আগে যা ঘটেছিল
রক্তপাত মেয়েমানুষকে নিশ্চিন্তি দেয়। অন্ত যৌবন আসলে খুব ভয়ের। সামনে যদি ভরন্ত যৌবনদের ক্রমাগত উঠতে দেখে কেউ তখন এক ফোঁটা রক্তের জন্য আকুলি বিকুলি করে মন। আসলে এমন অপবিত্রতা মেয়েমানুষ কামনা করে। গেরস্ত ঘরেও কি তাই হয়! কে জানে। সেদিন অবিশ্যি গঙ্গার পাড়ে গোলাপসুন্দরী আর বিনোদিনী দাসীর ওঠা নামা চলতেই থাকে। কে কাকে ছাড়িয়ে ওপরে উঠে যায় নিজেরাই টের পায়না। কেবল এই ওঠা নামায় তাদের অতীতখানা জেগে উঠতে থাকে। একসময় এই টানা পোড়েন বন্ধ করে দুজনেই উঠে বসে এক গাড়িতে। গোলাপের বাড়ি যাবার আমন্ত্রণ পায় বিনোদিনী —
নীলা বন্দ্যোপাধ্যায়
পর্ব ৬
আগুন আর চাকা আবিষ্কার করে মানুষ দুনিয়ার অধীশ্বর হয়েছিলো।
মানুষ আগুন না চিনলে অন্তর্দাহ কী তাই হয়তো জানতো না। আর চাকা না থাকলে সমস্ত কিছুকে পিষে দিয়ে সকলের আগে এগিয়ে চলার স্পৃহাটুকুও হয়তো তৈরি হতোনা। অথবা মানুষ ওই এগিয়ে চলার নেশা আর অন্তরের আগুনটুকু নিয়ে জন্মায় বলেই সমস্ত প্রাণীকুলে মানুষই একমাত্র চাকা আর আগুন আবিষ্কার করেছে। কোনটে যে বেশি সম্ভব এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো মানুষ তামাম দুনিয়ায় আর একটিও নেই।
তবে আগুন দুনিয়া ছারখার করে দিতে পারে বটে, কিন্তু আগুন আগুনকে ধ্বংস করতে পারেনা। এই বিশ্বাসে দুটি আগুন ঘেঁষাঘেঁষি করে পাশাপাশি থাকতে পারে কোনও রকম সখ্য ছাড়াই। সেদিন ভোরে কলকাতার রাজপথে একটা ছ্যাকড়াগাড়ির তিনটে চাকা দুটি জ্বলন্ত আগুনের গোলা নিয়ে ছুটে চলেছিলো দুরন্ত গতিতে। প্রথম আগুনের নাম গোলাপসুন্দরী, দ্বিতীয় আগুনের নাম বিনোদিনী।
গোলাপসুন্দরী আর বিনোদিনী সে যাত্রায় একটিও বাক্য বিনিময় করেনি বেশ খানিকটা পথ। জোড়াসাঁকোর পাঁচ নম্বর আর ছয় নম্বর বাড়ির ঠিক মাঝখানটাতে এসে প্রথম কথা বলে গোলাপ —
“কোচোয়ান এইখেনে খানিক থামো। আমরা ভোরের হাওয়া খাবো। তুমি কিচুক্ষণ ঘুরে এসো”
কোচোয়ান আর বিনোদিনী দুজনেই অবাক হয়। এতক্ষণ গঙ্গার হাওয়া খেয়ে হলোনা! এইখানে হাওয়া খেতে হবে! বিনোদিনী ভাবে এ অবস্থায়, রক্তমাখা কাপড়খানা আগে বদলানো প্রয়োজন। গোলাপসুন্দরীর কি মাথা খারাপ হলো!
গাড়িখানা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো তার পাশেই মস্ত জায়গা জুড়ে পাঁচিল আর পাঁচিলের ভেতরে একখানা টলটলে বাঁধানো পুকুর। পুকুরের পাড়ে তালগাছের সারি, আর পুকুরের অপর পাড়ে মেটে লাল রঙের পেল্লায় পাঁচ নম্বর বাড়ি, পাশ দিয়ে উঁকি মারছে ছয় নম্বর বাড়ি। ভায়ে ভায়ে জাতে, ধর্মে ভেন্ন হয়েছে বলে বাড়ি দুখানাও আলাদা। কিন্তু আসলে এদের ইচ্ছে আর ভেতরখানা আজও একই রকম। সামান্য ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে দু বাড়িতে ওপর ওপর বিরোধ নেই তেমন। বড় মানুষদের বিবাদ বিসম্বাদ, রেষারেষি থাকলেও বাইরে থেকে বোঝার উপায় থাকেও না।
তখন সময় কত বিনোদিনী আর গোলাপ কেউই জানেনা। তবে কলকাতা শহর তখনও তেমন ব্যস্ত হয়ে ওঠেনি। ভোরের পাখিদের অবিশ্রান্ত কিচ কিচ চলছে। সঙ্গে কোনও উঠনো কেউ ঝাঁট দিচ্ছে, শানের ওপর নারকেল পাতার ঝাড়ু কর্কশ আওয়াজ তুলে মাঝে মাঝে ভোরের শান্তি খান খান করছে। এই ভোরবেলা দুই বাড়িরই জানলা এখনও বন্ধ। এ সমস্ত বড় বাড়ির বাবুদের ঘরের জানলা দেরিতেই খোলে। সারারাত তাঁরা গান বাজনায় মত্ত থেকে বাড়ি ফেরেন। ভোরের দিকে তাই তাঁদের ঘুমোবার সময়। এ দু বাড়ির কথা অবিশ্যি আলাদা। এখানে বাবুরা রাত জেগে লেখা পড়া করে। কেবল বাবুরা কেন এ বাড়ির মেয়ে বউরাও লেখা পড়া করে ইচ্ছে মতো।
গোলাপ কেনই বা গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর কতক্ষণই বা দাঁড়াবে বিনোদিনী ঠাহর করতে পারেনা। কিন্তু এমন নিস্তব্ধ পরিবেশে বিনোদেরও বেশি কথা বলতে ইচ্ছে হয়না। খানিকবাদে গোলাপ নিজেই স্তব্ধতা ভাঙে।
“এইটে কার বাড়ি জানিস বিনি?”
বিনোদিনী জানেনা। কিন্তু বিনোদিনীর আজকাল কোনও কিছু জানেনা একথা স্বীকার করতে মন চায় না। সকলে জানে, বিনোদিনী অনেক জানে। সেইটে লোকের চোখে বাঁচিয়ে রাখতে চায় সর্বদা। তাই উলটে বিনোদিনী প্রশ্ন করে গোলাপকে
” কেন বলতো?”
গোলাপ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বিনোদিনীর হ্যাঁ বা না-এর প্রত্যাশা গোলাপ করছিলোও না। গোলাপ বলে — ” অবিশ্যি তুই তো জানবিই। এ বাড়িতে থ্যাটার দেকতে এয়েচিস কখুনো?”
অসম্ভব বুদ্ধিমতী বিনোদিনীর এই একটা কথায় বুঝতে বাকী থাকেনা এ বাড়ি কার। আগেই আন্দাজ করা উচিৎ ছিলো। গোলাপ কেন এনেছে এ পথে বিনোদিনীকে, বিনোদের বুঝতে বাকী থাকেনা। শোধ নিতে চায়, না কী ক্ষমতা দেখাতে চায়! বিনোদ মনে মনে ভাবে লোকে গোলাপসুন্দরীকে আর দাম দেয়না এ সত্য তবে গোলাপ মেনে নেয়নি এখনও। বিনোদিনী কর্কশ স্বরে জবাব দেয় —
” বিনা আমন্ত্রণে বিনোদিনী দাসী কোতাও যায় না। জগতের আর পাঁচটা হ্যাঙলা মেয়েমানুষের সঙে আমায় গুলিয়ে ফেলোনা”,
গোলাপ বিনোদিনীর কথার মধ্যে ঔদ্ধত্যের সুর পায়। মনে মনে ভাবে, কাকে দেমাক দেখাচ্ছে বিনোদিনী জানেনা। সেও মৃদু আক্রমণের ভঙ্গিতে বলে —
” ও আমন্ত্রণ পাসনি বুঝি! আমি এয়েচি। আমন্ত্রণ পেয়েই এয়েছি। আসলে তিনি নিজে হাতে আমায় তৈয়র করেচেন কিনা। অলীক বাবু দেকতে এয়েচিলেম। আমায় তাবড় তাবড় নাম করা বাবুদের কাচে বসতে দিয়েছিলেন।”
কথাগুলো বলে গোলাপ দুকলি অলীকবাবুর গান গেয়ে ওঠে —
” শুধু ধনে কি করে
যে যারে সঁপেছে প্রাণ
সে চায় তারে”
বেলা যত বাড়তে থাকে মানুষ খর হয়ে ওঠে বেশি। দুজনেরই মনের মধ্যে জ্বলতে থাকা ধিকিধিকি আগুনকে একটা মেটে লাল রঙের পেল্লায় বাড়ি গনগনে করে তোলে। গানের কলিখানা শুনে বিনোদিনী মনে মনে হিসহিসিয়ে ওঠে। বিনোদিনী বলে ওঠে
“তোমার স্থান তো বাবুদের পাশেই হবে, কি আশা করেচিলে এ বাড়ির অন্দরমহলের মেয়েদের পাশে বসবে “,
গোলাপ অবাক হয়, বিনোদিনীর দেমাক এমন পর্যায়ে গেছে যে ছোট বড় পর্যন্ত রেয়াৎ করেনা! গোলাপ জবাব দেয়
” আমি তা আশা করিনি বিনি। তিনি সে আশা আমায় এ জীবনে দেননি। আমি তার নাটকের প্রথম অভিনেত্রী, এই আমার কাছে ঢের। বরং বাজারে তোর সঙে তেনার সমপ্পকের কতাই উড়ে বেড়ায়”।
কি যে সম্পর্ক সে কথা বিনোদিনীর চেয়ে ভালো আর কে জানে। তিনি যে ফিরেও তাকান না। সে কথা বিনোদিনী গোলাপকে বলতে পারেনা। কিন্তু গোলাপের প্রবল টান আছে সেকথা বিনোদিনী বুঝতে পারে। গোলাপ আবার বলে ওঠে —
“বিনি , তোর মতো গুণী মেয়েকে তাঁর পছন্দ হবারই কতা। তিনি রূপের চেয়েও গুণ বোঝেন বেশি। আর তোর তো দুটোই আচে।”
বিনোদিনী অবাক হয়। হঠাৎ নরম সুরে কতা বলছে গোলাপ! এ কেমন কৌশল গোলাপের। আক্রমণ কোনদিন থেকে আসবে বুঝে উঠতে পারেনা। বিনোদিনী বলে —
“লোকে যে বলে গোলাপসুন্দরীর জন্যি তিনি পাগল। ভুল বলে?”
“তেনারা কি কারও জন্যি পাগল হয় বিনি! তাঁদের জন্যি আমরা পাগল হই। সত্যকার পাগল! চল আমার বাড়ি চল, আমায় আবার নাইতে হবে এমন রক্তমাকা অবস্থায় আর থাকতে পারছিনে। মেয়েটাও ঘুম থেকে উঠে আমায় না দেখে কাঁদবে”
গোলাপসুন্দরী কোচোয়ানকে হাঁক দেয় বেশ কয়েকবার। সাড়া পায়না। তারপর নিজেই গাড়ি থেকে নেমে খুঁজতে যায়। পেছনে বিনোদিনীও নামে। পাঁচিলের ধার ঘেঁষে খুঁজতে খুঁজতে পাঁচ নম্বর বাড়ির সামনের দিকে এসে পড়ে দুজনে। দেখে ও বাড়ির দরোয়ান আর গোলাপের গাড়ির কোচোয়ান গল্পে মত্ত। দেশোয়ালি ভাই বোধহয়। গোলাপ রেগে মেগে কোচোয়ানকে হাঁক দেওয়ার আগেই দেখে ও বাড়ির দরোয়ান ব্যস্তসমস্ত হয়ে সদর দরজা খুলছে। গেটের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে প্রায় বিনোদিনীর বয়সের এক যুবক। এ বাড়ির সেজো কত্তার মতোই সুপুরুষ, লম্বা, ফর্সা, কাঁধ অব্দি চুল, মাথায় আলগা পাগড়ী বাঁধা, ধুতি ও ফতুয়ার ওপর গায়ের চাদরখানা এদিক থেকে ওদিক আলগোছে ফেলা। আপাত দৃষ্টিতে দেখলে মনে হয় অযত্নের সাজ। আসলে তার মধ্যে একটা যত্ন আছে। বিনোদিনী আর গোলাপ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে! এ বাড়ির সেজো কত্তাও সুন্দর, কিন্তু এ যেন সেই রূপের সঙ্গে আরও কিছু মিশেছে। সম্মোহিত হয়ে যেতে হয়। গোলাপ চিনতে পারে এ বাড়ির ছোটকত্তাকে। অলীকবাবু নাটকে মেন পাট করেছিলেন।
দরোয়ান ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলে
“ছোটকত্তা গাড়ি নিকালতে বলি!”
যুবক মোলায়েম স্বরে জবাব দেয়
“না হাঁটব ভাবছি। এ বুঝি নতুন কাজে যোগ দিলে?”
হিন্দুস্থানি দরোয়ান জবাব দেয় ভাঙা বাংলায়
“জী না ছোটকত্তা, হামার দেশের লাড়কা, কোচোয়ান আছে , ইধার গাড়ি নিয়ে আসলে মোলাকাত করে”
কোচোয়ান হাত তুলে নমস্কার করে। ছোটকত্তা যাবার জন্য এগোলে দেখে রাস্তার উলটো পিঠে দুজন অসামান্য সুন্দরী মহিলা তার দিকে অবাক হয় চেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এ বাড়ির ছোটছেলে ওদের দুজনকে চিনতে পারেন।
“আপনারা এখানে? কোনও কাজে? কারও সঙ্গে দেকা করবেন! ”
এমন অসামান্য রূপের ছটা, ব্যক্তিত্ব আর মোলায়েম বাচন ভঙ্গিমায় দুই প্রগলভ নারীও কি জবাব দেবে ভেবে পায়না। গোলাপসুন্দরী কেবল হাত তুলে নমস্কার জানায়। যুবাও প্রতি নমস্কার করে ফের বলেন —
“কারও সঙ্গে দেখা করার থাকলে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন”
গোলাপ জবাব দেয় ঘোর ভেঙে
“আজ্ঞে না বাবু। এমনি এ পথ দিয়ে যাচ্ছিলুম, আপনাদের বাড়ির পুকুরখানা দেকে ভারি থামতে ইচ্ছে হলো। অপরাধ নেবেন না। ”
“নানা অপরাধ কিসের। আপনারা শিল্পী প্রকৃতির শোভা তো আপনাকে টানতেই পারে! ”
একথার প্রত্যুত্তরে কি বলতে হবে ভেবে পায়না গোলাপসুন্দরী, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে তার। আজকাল কারণে, অকারণে বড্ড ঘাম হয়। এখন বোধহয় একটু অপ্রস্তুতেও পড়েছে বলে আরও ঘামছে। এই ভোর বেলায় এমন আচম্বিতে কারও সঙ্গে দেখা হবে ভাবেনি সে। সামাল দেয় বিনোদিনী। হাত তুলে নমস্কার করে বলে
” কোচোয়ান আমাদের বসিয়ে রেকে এখেনে গপ্প করতে চলে এয়েছে, তাই তাকে খুঁজতেই, আমার নাম বিনোদিনী দাসী আর এ…”
ছোট কত্তা বিনোদিনীকে কথা শেষ করতে দেননা। মৃদু হেসে বলেন
” গোলাপসুন্দরী, ওরফে সুকুমারী দত্ত। থিয়েটারের এই দুই নারীকে তামাম বাংলা জানে, পরিচয়ের প্রয়োজন নেই”
তারপর গোলাপসুন্দরীর দিকে চেয়ে জানতে চান
“আপনি এখনও লিখছেন নিশ্চয়ই? ”
গোলাপ কেবল মাথা নেড়ে না বলে। যুবক না লেখার কারণ জানতে চাননা কেবল বলেন ।
“পারলে লিখুন, মেয়েদের লেখা প্রয়োজন, আর নাটক তো আপনি ছাড়া আর কোনও মেয়ে লেখেননি।”
গোলাপের বদলে বিনোদিনী জবাব দেয়
“আপনিও খুব ভালো নাটক লেকেন শুনিচি। আপনার লেকা বাল্মিকী প্রতিভা তো এ বাড়িতেই এস্টেজ হয়েচে।”
ছোটকত্তা শান্ত ভাবে জানতে চান
“কার থেকে শুনলেন?”
বিনোদিনী ঈঙ্গিত বুঝতে পারে, জবাব দেয়
“আপনাদের কতা সকলের মুকে মুকে ঘোরে কার নাম বলবো বলুন দিকিনি।”
“সেই কার নামই বা আপনারা বলবেন।
যাক আপনারা সত্যিই যখন কারো দেখা চাননা তখন চলুন এগোনো যাক”
যুবক দু এক পা এগিয়ে যায়, বিনোদিনী যুবকের পেছনে দু এক পা এগিয়েও দ্যাখে গোলাপ পাঁচিলের গা ঘেঁষে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, গোলাপসুন্দরীর অস্বস্তি বিনোদিনী টের পায় তাড়াতাড়ি বলে মোহিনী কন্ঠে
” বাবু আমাদের পথ তো আলাদা, আপনি এগোন আমরা আসছি।”
ছোটকত্তা জবাব দেননা। লম্বা লম্বা পা ফেলে ফেলে অতি ঋজু ভঙ্গিতে এগিয়ে যান। হাঁটা দেখেই বোঝা যায় ইনি বহু বহু দূর যাবেন। সামান্য গতি নিয়ে ওঁকে ধরা অসম্ভব।
কখনও খুব মিঠে, শান্ত বাতাসও নিভু নিভু আগুনকে বাড়িয়ে দিতে পারে। বিনোদের মনের আগুন আবার দপ করে জ্বলে ওঠে। তার বয়সী সুপুরুষ যুবা তাকে পাত্তা না দিয়ে কেবল গোলাপের উদ্দেশ্য কথা বলে বেরিয়ে গেলো এ মন থেকে মেনে নিতে পারেনা। আঘাত করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। নিচু গলায় কঠিন স্বরে বলে —
“গোলাপ দিদি, রক্তের দাগ দেকিয়ে বুঝি যৌবন জাগিয়ে রাকা যায়, বলিহারি তোমায়, যেতই বারো ভাতারী মেয়ে মানুষ হই আমরা, ঘেন্না পিত্তি কিচু থাকবে না তা বলে।”
গোলাপ অবাক হয় বিনোদিনীর কথার ভঙ্গিতে। এ সেই বিনোদ! যে শেক্সপিয়ার থেকে কালীদাস সমস্ত কাব্য পাঠ করে! যাকে এক ঝলক দেখার জন্য বাংলা দেশের অভিজাত পুরুষদের মন আনচান করে! যার জন্য বড় বড় বাড়ির অসামান্য সুন্দরী বৌরাও বাড়ির এক কোণে আসবাব হয়ে পড়ে থাকে, নিজেকে তৈয়ের করতে থাকে বিনোদিনীর ঢঙে যাতে স্বামীর মন পাওয়া যায়। গোলাপ বলে —
” ছিঃ বিনি, আমি একটা মেয়ের মা! তোরই তো দিন এখুন পাগলী, তাও কিসের এতো রাগ আমার ওপর! তুই বরং বাড়ি যা, তোর মাতার ঠিক নেই আজ, এ মন নিয়ে আমার মেয়েটাকে দেখতে যাসনে। আমি বাড়ির কাচেই চলে এয়েচি। গাড়ি আমায় সেখেনে নামিয়ে দিয়ে তোকে দিয়ে আসবে”
বিনোদিনী তার ব্যবহারে কিঞ্চিৎ লজ্জা পায়, কিন্তু দমবার পাত্রী সে নয়।
“সেই ভালো, আমার এই ভোরে কন্ঠ চর্চার সময়। মিচিমিচি সময় নষ্ট করতে পারবোনা ”
আবার তিনটি চাকার ওপর দুটি আগুনের গোলা ছুটতে থাকে। ছ্যাকড়াগাড়ি এসে একটা ছোট্টো দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। গোলাপ তার গঙ্গা স্নানের পুঁটুলিখানা নিয়ে নিচে নেমে কড়া নাড়ে। দরজা খুলে এসে দাঁড়ায় গোলাপের মতোই দেখতে ফুটফুটে বছর তিন চারের একটি মেয়ে। এক মাথা চুল, চোখে ঘুম জড়ানো, ছুটে এসে জড়িয়ে ধরতে চায় গোলাপকে। গোলাপ ছিটকে যায়
” খবরদার ছুঁসনে এখন কমি , স্নান সারি আগে”
মা গঙ্গা স্নান সেরে এলে প্রতিদিন দরজা খুলে মাকে জড়িয়ে ধরা অভ্যেস কমির, মা ছাড়া আর কে আছে তার এ দুনিয়ায়। মাও তো ঘরে বাইরে ব্যস্ত থাকে সারাদিন, এই টুকুই তো কমির আর মায়ের নিজের সময়। সেই মা তাকে ছুঁতে দিলনা দেখে দু চোখ জলে ভরে ওঠে কমির। গোলাপসুন্দরী লক্ষ্য করেনা ভেতরে ঢুকে যায়। ছ্যাকড়া গাড়িখানা বিনোদিনীকে নিয়ে রওনা দেয়। যাবার সময় কমিকে দেখে বিনোদিনীর মনে হয় একটা ছোট্ট গোলাপ থেকে ভোরের শিশির ঝরে পড়ছে। বিনোদিনী হাত নাড়ে। কমি ছুটে গিয়ে দরজা বন্ধ করে।
চিৎপুরের রাস্তা দিয়ে চাকা খানিক গড়ানোর পর বিনোদ জানতে চায় “কোচয়ান এখন মেঠাইয়ের দোকান কোনও খোলা আছে?”
কোচয়ান না জানালে বিনোদিনী আর জবাব না দিয়ে জানলার বাইরে দেখতে থাকে। হঠাৎ দ্যাখে পথের পাশে তাজা লাল গোলাপ বিক্রি করছে এক বুড়ো। বিনোদ গাড়ি থামিয়ে এক গোছা ফুল কেনে, তারপর নির্দেশ দেয়
“গাড়ি ঘোরাও আবার গোলাপ দিদির কাচে যাবো’
ক্রমশ…
আপনার লেখা একটা নেশার মতো মনে হয়।বহুক্ষণ ভেতরে বাস করে। আপনার এই সে সময়ের ভাষাকে ব্যবহার করে সাবলীল ভাবে কথোপকথন করেছেন। মুগ্ধ হয়ে যাই। খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলে মন খারাপ লাগে, আবার জার্নাল পড়তে পারবো অপেক্ষায় থাকি।
ধন্যবাদ অসীমবাবু। আপনারা অপেক্ষা করেন এরচেয়ে বেশি লেখকের প্রাপ্তি আর কি হতে পারে। 🙏
চমৎকার হচ্ছে। এক নিঃশ্বাসে পড়লাম
খুব ভালো লাগছে। সেই সময়টা দৃশ্যপটে ভেসে উঠছে। শুভেচ্ছা রইল।
অজস্র ধন্যবাদ, ভালোবাসা
অনবদ্য লেখা এটি। কি সুন্দর নিখুঁত বর্ণনা সব। শুধু দুই পর্বের মধ্যে অনেকদিনের ব্যবধান!
অসাধারণ.. আবারও বাকরুদ্ধ হলাম.. এমন লেখা পড়ে.. ধন্য আমি.. তাই পড়ার সুযোগ পেলাম🙏
ধন্যবাদ, নিয়মিত চোখ রাখুন। প্রশ্ন বা মতামত থাকলে জানাতে পারেন।
ভালো থাকবেন।
আবারও আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে হুঁশ ফিরিয়ে শেষ হয়ে গেলো… কিংবা গেলো না… অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি পরবর্তী অংশের জন্যে… বেশ একটা আবেশ তৈরী হয়েছে বাংলার Renaissance এর… “সেই সময়” থেকে আজ ও ওই সময়ের আখ্যানে কোথায় যেনো নিজেকে ও খুঁজে পাই… সীমাহীন সীমাবদ্ধতায়… অনেক ভালবাসা… এমনে বিষয় নির্বাচন করেছো বলে… আর গবেষণার পরিধি ও অনুভূত হচ্ছে 🙏❤️
দুই নারীর ব্যক্তিত্ব ও পেশাগত দ্বন্দ্ব, তাদের কাছে আসা, আবার দূরে যাওয়া, তাদের এ-ই জ্বলে ওঠা, পর মূহুর্তে অনুতপ্ত হওয়া, এইসবের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে অগ্নি-চক্র, আগুন-ভরা রথের চাকা। এ-ই উপন্যাসের সম্ভাবনা অসীম!
অতি চমৎকার।
একটি সময় – নাটকে মেয়েদের অভিনয়ের ইতিহাস- সংগে বিনুনির মত নিটোল একটি কাহিনীর বুনোট।
অসাধারণ ! টাইম মেশিনে চেপে এক পরিক্রমা চলছে যেন। অপেক্ষায় থাকি।
শুরু থেকেই পড়ছি,দুর্দান্ত লাগছে… অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রইলাম পরের কিস্তির…..
এমন লেখায় কী যে মন্তব্য করি!
নেপথ্যে দাঁড়িয়ে সেই সকালকে দেখলাম।
এমন ক’রেও লেখা যায়!
কি মসৃণ চলনে এগিয়ে চলছি আমরা। জয় হোক লেখকের এই দুরন্ত সৃষ্টির।
এই পর্ব শুরু থেকে শেষ অসম্ভব আকর্ষণীয়। টেনে রাখে। শুরুর উপমা সুন্দর আর সেই উপমাকে সমস্ত লেখা জুড়ে বাঙময করে তোলার কাজ লেখক সুন্দরতরভাবে সম্পন্ন করেছেন। জয়তু। ।
এ লেখা পড়ার পরে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি । মনটা একদম সেই সময়ে ছুটে যায় । আগুন আর চাকার প্রসঙ্গ যেভাবে আনা হয়েছে –বড় গভীর চিন্তা ।
অসামান্য লেখা হচ্ছে ।