মান্না-কিশোরের গল্প | মলয় ঘোষ

খুব রসিক ছিলেন মান্না দে। আবার হঠাৎ করে খুব রেগেও যেতেন। কোথাও কোনো বেচাল দেখলে মেজাজ চড়ে যেত তাঁর। অনেকেই জানেন যে, একবার বম্বে থেকে তিনি কলকাতা আসবেন। প্লেন ধরতে ভোরে বেড়িয়েছেন বাড়ি থেকে, হাতে একটা এটার্চি। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ট্যাক্সি ধরবেন। ঠিক সেই সময় রাস্তা ফাঁকা দেখে কয়েকজন দুষ্কৃতি ছুরি হাতে আটকালো তাঁকে। এটার্চিটা দিয়ে দিতে বলল তাঁকে। কিন্তু মান্না দে গোবর গুহর কাছে কুস্তি শেখা লোক। ব্যাস শুরু হয়ে গেল মারামারি। দুষ্কৃতির সংখ্যা বেশি থাকায় তারা মান্না দেকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে কাবু করে এটার্চি কেড়ে নিয়ে চলে গেল। গুরুতর আহত অবস্থায় মান্না দে’কে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। কিশোরকুমার ঘটনাটা শুনে বলেছিলেন, ” জানতাম, ফাইট না করে মান্নাদা ছাড়বে না।”

কিশোরকুমারের সঙ্গে মান্না দে’র সম্পর্ক ছিল খুব গভীর। সপ্তাহে একদিন নিশ্চিত মান্না দে কিশোরকুমারের বাড়ি যেতেন কিশোরের মায়ের হাতের লুচি খেতে। কিশোরকুমার প্রচুর আজেবাজে গান গাইলেও মান্না দে কখনো কিশোর সম্পর্কে একটা অপ্রীতিকর শব্দ উচ্চারণ করেননি। কিশোরকুমার সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে জীবন শুরুর ক্ষেত্রে মান্না দে’র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। মিউজিক ডিরেক্টর কিছুতেই কিশোরের লিপে কিশোরকে গাইতে দেবেন না। সহ সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন মান্না দে। হঠাৎ সঙ্গীত পরিচালক মারা গেলেন, ফলে সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব এসে পড়ল মান্না দে’র উপর। আর মান্না দে কিশোরকে গাইতে দিলেন গান, নিজে গাইলেন না। সে গল্প আর এক দিন হবে বিস্তৃত ।

পড়োশন ছবিতে ‘এক চতুরনার ‘ গানটির নিজের পার্টটুকু মান্না দে আর. ডি. বর্মণ এর কাছে শুনে খুব খুশি হলেন। অনুশীলন সেরেও নিলেন বাড়িতে। রেকর্ডিংয়ের দিন গোটা কম্পোজিশন শুনে মান্না দে তো রেগে লাল। এক জন গান না জানা গায়কের কাছে একজন ক্ল্যাসিক্যাল সঙ্গীতশিল্পী হেরে যাবে? এ কী করে হয়! অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন মান্না। রাহুল দেব বর্মণ কিছু বলতে পারছেন না। শুধু বলছেন, ফিল্মের সিকোয়েন্স এমনই আছে। শেষ পর্যন্ত মান্না দে গান না গেয়ে স্টুডিও থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছেন। এমন সময় আসরে নামলেন এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকা কিশোরকুমার। ছুটে এসে মান্না দে’কে জড়িয়ে ধরে বললেন, “মান্না দা গান গেয়ে জীবনে তো আপনাকে হারাতে পারব না, ফিল্মে নয় আমার কাছে এক বার হারুন।” ব্যাস আর কিছু করতে হল না। কিশোরকুমারের সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে গাইতে রাজি হলেন সেই গান।

শোলে-তে ‘ইয়ে দোস্তি হাম নেহি ছোড়েঙ্গে’ গাইতে গিয়েও বিভ্রাট। যে কোনও গানের মেকিংয়ে মান্না দে’র একটা অন্য রকম ভূমিকা থাকত। ‘তোরেঙ্গে’র জায়গায় মান্না হালকা একটা কাজ দিলেন। কিশোর কিন্তু স্ট্রেট গাইছেন। রাহুল দেব বর্মণ কিশোরকে বললেন, ‘মান্না দা যেমন গাইছেন অমনই গান, ভাল লাগবে।’ ব্যাস কিশোর রেগে আগুন, স্পষ্ট বলে দিলেন,” ও গান তুমি মান্না দেকে দিয়েই গাইয়ে নাও”। রাগ ভাঙালেন মান্না, বললেন, “পঞ্চম ও ওর মত গাক, আমি আমার মত গাইব”। কিন্তু কোরাস!! সে কথা আর.ডি. আর তখন তুললেন না। আশ্চর্য গানের রিহার্সালে কোরাসে কিশোর মান্নাকেই ফলো করলেন। আসলে মান্না দে’কে এই রেসপেক্টটা কিশোর দিতেন।

প্রথম দিকে মান্না দে’র গান ফিল্মে লিপ দিতে হয়েছে কিশোরকুমারকে। প্রায় দশ এগারোটি এমন গান আছে হিন্দি ছবিতে। এর মধ্যে কয়েকটি হিট গানের কথা প্রায় সবাই জানে, যেমন ‘পহেলি মুরগি হুয়ে থি ইয়ে আন্ডা এ জারা সোচকে বাতানা’ (কোরেপতি ছবির গান, ১৯৬১), ‘দিন আলেবেলে পেয়ার কি মৌসম’ (বেগুনাহ ছবির গান, ১৯৫৭)। আবার নিজের প্রযোজনায় ছবি করার সময় মান্না দে’কে নিজের সুরে গান গাইয়েছেন কিশোরকুমার। সে গান বিখ্যাতও হয়েছে। ‘এক দিন আউর গেয়া’ (দূর কা রাহি, ১৯৭১) গানটির আবেদন এবং গায়কী এখনও সমান আর্তিময়। এ গানের বাংলা ভার্সন গেয়েছেন কিশোর নিজে। হিন্দি বাংলা দুটি পাশাপাশি শুনলে মান্না কিশোর দু’জনের গায়কী, উচ্চারণ এবং সূক্ষ্মতা বোঝা যাবে।

মান্না দে’র কাছে পুত্র অমিতকুমারকে গান শিখতে পাঠিয়েছিলেন কিশোরকুমার। অমিত মান্না দে’র কাছে গানও শিখেছিলেন কিছু দিন। কিন্তু বাবার ধারাকেই অমিত ‘কণ্ঠধার্য’ করেছিলেন । ফলত, ক্ল্যাসিক্যাল সঙ্গীতের দিকে বা মান্না দে’র মত সব ধরনের গান গাইবার দক্ষতা অর্জন করার দিকে মনোযোগী হননি তিনি।

মান্না-কিশোরের অনেক ঘটনা আছে। এক বার মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় একটা বাংলা ছবির গান নিয়ে হাজির মান্না দে’র কাছে। গানের বাণী ছিল – ‘তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে আমার মরণ যাত্রা যেদিন যাবে’! (তুমি কত সুন্দর, ১৯৮৮)। মান্না দে কেন যেন এ গান গাইতে রাজি হলেন না। মৃণাল ব্যানার্জীকে বললেন, এ গান মৃত্যুর গান, গাইলেই মরে যাব।’ অগত্যা মৃণাল ব্যানার্জীকে অন্য গায়ক খুঁজতে হল। গানটি গাইলেন কিশোরকুমার। মান্না দে খবর পেয়েছিলেন আগেই, কিশোরকে ফোনে বারণ করলেন, ‘ও গান গেয়ো না’। কিশোর মান্না কে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘খুব ভাল সুর, গানটা আমাকে গাইতে দিন মান্নাদা।’। আশ্চর্য এই গান গাওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই কিশোরকুমারের মৃত্যু হয়(১৯৮৭ সালে)। মান্না দে কিশোরের মৃত্যুর খবর শুনেই বলেছিলেন, ‘আমার কথা শুনল না, ঐ গানটা গাইল, আর কিশোর মরে গেল।’

One thought on “মান্না-কিশোরের গল্প | মলয় ঘোষ

  1. চমৎকার একটি সংকলন। আগামীতে আরও এগিয়ে চলুক এই লেখা।

Comments are closed.