আগে যা ঘটেছিল
নর-নারীর প্রেম হার মানে আত্মপ্রেমের কাছে। অথচ কখনও কখনও মনে হয় প্রেমের জন্য জীবন দেওয়া যায়। তরুলতাও স্বপ্ন দেখে ঘর ছেড়েছিলো ননীর সঙ্গে। অথচ ননী গিরিশ ঘোষের সামনে পাট বলার আশায় তাকে পথে বসিয়ে চলে আসে মহলা দিতে। কঠিন বাস্তব বোঝা লোভী কালীমতীর মনও কখনো কখনো নরম হয়ে পড়ে। অকিঞ্চিকর অভিনেত্রী কালীমতী তরুলতাকে দেখতে পেয়ে হাত ধরে নিয়ে আসে মহলা কক্ষের বাইরে যেখানে ননীমাধব আছে। এদিকে মহলা কক্ষে অদ্ভুত এক বাতাবরণ, বিনোদিনী বহুদিন বাদে মহলায় এসেছে, মুখে একরাশ কালো মেঘ নিয়ে।
আজকের পর্ব
আষাঢ়ের মাঝরাতে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বেবুশ্যে পল্লীর কোনও কোনও বাড়ি নিকষ অন্ধকারে ঢেকে রয়েছে। কোনও বাড়ির কুপীর হালকা হলুদ আলো মেটে এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় কুৎসিত ভাবে পড়ে রয়েছে। কোনও বাড়িতে এখনও মাতালের গান আর বেবুশ্যের তামাসা চলছে। এরই মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলেছে কালীমতী, ননীমাধব আর তরুলতা। তারা তিনজনেই বেদম শ্রান্ত। এ শ্রান্তি পরিশ্রমের নয়, হতাশার, মন বেদনার, অপ্রাপ্তির, আশা ভঙ্গের, আশঙ্কার।
কালীমতীর বাড়ির সামনে এসে তিনজনে থামে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কালীর মেয়ে দুটো বাড়িতে নেই। সিন্ধু বেশ্যার কাছে জমা আছে। কাল সকালে গিয়ে নিয়ে আসবে। কালী আঁচল থেকে চাবির গোছা খোলে। সাধারণত বেবুশ্যের চাবি গোঁজা থাকে কোমরে। কালীর শখ গেরস্ত বাড়ির বৌদের মতো চাবি আঁচলে বেঁধে কাঁধে ফেলে রাখার। ঘরে ঢুকে কালীমতী দু তিনটে কুপী জ্বালে। তারপর ননীমাধব আর তরুলতাকে ভেতরে ঢোকার নির্দেশ দেয়। কুপী জ্বলা সত্ত্বেও তরুলতার মনে হয় আরও অন্ধকারে পা দিল সে। কালী তরুকে হাত পা ধুয়ে কাপড় ছেড়ে নিতে বলে, এক চিলতে ঢাকা চালা দেখায়, চালার পাশেই পাতকুয়া একটা। তরুলতা বিনাবাক্যব্যয়ে পুঁটলি থেকে গামছা আর একটা সাদা থান নিয়ে সেদিকে যায়। কাউকে কোনও প্রশ্ন করেনা। প্রশ্ন করার অবস্থাতেও নেই তরু। আজকে তরুর নিজেরও মাথা কাজ করছেনা। ঘোরের মধ্যে কেটে গেছে প্রথম কলকেতা শহরে পা দেওয়ার আঠারোটি ঘন্টা। যন্ত্রের মতো স্নান সেরে এসে দাঁড়ায় তরু। কালীর ঘরে থাকা চিঁড়ে মুড়কি খাওয়া পর কালীমতী একটি মেঝেতে আর তক্তপোষে একটি বিছানা করে। ননী আর তরুলতাকে মেঝেতে শোওয়ার নির্দেশ দিয়ে নিজে তক্তপোষে শোয়। ক্লান্ত ননীমাধব একটিও কথা না বলে শুয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ বুজে আসে। কালীমতীও বিছানায় পড়া মাত্র মৃদু নাসিকা গর্জন করতে থাকে। কেবল তরুলতার চোখে ঘুম নেই। আসলে তরুর চোখ দুটি আজ চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করছিল না। মরুভূমির মতো শুকনো খটখটে হয়ে ছিলো। আজ সারাটা দিন তরুর সঙ্গে মড়া মানুষের তফাত ছিলো কেবল নিশ্বাস নেওয়া আর চলে ফিরে বেড়ানোতে। সকলে ঘুমিয়ে পড়ার পর ঘরের কোণে একা বসে থাকা তরুলতা কালীমতীর এক চিলতে জানলাতে গিয়ে দাঁড়ায়। হঠাৎ ভিজে ভিজে বাতাস এসে লাগে তরুলতার মুখে। এমন বাতাস রোজ তার মুখে ঝাপটা মারে শ্রীরামপুরের গঙ্গার ধারে দাঁড়ালে। তরুলতা হঠাৎ যেন সম্বিত ফিরে পায়। এতোক্ষণে চারিদিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে যায় তরুলতা। কিছুতেই বুঝতে পারেনা কোথায় এসেছে, কেন এসেছে! অথচ তার আসাটুকু স্পষ্ট মনে আছে। কেবল কোথায় যাচ্ছে এ প্রশ্ন মনে আসেনি। তরু ঘাবড়ে জানলার বাইরে তাকালে দেখে ঘিঞ্জি একটা গলিতে সার সার বাড়ি। সবকটাই প্রায় অন্ধকার। রাস্তাও তাই। তবু সেই রাস্তা দিয়ে কিছু লোক এই নিঝুম রাতেও হেঁটে চলেছে টলতে টলতে। রাস্তার কুকুরগুলো আশ্চর্য নির্বিকার। অপরিচিতের যাতায়াতেও সারমেয়দের হেলদোল নেই। ওরাও জানে এসব পাড়ায় রাতেই অচেনা লোকের আনাগোনা বাড়ে। এই অচেনা লোকেরা আসে বলে পাড়ার বাড়িগুলোতে মাছ মাংস হয়, ওরা খেতে পায়।
তরু জানলা দিয়ে দেখে একতলা খুপরি বাড়িগুলোর মাঝে খুব যত্নে বানানো একটা দোতলা বাড়ি। এ পাড়ায় বেমানান। বেমানান বড় বাড়িটার সামনে দেখে ঘোড়ার গাড়ি এসে থামে। একটা মধ্যবয়সী মোটা লোক গাড়ি থেকে নামে। লোকটাকে আজ দুপুর থেকে রাত অব্দি তরুলতা দেখেছে। দুপুরে কালীমতীর হাত ধরে যে বাড়িতে এসে দাঁড়ায় সেখানে এই লোকটা মুরুব্বী গোছের কেউ। সকলে খুব খাতির করছিল। ননীমাধবও। লোকটা বড় বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ায় টলতে টলতে। তারপর জোরে জোরে সদরের কড়া নাড়ে।
“বিনি খোল বিনি। বোকার মতো রাগ করিসনে। সকলে যা বলছে তা তোর ভালোর জন্য, বাংলা থিয়েটারের ভালোর জন্য। শুনছিস, লক্ষ্মীটি খোল”। বড় বাড়ির সদর খুলে যায় লোকটি ঢুকে পড়ে।
তরুলতা জানলায় মাথা হেলিয়ে সব দেখছিলো। মোটা লোকটার কথা শুনে আজ সকালে বলা ননীর কথাকটা মনে পড়ে “মনে মনে পাপ বোধ রেখোনা তরু, যা হচ্ছে তোর মার ভালোর জন্য হচ্ছে, বাংলা থ্যাটারের ভালোর জন্য হচ্ছে”। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে তরুর কখন যেন জানলায় মাথা হেলিয়েই চোখটা বন্ধ হয়ে গেছিলো। হঠাৎ কেমন অস্বস্তি লাগায়, তরু চোখ খুলে দেখে একটা বিকট মুখ চওড়া হাসি নিয়ে তার গালে গাল ঠেকানোর চেষ্টা করছে। তরু প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে ওঠে। তরুর চিৎকারে ননীমাধব আর কালীমতী দুজনেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। কালী বিছানায় বসেই জানলায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে দেখে। চিৎকার করে ওঠে “তবেরে আবাগীর ব্যাটা। আঁশ বঁটি দিয়ে কেটে রেকে দেব”।
বলেই ঘরের কোণে রাখা একঘটি জল ছুঁড়ে মারে, লোকটা পালায়। কালীমতী তরুলতাকে হিড়হিড় করে টেনে ননীমাধবের বিছানায় ফেলে। “মাঝ রাত্তিরে লীলেখেলা হচ্ছে। সারাদিন খেটে কুত্তার মতো হয়ে আছি এখন তুমি রঙ্গ দেকাচ্চো? ঘুমো এখেনে পড়ে পড়ে” তরুলতা শক্ত কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কালীমতী পুনঃপুন নির্দেশ দিতে থাকে ননীর পাশে শুয়ে পড়ার জন্য। তরুলতা নড়ে না। ননীমাধবের কোনও হেলদোল নেই। সে আবার শুয়ে পড়ে। কালী নোড়া ধরে ননীর বিছানায় টেনে আনলে অস্ফুট স্বরে তরুলতা বলে ওঠে “আমাদের এখুনো বে হয়নি কো”…
কালী হো হো করে হেসে ওঠে। তারপর নিজের তক্তপোষে তরুকে শুতে নির্দেশ করে নিজে ননীর পাশে গিয়ে শোয়। তরু পরম বিষ্ময়ে চেয়ে থাকলে বলে “ভয় নেই তোর সতীন হব না। যা শুয়ে পড়। “তরু আর কথা বাড়ায়না। শুয়ে পড়তেই চোখে ঘুম নেমে আসে।
পরদিন সকালে কালীমতীর ঘুম ভাঙতে দেখে তরুলতা তখনও গভীর ঘুমে। ননীমাধব তার পাম্পশু গলিয়ে কোথায় বেরোচ্ছে। কালী ডাকে ননীকে “কোতায় যাচ্ছ! একে নিয়ে যাও। ভোর হয়েছে আমি সিন্ধু বুড়ির বাড়ি থেকে মেয়েদের আনতে যাব” ননীমাধব বেরোতে গিয়েও দাওয়ায় আটকে যায় টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। দাওয়া থেকেই জবাব দেয় “চন্দ্রবদন বাবু ওকে দেকবেন। থ্যাটারে পাট দেওয়া যায় কিনা এখেনেই পরীক্ষে নেবেন। এখন এখানে থাক আমি বাড়ি দেখতে যাচ্ছি”। কালীমতী বলে “আমার বাড়িখানা পাঠশালা নাকি যে এখেনে পরীক্ষে হবে। নিয়ে যাও”…
এবার একটু নরম হয় ননীমাধব। “কোথায় নেব! তোমার বাড়িতে কদিন থাকুক। আমি ওকে চন্দ্রবদন বাবুর কাছে পরীক্ষা দেবার জন্য তৈয়ের করি, তারপর”…
কালী এবার আর কোনও কথা না বলে তরুলতাকে ধাক্কা মেরে ওঠায় গজগজ করতে করতে “পরীক্ষা দেবার জন্য তৈয়ের করবেন উনি। আজ তো তোমার নিজেরই গিরিশ ঘোষের কাছে পাট বলতে পাছার কাপড় হলদে হয়ে গেল। এই মেয়ে ওঠ, ননী তোকে ফেলে পালাচ্ছে”।
তরুলতা উঠে বসে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। ননী পাম্পশু খুলে ঘরে আসে। “না তরু এসব মেয়েছেলের কতা বিশ্বেস করোনা। তোমাকে ফেলেই যদি পালাব তবে নিয়ে এলেম কেন। আমি তোমার আমার বাসা দেখতে যাচ্ছি”। তরু বুঝতে পারেনা এসব মেয়েছেলে মানে কী! তবে এই মহিলা যে সাধারণ গেরস্ত নয় তা বেশ বুঝতে পারে। থিয়েটারের অভিনেত্রীরা বুঝি এমন হয়! তবে যে ননীমাধব তাকে বিনোদিনী, গোলাপ সুন্দরী, কাদম্বিনীর বর্ণনা যা দিয়েছিল, তাতে তো মনে হয়েছিল অভিনেত্রীদের জীবন স্বপ্নের মত, তাদের আচরণ রাজকন্যাদের মতো। তরু কিছুতেই মেলাতে পারেনা। এই আচরণ, এই রূপ, এই বাসস্থান এর চেয়ে যে তার বিধবার জীবন অনেক ভালো ছিল। তরুর ভাবনার মাঝেই কালী চেঁচিয়ে ওঠে।
“দ্যাকো ননীবাবু কালী একদিন ভালো থেকেছে বলে আজকেও ভালোমানুষ থাকবে ভেবুনি। আমার চন্দর বাবু পযন্ত অপেক্ষা করতে হবেনে। তার আগেই ঘরে খদ্দের চলে আসবে। বেচে দিতে মায়া করবুনি আমি। বাড়ি দেকতে যাও আর যে চুলোয় যাও একে নে যাও”। তরু অবাক হয় এ মহিলা বলছে কী! ননীমাধব পড়ে বিপাকে। চন্দ্রবদনকে দেখাবে বলেই তরুলতাকে ফুসলে এনেছে ননীমাধব। নায়িকা পছন্দ হলেই চন্দ্রবদন থিয়েটার খুলবে। ননীর মেন পাট। ননীমাধবের ধারণা তরুলতাকে পছন্দ হবে চন্দ্রবদনের। সে কেত্তন জানা সুন্দরী নায়িকা খুঁজছে। গোলাপ সুন্দরীর বয়স না হলে তাকেই নিত। আর তরু শ্রীরামপুরের মেয়ে। গোলাপের দেশ। কিন্তু এখন কালী বের করে দিলে কোথায় যাবে! কালীর তরুর রূপ দেখে হিংসে হয়েছে ননী খুব বোঝে। ও মাগী ভাবছে যদি চন্দ্রবদন তরুর হয়ে যায়! তাই পাঠানোর জন্য ব্যস্ত। হঠাৎ ননীর খেয়াল হয় সোনাগাছির মানদা বেশ্যার সঙ্গে চন্দ্রবদনের খুব মাখামাখি। ওখানে কদিন তরুলতাকে রেখে বাসা খুঁজবে ননী। ততদিনে চন্দ্রবদনও তরুলতাকে দেখে ফেলবে নিশ্চয়ই। ননীমাধব তরুলতাকে বলে “তরু তৈয়ের হয়ে নাও আমরা বেরোবো।”
তরু একবার স্নান ঘরের দিকে যায়, নিজেকে হালকা করে, মুখে চোখে জল দিয়ে ঘরে রাখা পুঁটলিখানা হাতে নিয়ে দাঁড়ায় ননীমাধবের কাছে। আজও সে বুঝতে পারছেনা সে কেন ননীর সঙ্গে চলে এলো, এ পাপ না পুণ্য, তার ভবিতব্য কী। কেবল যন্ত্রের মতো নড়ে চলেছে। আর কাল থেকে অবাক বিষ্ময়ে এক অজানা জগতকে দেখে চলেছে। এই বুঝি কলকেতা শহর, এমন শহরে আসার জন্য লোক হাঁকুপাঁকু করে মরে!
ননী তরুকে বলে “তুমি দাঁড়াও আমি গাড়ি ডেকে আনি”। কালীমতী রুখে দাঁড়ায়। “একে না নিয়ে কোতাও নড়বেনে, আমি গাড়ি ডেকে আনতেছি”। কালীমতীর কথা শেষ হওয়ার আগেই বাড়ির সামনে দিয়ে একটা টমটম যাচ্ছিলো। কালী হাঁক পাড়ে “সওয়ারি না থাকলে রোকো। নোক যাবে” টমটম দাঁড়ালে তরুলতা আর ননী উঠে পড়ে। দরজা বন্ধ হয়ে যায়। গাড়ির চাকা গড়ায়। তরু বাইরেটা দেখতে পায়না। পেলে দেখত কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের এই মধ্য অঞ্চল থেকে পূর্ব চিৎপুরের পুরোটাই বিচিত্র এক নারী জগত। যেখানে মেয়েরাই রাজা, মেয়েরাই সেপাই আবার মেয়েরাই দুখিনী দুয়োরাণী।
গাড়ির চাকা মিনিট দশেক গড়িয়ে শোভাবাজারের একটু আগে ডানদিকে বাঁক নেয়। এই হলো কলকেতার বৃহৎ নারীপ্রধান অঞ্চল। গাড়ি থেকে নামার আগে ননী বলে “তোমায় যে লাল কাপড়খানা দিয়ে ছিলেম গায়ে জড়িয়ে নাও” তরু ভাবে তবে কী কোনও মন্দিরে এলো, ননী বিয়ে করবে এবারে! অনভ্যেসের লাল কাপড়খানা পুঁটলি থেকে বেরোতেই চোখে ধাঁধা লেগে যায়। তবু তা গায়ে আলগা ফেলে জড়োসড়ো হয়ে নামে। সামনে দেখে শ্রীহীন একখানা বাড়ি। কিন্তু বিরাট। ননী কবাট ঠেলে ঢোকে। তরুলতা অবাক হয়ে যায়। এ বাড়িতে নানা বয়সের মেয়ে ঘুরছে। কারও মুখে সাদা ময়দার গুঁড়ো, কারও ধ্যাবড়ানো ঘেঁটে যাওয়া আলতা ঠোঁটে, বাসী কাজল লেপ্টে আছে মুখে, কেউ কেউ আবার বুকের কাছে এক খন্ড কাপড় বেঁধে ঘুরছে। ননীমাধব এসে হাঁক দেয় “মানদা সুন্দরী”…
একটি মেয়ে এসে বলে “আমাদের পচন্দ নয় বুজি, মাসিকেই চাই?” ননী তার থুতনি ধরে নেড়ে মানদাকে ডাকার অনুরোধ করে। হাঁক ডাক শুনে মানদা দোতলা থেকে নিচে নামে। বছর পঁত্রিশের মানদার একঢাল কোঁচকান চুল, নীল চোখ, ধবধবে গায়ের রঙ,ছিপছিপে শরীর, আদুর গায়ে লাল সাদা শান্তিপুরী শাড়ি। বাজুতে ইয়া মোটা সোনার বাজুবন্ধ, হাতে কঙ্কন, কপালে ধ্যাবড়ানো কুমকুমের টিপ। অনেকে বলে মানদার দিদিমার মা নাকি ফরাসি দেশ থেকে এসেছিলো এ দেশে। ননী আর তরুলতার দিকে চোখ পড়ে মানদার। “কি ব্যাপার ননীবাবু কি মনে করে, ঘর খালি নেই, নতুন মেয়ে আর বসাতে পারব না, বিনে পয়সায় দিলেও নেব না কো, সারারাত খাটাখাটুনি গেছে। রেতে এসো যদি চাপতে চাও”…
ননী জবাব দেওয়ার আগেই দুটো লোক আসে।
“এবাড়ির মাসি কে আচ, সরকার বাহাদুরের কাজে এয়েচি ”
মানদা তড়িঘড়ি করে এগিয়ে আসে।
“কিসের কাজ বাবু”
“সার্ভে সার্ভে, ১৮৫২ পর তোমাদের পল্লীগুলোর আর সার্ভে হয়নি কো।”
মানদা বলে
“কি হয় সার্বে জিনিসটা বাবু?
ওদের মধ্যে একটি লোক বলে ” ত্যাখন ৪৪৪৫টা পল্লীতে সাড়ে ন হাজার ছিলি তোরা, এখুন বেড়ে কটা হয়েছে তাই গোনা।”
এই সার্বে না টার্বে করে, গুণে গেঁথে কী হয় বাবু, আমাদের দুক্কু ঘোঁচে?”
“আমরা নিজেরাও জানিনে কী হয়, বেতন পাই কাজ করি। মেলা না বকে বল এ বাড়িতে মেয়ে কটা?”
মানদাসুন্দরী জবাব দেয়
“বাইশটি”
“বাড়ির মালিক কে?”
” আমি মানদাসুন্দরী ”
“বাড়ির কাগজ কার কাচে?”
“কাগজ নেই। দিদিমার আমল থেকে আমরাই এ বাড়িতে বাস করচি”
“ভাড়া কাকে দিস?”
“আজ্ঞে মায়ের আমল পর্যন্ত জোড়াসাঁকো থেকে লোক আসতো নিতে। এখুন আর কেউ আসেনা বাবু”
সার্ভেয়ার দুজন লিখতে লিখতে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে “এই নিয়ে তেতাল্লিশ নম্বর বাড়ি হলো জোড়াসাঁকোর মালিকানায়। বাবুর ক্ষমতা ছিলো এতো মাগী সামলানোর “দুজনে খ্যাক খ্যাক করে হাসতে থাকে।
তরুলতা এতোক্ষণে বুঝতে পারে কোথায় এসেছে। শ্রীরামপুরে যৌনপল্লীর অভাব নেই। ভদ্র মেয়ে মানুষরাও এদের রকম সকম দেখেছে পথে ঘাটে। তরুলতা হঠাৎ ননীমাধবের হাত ছাড়িয়ে দৌড় মারে। ননী ধর ধর করে চেঁচায়। সেই সঙ্গে বাড়ি শুদ্ধু আধা ন্যাংটা মেয়েমানুষ ধর ধর করে ছোটে। তরুলতা বেশি দূর যেতে পারেনা। ননীমাধব ধরে ফেলে, হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে আসে।
মানদা সরকারি লোকের সামনে এসব অনাছিষ্টির কান্ড দেখে ভয় পায়।
লোকগুলো বলে
“জোর করে ইলোপ করে বেশ্যা বানালে শাস্তি জানিস?”
মানদা বলে “আজ্ঞে আমি আনিনি বাবু। রাখবো না একে”
একজন সার্ভেয়ার চোখ মটকে মানদার কানে কানে বলে “রাখ, আমি আসব এর কাচে।” বাকিরা শুনতে পায়না সে কথা, কিন্তু মানদার মুখের হাসি চওড়া হয়। সার্ভেয়ার বলে “সংশোধন করে লেখ জোড়াসাঁকোর মালিকাধীন তেতাল্লিশ নম্বর বাড়ির সদস্য সংখ্যা বাইশ নয় তেইশ”
তরুলতা তার জীবনে কুমারী থেকে সদবা, সদবা থেকে বিধবা, বিধবা থেকে সংখ্যা হয়ে গেলো নিজেরই অজান্তে।
ক্রমশ….
ঠাকুর বাড়ির কত কত দালানকুঠী যে সেই সময় পতিতাদের আশ্রয়স্থল কোঠাবাড়িতে পরিনত হয়েছে এবং করে খাওয়ার জায়গা হয়েছিল তা অনুধাবন করা যায় লেখকের ছোট ছোট ইনফরমেশন থেকে। রবীন্দ্রনাথের এসব জানা ছিল কি ছিল না তা কিন্তু জানা যায়নি কবির কোনো লেখায়!
এই পর্ব যেখানে শেষ হলো তা খুব টেনশনের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।
অপেক্ষায় রইলাম পরবর্তী লেখা পড়ার জন্য।
ধন্যবাদ অসীমবাবু। আপনাদের পাঠ আমায় উৎসাহ দেয়।
কি সুন্দর শব্দ চয়ন।অবাক বিষ্ময়ে পড়ে গেলাম।অনেক কিছুই জানা। তবে এমন সুন্দর মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখা আগে পড়িনি কোথাও।
লেখিকা কে আমার শুভেচ্ছা জানাই।
শেষ হয়ে হইল না শেষ।
প্রত্যেক বার পড়ি আর অসাধারণ লেখনী তে কিছুক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে থাকি..ভীষণ গবেষণালব্ধ একটি ক্লাসিক…
প্রতিটা পর্ব আগ্রহ ভরে পড়ি… আর, পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় থাকি… ঠাকুর বাড়ির অধীনে এই হেন ভাড়া বাড়ি ও ছিলো, জানতাম না…
খুব অধীর হয়ে অপেক্ষায় থাকবো পরের পর্বের… এত চমৎকার বাঁধুনি…. এত সুন্দর ডিটেইলিং করেছো,ঘোরের মধ্যে থাকছি….
প্রতি পর্বের মতোই অপেক্ষা নিয়ে শেষ করলাম! অসাধারণ লেখা, নীলা।
অসামান্য লেখা। খুব ভালো লাগছে পড়তে। সেই সময়কার অনেক অজানা তথ্য সামনে আসছে। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
আগের সবকটা পর্ব খুঁজে পাইনি।
প্রতিটি পর্বের শেষটা পরের পর্বের জন্য আগ্রহ জাগিয়ে তোলে। এই পর্বে তো বটেই। কষ্টও হয়। কি গেছে সে সব দিন!
আপনাকে লিঙ্ক পাঠিয়ে দেব। আরো বেশি বেশি করে মতামত প্রার্থনা করছি।
খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ি তার কৃতিত্ব ন্যারেটিভ টেকনিকের।
লেখককে একটি নিবেদন। দ্বারকানাথ বেশ্যাপাড়ার মালিক ছিলেন এই অর্থে যে তখনকার ঠিকা টেনেন্সি এক্ট অনুযায়ী ভাড়াটে সহ জমি কেনা যেত এবং তাদের উচ্ছেদ করা কঠিন ছিল। উনি যখন জমিগুলি কেনেন তখন ওখানে রমরমিয়ে বেশ্যালয় আগে থেকেই চলছিল। ফিকশনের অক্ষরে অক্ষরে সত্যি কথা বলার দায় নেই, তবুও রবীন্দ্রনাথ অব্দি দায়ভাগী হয়ে পড়তে পারেন এ-ই আশংকায় কথা ক’টি বললাম।
অভিনন্দন লেখককে।
এমন সযত্নে লিখিত উপন্যাস আমাদের জার্নালের গর্ব। প্রথম দিন থেকেই।
সত্যিই!! কতো অজানা ইতিহাস পড়ছি। এই লেখাটার জন্য অপেক্ষা করে থাকি।
এই লেখাটা আমি বেশ সময় নিয়ে পড়ি, একবার, দুবার, তিনবার….
মনে হচ্ছে আমিই দাঁড়িয়ে আছি বিপন্ন, সময়ের কাছে অসহায় তরুর মুখোমুখি!
অথচ কিছু করতে পারছিনা!
তাঁর সেই বিপর্যস্ততা আমার মনের আকাশকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছে।
অনেক ধন্যবাদ নীলা, লিংক পাঠানোর জন্য।
প্রতিটি পর্বে নতুন মোচড় নতুন বাঁক । কি অদ্ভুত ন্যারেশন –শব্দ নির্বাচন । প্রতীক্ষায় রইলাম তরুর ভাগ্যে কি আছে —
দারুণ হচ্ছে নীলা
May I simply just say what a relief to find someone who truly understands what they are discussing on the web. You definitely understand how to bring a problem to light and make it important. More and more people ought to check this out and understand this side of your story. Its surprising you arent more popular because you definitely have the gift.