জীবন নানাভাবে, নানা মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। সাধারণত আমরা তাকে ব্যক্তিগত, একরৈখিক হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু তা যখন কোনো শিল্প-মাধ্যমের সংস্পর্শে আসে তখন বন্ধ দরজা খুলে যায়। জানলা খুলে হুহু করে ঢুকে আসে ঝোড়ো হাওয়া। সে হাওয়া ওলটপালট করে দেয় ঠাসবন্ধ সমাজের আগল। আর সবকিছুর থেকে যা আমাদের শিল্প-চেতনাকে পরিপুষ্ট করে তা হল, সেই শিল্পের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শন। নব্বই দশকের গোড়ায়, একদিকে রাশিয়ার পতন অন্যদিকে বিশ্বায়নের প্রভাব ঔপনিবেশিক দেশগুলোর শিল্প-সাহিত্যের ওপর যথেষ্টই পড়েছিল। পাশাপাশি প্রভাবিত ও পরিবর্তিত হচ্ছিল দেশের বিনোদন ও গণমাধ্যম। যেহেতু ভাঙনের মধ্যে দিয়ে নতুন সূচনা আসে, ঠিক সেই কারণে যে কজন নাট্য-নির্দেশক তাঁদের রঙ্গমঞ্চে নানাদিক থেকে সময়কে ধরতে পেরেছিলেন, সুমন মুখোপাধ্যায় তাঁদের মধ্যে অন্যতম। আমি কোনো নাট্যবোদ্ধা নই, মঞ্চসজ্জা বা আলোর ব্যবহার সম্পর্কেও দীক্ষিত নই। তবু এতটুকু বুঝতে পারি, “তিস্তাপারের বৃত্তান্ত”-এর মতো উপন্যাসকে যখন এক প্রেক্ষাগৃহের মধ্যে অবস্থিত মঞ্চে এনে ফেলা হয়, তার জন্য কতখানি শৈল্পিক দীক্ষার প্রয়োজন। সম্প্রতি দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত ও সুমন মুখোপাধ্যায় রচিত “মঞ্চ-চিত্রের বৃত্তান্ত” গত চার দশকের এক নিরবচ্ছিন্ন শিল্প-যাত্রাকেই বর্ণনা করে। আশির দশক থেকে যাত্রা শুরু ক’রে প্রেক্ষাপটের পর প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়।তিস্তাপারের বৃত্তান্ত থেকে রাজা লিয়ার, এবং সাম্প্রতিক মেফিস্টো তার প্রমাণ, যা কিনা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও মহামারীকে পার করে চলে যায়, রীতিমতো চ্যালেঞ্জ করে তাকে।
“ভালো করে ঘুমোক। ঘুমোলেই ঠিক হয়ে যাবে।”
ঘুমোলে আসলে কিচ্ছু ঠিক হয় না, কারণ ঘুম ভাঙার পর আমাদের পাশাপাশি জেগে ওঠে বিষণ্ণতাবোধ, যা সমস্তকিছুকে অসাড় করে রাখে। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবার জন্মের পর থেকে ভাবতে শেখায় কীভাবে একটু একটু করে দিনমান পার করে দিতে হয়, অত্যন্ত সাধারণভাবে। তাতে বিশেষ কোনো ঘটনা নেই, রাজনীতির প্রত্যক্ষ্য ছায়া নেই, শিল্পের আড়ম্বর নেই। আমরা সাধারণ চাকুরীজীবী হয়ে থাকতে চাই। সমাজকে মাথানিচু করে মেনে নিই, মেনে নিই অচলায়তনে বন্ধা নিয়মগুলোকে। আমরা ভয় পাই। ভীষণ ভয়।হারিয়ে যাওয়ার ভয়, হেরে যাওয়ার ভয়, একা হয়ে যাওয়ার ভয়। সন্তানকেও ভয়ে ভয়ে মানুষ করি। জন্মের পর থেকে তাকে নানান বিদ্যায় পারদর্শী করতে চাইলেও, সে সন্তান অন্য পথে হাঁটতে চাইলে আমরা ভয়ের কারণে তাকে আমাদের সঙ্কীর্ণ পথে হাঁটতে বাধ্য করি।
কথায় বলে, জীবন ও তার সত্য কল্পনার থেকেও অদ্ভুত। চুপ করে থাকতে থাকতে সে যে কখন তার ম্যাজিক দেখাতে শুরু করে তার হদিশ পাওয়া বড় কঠিন। আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনও বিগত কয়েক দশকের প্রত্যক্ষ্য ও পরোক্ষ রাজনীতি ও সমাজের মারপ্যাঁচের সঙ্গে ক্রমাগত লড়াই করতে করতে পরিপুষ্ট হয়ে ওঠে। শিল্প আর বন্ধুত্ব যদি জীবনের শেষ দিন অবধি থেকে যায়, তবে সঠিক মানুষ ও পন্থাকে বেছে নেওয়াই আমাদের কাছে আশির্বাদ হয়ে ওঠে। বিষময় শীতল অচলায়তনকে ভাঙতে হলে আভ্যন্তরীণ সুবিধাজনক অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, চলতে চলতে একটু একটু করে সরিয়ে ফেলতে হবে ভয় নামক সেই জগদ্দল পাথরটাকে। তারপর সবশেষে এক প্রবল ধাক্কা। যদিও এখানে সেই অতিপ্রাচীন পন্থাকে আমরা অবলম্বন করবো।অপেক্ষা, চুপ করে কাজ করে যাওয়া একটু একটু করে, ধাপের পর থাপ অতিক্রম করে।সাধনায় যেমন মার্গ অতিক্রম করা হয়, ঠিক সেভাবে। এক অবিচল যাত্রীর মতো।
আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হচ্ছে। পুরাণমতে, দীর্ঘ সাধনা ও কঠিন পরিশ্রমের পর সদগুরুর কৃপায় ব্রহ্মাস্ত্র লাভ হতো তীরন্দাজের। আহ্বান ও লক্ষ্য স্থির করা মাত্র সে ছারখার করে দিত সবকিছু। যার প্রয়োগ একমাত্র করা যেত সত্যের পথে, ধর্মের পথে, অধর্মকে বিনাশ করার লক্ষ্যে।বেশ কয়েকদিন ধরে সুমন মুখোপাধ্যায়ের “মঞ্চ-চিত্রের বৃত্তান্ত”-র পাতা উল্টাতে উল্টাতে ক্রমশ অস্বস্তিকর হয়ে উঠছিল সময়টা। মনে পড়ে যাচ্ছিল অনেককিছু। আজ থেকে মাত্র একদশক আগে আমাদের বড় হওয়ার সময়ের ছোটো ছোটো বিপন্নতাগুলো। আমাদের বন্ধুত্ব, হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা, বিশ্বাস করে ছুরিকাহত বন্ধুর রক্তাক্ত শরীর, প্রতিদিনের অসম যুদ্ধে লড়াই করতে থাকা সহযোদ্ধার ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস, আর প্রতিদিন সকালে বেঁচে ওঠার নতুন উদ্দ্যম। এই সব স্রোতের মধ্যে আমাদের ঠিকানা বদলেছে, জীবন বদলেছে, আশেপাশের মানুষরা বদলে গেছে। কিন্তু আমরা বদলাইনি, ঠিক যেমন বদলায়নি এই শহরের মাটি আর পারস্পরিকভাবে তার প্রতি আমাদের জড়িয়ে থাকাগুলো।
আমি কোনো সাহিত্যিক নই, লেখক নই, যে কোনো বই বা শিল্পকে সামনে পাওয়ার পর তার প্রতি পাঠকধর্ম পালন করি মাত্র। ভাষার ধর্ম পালন করি, শব্দকে ব্রহ্মজ্ঞানে ধারন করি, বিশাস করি তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা অমোঘ মন্ত্র শক্তিকে। কারণ এই একমাত্র পারে দীর্ঘ কঠোর সাধনার শেষে জ্ঞান ও শক্তির চরম শিখরে পৌঁছে দিতে। যে কোনো শিল্প, সে চলচ্চিত্রই হোক, বা প্রকাশনা, বিশেষ কিছু মানুষের একাত্ব-ঐকন্তিক প্রচেষ্টা ছাড়া তা কিছুতেই সম্ভব নয়। শিল্পী সুমন মুখোপাধ্যায় যখন “মঞ্চ-চিত্রের বৃত্তান্ত”-র পাতার পর পাতায় তুলে ধরেন তাঁর কাজের পথ ও তা পেরোবার সময়কার অন্তর্ঘাতের চিহ্ন। ঠিক সেই সময় চিত্রকার হিরণ মিত্র সেসব চিহ্নকে সজোরে আছড়ে ফেলেন তাঁর ক্যানভাসে, আর এই সবকিছুর পেছনে থেকে ধনুকের টঙ্কারের সুরকে একসূত্রে বেঁধে দেন দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়।এ এমন এক বই যা সাধারণ সমস্তকিছুকে ছাপিয়ে যায়, এমন এক আয়না যাতে সময়ের অন্য এক ছবি ধরা পড়ে, আমাদের জন্মের আগের দশক থেকে আগামী দশক আর এই শহরের ভেতর গলিত লাভার মতো ফুটতে থাকা এক স্বতন্ত্র ধারার মানুষ, যারা চুপ করে থাকলেও কখন, কোথায়, কীভাবে বিস্ফোরণ ঘটাবে, তা এখনো রাষ্ট্রযন্ত্রের ধারণার অতীত।