কৃষ্টির নাট্য চলমান সময়ের অনুবাদ | সিতাংশু খাটুয়া

পশ্চিমবঙ্গে সবমিলিয়ে মোট নাট্যদলের সংখ্যাকে যদি হিসেব করতে যাওয়া হয় নিশ্চিত ভাবেই তা অসীমের কাছাকাছি পৌঁছবে। কাজেই প্রথম যখন ‘কৃষ্টি’র প্রতিষ্ঠা হয়, সেই অসীমের মাঝেই একক হয়ে উঠবার প্রয়োজনে নাট্যশিল্পের পরিসরে কোনও একটি ধরণের মৌলিকত্ব অর্জনের বিশেষ ভাবে দরকার হয়ে পড়েছিল। সোজা কথায় যাকে আমরা ‘দলের বৈশিষ্ট্য’ বলে চিহ্নিত করতে পারি। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে প্রতিষ্ঠিত ও স্বনামখ্যাত প্রতিটি দলের ক্ষেত্রেই এমন একেকটি করে বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কেউ বা লোকনাট্যে বিশারদ, কেউ বা রাজনৈতিক অথবা সামাজিক আলোচনাকে, সমসাময়িক নানান আন্দোলনকে প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে মঞ্চে তুলে আনতে চেষ্টা করে। কেউ বা আবার অনুবাদ নাটক, অথবা বিদেশী অনুপ্রেরণায় লিখিত সমস্ত নাটকের বিষয়েই বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। কারোর বা আবার মূল মুন্সিয়ানার জায়গাটি হলো সঙ্গীত, মিউজিক্যাল ইত্যাদি – ঠিক এমনিভাবে ‘কৃষ্টি’ও চেয়েছিল সচেতনভাবেই, শুরু থেকে নিজেদের একটি ‘নিজস্ব বৈশিষ্ট্য’কে তৈরি করে নিতে। সেই বৈশিষ্ট্য যতখানিই বা মৌলিক হবে, অন্যদের থেকে আলাদা হবে – ততই, ‘কৃষ্টি’র একক অস্তিত্বটুকুও সকলের গোচরে আসবে। ‘কৃষ্টি’র পরিচয় ফুটে উঠবে তার নিজস্ব পরিসর, চিন্তা, ও তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমেই। কেবল ‘আরও একটি নতুন নবনাট্য সংঘ’ হয়ে সে কোনওমতে ‘টিকে’ থাকবে না।

এইভাবেই ‘কৃষ্টি’র যখন যাত্রা শুরু হয়, হয়তো বা অবচেতনেই মনে হয়েছিল – বাংলা মঞ্চে যেন বা খাঁটি বাংলা নাটক, বিশেষত বাংলা সাহিত্যধর্মী নাটকের বিষয়ে বেশ একটা আকাল দেখা দিয়েছে। বিদেশি নাটক, বিদেশি সাহিত্য, বিদেশি ভাবনার প্রকট অথবা প্রচ্ছন্ন প্রেরণাটুকুই যেন বা শহর বা শহরতলির মঞ্চে, বেশি করে নজরে আসছিল। শরৎচন্দ্রের গল্প থেকে শিবরামের নাট্যরূপ দেওয়া জনপ্রিয় নাটক ‘ষোড়শী’ বা তেমন কোনও নাটকের সাফল্যের দিন হয়তো বা অস্তমিত হয়েছে, তবুও বাংলা সাহিত্যের এমন মণিমাণিক্যের ভাণ্ডার সকলের হাতের নাগালে পড়ে থাকলে পরেও, এমন করে বিদেশি অথবা বিদেশিভাব-অনুসৃত নাটকেরই বা রমরমা হবে কেন, এই প্রশ্নটাই অবচেতনে ভীষণ ভাবিয়ে তুলেছিল তখন। এমন ভাবে ভাবতে ভাবতে, ‘কৃষ্টি’র তরফে এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে পরেই – কেবলই যে বাংলা সাহিত্যের পুনরায় মঞ্চপ্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে নিয়ে তারা উৎসাহী হয়ে উঠল তাই নয়, ‘কৃষ্টি’র সদস্য হিসেবে তারা সেই সাহিত্যেরই বিবিধ রূপগুলির মধ্যে নাটক অথবা ছোটগল্পের মতো আপাতসহজ মাধ্যমগুলিকে দূরে সরিয়ে রেখে, সাহস করে বেছে নিতে চেষ্টা করল ‘উপন্যাস’এর যে বিস্তৃত, বিশাল রূপ – সেই বিরাটাকায় পরিসরটিকেই। তাদের স্মরণে ছিল উপন্যাসের নাট্যায়নের ক্ষেত্রে বাংলা নাট্যমঞ্চে তেমনভাবে কোনও স্মরণীয় কাজ হয়নি। রবীন্দ্রনাথের কিছু উপন্যাসের নাট্যরূপ, হয়তো বা বিভিন্ন সময়ে বিবিধ নাট্যদলের মাধ্যমে অভিনীত হয়েছে – কিন্তু রবীন্দ্রসাহিত্যের বাইরেও বাংলার যে বিপুল সাহিত্যসম্ভার, তাই নিয়ে অধিকতর মঞ্চ-গবেষণার উদাহরণ নেই। দেবদাস, একাধিকবারে মঞ্চে এসেছে, কিন্তু তাও এসেছে বাংলা অথবা হিন্দি চলচ্চিত্র হিসেবে ‘দেবদাস’এর রূপোলী পর্দাতে আগমনের পর; অর্থাৎ কিনা একেবারে মৌলিক সাহিত্যকীর্তি অথবা কেবল মাত্র উপন্যাস হিসেবেই জনমানসে সুপরিচিত হয়ে রয়েছে এমন কোনও সাহিত্যের উদাহরণকে নিয়ে মঞ্চে কাজ করবার বিষয়ে এতদিন যাবৎ কেউই তেমন ভাবে আগ্রহ প্রকাশ করেননি। ‘কৃষ্টি’ তাই সেই চ্যালেঞ্জটাকেই বেছে নিল নিজেদের জন্য, নিজেদেরকে প্রথম দিন থেকেই একক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনেই।

প্রথম নাটক ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস। শোনা যায় বিভিন্ন পরিচালক এটিকে চলচ্চিত্র হিসেবে তৈরির কথা ভেবেও শেষমেশ পিছিয়ে গিয়েছিলেন, উপন্যাসটির ঐতিহাসিক চরিত্র ও তার বিপুল বিস্তৃতির কারণে। ‘কৃষ্টি’ সেই চ্যালেঞ্জকেও সাফল্যের সঙ্গে গ্রহণ করল, এবং বাংলা নাট্যমঞ্চে ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’কে মঞ্চস্থ করে ইতিহাসের পাতায় সামান্য এতটুকু হলেও, একটি আঁচড় কেটে ফেলতে সক্ষম হলো। এরপর আর ‘কৃষ্টি’কে নিজেদের পরিসর বা মৌলিকত্ব নিয়ে ভাবতে হয়নি। পরের পর আরও তিনটি প্রযোজনায় তারা নিয়ে এল সমরেশ মজুমদারের ‘কালপুরুষ’, বুদ্ধদেব গুহের ‘মাধুকরী’ এবং এই মুহূর্তে তাদের নবতম প্রযোজনা, যা কিনা এই মুহূর্তে অভিনীত হয়ে চলেছে – আবারও সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস অবলম্বনে ‘গর্ভধারিণী’। এই তিনটি উপন্যাসের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র যদি সেগুলির আয়তন বা পরিসরকে বিচার করেন কেউ, তাহলেই তিনি বুঝবেন সেই বিপুল বিস্তারগুলিকে দুই বা আড়াই ঘণ্টা সময়ে নাট্যমঞ্চে তুলে নিয়ে আসাটা কি অবিশ্বাস্য কাজ। ‘কৃষ্টি’ সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করতে চেয়েছিল এবং তারা তা করে দেখিয়েছে। মূল উপন্যাসের সারাংশটুকুকে নিংড়ে, ছেঁকে নিয়ে এসে, একেকটি করে সুপরিকল্পিত দৃশ্যের মাধ্যমে যেভাবে সম্পূর্ণ আখ্যানটিকে মালার মতো দুই বা আড়াই ঘণ্টার পরিসরে গেঁথে তোলা হয় ‘কৃষ্টি’র মহলাঘরে, তা সে নাটক যাঁরা দেখেছেন তাঁরাই বলতে পারবেন তার মুন্সিয়ানার বিষয়ে। উপন্যাসের বিশালত্বকে মনে রেখে, তার রোমাঞ্চ, তার রঙ, তার ঘটনাবহুলতা, তার সামাজিক ও ভৌগোলিক বিস্তার, তার মধ্যেকার বিবিধ সমাজ ও মানুষের যে বিপুল বৈচিত্র্যের সহাবস্থান, এই সবকিছুই তিলে তিলে নাটকের মূর্তিটুকুতে লেপে দেওয়া হয়ে থাকে। সাজিয়ে তোলা হয়ে থাকে। এই ‘বৈশিষ্ট্য’টুকুই ‘কৃষ্টি’র গর্বের কারণ। সাহিত্য, বাংলা সাহিত্য ও বাংলা উপন্যাস – এই তিন বিশেষ বিষয়কে সচেতন ভাবে নিজেদের কাজে গুরুত্ব দেওয়াটাই ‘কৃষ্টি’র একক হয়ে উঠবার পথে বিশেষ পাথেয় হয়ে উঠেছে।

এছাড়াও যদি ভাবি, একজন শ্রষ্টা বা শিল্পীর কাজই হলো চলমান সময়ের অনুবাদ। শিল্পীর চিরকালীন হওয়াটা জরুরি, কিন্তু তারও আগে বোধহয় সমকালীন হওয়াটাও একইরকম জরুরি। কারণ শিল্পীর যে কেবল মহাকালের পথে নিজের অস্তিত্বরক্ষার দায় থাকে না, বরং সার্থক শিল্পী সমাজের জন্য কাজ করেন। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে তাই উপন্যাস হিসেবে তো বটেই, বিষয় হিসেবেও ‘কালপুরুষ’কে মঞ্চে আনাটা দরকার ছিল। একজন মানুষের আদর্শ, সেই আদর্শ যদি সৎ হয়, তবে সেই আদর্শের জন্য সংগ্রাম, এই কথাগুলোকে আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করাটা প্রয়োজন ছিল। আজকের পৃথিবীতে, বা চিরকালেই, যদি বা কোনও মানুষ আদর্শের জন্য মৃত্যুকে অবধি অস্বীকার করে, তবে সেই আদর্শের সত্যটুকুকে মেনে নিতেই হয়। সেই বিশ্বাসটুকুকে মেনে নিতেই হয়। সেই অদ্ভুত এক ইউটোপিয়ান সত্যের জন্যই চিরন্তন এক সংগ্রামের নাম ‘কালপুরুষ’। সেই একই সংগ্রামের উপাখ্যান অন্যরকম ভাবে উঠে আসে ‘গর্ভধারিণী’তেও। বিশাল এই সমস্ত উপন্যাস, আদতে মানুষের কথা বলে। মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাসের কথা বলে। উপন্যাসের বিশালত্বকে মঞ্চে তুলে নিয়ে আসার পিছনে আদতে কাজ করে সেই বিশ্বাসেরই উদযাপন। পক্ষান্তরে অন্যদিকে দাঁড়িয়ে, পৃথু ঘোষ আর ‘মাধুকরী’। এই চূড়ান্ত এক বস্তুসর্বস্ব পৃথিবীতে কোথাও যেন এক দারুণ বোহেমিয়ান শিল্পীর নিজের মতো করে বাঁচার গল্প। নিজের স্বাধীনতায় উজ্জীবিত হয়ে দাপিয়ে বেড়ানোর উপাখ্যান। কালজয়ী এমন একেকটি উপন্যাসের বিশালত্বকে, ক্রমানুগ দক্ষতায় এভাবে মঞ্চে উপস্থাপিত করতে পারাটা কেবল কৃতিত্বের নয়, পরিশ্রমের। ‘কৃষ্টি’ যে সেই পরিশ্রমকেই উদযাপন করতে চেয়েছে।

… তুলে ধরতে চেয়েছে মানবসমাজের বিপুলতাকে, মানবজমিনের বহুফসলি চরিত্রকে, আর এর পাশাপাশিই বিশেষ ভাবে বহন করতে চেয়েছে বাংলা সাহিত্যের উত্তরাধিকার। বাংলা নাট্যমঞ্চে তাই সেই বাংলা সাহিত্যকেই, বাংলা উপন্যাসকেই বিশেষ ভাবে তুলে আনার ক্ষেত্রে তাদের আন্তরিক অঙ্গীকারকে বুকে নিয়েই, আজ ‘কৃষ্টি’র নিজস্ব নাট্য-ভাবনা’র উদযাপন!

3 thoughts on “কৃষ্টির নাট্য চলমান সময়ের অনুবাদ | সিতাংশু খাটুয়া

  1. গর্ভধারিনী দেখেছি। ভাল লেগেছে। কিছু প্রশ্নও তৈরি হয়েছে বটে…কিন্তু বড় ক্যানভাসে কাজ।

  2. Excellently described about the vision & success story of Garia Krishti & it’s Master Dr. Sitangshu Khatua. Feeling proud being a regular artist of this caring group.

  3. খুব ভাল লেখা। এমন লেখায় একটা দলকে জানা যায় তার কাজের নিরিখে।

Comments are closed.