মারের সাগর পাড়ি দেবো – ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া – অনুপম চন্দ

না, টুটুল, খুব ভালো ভালো কথা বলব না৷ বরঞ্চ একটু আলোচনা করব যার সবটা হয়তো ভালো লাগবে না৷ তুই আমার একটা আদরের বোন, দাদার খারাপ কথাগুলোতে খুব একটা রাগ করবি না, এই ভরসা নিয়েই দু একটা কথা বলি৷

আলো জ্বলার পরে, একজন এসে বলল, এটা ঠিক থিয়েটার নয়, মানে এক ধরণের খোঁজ৷ যে খোঁজটা মানুষ জীবনের এই মুখোশ পর্বে তোরা অনেকে মিলে করেছিস৷ এখানেই প্রথম খটকাটা লাগলো৷ থিয়েটারের সংজ্ঞা কী? থিয়েটার এরকম হবে, ওরকম হবে না, এটা কেন ঠিক করা হবে? জানি, এটাই হয়ে এসেছে৷ একটা কাজ দেখে কেউ কেউ বলেছে, ধুস! এটা থিয়েটারই হয়নি৷ আমি এই বয়সে এসে, ঠিক বুঝতে পারি না, এভাবে বলা যায় কিনা৷ শিল্পকে সংজ্ঞায়িত করা আদৌ উচিত কিনা এ নিয়ে আমার সংশয় প্রবলতর হয়ে উঠছে৷ এই এই রকম হলে, তাকে থিয়েটার বলা হবে, এই ডিকটাটটা আমার আদৌ ঠিক বলেই মনে হচ্ছে না৷ তাই শুরুতেই যখন এই দ্বিধান্বিত কৈফিয়ৎ শুনি, মনটা একটু খচখচ করে উঠলো৷

তারপর আসি, ডিজাইন প্রসঙ্গে৷ অমলআলো বা এই ধরণের স্পেসে শিল্পকে কীভাবে উপস্থাপিত করা উচিত, এনিয়েও আমার একটু গোলমাল হচ্ছে৷ এতগুলো মানুষ, তারা সবাই নিজের নিজের জায়গায় অসম্ভব দক্ষতার সাথে তাদের কাজ করে চলেছে, অথচ ভগবান আমাকে মাত্র দুটো চোখ দিয়েছে, যা দিয়ে একবার তোর হাহাকার দেখছি আর ঠিক সেই মুহূর্তে ঝুমুর বা দীপ্তসীর অভিব্যক্তি মিস করে ফেলছি৷ দেবপ্রিয়ার দীপ্ততা দেখতে গিয়ে মিস করে ফেলছি এক কোনে বসে অসম্ভব প্যাশনেটলি ড্রাম বাজাতে থাকা বাচ্চাটির মগ্নতাকে৷ অথচ বিশ্বাস কর, আমি সবটাই দেখতে চাইছি, একইসাথে৷ দর্শক হিসেবে আমার এই অতৃপ্তি তুই ডিজাইনার হিসেবে কীভাবে মিটাতে পারবি বা আদৌ পারবি বা চাইবি কিনা সে চিন্তার দায় তোর৷ আমি শুধু আমার অতৃপ্তির জায়গাটুকু জানালাম৷

চারটে বিখ্যাত নাটককে তুই দেখতে চেয়েছিস আজকের এই অন্ধকার সময়ে দাঁড়িয়ে৷ কোন অন্ধকার থেকে আলোর শিখা হয়ে জ্বলে উঠেছিল এই অসামান্য চারটি রবীন্দ্রনাট্য, সেই অন্ধকারকে বুঝতে চেয়েছিস দলগত যৌথতায়৷ আজকের অন্ধকারকে সেই সৃষ্টির অন্ধকারের সাথে এক করে দেখতে চেয়েছিস হয়তো! হয়তো আজকের অন্ধকারও হিরণ্যগর্ভ হয়ে উঠতে পারে সেই মানুষসুলভ আশা দেখতে পেলাম এই প্রযোজনায়৷ কিন্তু রাজা নাটকটির প্রেক্ষাপট যেন সামান্য কম গুরুত্ব পেল অন্যদের তুলনায়৷

অনেক খারাপ খারাপ কথা বললাম৷ এবার একটু প্রসংশা করতেই হবে৷ না ব্যালান্স করার জন্য নয়৷ এটা তোর পাওনা৷ অনেকদিন পরে একটা এত বড়ো প্রযোজনা দেখলাম, যেখানে সব্বাই ভালো৷ আর এটাই শিক্ষক হিসেবে, শিক্ষিকা বলছি না কিন্তু, তোর সার্থকতা৷ প্রতিটি ছেলে মেয়েকে এত যত্ন করে তৈরি করলি কী করে বলতো! তোর এই অসামান্য পরিশ্রমকে কুর্নিশ না জানালে অপরাধ হবে৷ আমি সব্বাইকে দেখে মুগ্ধ হয়েছি৷ দলগত কাজ কাকে বলে, তার এক অসাধারণ উদাহরণ হয়ে থাক তোর এই সৃষ্টি৷

সবচেয়ে বড়ো কথা হল, এই বিষয় ভাবনা৷ সৃষ্টির মুহূর্তের যন্ত্রণা যে আরেক সৃষ্টির বিষয় হয়ে উঠতে পারে এই ভাবনার অভিনবত্বর জন্য তোর একটা ক্যাডবেরি পাওনা রইলো৷ সত্যি সত্যি রবীন্দ্রনাথকে বেশ অন্যরকম ভাবে দেখতে চেয়েছিস তোরা৷ রবীন্দ্রচর্চার লালিত্যকে রাবীন্দ্রিক কঠোরতা দিয়ে এভাবে আঘাত করার চেষ্টা আমাকে অন্ততঃ মুগ্ধ করেছে৷ পরিশীলিত উচ্চারণের শুদ্ধতা বহন করেছে প্রতিটি কুশীলব, অথচ, চিরচেনা রাবীন্দ্রিক পেলবতাকে বর্জন করেছে সযত্নে৷ নৃত্যশৈলীর ভঙ্গিমায় রাবীন্দ্রিক ছাঁদ রয়েছে, অথচ তা উদ্দাম আর দৃঢ়৷ এই অসামান্য পরিবর্তন কোথাও যেন বিশ্বভারতী বা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরপুজোকে চ্যালেঞ্জ করে৷ আর এই বিদ্রোহটুকুই আমার মন ভরে দিয়েছে৷

বুদ্ধদেব যখন সাধনা করছিলেন, তখন তার সামনে সেই সাধনার সিদ্ধিলাভের পথে বারংবার এসে দাঁড়াচ্ছিল মার৷ সেই মার কে জয় করেই গৌতম বুদ্ধ হতে পেরেছিলেন৷ তোরাও মারকে জয় করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ৷ সমস্ত পৃথিবীর কর্তাব্যক্তিরা যখন সজোরে বলে চলেছেন, দূরত্ব বজায় থাক মানুষের সাথে মানুষের, তখন তোরা সমবেত হতে চাইছিস, কাছে থাকতে অঙ্গীকারবদ্ধ হচ্ছিস, শপথ নিচ্ছিস—মারের সাগর পারি দেবো৷ পারি তো অবশ্যই দিবি৷ কোন মার আটকাবে তোদের? বুড়ো দাদাটার শুভেচ্ছা রইলো৷

একটু বড়ো হয়ে গেল বোধহয়৷ বয়স হচ্ছে তো, বেশি বকার অভ্যেস হয়ে যাচ্ছে৷

2 thoughts on “মারের সাগর পাড়ি দেবো – ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া – অনুপম চন্দ

Comments are closed.