আগে যা ঘটেছিল…
ব্রাহ্ম সমাজের আশ্রয় স্থল অবলা ব্যারাক থেকে বিরাট জুড়িগাড়ি এসে থামে বিনোদিনীর বাড়ির সামনে। কে এসেছে জানার আগ্রহে পতিতা কালীমতি ছটফট করে। এদিকে সে দুই মেয়েকে বুড়ি সিন্ধু বেশ্যার কাছে জমা রেখে ঘরে বাবু ঢুকিয়েছে। ইচ্ছে হলেও তাকে ছেড়ে যাবার উপায় নেই। লোকটা কালীমতিকে থিয়েটারে পাট দেবে বলেছে। হঠাৎ সিন্ধু বুড়ি এসে খবর দেয় কালীমতির ছোটমেয়ে তারাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
কত রঙ্গ দেখি কলকেতায় – ২
অপ্রত্যাশিত সাফল্য অথবা ক্রমাগত ব্যর্থতা অনেক সময় জীবনকে উচ্চগ্রামে বেঁধে দেয়। সে সমস্ত জীবনে সামান্য শোকের, সামান্য আনন্দের, সামান্য বিপদের প্রকাশও হয় উচ্চকিত, ঘোষিত, বাড়াবাড়ি। কালীমতির জীবনের সমস্ত অসাফল্য ওর জীবনকেও উচ্চগ্রামে বেঁধে রেখেছে। ভদ্র জীবন তো দুরস্ত, বেশ্যা হিসেবেও কালীমতি দাম পায় খুব কম। তাই একটি নামজাদা খদ্দের তার ঘরে এলে কালীমতি পরদিন সে কথা রাষ্ট্র করে সোচ্চারে, “আমার কি আর দু দন্ড গল্প করার উপায় আচে, লাহাবাবু বৈকালায় ফের আসবেন বলেছেন হীরের নাকফুল নে”
মেলায় কেনা একটি সাধারণ আয়না ভাঙলেও চিৎকার করে সাত পাড়া জানান দেয় কালী “ওগো বিলেত থেকে আনা বেলজেম কাঁচের আয়না ভেঙে গেলো গো, কে কোতায় আচো গো”, মেয়েদের জ্বর হলে প্রায় মরাকান্না কাঁদে কালীমতি। এমনিতে যার আকর্ষণ কম তাকে নানা ফিকিরে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হয়। চৌষট্টি কলা না শিখলেও এই একটিতে কালীমতি বেদম পারদর্শী।
আজ বুড়ি সিন্ধু বেশ্যা যখন এসে খবর দিলে কালীমতির ছোট মেয়ে তারাসুন্দরীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা, তখন কালীমতি উচ্চগ্রামে কান্না জোরে “ওগো এই ভাতারখাগী আমার কি সব্বনাশ করলো গো, আমার মেয়েটাকে বেঁচে দিলে নাকি মেরেই ফেললে গো” ইত্যাদি।
সিন্ধু নিজেও কালীর থেকে কম কিছু নয়, সেও প্রবল চিৎকারের সঙ্গে গালমন্দ করে চলে। পতিতাপল্লীগুলিতে এমন হল্লা, হট্টগোল, হাহাকার কিছু নতুন কথা নয়। তবে ইদানিং এ পল্লী কিঞ্চিৎ জাতে ওঠায় চেঁচামেচি সামান্য কমেছে। তাই ঝগড়া শুনে দু-এক ঘর থেকে উঁকি মেরে দ্যাখে কি ব্যাপার। এ পল্লীতে দিনের বেলাটা প্রায় সকলেরই বিশ্রামের সময় তাই বিরক্তও হয় অনেকে। খানিকটা কালীমতির তিলকে তাল করার স্বভাব সকলে জানে বলে আরও বিরক্ত হয়। এই হল্লাতে কালীমতির ঘর থেকে চন্দ্রবদনও বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে আসে –
“আঃ, আর একবারও চেঁচালে তোর বাকি পয়সা কেটে নেব বলে দিলুম, তাছাড়া আগাম দুদিনের যে পয়সা দিইচি তাও কড়ায় গন্ডায় বুজে নেবো” –
নিমেষে কালীমতির কান্না থেমে যায়, আড়াই দিন অক্লান্ত শরীর দেওয়ার পর এতোটুকু ঠকতে রাজি নয় সে। সিন্ধুও কালীমতির সঙ্গে চুপ করে যায়। আর যাই হোক কালীর কষ্টের রোজগার মার যাক এ সিন্ধুও চায় না। দুজনের প্রবল চিৎকার থামার পর কালীমতি সত্যিই চিন্তায় পড়ে যায় সন্তানের জন্য, গেলো কোথায় মেয়েটা! চন্দ্রবদনকে বলে “বাবু আপনি খানিক জিরোন, আমি মেয়েটারে খুঁজে আসি” –
চন্দ্রবদন বলে “এখনও ঘন্টা দেড় দুই থাকব আমি, তারপর যাসখন” –
কালীমতি মিনতি করে “বাবু তখন অনেক দেরী হয়ে যাবে যে, মেয়েটাকে যদি কেউ নিয়ে যায়”-
চন্দ্রবদন সাদা মোষের মতো চেহারা দুলিয়ে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে ওঠে-
“বেশ্যার বাচ্ছাকে আবার কে চুরি করবে র্যা, এই বুড়িকে বল খুঁজে দেকতে”-
সিন্ধু বাবুদের এ স্বভাবে অভ্যস্থ, কথা বাড়ায়না বেশি। বলে – “তুই বাবুর সেবা কর, আমি আরেকবার খুঁজে দেকছি”-
ঘরে ঢুকে চন্দ্রবদন দ্রুত দেড় ঘন্টা উশুল করে নিতে চায়। থিয়েটারের গান গাইতে গাইতে ছিঁড়ে খুঁড়ে খায় কালীমতিকে। কালীমতির বুকের একখাবলা নুন ছাল চন্দ্রবদনের হাতে উঠে এলে কালী শিউরে ওঠে। তার একরত্তি মেয়েটাকে কেউ যদি খাবলে খায়, পুরুষ মানুষ বয়স বোঝেনা যে! ওইটুকুন মেয়েকে যদি কেউ অত্যাচার করে তবে আর বাঁচবে মেয়েটা! আর বেশ্যার মেয়েকে চিবিয়ে খেলেও কোতয়াল নালিশ নেবেনা। চব্বিশ বছরে এমন ঘটনা কম দেখেনি কালীমতি। চন্দ্রবদনের শরীর থেকে ছিটকে ওঠে কালী।
“বাবু আমি মেয়েকে খুঁজতে যাবো, তোমার যদি বিবেক থাকে আমার পাওনা মেরোনি। এই তক্তপোশে পয়সা কটা রেকে যেও”-
অসমাপ্ত সঙ্গমে প্রথমে খানিক হতবাক হয়ে যায় চন্দ্রবদন তারপর অপমানে বাক্যহীন পাশবিক আওয়াজ করতে থাকে লোকটা।
নিজের ভিটে থেকে নেমে জোরে জোরে নিজের মেয়ের নাম ধরে ডাকে কালীমতি-
”তারা, তারারে, কোতায় নুকুলি মা ও তারা, একবার সাড়া দে মা। তোকে গুড়ের বাসাতা খাওয়াবো ঘরে এলে”-
তারার নাম ধরে হাঁক পাড়তে পাড়তে এগোতে থাকে কালীমতি। গোটা পাড়ার সমস্ত সম্ভাব্য জায়গায় খুঁজে বেড়ায় মেয়েকে, সিন্ধুও যোগ দেয় সঙ্গে, কোত্থাও পায়না। সিন্ধুর কাছে জানতে চায়-
“সত্যি বলতো মাসি ওকে কখন থেকে দেকছনি?”
সিন্ধু উত্তর দেয় “ওই একটা জুড়িগাড়ি এলোনি ত্যাখন? আমার ঘর থেকে বেইরে সব বাচ্ছা তাই দেকতে ছুটলে, সবাই ফিরেও এলে কেবল তোর ছোট মেয়েটা এলেনা। তারপর থেকে কত খুঁজছি”।
হঠাৎ কালীমতির মনে হয় আজ বিনোদিনী বাড়ি আছে। বিনোদিনীর ওপর বড় আকর্ষণ তারাসুন্দরীর। তার বাড়ি যায়নি তো!
“বিনোদের বাড়ি দেকে চিলে?”
সিন্ধু জবাব দেয় “কি যে বলিস, সেখেনে আমরাই ঢুকতে পাইনা আজকাল, তোর মেয়েকে ঢুকতে দেবে!”
কালী বলে- “তবু চলো একবার দেকি। মেয়েটা আমার দিনরাত বিনোদের মতো হবার চেষ্টা করে মাসি”!
নিখুঁত সংস্কৃত উচ্চারণে অভিজ্ঞান শকুন্তলম পড়ছিলেন বাবুটি, মাঝে মাঝে থেমে বাংলায় তর্জমা করে দিচ্ছেন। যেমন মনোহরণ রূপ তেমনি জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর। বিনোদিনী বাবুটির পায়ের কাছে বসে সেই পাঠ শুনছিলো। ঠোঁট পানে রাঙানো, চোখে গাঢ় কাজল, এক মাথা ঢেউ খেলানো চুল খোলা, তার খানিক অংশ লুটোচ্ছে মাটিতে। পাশে মাটির সরাতে ধুনোর ধোঁয়া উঠছে, চুল শুকোচ্ছে বিনোদিনী, ঠিক যেমন রূপকথার রাজকুমারীরা শুকোয়। বাইরের মিঠে রোদে দাঁড়িয়েই চুল কখানা শুকিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু বিনোদ জানে আর পাঁচজন যা করে তার তা করলে চলেনা।
গিরিশবাবু একবার শিখিয়ে ছিলেন অভিনেত্রীর নিজের দাম রাখতে গেলে, আকর্ষণ ধরে রাখতে গেলে আর পাঁচজনের মতো বেঁচে থাকলে চলেনা। নিজের ওপর একটা রূপকথার পলেস্তারা চাপাতে হয়। নিজেকে বিশেষভাবে গড়ে তুলতে হয়। তারপর থেকে নিজেকে তিলে তিলে তৈরী করেছে বিনোদিনী। বেশ্যার কন্যা থেকে রাজকন্যা যেন। বাংলার তাবড় পুরুষের নয়নের মণি, প্রখ্যাত অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসী এখন আকাশের তারা, ধরা ছোঁয়ার বাইরে। নিজে হিসেব করে ধরা দিতে চাইলে তবে ধরা পড়ে।
তবে এই বাবুটির কাছে বারে বারে ধরা দিতে মন চায়। কেবল নাম পিপাসু নয়, ক্রমাগত চর্চার মধ্যে থেকে জ্ঞান পিপাসুও হয়ে উঠেছে বিনোদিনী। গিরিশবাবু ছাড়া এমন করে জ্ঞান তৃষ্ণা কেউ আর মেটাতে পারেনি বিনোদের।
সবে শকুন্তলার মনের পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করতে যাবে বাবুর সঙ্গে বিনোদিনী এরই মধ্যে মায়ের তীক্ষ্ণ চিৎকার শোনে।
“বললাম তো ঢোকা যাবে না। কেউ নেই এখেনে। খুব নামী একজন বাবু এয়েছেন তার সামনে যাওয়া যাবেনা”-
বিনোদিনী যতই ঘষে মেজে নিজেকে তৈরী করুক না কেন, বিনোদের মা উচ্চকিত জীবনের অভ্যেস থেকে কিছুতেই বেরোতে পারেনা। তাছাড়া বিনোদিনীর মায়ের কিঞ্চিৎ স্নায়ুর দোষ থাকায় ক্ষণে ক্ষণেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে। একই কথা বারবার বলা তার স্বভাব। এখনও তাই করছিলে। মায়ের গলার আওয়াজে পড়ায় বাধা পড়ে বাবুটির। বিনোদিনী মাফ চেয়ে বাইরে আসে। দেখে সদরের সামনে দাঁড়ানো জুড়িগাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কেঁদে চলেছে কালীমতি। বিনোদ জানতে চায়-
“কি হলো, কাঁদছ কেন কালীদিদি? ”
কালীমতি বলে “ও বিনোদ, বিনিরে আমার ছোট মেয়েটাকে কোত্থাও পাচ্ছিনে, তোর তো খুব ভক্ত এখেনে এয়েচে?”
বিনোদিনীর মা বলে “বললাম তো একবার আসেনি, বললাম তো”-
বিনোদিনীর সাফল্য, অর্জিত শিক্ষা ওকে অন্যদের তুলনায় অনেক স্তিমিত হতে শিখিয়েছে। মায়ের ঠিক বিপরীত গলায় সে বলে-
“এখেনে তো আসেনি, তবে দুকুর বেলায় বাগানের পাশে কয়েকখানি ছোট ছেলে-মেয়ে ঘুরঘুর করছিল। তার মধ্যে বুঝি ছিলো তোমার মেয়ে? আসলে রোজ বেরিয়ে যাই তাই পাড়ায় কোনটে কার বাচ্ছা চিনতে পারিনে। দেখোতো একবার বাগানের পিছনটিতে”-
বিনোদিনীর কথা শুনে কালীমতি পড়ি কি মরি করে বাড়ির পেছন দিকে ছোটে। ১৪৫ নম্বর কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের খোলার চালের বাড়ি এখন বিনোদিনীর কল্যাণে দোতলা। এবাড়ি আগে বিনোদিনীর দিদিমার ছিলো, মেয়েমানুষদের ভাড়া দিয়ে খেতো বুড়ি। আগে অনেক ভাড়াটিয়া থাকতো এ বাড়িতে, কালীমতিও তার মায়ের সঙ্গে থেকেছে কদিন। এখন আর কেউ নেই এক বুড়ি গঙ্গাবাঈ ছাড়া। সে এখন বিনে ভাড়াতেই পাকা ঘরে থাকে। বিনোদিনী গান শিখেছে গঙ্গার কাছে, তার জন্যই বিনোদের থ্যাটারে নামা তাই গুরুদক্ষিণা স্বরূপ এবাড়িতে থাকার অধিকার পেয়েছে গঙ্গা। গঙ্গারও খুব নাম ডাক থ্যাটার পাড়ার গাইয়ে হিসেবে। এত কিছু করে তবু উঠতে পারলেনা কালীমতি। তার গলাও তো মন্দ নয়। কপালে সুখ থাকতে হয়!
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে বাগানের এপাশ ওপাশ খোঁজে মেয়েকে কালীমতি। বাগান বলতে এক চিলতে মাটিতে কুল, কাঁঠাল, জবার কয়েকটি অযত্নের গাছ। বাগানের শেষে বিনোদিনীর ঘরের পেছনেই খুব ছোট্ট একটা ডোবা। বিনোদিনী বাড়ি থাকলে বেশ্যাপাড়ার বেজন্মা ছেলেরা ছিপ নিয়ে ডোবার ওপারে বসে থাকে, যদি একবার দেখা পায়! আজ কেন যেন কেউ নেই। কালী তার মেয়েকে কোত্থাও পায়না। আবার হাহাকার করতে করতে বিনোদের সদরের সামনে ফেরে।
“ওরে আমার প্রাণের ধন কোতা গেলি মা, আমার একি সব্বনাশ হলো”!
হঠাৎ বিনোদিনীর ঘর থেকে সেই জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর হাঁক পাড়ে –
“বিনোদিনী, বিনোদিনী দ্রুত এসো, তোমার ঘরের পিছনের ডোবাতে পড়ে কেউ হাবুডুবু খাচ্ছে”-
সকলে মিলে হৈ হৈ করে বাগানের পেছনে যায়। একি, ডোবায় যে একরত্তি একটা বাচ্ছা মেয়ে! কালীমতির এ সব্বনাশও বাকি ছিলো! উচ্চগ্রামে চিৎকার করে কালী-
“ভকমান আর কত দিক দে মারবে আমায়!”
চলবে…
অসাধারণ লাগছে, পড়তে পড়তে সেই সময়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম, সেখানেই লেখক সার্থক। আগামী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
আহা.. কি যে অপূর্ব.. লেখা..
দারুণ ! দারুণ ! আমি একটানা পড়বো বলে অপেক্ষায় ছিলাম।আজ শুরু করতে গিয়ে প্রথম পর্ব কিছুতেই পেলাম না।প্রথম পর্ব খুললেই নবম পর্ব আসছে।
শেষ হয়ে গেল এত দ্রুত! এত অপেক্ষার পর! এরপর থেকে বেশি করে চাই কিন্তু।
খুব ভালো লাগলো। পরের পর্বের অপেক্ষায়।
রুদ্ধশ্বাসে পড়লাম!চুপ করে থাকি একটু
অপূর্ব! থামতে পারছিনা এমন গতি!