মাৎস্যন্যায়- ব্রাত্য বসু | প্রকাশক- সিগনেট | অভি চক্রবর্তী

করোনার প্রথম বছরের পুজোর কথা- শরৎ আকাশের মৃদু উদ্ভাস তখন মৃত। শিউলির গন্ধে যেন চেপে বসেছে হাসপাতালের ভয়ার্ত দমবন্ধ হয়ে আসা ঠান্ডা গন্ধ। সারাদিন শুধু এম্বুলেন্সের এক নাগাড়ে যাতায়াতের শব্দ কানে আসে, আতঙ্কের পর আতঙ্কের পরত পেঁচিয়ে ধরে আমাদের দিবানিশি, আমরা ভাজা হই। ভাজে ভাজে। প্রতিটা মানুষকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে লালচে টুসটুসে জিলিপির মতো করে ভাজে রাষ্ট্র। কখনো বা অনেক রাষ্ট্রমুখ (নাকি মুখোশ!) একত্র হয়ে জনগণকে ভাজতে থাকে। থাকেই। আমরা নিয়তি বলে মেনে নিয়ে নির্লিপ্ত হয়ে থাকি। এ প্রবাহ বড় পুরনো। সেপিয়া টোন থেকে শুরু হয়ে আজও ঝকঝকে স্পষ্ট হয়ে আছে এই প্রণালী। জন্মালেই এই প্রণালীর আমি অংশীদার। চাই বা না চাই। এই নিষ্পেষণ আমাদের গন্তব্য, ভবিতব্যও। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হবে প্রাণ যাবে আমাদের। যাবেই। যুগভেদে বদলে যাবে রাজাদের নাম। শুধু আমি কোন সময়ে জন্মাচ্ছি তার উপরে নির্ভর করছে আমার মৃত্যু পদ্ধতি কতোটা যন্ত্রণাহীন, নীরব এবং নিখুঁত হবে। ঈশ্বরও হয়তো তখন অংশ হয়ে ওঠেন রাষ্ট্রের, ক্ষমতাবৃত্তের। ” তুমি নতজানু হয়ে কি চাইছ? ঈশ্বরের কাছে কী প্রার্থনা করছ? তোমার কি মনে হচ্ছে ঈশ্বর আর আমাদের কথা শুনবেন? দেখো মা দেখো, আমার সম্রাটকে দেখো। আমাদের দুঃখ বস্তুত তাঁর কাছে ক্রীড়ার বস্তু। আমাদের সংকল্প তাঁর কাছে উপহাসের বস্তু। হায় কন্যা, ঈশ্বরও কি রাজার মতোই নন? তিনিও কি কোনও ত্যাগ, অপমান, বেদনা, সংগ্রাম… এসবের যথার্থ মূল্য বোঝেন?”

এই প্রশ্ন মহাবাহু তার মেয়ে ললন্তিকাকে করছেন শারদীয়া আনন্দলোকে লেখা ব্রাত্য বসুর নাটক ” মাৎস্যন্যায়”এ। যা কিনা সদ্য প্রকাশ পেয়েছে বই আকারে, সিগনেট প্রেস থেকে। এ নাটক পড়লে আমরা জানব মহিয়সী(? ) মূলার দুই (কু) পুত্র পুন্ডবর্মা এবং কীর্তিবর্মা মায়েরই নিপাট সম্মতিতে এই ললন্তিকাকে ভোগ করে, ভোগ করে ওরই প্রেমিকের নিশ্চল শরীরের উপর রেখে। যে শরীরকে মজা নদীর মত নিশ্চল, আতঙ্কের মতো ঠান্ডা করেছে এরাই। এরপরে জিভ কেটে নেওয়া হয় ললন্তিকার। মূলাকে প্রবল অনুনয়ের পরেও রক্ষা পায়না ললন্তিকা, ধর্ষণ তার অবশ্যম্ভাবী শাস্তি হয়ে ওঠে। কারণ মূলার ছেলে দন্তিবর্মাকে হত্যা করেছিল ললন্তিকার পিতা মহাবাহু। অর্থাৎ সেই রাজায় রাজায় যুদ্ধ! কিন্তু এই প্রতিশোধের মাঝে পড়ে এক নারীর হাহাকার, কাতর ক্রন্দন এক যুগ থেকে আরেক যুগে নিয়ে ফেলে পাঠককে। আমরা দেখি মণীষা বাল্মিকীর ধর্ষিত শরীর মধ্যরাতে পুড়িয়ে দিচ্ছে প্রশাসন, নিশ্চিহ্ণ করে দিতে চাইছে ধর্ষণের চিহ্ন বা প্রমাণকে। মহা সমারোহে চিতা জ্বলে ওঠে একসঙ্গে। আগুনের রং লালচে হলদে। বোঝা যায়না ওই উজ্জ্বল রং এর ভিতর কে ছাই হয়ে যাচ্ছে, কে বোবা হয়ে বাঁচতে চাইছে? ললন্তিকা নাকি মণীষা?

উইলিয়াম শেক্সপিয়রের অন্যতম ট্রাজেডি “টাইটাস অ‍্যান্ড্রনিকাস” যার রচনাকাল ১৫৮৮-১৫৯৩ এর মধ্যে এবং বাণভট্টের ষষ্ঠ শতাব্দের শেষকাল থেকে সপ্তম শতাব্দের পূর্বার্ধে লেখা গদ্যকাব্য “হর্ষচরিত” অবলম্বনে এই নাটক লিখিত, লেখার মুখবন্ধে জানিয়েছেন নাটককার। কিন্তু আমরা যারা তাঁর নাটক- লেখার বহুস্তরীয় পরতের বিবিধ অনুষঙ্গের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিকভাবে অনেকদিন থেকে জড়িত, তারা জানি এই অবলম্বনের মধ্যে কি অনায়াসে নিজের সময়ের জোব্বা পরে, নিজের কুড়ানো কথার অস্মিতা জড়ো করে ঘুরে বেড়ান তিনি। এই আশ্চর্য অনায়াস জ্যোতির্ময় অথচ প্রান্তিক পদচারণা ইতিপূর্বে আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি তার একাধিক রচনায়, যেখানে তিনি কখনো অলিখিত ইতিহাসকে ঢেলে দিয়েছেন এই সময়ের উত্তপ্ত রাস্তায়। কখনো মুছে যাওয়া রাজনৈতিক সময়কে এনে বসিয়েছেন মুখোমুখি, সমকালের সঙ্গে। কখনো অনন্য ব্যক্তিজীবনের বহুকোণে ফেলেছেন চিলতে আলো আবার কখনো বা কমিকস চরিত্রের আলখাল্লা গায়ে চাপিয়ে সমসময়ের পলেস্তারা খসিয়ে ফেলেছেন আপাদমস্তক বা আগতকালকে ভেংচিয়েছেন। আবার কখনো অন্য কোনো মহান নাট্যের মধ্যে দিয়ে নিজের সময়কে এফোঁড়- ওফোঁড় করে খুঁড়েছেন তিনি। পাঠক- দর্শককে পড়ানোর থুড়ি দেখানোর চেষ্টা করেছেন গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে। নাটককার ব্রাত্য বসুর এই ধরন এবং অবশ্যই কৌশল সহজাত এবং অবাধ। বিষয়গত বিবিধ বৈচিত্র্যের পাজেলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তিনি প্রাচীন পীরের মতো, বৌদ্ধ পরিব্রাজকের মতো, ধ্যানী সন্তের মতো, নিষ্ঠ প্রত্নতাত্বিকের মতো একলা খুঁজে ফেরেন এইসময়কে ধরে ফেলার খোলস, যা হয়তো কোনো পুরনো সময় ফেলে রেখে গেছে। শ্যাওলা ধরা সেই আলসে খোলসের বিবর্ণ সময়চিহ্নের মধ্যে, যাবতীয় দংশনের মধ্যে ধীরে ধীরে ঢুকে পড়েন তিনি। তখন তিনি একেবারেই নির্জন এক আত্মমগ্ন সাধক। বিকেলের সূর্যাস্তের আচ্ছন্নতায় একলা কবি। আত্মধ্বংসে মেতে ওঠা নির্জন কথক। যিনি কথা বলে চলেছেন নিজের সঙ্গে নিজেই। তার প্রতি নাট্যেই এই আত্মোন্মচনের অভাবনীয় এবং তুলনারোহিত বয়ান আমরা পড়েছি। দেখেছিও। এই বয়ানের ভাষায় বা বলা ভালো সংলাপ লেখার সময়ে তিনি আর সংলাপকে কলোকিয়াল হতেই হবে এই তত্ত্ব মানছেন না। বরং ভেঙেচুরে তৈরি করছেন নাটক লেখার নতুন তারিকা। বলাবাহুল্য প্রায় প্রবন্ধের ভাষায় তিনি কথা বলছেন নাটকে, বদলে দিচ্ছেন কাব্যে। আমরা কিন্তু পড়তে পড়তে ঠোকর খাচ্ছিনা কারণ চরিত্রের বুনন, দৃশ্যের গঠন আমাদের সেদিকে খেয়াল রাখতে দিচ্ছেইনা। এই সাপেক্ষে মহাবাহুর আরেকটি সংলাপ-অংশ আমরা এখানে উল্লেখ করতে পারি। তিনি মূলাকে বলেন, “দেখুন রানি , আমার একমাত্র প্রতিবন্ধী কন্যা ললন্তিকাকে। শুক্রাচার্য -কন্যা দেবযানীর চেয়েও, ধ্যুষ্টদ্যুম্ন- ভগিনী পাঞ্চালীর চেয়েও, প্রবীর পত্নী জনার চেয়েও আমার এ মেয়ে অধিক কষ্ট ও নির্যাতন সহ্য করেছে। ওর এতখানি নির্মমতা প্রাপ্য ছিল কি? বলুন রানি, ছিল কি? ছিল না। আমি সৈন্যদের একটু পরে গিয়ে শেখাব নির্মমতাকে, হিংস্রতাকে শরীর থেকে নির্গলনের আগে নিজেকে মাধুর্যপূর্ণ করা সমীচীন, পবিত্রতার স্তোত্রপাঠ করা সমীচীন, এক স্নিগ্ধশীতল দীপনছটায় নিজেকে অনঘ নিস্কলুষ করা সমীচীন, আর তাই মা আমার, আমার ললন্তিকা…”

এরপরেই নাটকে আমরা পড়ি তলোয়ার নিয়ে ললন্তিকাকে হত্যা করেন মহাবাহু। মূলা সভয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন।

এভাবেই একটা টেক্সটকে নাট্য হবার বহু উপাদানের ইশারায় আবিষ্ট এবং চমৎকৃত করে রাখেন নাটককার। যাকে বলে ক্লাইমেক্স- অ‍্যান্টিক্লাইমেক্সে মুহুমুর্হ ওঠাপড়ায় ভরপুর একটি জমজমাট নাট্য। এর বেশি গল্প বলে দেওয়া ঠিক হবেনা। চাইওনা হয়তো। পাঠকের জন্য এইটুকুই যথেষ্ট বলে মনে হয়। মূলত প্রতিশোধ স্পৃহার নাটক হলেও এই নাট্যের প্রতিটি শব্দে মানবের নানান হীন অনৈতিক কুটকচালের কটু গন্ধ ভেসে বেড়ায়…ঘন থেকে ঘন হতে থাকে। ঘনিয়ে ওঠে।

নাটকের আরেকটি অংশে আলো পড়ে, নিজের পেটে তলোয়ার ঢুকিয়ে দেন। সবাই স্তব্ধ। মহাবাহু ছটফট করেন। বলেন,” তা হলে এসো প্রতারণা এসো। তার ভ্রাতা চক্রান্ত তুমিও এসো। তুমি জয়যুক্ত হও। এসো মধ্যমেধা এসো। ঈশ্বরের বরপুত্র হয়ে তুমি প্রতিজন্মে যেন নবজন্ম লাভ করো মিথ্যা, শঠতা আর নিষ্ঠুরতার মাঝে। এসো চাটুকারিতা, প্রবঞ্চনা, আর কুৎসাকারী এসো, জয়ী হও। মানুষ হয়ে অন্য মানুষকে ভর করে, ব্যবহার করে বেঁচে থাকা ভীরু ক্ষমতাজীবীর দল। এসো জন্মে- জন্মে, যেন তোমরা প্রতিবার জয়যুক্ত হও, আজ সেই প্রার্থনা করি। এসো মৃত্যু এসো, তুমি আলিঙ্গন করো আমাকে। তুমি জেনে রেখো, জয়ী হতেই শুধু মানুষ তরবারি ধরে না, সংগ্রাম তার স্বধর্ম বলেও সে তরবারি ধরে। হেরে যাবে জেনেও সে লড়ে, লড়তে হবে বলে সে লড়ে।” এইরকম একাধিক দৃশ্য-সংলাপ-মুহূর্তরাশির সহযোগে কালসিটে পড়া ক্যানভাসের পেইন্টিং সিরিজের গ্যালারি গড়ে তোলেন নাটককার। যেখানে সংলাপের মাধুর্য ধ্রুপদী সংগীতের মতো ভেসে বেড়ায়। একা নাটককার সেই মহান সিম্ফোনির মধ্যে দাঁড়িয়ে কোনো এক অদৃশ্য নির্দেশককে আহ্বান জানান ডুয়েল লড়বার জন্য আর আমরা অপেক্ষা করে থাকি সেই ডুয়েলের থার্ডবেলের জন্য।

সদ্য সাহিত্য আকাদেমির পুরস্কারে ভূষিত এবং বাংলা আকাদেমির চেয়ারপার্সনের দায়িত্বপ্রাপ্ত আমাদের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর অভ্যন্তরে যে নাটককার বসে আছেন, বসে আছেন সময়কে এক নতুন হরফে নিজস্ব প্যাপিরাসে লিখবেন বলে সেই ব্রাত্য বসুর ‘মাৎস্যন্যায়’ পড়ুন।