কত রঙ্গ দেখি কলকেতায় | নীলা বন্দ্যোপাধ্যায়, পর্ব – ১১

আগে যা ঘটেছিল 

গুর্মুখের টাকায় বিনোদিনীর নামে নতুন থিয়েটার বাড়িতে নামবে দক্ষযজ্ঞ নাটক। গিরিশ ঘোষের নেতৃত্বে তারই প্রস্তুতি চলছে। অথচ বিনোদিনী অনুপস্থিত সে মহলায়! কী সে কারণ তা কেবল উপরমহলই জানে। কালীমতীর মতো দুটাকার থিয়েটারের অভিনেত্রীদের তা জানার কথা নয়। এদিকে খবর জোগাড় করাই কাজ তার। কালীমতী স্থির করে কাদম্বিনী নটীকে ধরবে। বিনোদিনীর আগে সেই মঞ্চ কাঁপাতো। তার দাপট কিছু কম নয় থিয়েটারে। কিন্তু কাদম্বিনীর ধারে কাছে এগোতে পারেনা কালীমতীর মতো সামান্য মেয়েমানুষ। কেবল লক্ষ্য করে কাদম্বিনী নটী সকলের অনুপস্থিতিতে নিজের পাটের চেয়ে বিনির পাট বলায় ব্যস্ত খুব। এদিকে মহলা শুরুর খানিক আগে গিরিশ ঘোষের সঙ্গে অনেকদিন পর মহলা কক্ষে আসে বিনোদিনী আর সকলে আসার পর হন্তদন্ত হয়ে হাজির হয় ননীমাধব। কালীমতীর সঙ্গে তার প্রয়োজন। কী দরকার রে বাবা! গিরিশ ঘোষ হঠাৎ ননীমাধবকে নির্দেশ দেয় আজ তাকে পাট বলতে হবে। অনন্ত কাল অপেক্ষা করেছে ননী এ সুযোগের আশায়। এদিকে ননীর আশায় অজানা কলকেতা শহরের রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে তরুলতা।

আজকের পর্ব 

দুটো স্বপ্ন ননীমাধব রোজ দেখত মনে মনে। এক গিরিশ চন্দ্র ঘোষের সঙ্গে মঞ্চে পাট বলছে, আর এক তরুলতাকে সে নিজের করে পাচ্ছে বরাবরের মতো। কিন্তু সেই ননী স্বপ্নেও একথা ভাবেনি যে দুটো স্বপ্ন বাস্তবে এসে এমন গোল বাধিয়ে বসবে। এখন সে শ্যাম রাখে না কুল রাখে ভেবে পায়না। একদিকে গিরিশ ঘোষ স্বয়ং তাঁর সামনে জীবনে প্রথম পাট বলার সুযোগ দিচ্ছেন, অন্যদিকে তরুলতা এই অজানা, অচেনা কলকেতা শহরের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে। আজ মহলা ঘর থেকে চলে গেলে আর কোনও দিন গিরিশ চন্দ্র এ সুযোগ দেবেন নাকি সন্দেহ আছে! আর তরুকে যে মহলা ঘরে এনে বসাবে সে উপায়ও নেই। কি পরিচয় দেবে সে! লোককে বলবে দাদার বিধবাকে নিয়ে পালিয়ে এসেছে, তাকে একটু বসতে দিন মহলা সেরে ঘর খুঁজতে যাবে তাকে রাখার। ননী এখানে এসেছিল কালীমতীকে ডাকতে, তার কাছে একদিন তরুকে রেখে সে ঘর খুঁজবে, সংসারের খুঁটিনাটি জোগাড় করবে। তারা বিয়ে করা স্বামী স্ত্রী হয়ত নয়, তবু এক সঙ্গে থাকতে কিছু জিনিস তো লাগেই। আর তাছাড়া ননীমাধব ভেবেছে তার পক্ষে যতটা সম্ভব তরুলতাকে সুখ দেবে সে। মেয়েমানুষের সুখে থাকার জন্য কী আর লাগে, শাড়ি গয়না পেলেই তারা খুশি। এখন ননীর তেমন টাকা নেই বটে কিন্তু থিয়েটার করলে তো টাকার অভাব হবেনা। তাছাড়া সে তো একা রোজগার করবেনা। তরুকেও থিয়েটারে নামাবে সে। চন্দ্রবদন কথা দিয়েছে তার থিয়েটার খুললেই তরুলতাকে পাট দেবে। সেরম সেরম অভিনয় করতে পারলে নায়িকার পাটও পেতে পারে তরুলতা। তখন দুজনের রোজগারে বাড়ি গাড়ি সবই হবে। তাই তো কালীমতীর বাড়িতে তরুকে আজ রাখবে ভেবেছিল। রাতে কালীমতীর বাড়ি চন্দ্রবদন এলে তরুলতাকে দেখেও নিত। কিন্তু এখন তো সে সব পরিকল্পনা সব গুলিয়ে গেলো। তরুলতাকে কতক্ষণ রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখবে! যে করে হোক একবার বেরোতেই হবে। কিন্তু তখন যদি ননীর পাট বলার ডাক আসে! ননীমাধব কোনও সিধান্তে আসতে না পেরে কুলকুল করে ঘামতে থাকে।

কালীমতী লক্ষ্য করে ননীমাধবের অস্থিরতা। প্রথমে ভাবে পাট বলতে হবে এই ভয়ে বোধহয় এমন অস্থির হয়ে আছে। কিন্তু কালী শুনেছে ননী যাত্রার নায়ক ছিলো। হাজার হাজার লোকের সামনে পাট বলেছে। থ্যাটারে তো মাত্তর এই কজন লোক। এমনিতে কালী ননীমাধবকে একদম পছন্দ করেনা। চন্দ্রবদনের সঙ্গে অনেকবার দেখেছে। প্রথম প্রথম কালী গায়ে পড়ে দু একখানা রসের কথা কইতেও গেছিলো পাত্তা পায়নি, ভাবখানা কেমন তুচ্ছু তাচ্ছিল্যের। বামুনের ছেলে, শুনেছে বড় বংশ তার ওপর কৃষ্ণ যাত্রা করে নাম ডাক হয়েছে তাইতেই এতো গুমর। কালী ভুলেও কথা কয়না আজকাল। কিন্তু আজ কি কারণে যেন কালীর অভিজ্ঞ চোখ অন্য গন্ধ পায়। ননীকে হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়ে যায় কুয়োতলার কাছে। তারপর বলে
– কি হয়েছে? ত্যাখন ডাকচিলে কেন?
ননী জামার হাতা দিয়ে ঘাম মুছে বলে
-একটা সমস্যায় পড়েচি। আমার সঙ্গে একজন আচে। তোমার কাচে নিয়ে গেসলুম। গিয়ে তোমার বড় মেয়ের কাছে শুনলুম তুমি মহলায় এসেচ। তাই তোমাকে ডাকতে এয়েছিলুম। এসে তো দেখলে এখেনে কেমন আটকে গেছি।

কালী কথা বলার ভঙ্গিমায় বুঝে যায় সঙ্গে কোনও মেয়েছেলে আছে। কালী বলে
-তাতে আমি কী করতে পারি। যে আচে তাকে সঙে করে এখেনে নিয়ে এসো।
ননীমাধব বলে- সে উপায় থাকলে কি কি আর করতুম না। উপায় নেই।

কালী বোঝে বাজারের মেয়ে মানুষ নয়। অবিশ্যি বাজারের বেবুশ্যে হলেও এখেনে আনার উপায় নেই। মহলা যখন চলে তখন সব কিছু কেমন পবিত্র হয়ে ওঠে। তাদের মতো বেবুশ্যেরাই সতী লক্ষ্মী, দেব দেবী হয়ে ওঠে। একটু পরেই বিনি কেমন সতী হয়ে উঠবে। এই সময়টুকুতে অভিনেত্রীরা যেন দেবীরি সম্মান পায়। অভিনয়ে এসে নানান রূপ ধরে আজন্ম গায়ে লেপা কালীমাটুকু কয়েক ঘন্টার জন্য মুছে ফেলা যায়। অবিশ্যি অভিনয় শেষে এরাই আবার বাবুদের ফুর্তির সরঞ্জাম হয়ে ওঠে। কালী ননীমাধবকে বলে
-বুঝতেই পারচি বড় কিচু গোল বাধিয়চো। কিন্তু আমি কিচু করতে পারব না। তুমি তবে গিরিশ বাবুকে বলে আজকের জন্য ছুটি নাও।

কালীমতীকে ননীমাধব হাতজোড় করে বলে
-এতো বছর অপেক্ষা করে করে জীবনে প্রথম সুযোগ পেলাম। সেটুকু ছেড়ে দেব কালী? তুমি কিচু করতে পারনা?
কালীমতী বলে – সুযোগ পেয়েচ? তুমি কি ভাবচ একবার পাট বললেই ওরা তোমায় এস্টেজে নাবতে দেবে? যাকে নিয়ে এয়েচ তার প্রতি দায়িত্ব নেই?

ননীমাধব কালীমতীকে মোক্ষম চাল দেবার চেষ্টা করে- তোমার বাবু চন্দ্রবদনের থিয়েটারের জন্য নিয়ে এসিচি। চন্দরবাবুকে তবে বলব কালীমতী আপনার লোককে সাহায্য করতে রাজি হয়নি কো।
কালী এইবারে ক্ষেপে ওঠে –
“শোন এই কালীকে ভয় দেখিয়ে কাজ আদায় করা যায়না। কালী কেবল বোঝে ট্যেঁকা। চন্দর বাবুর মত অনেক বাবু কালীর শরীর খুবলে খেয়েচে, তারপরেও এখুনো খুবলোনোর মতো অনেক মাংস আচে। এক চাঁদবদন গেলে আরেক চাঁদবদন আসবে। আমার মায়া, দয়া, ভয়, বন্ধন, লজ্জা, ঘেন্না কিচ্চু নেই। খালি লোভ আচে। ওটুকুতেই মরেচি। নইলে কালীর সঙে সন্ন্যেসীর তপাত নেই। আমায় ভয় দেকিও না। আমি কিচু করতে পারবুনি। তুমি কী করবে তুমি দ্যাকো।

কথা কটা বলে কালী ভেতরে চলে যায়। কালী যেখানে বসে সেখান থেকে কুয়োতলা আর বাইরে বেরুনের দরজা স্পষ্ট দ্যাখা যায়। চেয়ে দ্যাখে ননীমাধব স্থির হয়ে কুয়ো তলায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর বাইরে ছেড়ে রাখা পাম্পশু খানা গলিয়ে সদরের দিকে বেঁকতেই মহলা ঘরে ঝাঁঝের আওয়াজ হয়। আর হারমোনিয়াম বাদক নাটকের প্রিলিউট খানা বাজাতে শুরু করে, তবলাওলা সঙ্গত করে তাতে। সেসব বাজনা ছাপিয়ে গিরিশ ঘোষের গলা শোনা যায় –
– আজ সব অভিনেতা অভিনেত্রীরা উপস্থিত আছেন। আজ ফুল রিহার্সাল। প্রথম থেকে না থেমে পাট বলবো। কেউ ভুলে গেলে বিশে প্রম্পট করে দেবে। দরকার হলে সারারাত রিহার্সাল হবে। কিন্তু আজ পাট মুখস্থ চাই।
গিরিশ চন্দ্রের কথা শেষ হতেই বাজনা দ্বিগুণ জোরে বেজে ওঠে। ননীমাধব সদর দরজা বন্ধ করে পাম্পশুখানি খুলে ফিরে আসে মহলা কক্ষে। কালী বোঝে আবার একটা মেয়ের বিশ্বেসের মরণ হলো। এ কলকেতা শহরে কত মেয়ে যে বিশ্বেস করে মরে আর কত মেয়ে নিরুপায় হয়ে মরে সে খপর ইংরেজ সরকারের আদমশুমারী দপ্তর জানে না কো।

গিরিশ ঘোষ গানের দলকে প্রথমেই ডাক দেয়। বলে “তোমরা প্র‍্যাক্টিস করে নাও দু তিনবার। তারপর মূল রিহার্সালে যাবো।”
এই দক্ষযজ্ঞ নাটকে গান তোলাচ্ছে বেনীমাধব অধিকারী। লোকে বেনী ওস্তাদ বলে ডাকে। বেনীমাধব অধিকারী থিয়েটারের এক নম্বর গানের শিক্ষক। গিরিশ ঘোষ এ নাটকে সেরা লোকগুলোকেই বেছে নিয়েছেন। কানাঘুষো শোনা যায় এই বেনীমাধব নাকি ননীর কেমন তুতো দাদা। তাকে ধরেই ননী এখেনে ঢুকেছে। কালী দেখেছে বেনীমাধব লোকটি খারাপ নয়। কালীর গানের গলা আছে বলে বলে তাকে সুযোগ দেয়। প্রথমেই কালীমতীকে খালি গলায় গান ধরতে বলে তারপর বাকি কোরাসের মেয়েদের ওর সঙ্গে গলা মেলাতে বলে। গান শেখায় যখন কে ছোট অভিনেত্রী কে বড়ো অভিনেতা এসব রেয়াত করেনা। একদিন কালীকে খুব বিপদে ফেলেছিল বেনী ওস্তাদ। বিনোদিনীর একজায়গায় সুর কিছুতেই লাগছিলো না। কালীকে ডেকে বলে তোর স্কেলে বিনোদিনীকে তুলিয়ে দে। বিনোদিনীর থমথমে লালমুখ দেখে কালী বোঝে সামনে সমূহ বিপদ। থ্যাটারে তো থাকা হবেইনা। ও পাড়া থেকে বাস না ওঠে। কালীমতী কিছুক্ষণ চুপ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় কি করতে হবে। সে নিজেই ভুল সুরে গান ধরে। দু তিনবারে যখন ঠিক হয়না রেগে গিয়ে বেনী ওস্তাদ কালীর দিকে একটা চায়ের পেয়ালা ছুঁড়ে মেরেছিল। কপালের কোণটা সামান্য কেটেও যায় তাতে। সকলে হৈ হৈ করে ওঠে। কেবল বিনোদিনী ছিলো নির্বিকার। যেন কিছু ঘটেইনি এমন মুখ করে বসে থাকলো কিছুক্ষণ তারপর নিজেই সঠিক সুরে, ঠিক মাত্রায় গান ধরলে। কিন্তু সেদিন রাতে বাড়ি ফেরার সময় বিনোদিনীর টমটম এসে দাঁড়াতে বিনোদিনী কালীমতীকে ডাকে। তারপর হাতে কটা টাকা দিয়ে বলে –
-একটা এক্কা গাড়ি ভাড়া করে নিও। এতোখানি পথ যাবে। আর হ্যাঁ, মেয়ে দুটোকে মেঠাই কিনে দিও। বোলো বিনি মাসি দিয়েচে।
হয়তো বিনি কিছুই মনে করেনি সেদিন। কোনও পাটই বলো আর গান শেখাই বলো এসব ব্যাপারে বিনোদিনীর নিষ্ঠার অভাব নেই। তবু কালীমতী এ জগতে বুঝেশুনে চলে। তার তো কিছুই হলনা। মেয়েটার যাতে হয় তাই এই সাবধানতা। তাই বেনী ওস্তাদ না বললে আগ বাড়িয়ে কালী কেরামতি দেখাতে যায়না। সেদিনও চুপ করে ছিলো। বেনী ওস্তাদ বলে –
-গান তো সকলে তুলেইছ আশা করি। আজ আমার কেবল শোনবার পালা।

ওস্তাদ হারমোনিয়াম ধরে সকলে একে একে এসে জড়ো হয়। একমাত্র বিনোদিনী আর গিরিশ ঘোষ ছাড়া। গিরিশ বিনোদিনীকে বলে
-গান পরে তুলিস। ও ঘরে আয় কতা আচে।
গিরিশের পিছু পিছু বিনোদিনী বেরিয়ে যায় কালীমতী গান ধরে
-ফিরে যাও প্রেমিক সন্ন্যাসী
এ গান বিনোদিনীর গলায় আছে। তবুও সকলকে তুলিয়ে রাখে বেনী ওস্তাদ।
ভুলগুলো ঠিক করতে করতে সকলকে তোলাতে তোলাতে বেশ খানিকটা সময় বেরিয়ে যায়। কালীরা একে একে গেয়ে চলে –

কিলো তোর ক্ষ্যাপা দিগম্বর, বাবার সঙ্গে খেলে মা নিবে কোলে
গানের মহরার শেষ পর্যায়ে ঘরে ফিরে আসে গিরিশ চন্দ্র ঘোষ আর বিনোদিনী। বেনীওস্তাদের নির্দেশ মতো এসে বিনোদিনী গান ধরে –
-আয় জবা আনি নইলে কি দিব তোর পায়
গাইতে গাইতে বিনোদিনী এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে গিরিশের দিকে। যেন গিরিশ চন্দ্রের পায়েই কোনও জবা উৎসর্গ করছে বিনোদিনী। গান শেষ হলে গিরিশ বলে
“এইবার আমরা একবার বসে পাট বলেনি সকলে তারপর দাঁড়িয়ে বলবো। ”

এইবারই বেনীমাধব অধিকারী কালীমতীকে বলে গানের অংশ আছে কিছুক্ষণ বাদে। কালী যেন কিছু খাবার ব্যবস্থা করে। এ কালীর রোজকার কাজ। কালীমতী কেশিয়ার আশুবাবুর থেকে টাকা নিতে যায়। জিজ্ঞেস করে
-আজ সকলের জন্য মুড়ি তেলে ভাজা আনি?
আশুবাবু বলেন আজ বিনোদিনী উপস্থিত আছে। তার থেকে জেনে নিতে। সকলেই জানে বিনোদিনীর নাগর গুর্মুখের টাকায় এই বিরাট কর্মকান্ড চলছে। তারমানে এক রকম বিনোদিনীর টাকাই হলো। কাজেই বিনির উপস্থিতিতে তার অনুমতি ছাড়া কেউ এক গেলাস জলও গড়ায় না। কালীমতী নিজে জানতে যায়না। ছোট থেকে চোখের সামনে বড় হয়ে ওঠা বিনির কাছে চাকরের মতো দাঁড়াতে লজ্জা করে। অন্নদা বলে একটি মেয়েকে পাঠায়। তারপর বিনোদিনীর মন মতো জিনিস আনতে বেরিয়ে যায়।

বাইরে বেরিয়ে গিয়েও ফিরে আসে কালীমতী। ননীমাধবের কাছে এসে চুপি চুপি জানতে চায়
-কোতায় ডাঁড় করিয়ে রেকেচ?
বেনীমাধব অবাক হয়! এ উপকার করবে কালী! উত্তরে বলে-
“দে বাড়ি মানে ছাতু বাবু, লাটু বাবুর বাড়ির ফটকের পাশে যে ঢাকা ছাউনিকানা আছে তার নিচে। ”

কালীমতী জিজ্ঞেস করে
“কী রঙের শাড়ি পরে আছে? ”
ননীগোপাল অস্ফুট স্বরে জবাব দেয়
“সাদা। কপালে তিলক আছে।”

কালী লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর মনে মনে ভাবে ইংরেজদের আদমশুমারীর লোকেরা জানল না কলকেতার বেবুশ্যে পাড়ার সদস্য সংখ্যা বাড়লো আরও একজন। কালী তাড়াতাড়ি পা বাড়িয়ে দে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। দেখে একটা ফর্সা টুকটুকে শ্বেত বসনা একটা মেয়ে একখানা পুঁটলি হাতে জড়সড় হয়ে কাঁপছে। আর কয়েকজন বিহারি কোচয়ান, ভিস্তিওয়ালা আর বনমালী চক্রবর্তীর তে- ঢ্যাঙা চাকরটা মেয়েটাকে ঘিরে হাসাহাসি করছে। কালীমতী সত্যিই কালী মূর্তি নিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় সামনে।

-তবে রে অনামুখো ড্যাকরারা। আর একবার একে বিরক্ত করিচিস কি এখনই থানার কোতয়াল ডাকব।

কালীর বাজখাঁই গলার আওয়াজ পেয়ে একে একে কেটে পড়ে সকলে। সদ্য উড়তে থাকা পাখিকে কাকে তাড়া করলে যেমন তিরতির করে কাঁপে মেয়েটির সর্বাঙ্গ তেমনই কাঁপছে। কালীমতী গিয়ে মেয়েটা ধরে ফেলে। মেয়েটি কালীর স্পর্শে যেন পরম নিশ্চয়তা পায়। আর কালীরও নিজের জন্য একটু ভালোবাসা তৈরি হয়। মনে মনে ভাবে কালী টিকে থাকতে গেলে মন্দটুকু বাঁচিয়ে রাখতে হয়। তবু যে কেন একেক সময় মন্দ হতে ইচ্ছে হয়না কেন কে জানে! তার পরক্ষণেই কালীর মনে হয় মেয়েটার হাতদুটো তো ধরলাম। কিন্তু এই হাত ধরে কোন পথে টেনে নিয়ে যাবো। যে পথেই চলি হয় কাঁকড় নয় কাদা। এ মেয়ে কর্দমাক্ত অথবা ক্ষত বিক্ষত হবেই। কালীমতী মেয়েটির হাত ধরে টানে ছাউনি থেকে নামার জন্য। মেয়েটি কালীর হাত ধরে আরও একধাপ নিচে নামে। যার হাত ধরে মুক্তির খোঁজে স্বাধীনতার খোঁজে বেরিয়ে এসেছিল সে সুখের শিখরে বাসা বাঁধবার আশ্বাস দিয়ে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে দিলো তাকে।

ননীমাধবের কাছে প্রেম তুচ্ছ হয়ে যায় আত্মপ্রেমের সামনে। ননীমাধব মনকে প্রবোধ দেয় পরম সাধনার জন্য জগতের সব কিছুকে তুচ্ছ করেছেন মহা ঋষিরা। এই গিরিশ ঘোষের কি সংসার নেই। সেসব অগ্রাহ্য করে কেবল সাধনার জন্য পড়ে রয়েছেন এখেনে। ননীও কিছু ভুল করেনি আজ। লোভী মানুষ, ভোগী মানুষ চিরকালই আকাঙ্খার নাম দিয়েছে সাধনা।

ক্রমশ…

15 thoughts on “কত রঙ্গ দেখি কলকেতায় | নীলা বন্দ্যোপাধ্যায়, পর্ব – ১১

  1. এমন লেখা পড়ার জন্য মুখিয়ে থাকি, কিভাবে সেকেলের গল্পকথাকে লেখক কথার প্রলেপ দিয়ে দিচ্ছেন সযত্নে।
    অপেক্ষায় রইলাম, এরপর..

  2. দুর্দান্ত বাঁধুনি আর ডিটেইলিং…. এক্কেরে গপাগপ খেয়ে ফেললাম,সব কাজ ফেলে…. উফফফফ কবে যে এক মলাটে পাবো!

    1. এক নিশ্বাসে পড়ে ফেললাম।এই উপন্যাস এক অসাধারণ উপন্যাস হবে এ আমার স্থির বিশ্বাস। এতো ছোট পরিসরে এক ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করা বিশাল ব্যাপার। অপেক্ষা করতেই হবে । ভালো কিছুর জন্য আমাদের অপেক্ষা করতেই হয়।

  3. Aro aro besi kore jante ichcha korche, please Neela di aro ektu besi kore jante dao…….chatak pakhir moto dosha hoyeche amar…..

  4. মুগ্ধ হই.. প্রতি টা পর্ব শেষে.. সত্যিই ক্লাসিক

  5. আজ দুটো পর্ব একসঙ্গে পড়লাম। কি মনে হল বলি?মনে হল প্রতিটি চরিত্রে অভিনয় করছ তুমি। নইলে এ লেখা সম্ভব হত না। অনেক ভালবাসা নিও।

  6. অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে অবশেষে আবার এক কিস্তি… মন ভরে গেলো…

  7. কি যে গাঢ় রসের লেখা!! অনবদ্য

  8. তুমি অনেক দূর এগোও নীলা। অনেক অনেক আশীর্বাদ ,ভালবাসা …
    এমন লেখার জন্যে অপেক্ষা তো করতেই হবে। পারবো।

Comments are closed.