটারে নামার আগে সমস্ত দাগ ঢেকে দেয় বিনি। গোটা থ্যাটার পাড়া জানে বিনোদিনীর রূপটানের জবাব নেই। সব দাগ, সব কালো ঢেকে দিতে বিনির জুড়ি নেই।
বিনোদিনী গামলার পাশে রাখা ঘটি জলে ডোবায় না। নিজের শরীরটাকে তামার গামলায় ডুবিয়ে দেয়। তারপর চোখ বুজে খানিক পড়ে থাকে। সকাল থেকে বড্ড অলস দিন আজ। কেন যেন ফুরোতেই চাইছেনা। যত মানুষের সঙ্গে আজই কি বিনোদের দেখা হবার ছিলো! আজকের দিনটা কি ফুরবে না। এসব ভাবতে ভাবতে বিনোদিনী গামলার জলে আঁকিবুঁকি কাটে। সেই এক জ্যোতিষকে ভাগ্যছক আঁকতে দেখেছিলো ঠিক তেমন করে। আঁকতে আঁকতে বিনোদিনী দেখে ছকের সর্বত্র কেবল রাহু ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিরাট মুখ করে হাঁ করে গিলতে আসা রাহু। বিনোদিনী ভয়ে গামলার বাইরে ঝুলতে থাকা পা দুটোকে জড়ো করে গামলার ভেতর গুটিয়ে নিয়ে গুটিসুটি মেরে যায়। হঠাৎ সে দ্যাখে নগ্ন বিনোদিনীর চারপাশে পুরুষ মানুষের ভিড়। বিনোদ গামলা থেকে উঠে পালাতে গেলে গিরিশ ঘোষ হাত ধরে আটকায়।

“এটা কি করলি বিনোদ। মহলার জন্য বনমালী চক্কত্তির বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়ে গেচে, থিয়েটার বাড়ির জমি দেখা হয়ে গেছে আর এখন তুই বলছিস পারবিনে। থিয়েটারের সঙ্গে ছেলেখেলা করছিস তুই!”

বিনোদিনী গিরিশের সামনে মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার গা থেকে টপটপ করে জলের ধারা গড়ায়। গিরিশ আবার হিসহিসিয়ে বলতে থাকে-

” তোদের পাড়ার মেয়েছেলেরা কত রকম ওষুধ পালা জানে, আটকাতে পারলিনে।কোনও শেকড় বাকড় খেয়ে নিগে যা, নেমে যাবে। ”

বিনোদিনী গিরিশের পায়ে পড়ে।
“আমি পারবো না মাস্টারমশাই। এ যে আমার পত্থম সন্তান। আমি কতা দিচ্ছি যত দ্রুত সম্ভব ফিরে আসবো।”

গিরিশ বিনোদিনীকে তুলে ধরে
” আবার একটা বাপের নাম ছাড়া সন্তান এ পৃথিবীতে আনিসনে বিনি। তুই জানিসনে তার কি কষ্ট। ”
বিনোদিনী জানে তার কি কষ্ট কি অপমান। জবাব দিতে পারেনা। গিরিশ বলতে থাকেন
“এখেনে কদিন থাকিসনে। তোর শরীরে সব লক্ষ্মণ স্পষ্ট। রানিগঞ্জে ময়নামতি থাকে তার কাছে পাঠাবো, কদিন সেখেনেই থাকিস। ওই সব ব্যবস্থা করে দেবে”

” মাস্টারমশাই আমি নাহয় জন্ম দিয়ে তার হাতেই তুলে দেবো, নিয়ে আসবো না এখেনে”

গিরিশ কিয়ৎকাল চুপ থাকেন তারপর বলেন
” কি হবে তাতে! আরেকজন বাস্টার্ড চাইল্ড- বেজন্মা এ পৃথিবীতে বাড়বে। তোর তো তবু ভাগ্য ভালো তুই এখেনে গিরিশ ঘোষকে পেয়েচিস। তাই বেবুশ্যে বিনোদিনী না হয়ে নটী হয়েচিস। সে কাকে পাবে!”

গিরিশের এ গুমরের জবাব নেই বিনোদিনীর কাছে। সে জবাব দিতে পারেনা। সত্যিই তো এ জীবনে তার অনেক ঋণ এই লোকটার কাছে। তবু গুনগুন করে বলে বিনোদ

” কটা তো মাস, তার মধ্যে আপনারা থ্যাটার বাড়ি সম্পূর্ণ করুন। আপনারা যেমন চেয়েছিলেন তাই হবে এ থ্যাটারে আমার নাম কোতাও থাকবে নে।”

গিরিশ বিনোদিনীর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে তারপর জবাব দেয়

“তুই না থাকলে গুর্মুখ টাকা দেবে মনে করিস? এমনিতেই তোর পুরনো নাগরের সঙে তোকে নিয়ে তার লড়াইয়ের কতা কলকেতা শহরে আর কারুর জানতে বাকী নেই। একবার তোর ওই জমিদার নাগর তরবারি দিতে তোর গলা কাটতে গেছে এবার গুর্মুখ কাটবে গলা”

“কিচ্ছু হবেনা মাস্টারমশাই। আমি গুর্মুখকে বুঝিয়ে বলবো”

গিরিশ পাথরের মতো ঠান্ডা গলায় জবাব দেয়
“কার কি হবে আমি জানিনে। থিয়েটারের ক্ষতি হবে। আর এই দায় কার গুর্মুখ না তোর সেই নবাব পুত্তুরের? গুর্মুখের না হলে সে মেনে নেবে? কিরে কার দায়?”

বিনোদিনী বিড়বিড় করে জবাব দেয়
” বেবুশ্যেরা নিজের কপালকে ছাড়া কাকে দায়ী করবে মাস্টারমশাই। দায় কতজনের হতে পারে, এমন কী আপনারও”
গিরিশ চন্দ্র ঠাস করে চড় লাগায় বিনোদিনীর গালে। সে চড়ে আচমকা বিনোদিনীর চোখ খোলে। অতীত ছাড়া তার সামনে কেউ নেই। স্নানঘরে সে সম্পূর্ণ একা। এমন সময় কচি গলায় ডাক শোনে বিনোদ।

” আর কতক্ষণ নাইবে। মা নুচি আর মোহনভোগ দিয়েচে। সব যে জুড়িয়ে জল হয়ে গেলো।”
গামলা থেকে উঠে আসে বিনোদিনী। যেমন ঘরের মা বউরা জ্যাকেট আর শায়া ছাড়া দুফেত্তা করে শাড়ি পরে তেমনি করে শাড়িখানা জড়ায়। ঘরে এসে দ্যাকে একটা ছোট আর একটা বড় কাঁসার থালায় লুচি মোহনভোগ বাড়া। কমি সেই ছোট থালার ওপর আঁক কাটছে। বিনোদিনী জিজ্ঞেস করে “তুমি খাওনি কমি?”
“বাঃ রে তুমি না এলে কেমন করে খাবো? তুমি চান করেই খেতে এলে যে বড়। গোপালের সেবা দেবে না?”

বিনোদিনী হেসে কমির পাশে বসে।
” না আজ শ্রীরাধার সেবা হবে। তা সেবা দেবে কে? গোলাপদিদি কই?”

কমি আর ধৈর্য ধরতে পারেনা। লুচির থালায় হাত চালান করে বলে

“মায়ের কাচে আশুবাবু এয়েচে। এইবার বোধহয় কলুটোলা যাবে”

বিনোদিনী অবাক হয় কমির কথায়
জানতে চায় –
” কলুটোলায় কি আচে?”
কমি লুচির টুকরো মুখে পুরে বলে – মায়ের আখড়া। নুচিগুনো বেশ নরম হয়েছে না গো? খেন্তিমাসির চেয়ে মা অনেক ভালো নুচি ভাজে। কিন্তু মা বাড়ি থাকে কই। কেবলই তো থ্যাটার আর আখড়া”,
বিনোদিনী নিজের পাতের লুচি ছিঁড়ে কমির মুখে পুরে দেয়। কমি প্রশ্ন করে

“তোমার মেয়ে আচে? তুমি তাকে খাইয়ে দাও? না কেবলই থ্যাটারে চলে যাও?”
এরই মাঝে গোলাপ ঘরে ঢুকে দ্যাখে দুই রাধিকারই চোখে জল। গোলাপ সেজেগুজে তৈরি হয়ে এসেছে। বিনোদিনীকে বলে
“আমি একটু বেরুচ্ছি বিনি। একটা কাজে একবার কলুটোলা যাবো। তুই না খেয়ে যাসনে কিন্তু।”
কমি কাঁদতে থাকে
” না তুমি যাবেনা, আজ তুমি থাকবে বলেচিলে। এই আশুবাবুটা খুব খারাপ”
গোলাপ কমিকে কোলে তুলে নিয়ে বলে
” ছিঃ মা এমন বলতে নেই। তিনি তোমার মামা হন। এই যাবো আর আসবো, তুমি বিনি মাসির সঙে খেলা করো”

বিনোদিনী বলে ” না আমিও যাবো। আমার আর সময় নেই। মহলায় যেতে হবে। থ্যাটার বাড়ি খানাও একবার দেকে যাবো যাওয়ার সময়। তুমি খেন্তিকে একটা গাড়ি ডেকে দিতে বলো”

বিনোদিনী কাপড় বদলাতে স্নানঘরের দিকে যেতে গেলে দেখে রোগা সিড়িঙ্গেপানা একটা লোক দালানে দাঁড়িয়ে। বিনোদিনীকে দেখে দু হাত তুলে বিগলিত হয়ে নমস্কার করে। বিনোদিনীও প্রতি নমস্কার করলে লোকটি বলে –
” নমস্কার অধমের নাম আশুতোষ গোলাপ দিদির সঙে নাটক শেখানোর আখড়া খুলিছি কলুটোলার কাচেই।”

বিনোদিনী নাটক শেখানোর আখড়া শুনে অবাক হয়, এও হয়! এতক্ষণ বিনি ভাবছিলো বৈষ্ণবী আখড়া। মুখে কিছু বলেনা। তার বিষ্ময় প্রকাশ করা মানা। মুখে বলে
” আপনার নাম জানি, গোলাপদিদির ‘অপূর্ব্ব সতী’ নাটক বইতে আপনার নাম রয়েছে।”

লোকটি একহাত জিভ কাটে।
” কি যে বলেন। আমি সে আশুতোষ নই। আমার তেতো জ্ঞানগম্যি নেই। আশুতোষ দাস অন্য মানুষ। আমি ভবানীপুরের আশু ঘোষ। খাঁটি কায়েত।”

বিনোদিনীর আবার অবাক হওয়ার পালা। ‘অপূর্ব্ব সতী’ বইয়ের ভূমিকাখানা চোখের সামনে ভাসে। ‘শ্রী আশুতোষ দাস প্রণেতা, শ্রীমতী সুকুমারী দত্ত প্রণেত্রী।’ সুকুমারী যে গোলাপসুন্দরী একতা সকলে জানে। তবে এই আশুতোষ কে! লোকমুখে যা শোনা যায় তাই কি সত্যি!

ক্রমশ…

11 thoughts on “কত রঙ্গ দেখি কলকেতায় | পর্ব-৭

  1. এইসব সোনায় মোড়া সোনার দিনের গল্প শুনেই যেতে ইচ্ছে করে। এ তো কেবল লেখা নয়, এ হলো কম্পোজিশন এক্টিং আর সিকয়েন্সের খেলা। দুর্দান্ত❤️❤️🙏

    1. আমি আজকের পুরো পর্বটি পাঠ করলুম একা ঘরে বসে।
      বারবার চোখ ঝাপসা হলো।
      এমন নিখুঁত চরিত্র বিশ্লেষণ পারিপার্শ্বিক বিবরণ মুগ্ধ করে রাখলো।
      গোলাপের চরিত্র টি অভিনয় করতে সাধও হলো।😊
      পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।

    2. পড়তে পড়তে অতীতে হারিয়ে যাচ্ছি। অতীতের থিয়েটার নারীদের অন্দর মহলে বিস্মিত কৌতূহলে বসে আছি। এর পর কী আছে??কী??

  2. একরাশ মুগ্ধতা আর কত অজানা কে জানা, অসম্ভব ভালো লাগছে । মাতৃত্ব কি মহান অনুভূতি??? সে বৈধ ই হোক, কি অবৈধ???
    পরের পর্বের জন্য শুরু হলো অপেক্ষা, এই লেখা আগামী বইমেলা থেকে লেখিকা র সাক্ষর সহ সংগ্রহ করার আশায় রইলাম 👍

  3. যখনই পড়ি…কেমন যেন ভাষাহীন.. হয়ে যাই.. কিছুক্ষণ একটি অন্য ঘোরের মধ্যে থাকি.. চরিত্র.. পারিপার্শ্বিক সব যেন ছবির মতো.. রেশ রেখে যায়.. অনেকক্ষণ…

    1. একটু দেরি করে পাচ্ছি, অপেক্ষায় থাকি এই লেখার।

  4. সকালের সকল কাজ ভুলে তোমার লেখা পড়লাম । নারী – মনের চিরন্তন অনুভূতিতে অনুভব করলাম । পেলাম অনেক নতুন তথ্য । অনেক ভালোবাসা তোমাকে ।

Comments are closed.