সদ্য যৌবনে-পা-দেওয়া একটি রোগা মেয়ের শরীর। আহিরিটোলার উদ্বাস্তু কলোনি থেকে নিছক পেটের দায়ে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সাহেববাড়িতে পরিচারিকার কাজে লিপ্ত হবার পর রাতের অন্ধকার বিছানায় কোন্ এক অচেনা পুরুষের হাত খেলা করে সেই কুঁকড়ে-যাওয়া শরীরে। মালিকের বাড়ির পার্টিতে মোকাম্বোর সিঙ্গার ভিভিয়ান হ্যানসনের সঙ্গে আলাপ এবং সেই আলাপের সূত্রে নাচ শেখা, পূর্ববঙ্গের নারায়ণগঞ্জ থেকে কলকাতায় পা-রাখা মেয়েটির ক্যাবারে ডান্সার হিসেবে ‘ফারপোজ’-এ যোগ দেওয়া। আরতি দাস থেকে হয়ে ওঠা ‘মিস শেফালি’, যে তার শরীরের আগুনে পুড়িয়ে দিতে শিখবে বাবু-কলকাতার নিশিবিলাসী নারী-পুরুষের চোখ ও হৃদয়। স্বাধীনতার পরে একে একে এই দেশ ছেড়ে বিলেতে পাড়ি দেওয়া ইউরোপীয় ক্যাবারে-গার্লদের জায়গায় হিল্লোল তুলবে তার বাঙালি শরীরের হাইব্রিড বিভঙ্গ। আরও টাকা, আরও খ্যাতি, আরও শৌখিন আদবকায়দার জীবনে অভ্যস্ত হতে হতে, সমাজের উচ্চবিত্ত ও নারী-সুরা-বিনোদনে আসক্ত পুরুষের নয়নের মণি হয়ে উঠতে উঠতে এই গ্ল্যামার-গার্লের শরীর যেমন একদিকে হয়ে উঠবে সাধারণের হাতের ধরাছোঁয়ার বাইরে এক অপার্থিব আকর্ষণ, সেরকমই ফের একদিন গ্র্যান্ড হোটেলের মুঘল রুমের আভিজাত্য থেকে হাতিবাগানের পাবলিক থিয়েটারের চৌহদ্দিতে একেবারে জনসাধারণের সামনে নিজের সেলিব্রিটি শরীরকে মেলে ধরা—সবই ওই একদা না-খেতে পাওয়া মেয়েটির উত্থান ও বিকল্প জার্নির ইতিহাস, যেখানে হাঁ-করে তার অন্তর্বাসের দিকে তাকিয়ে থাকা পুরুষের ‘মেল-গেজ’-এর উলটো পিঠে অব্যক্ত থেকে যায় পুরুষ-চোখের প্রতি ওই মেয়েটির পালটা দৃষ্টিপাত। পুরুষ চোখকে অ-দেখা করে ঘুরিয়ে তাদেরও দেখা বা না-দেখা। আর এভাবেই একদিন, মিস শেফালি, কলকাতার গ্ল্যামারাস ক্যাবারে কুইনের শরীর হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের চোখে যুগপৎ অস্বস্তি ও প্রতিস্পর্ধা, বিদ্রোহের ভাষ্য। একইসঙ্গে, গ্র্যান্ড হোটেলের দামি ডান্সফ্লোরে সমাজের শীর্ষস্তরের পুরুষ থেকে শুরু করে রংচটা বিশ্বরূপা, সারকারিনা, বয়েজ ওন হল-এর আটপৌরে সস্তার দর্শকের চোখে এক অধরা শরীরী এনটিটি, যাকে হজম করা যায় না আবার অস্বীকারও করা যায় না। যাকে দেখার তীব্র লালসা বারবার টিকিট কেটে তার কয়েকমিনিটের শরীরী ভাঁজ আর খণ্ডিত দেহাংশের মাদকতায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে চায়। একইসঙ্গে তার সম্পর্কে ‘বিষকন্যা’ আখ্যা প্রয়োগ করে—সে নাকি যুবসমাজকে উচ্ছন্নে পাঠাচ্ছে এই অভিযোগ দায়ের করে তার বিরুদ্ধে। কীভাবে তাকে গ্রহণ করবে ষাট-সত্তর-আশির দশকের বাঙালি কলকাতা? যখন একদিকে ব্যর্থ নকশালবাড়ি আন্দোলন আর সরকারি বামপন্থার নড়বড়ে ভদ্রবিত্ত নৈতিকতা তার শরীরের মধ্যে খুঁজে পাবে ক্ষয়িষ্ণু বুর্জোয়া ‘অপসংস্কৃতি’, আবার ১৯৭২-এর পালাবদলের পর স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় ওই শরীরী প্রতিভাকেই সম্মান জানিয়ে তার হাতে তুলে দেবেন ‘নৃত্যসম্রাজ্ঞী’ সম্মান। এই দ্বিকোটিক বিভাজনের ভিতর ঠিক কোন্ অবস্থানে আমরা রাখব তার ব্যাখ্যার খাঁচায় আটকে না-রাখতে-পারা শরীরকে? নীতি-দুর্নীতি, শ্লীল-অশ্লীল, শালীনতা-অশালীনতার মধ্যে দাগ টেনে সমান্তরাল দুটো সাংস্কৃতিক বর্গকে আলাদা করে রাখার রাজনীতি গড়ে উঠবে তার শরীরকে কেন্দ্র করেই। আদিম যৌনতার অবয়বস্বরূপ পুরো কলকাতার রাতটাকেই ‘অশুচি’ করে তোলা এই ক্যাবারে-কুইন কীভাবে তৈরি করবে ও নতুনভাবে নির্ধারিত করবে আমাদের সামাজিক প্রতর্ককে?
তাই এই সন্ধ্যারাতের ‘মিস শেফালি’-র জীবনের কোনও সরলরৈখিক ন্যারেটিভ তৈরি করা সম্ভব নয়। বরং ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক স্পেস-এর সাপেক্ষে বিনির্মাণ ঘটেছে এই বিধ্বংসী নারীর জটিল জীবনপথের। কীভাবে বাঙালি হাই কালচার তাকে নিজের মতো করে গ্রহণ-বর্জন করতে চেয়েছিল? জনপ্রিয় সাহিত্যিক শংকর তাঁর দুটি উপন্যাস ‘চৌরঙ্গী’ এবং ‘সম্রাট ও সুন্দরী’ লিখেছিলেন মিস শেফালির আদলে চরিত্র তৈরি করে। আর বাস্তবে অভিনেতা তরুণকুমার শেফালিকে নিয়ে যেদিন প্রথম গেলেন ‘বিশ্বরূপা’-র মালিক রাসবিহারী সরকারের চেম্বারে, শেফালির জবানিতে রাসবিহারীর চোখের ভাষা সেদিন—“যেন আমি ব্রা-প্যান্টি পরে গেছি ওনার সামনে”। কিন্তু যেমুহূর্তে শেফালি ঘোষণা করেন, তার নিজের জন্য আলাদা দামি বিলাসবহুল গ্রিনরুম, বেসিন, সোফাসেট, রিক্লেইমার চাই, রাসবিহারী গ্র্যান্ড হোটেলের প্রিন্সেস ড্রেসিং রুমের চেয়েও সেরা ব্যবস্থা করে দিলেন তার জন্য। সপ্তাহে পাঁচটি শো-এর জন্য তার পারিশ্রমিক হল মাসে সাত হাজার টাকা। পাসাপাশি গ্র্যান্ডের ক্যাবারে ধরলে সেই ১৯৭১ সালে তার মাসিক রোজগার তখন বাইশ হাজার টাকা। অথচ সত্যজিৎ রায় যখন তাকে ‘সীমাবদ্ধ’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবির জন্য কাস্টিং করেন, তখন , শেফালির ওই শরীরী অস্তিত্বের বাইরে কোনও স্বীকৃতি নেই সেখানে। প্রথম ছবিতে বিত্তবান দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজের প্রতিনিধি শ্যামলেন্দু চ্যাটার্জি যখন পদোন্নতির শীর্ষে ওঠে তখনই তার অধঃপতন পূর্ণতা পায় যৌন নৃত্যের অভিনন্দনে, শেফালি যখন ভরা সভায় তার গলাতেই নিজের মালা খুলে পরিয়ে দেয়। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবিতে শেফালি এক নার্স, যে বাড়তি রোজগারের জন্য দেহব্যবসায় লিপ্ত। সে সিগারেট হাতে চুল খুলে এসে দাঁড়ায়, শুধু অন্তর্বাস পরে, অচেনা পুরুষের সামনে। এই দৃশ্যটি নেগেটিভ প্রিন্টে ধরেন সত্যজিৎ, যেন সে এক অবক্ষয়ের প্রতীক, বিপর্যস্ত পৌরুষের সামনে দাঁড়ানো অনৈতিক, অশালীন নার্স। ভদ্রবিত্ত বাঙালির চোখে শেফালির টাইপকাস্ট চিত্রিত হয়, আর সেই দৃশ্যায়নের ভরকেন্দ্রে রয়ে যায় এই চেনা-আধচেনা নারীর যৌনশরীর, যে শরীর নিয়ে কোনও অন্তিম মীমাংসাই করা যায়নি।
১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার আসার পর দামি হোটেলের ক্যাবারে এবং পাবলিক থিয়েটারের স্বল্পবাস নৃত্যশিল্পীদের উপর আর এক নতুন নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ যেন নতুন কমিউনিস্ট ভিক্টোরীয় নীতিবাগীশ দমনপীড়নের পর্যায়। ১৯৭৭-৭৮ সাল জুড়ে ‘গণশক্তি’ কাগজে ‘অপসংস্কৃতি’ নিয়ে অজস্র নিবন্ধ, চিঠিপত্র ছাপা হতে শুরু করে। কনক মুখোপাধ্যায় লেখেন ‘অপসংস্কৃতি রোধে নারীসমাজের দায়িত্ব’ শীর্ষক প্রবন্ধ। মন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী এই বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো খড়্গহস্ত হয়ে ওঠেন সেইসময়ের উঠতি বিপুল জনপ্রিয় পপ গায়িকা ঊষা উত্থুপের উপর এবং সমস্ত সরকারি হলে ঊষার অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঊষা উত্থুপ সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এই মামলার আনুপূর্বিক বিবরণ খুব আগ্রহজনক। কারণ, আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে ঊষার আইনজীবী বারবার এটাই প্রতিষ্ঠিত করেন যে ঊষার পাবলিক অ্যাপিয়ারেন্স, তাঁর সনাতন ভারতীয় পোশাক, চুলে গোঁজা ফুলের মালা, কপালের টিপ, তার মাতৃত্ব কোনওটাই পাশ্চাত্য অপসংস্কৃতির ধারক-বাহক নয়। বামফ্রন্ট সরকার এমবার্গো তুলে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু মিস শেফালি এবং কলকাতার অন্যান্য ক্যাবারে ডান্সারদের ভাগ্যে সেই ছাড়টুকু জোটে না। কারণ, তারা কোনওমতেই মান্য বাঙালি শালীন সংস্কৃতির কাঠামোয় নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারে না। কমিউনিস্ট পার্টির কালচারাল ফ্রন্টের নেতা নারায়ণ চৌধুরী ১৯৮৫ সালে লেখেন ‘সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য’ নামক ম্যানিফেস্টো। তাতে যেকোনও শরীরী ও যৌন বিনোদনকেই ‘স্থিতাবস্থার উপাসক, কায়েমি স্বার্থের সমর্থক, বুর্জোয়া মূল্যবোধের ধারক’ হিসেবে দেগে দেওয়া হয়। গোটা পার্টিযন্ত্র নেমে পড়ে নারী-পুরুষের শরীরী উপস্থাপনের বিরুদ্ধে। নব্বইয়ের দশকে পৌঁছে একের পর এক পাবলিক থিয়েটার হল অজ্ঞাত কারণে অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়। মিস শেফালিরাও একটু একটু করে হারিয়ে যান লোকচক্ষুর অন্তরালে। কিন্তু এই অপসৃয়মান ইতিহাসের খণ্ডাংশ আরেকবার খুঁটিয়ে ফিরে পড়া দরকার। বিশেষত এই সময়ে, যখন, শরীর ও যৌনতা সম্পর্কে আমাদের ধারণার র্যায়ডিক্যাল পরিবর্তন ঘটছে। বিশেষত যৌনতা ও যৌনকাজকেও অধিকারের আওতায় নিয়ে এসে আমরা দেখতে শিখছি।
১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় আসার পরেই বামফ্রন্ট সরকার তাদের প্রস্তাবিত ‘পলিসি পেপার অন কালচার’ নিয়ে আসে। পার্টির দলীয় মুখপত্র ‘গণশক্তি’-তে ছাপা হয় অজস্র আর্টিকল, যাতে সংস্কৃতির প্রশ্নে রাজ্য সরকারের দায়বদ্ধতার কথা ছাপা হতে থাকে। প্রকাশিত হয় একাধিক বুকলেট, সংস্কৃতির উপর পার্টির নৈতিক খবরদারির যুক্তিকে আরও দৃঢ়বদ্ধ করতে। আমাদের বাঙালি জীবনে যৌনতার ক্ষেত্রে ‘ভিক্টোরিয়ান শুচিতা’-র অনুপ্রবেশ ও জাঁকিয়ে বসার কাজটা সফল হয়েছিল উনিশ শতকে। কিন্তু সেই ভিক্টোরীয় নৈতিকতার দাপট বাঙালি ভদ্রবিত্ত মননে আরও দীর্ঘ দেড় শতকেরও বেশি জারি থাকে। বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টির সরকার প্রতিষ্ঠা হবার পরেও কমিউনিস্ট ভিক্টোরিয়ান মরালিটির ধারাবাহিকতা চলতে থাকে। মনে পড়বে নাট্যকার ও পরিচালক অসীম চক্রবর্তীর সুপার-ডুপার হিট নাটক ‘বারবধূ’ সম্পর্কে তৎকালীন সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং গোটা বামমনস্ক থিয়েটার জগতের অসীমের ‘বারবধূ’-বিরোধী হীন ষড়যন্ত্র। এখন এটা পরিষ্কার, বাম মধ্যমেধার যৌনশুচিতার ভণ্ডামির দিকটা কতোখানি দৃঢ় জায়গা নিয়েছিল বামফ্রন্টের কালচারাল লাইনে। ঊষা উত্থুপকে সরকারি মঞ্চে বয়কট করে বাম সরকার তার যৌন হিপোক্রেসির বাস্তব প্রয়োগ ঘটাতে শুরু করল। ততোদিনে জনসংস্কৃতির পরিসরে ঊষা উত্থুপ একজন ‘মাস-আইকন’। পপ মিউজিকে দেশ-বিদেশজোড়া নাম তিনি। ১৯৮৩ সালের ১৭ জুন ঊষা উত্থুপ উচ্চ আদালতে যতীন চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন। ঊষার আইনজীবী আদালতে জানান, ঊষা একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী। সারা দুনিয়ার বহু দেশের অসংখ্য বিশিষ্ট মানুষ ঊষার গুণমুগ্ধ। এহেন একজন জনপ্রিয় শিল্পীর গান কীকরে বাম-সরকার কথিত ‘অপসংস্কৃতি’ তকমা পেতে পারে? গোটা আইনি তরজা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ঊষার আইনজীবী আদালতে ‘পপ’ তথা ‘পপুলার কালচারের’ জনগ্রাহ্যতা এবং লোকায়ত জনসমাজের কাছে এর আবেদনকেই বারবার পয়েন্ট আউট করেন। বিশেষত ঊষার পোশাক, তাঁর পারফরম্যান্সের সময় কাঞ্জিভরম শাড়ি, কাচের চুড়ি, ফুলে মোড়া লম্বা বেণী, কপালের ‘ওম’ টিপ এবং তাঁর দক্ষিণ ভারতীয় উচ্চবর্ণীয় পরিচিতিও কোনওভাবেই চটুল ‘অপসংস্কৃতি’ নামক ট্যাগলাইনের সঙ্গে যায় না। শেষ অব্দি পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয় সরকার। ঊষা উত্থুপের গানকে বিকৃত বা অশ্লীল সংজ্ঞায় চিহ্নিত করার মার্ক্সবাদী ভিক্টোরীয় প্রকল্পটি রীতিমতো ফ্লপ করে। সরকার জানিয়ে দেয় সমস্ত সরকারি প্রেক্ষাগৃহে ঊষা উত্থুপের গান গাইতে কোনও বাধাই থাকবে না। কিন্তু সরকারি হলে ক্যাবারে, বেলি ড্যান্স বা স্নেক ড্যান্সের মতো রুচিহীন জিনিস প্রদর্শন করা চলবে না।
তাই ঊষা উত্থুপ যা পারেন, তাঁর উচ্চবর্গীয় সামাজিক অবস্থান যা পারে, মিস শেফালি আর বাদবাকি মিসরা তা পারেন না। তাঁরা সামাজিক নিরিখে সেই নিম্নবর্গীয় আউটকাস্টই রয়ে যান। অশিক্ষিত রিফিউজি পরিবারের মেয়ে শেফালি, পার্ক স্ট্রিটের নৈশবিনোদনের জগতে ঝড় তোলা শেফালি, হাতিবাগানের থিয়েটার-পাড়ায় রীতিমতো আগুন-জ্বেলে-দেওয়া শেফালিকে ঊষা উত্থুপ যে সম্ভ্রান্ত সাংস্কৃতিক বৃত্তে বিচরণ করতে পারেন, সেই উচ্চবর্গীয় বৃত্তে কোনওদিনই ঠাঁই দেওয়া হয়নি, হবেও না। শেফালি তাঁর আত্মকথায় বলেছেন—“একবার ভেবেছিলাম যে, ক্যাবারেও যখন অপসংস্কৃতির মাধ্যম, থিয়েটারে নাচতে আসা ‘মিস’-রাই যখন রাজনীতিবিদ বা সংস্কৃতিরক্ষকদের সহজ টার্গেট, তখন সবাই মিলে প্রতিবাদ করা উচিত। তখন আমি গ্র্যান্ড হোটেলে অনিয়মিত। বরং পুরোপুরি থিয়েটারের অন্দরের বাসিন্দা। পার্ক স্ট্রিটের সাহেবি গন্ধ তখন অনেকতাই ফিকে হয়ে আসছে শরীর থেকে। এক অর্থে ওই লড়াইটা আমাকে একাই লড়তে হয়েছিল সত্তরের গোড়া থেকে। কাউকে পাশে পাইনি। পরে অবশ্য আমি মিস জেমি, মিস ববিদের বলেছিলাম যে, ক্যাবারে ড্যান্সাররা একজোট হয়ে এই লাগাতাত্র ‘অপসংস্কৃতির’-র অপবাদ আর নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে তো ওরা কেউ এগিয়ে এল না। যারা নাম ভাঁড়িয়ে লুকিয়ে নাচত, তারা বলল, সবাই জেনে যাবে যে, আমরা ক্যাবারে করি। ধরা পড়ে যাবার ভয়। নতুন করে বদনাম জুটবে, লাভের লাভ কিছুই হবে না”। বামফ্রন্টীয় নীতিপুলিশির পাশাপাশি সাধারণ ভদ্রবিত্ত সমাজ থেকেও প্রবল বাধা এবং বিরোধিতা বাঙালি সমাজে ছিলই। সেই সমস্ত বাধার সামূহিক ফল এই অশ্লীলতা-বিরোধী নিদানের সামনে ক্যাবাত্রে নর্তকীদের সবচেয়ে সফট টার্গেট হয়ে পড়া।
তাহলে দিনের পর দিন একটানা ব্যবসা করে-যাওয়া এই থিয়েটারগুলোর দর্শক ছিলেন কারা? মধ্যবিত্তের একাংশ হয়তো বিরোধিতা পোষণ করেছিল, কিন্তু সাধারণ মধ্যবিত্ত অথবা নিম্নমধ্যবিত্তের একটা বিরাট অংশই ছিল এই ক্যাবারে-থিয়েটারের ক্লায়েন্টেল। এই বিনোদনের ব্যবসায়িক দিকটা লক্ষ করলেই ব্যাপারটা বোঝা যায়। এমনকি নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি অব্দিও এই বিনোদনের কোনও কমতি ছিল না। খবরের কাগজে বড়ো বড়ো করে বিজ্ঞাপন বেরোত—‘চক্রান্ত করে এ নাটক বন্ধ করা যায়নি, যাবে না’। নাটকের উত্তেজক নাম এবং নর্তকীদের উত্তেজক ছবিসহ বিজ্ঞাপন বেরোত সেইসময়ের সবচেয়ে বড়ো কাগজগুলোতে—‘বিক্ষুব্ধ যৌবন’, ‘নিষিদ্ধ নারী’, কামনার আগুন জ্বলছে’, ‘ব্যভিচার’, ‘মৈথুন’, ‘অভিশপ্ত যৌবন’, ‘লাঞ্ছিতা’, ‘লাজ রাখো’, ‘রাজের বন্দিনী’, ‘পাঁচ মিনিটের স্বামী’, বন্য প্রেম’ ইত্যাদি। ক্রমশ ‘ক্যাবারে’ নাচেরও বিবর্তন ঘটতে লাগল। পাশ্চাত্য ইরোটিক নাচের বিনোদনের সীমা ছাড়িয়ে থিয়েটারের বাজারে ‘ক্যাবারে’ হয়ে দাঁরাল নিছক অর্ধনগ্ন শরীরের অঙ্গভঙ্গির চমক। ‘ক্লেম ব্রাউন’ নামের একটি নতুন মঞ্চ তৈরি হয়েছিল, যাতে প্রত্যেকটা নাটকের বিজ্ঞাপনেই লেখা থাকত আকর্ষক ও উত্তেজক ক্যাচলাইন—‘সমুদ্র সৈকতে মধুচন্দ্রিমা’, ‘প্রতিটি দৃশ্যই প্রাপ্তবয়স্কদের’। অজস্র আনকোরা নতুন ‘মিস’ উঠে আসছিলেন এইসময়ে—মিস শোভনা, মিস জেমি, মিস ময়ূরী, মিস মালা, মিস রোজি, মিস এরিনা, বিজলি, মিস মেনকা, মিস বাবলি, মিস প্রতিমা প্রমুখ। ১৯৯৪ভ সালের ৬ নভেম্বর থেকে ১১ নভেম্বর অব্দি সাওরকারিনায় বিজ্ঞাপন দিয়ে চলেছে—‘অশ্লীলতার উৎসব’। ১৯৭৯ সালে মিনার্ভাতে অভিনীত ‘জুয়া’ নাটকের ক্যাপশন—‘সমুদ্র স্নান/ উদ্দাম নৃত্য/অভিনব গান’। একই বছরে একই মঞ্চে ‘প্রিয়ার খোঁজে’ নাটকে কি-ওয়ার্ড হিসেবে লেখা থাকত—‘প্রাপ্তবয়স্কদের প্রাপ্তিযোগ’। ১৯৮২ সালে বিশ্বরূপায় চলেছিল ‘রক্তরঙ্গ’ নাটক, যার বিষয় ছিল যৌনবিকার ও সিফিলিস রোগ। ‘নাইট ক্লাব’ নাটকে ‘বিধান মঞ্চের’ ক্যাচলাইনে লেখা ছিল—‘অশ্লীল, উদ্দাম, ডিস্কো’। তবে সমাজের কোন অংশটি এই নাটকের প্রত্যক্ষ ক্লায়েন্ট ছিল তার সম্পূর্ণ হিসেব আজ আর খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু শেষ-ষাট দশক থেকে প্রায় বিশ শতকের শেষ অব্দি এই নাটকের অসম্ভব জনপ্রিয়তারইয়নিরিখে বলা যায় মূলত উত্তর ও মধ্য কলকাতার ছাপোষা মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন, যারা সপরিবার আসত এই নাটকগুলো দেখতে। মফস্সল, আধা মফস্সল থেকে সপরিবারে ট্রেনে চেপেও বহু লোক আসত এই সময়ের নাটক দেখতে। মাজখবয়সী সাশুড়ি তার নববিবাহিতা পুত্রবধূকে নিয়ে এই নাটক দেখতে আসছেন, এরকম দৃষ্টান্তও আছে। এতোদিন গ্র্যান্ড হোটেলের কৌলীন্যে যাদের প্রবেশাধিকার ছিল না, তাদের হাতের নাগালে চলে এল উত্তর কলকাতার নাটকে ব্যবহৃত এই ক্যাবারে, ফলত একটা ভিন্ন গোষ্ঠীর কাছে এর জনগ্রাহ্যতা অবশ্যই ছিল। এর থেকে বোঝা যায়, যৌনতা ও যৌনবিনোদনের একটা একটা সমান্তরাল গ্রহণযোগ্যতার ধারা বিশ শতকের শেষ অব্দি এই তরলায়িত অর্ধনগ্ন, অ-কুলীন, অ-ঔপনিবেশিক, সস্তার ক্যাবারের মধ্য দিয়েই বজায় থেকেছিল, যা সম্পর্কে চোখ বুজে থাকাই সমীচীন মনে করেছেন আমাদের সুশীল, বামপন্থী, বিপ্লবী ও তথাকথিত সাম্রাজ্যবাদী অপসংস্কৃতির গন্ধ-খুঁজে-পাওয়া ভিক্টোরীয় মার্ক্সবাদী মহল।
নারায়ণ চৌধুরীর লেখা ‘সংস্কৃতি, শিল্প ও সাহিত্য’ বইটি এই প্রসঙ্গেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই বইয়ের মধ্য দিয়েই একাধারে বস্ত্র-বিবর্জিত নাচের এই নতুন ‘সিন্ড্রোম’-কে খারিজ করা এবং একে সাম্রাজ্যবাদ-বাহিত ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অভিসন্ধি, সামাজিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখার এসট্যাবলিস্টমেন্টের চাল বলে দেখানো হয় এবং এর বিরুদ্ধে এক সার্বিক আক্রমণ নামানো হয়। এই বইতে ক্যাবারে নাচের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে ‘সমাজক্রান্তির বিপ্লব’ বলে ব্যাখ্যাও করা হয়েছিল। এই ধরনের নাটক, ব্যবসায়িক পত্রিকার পাতায় লেখা বাজারি সাহিত্য, সবকিছুর বিরুদ্ধেই নারায়ণবাবু ঘোষণা করেন এক পবিত্র জেহাদ। তাঁর মতে—শিল্পসাহিত্যের সজাগতার জগৎকে পঙ্গু করে দেবার সমাজবিরোধী পুঁজিবাদী অভিসন্ধিই আসলে ‘অপসংস্কৃতি’। তিনি লিখেছেন—‘অপসংস্কৃতিমূলক সাহিত্য প্রণয়নে ও প্রচারে যে সব লেখককে সবিশেষ উৎসাহী দেখা যায়, তাঁদের গায়ে একটু আঁচড় কেটে দেখলে দেখা যাবে প্রায়শ তাঁরা স্থিতাবস্থার উপাসক, কায়েমি স্বার্থের সমর্থক, বুর্জোয়া মূল্যবোধের ধারক ও বাহক। তাঁরা তথাকথিত সৌন্দর্য সৃষ্টির আদর্শের অজুহাত পেড়ে প্রায়শ যা করে থাকেন তা হল মুষ্টিমেয় সংখ্যক সুবিধাবাদী সম্প্রদায়ের নরনারীর চিত্তবিনোদন, তাঁদের অসার আমোদপিপাসার নিবৃত্তি…আরও যেটা লক্ষণীয়, তা হল এই যে, অপসংস্কৃতির পোষক এই সমস্ত লেখকের দল তথাকথিত সৌন্দর্যের দেবীর পায়ে গড় করেন “আর্ট ফর আর্ট সেক” বা “কলাকৈবল্যবাদ” নামক এক বিতর্কিত শিল্পাদর্শের উপচার অঞ্জলি প্রদানপূর্বক। তাঁরা তাঁদের সৌন্দর্যের তত্ত্বকে বলেন “নন্দনবাদ” (ইস্থেটিজম) এবং এই নন্দনবাদের বিগ্রহের বেদিমূলে সভক্তি আরতি করেন সদাসর্বদা যে ধুনি জ্বালিয়ে, তার নাম “ব্যক্তিস্বাতন্ত্র”, “শিল্পীর স্বাধীনতা”, “চিন্তার স্বাধীনতা”, ইত্যাকার গালভরা বচনমালিকা…”শিল্পীর স্বাধীনতা” কিংবা ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র কথাগুলি শুনতে ভালো কিন্তু এটা এদের খেয়াল হয় না যে, নিরঙ্কুশ ব্যক্তি-স্বাধীনতা কোনও সমাজই বরদাস্ত করতে প্রস্তুত নয়—তা সে সমাজ যত বড়ো পারমিসিভ সোসাইটি হোক না কেন। সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অকল্যাণ সাধন করে যে বস্তুর চর্চা, তা শিল্পই হোক আর সাহিত্যই হোক আর অন্যবিধ কিছুই হোক, কোনও মতেই গ্রাহ্য নয়’। নারায়ণ চৌধুরী ‘গণতান্ত্রিক লেখক-শিল্পী সঙ্ঘের পক্ষ থেকে এই ‘অপসংস্কৃতি-বিরোধী জেহাদের’ ডাক দিতে আহ্বান করেন। উত্তর কলকাতার পাবলিক থিয়েটারে ক্যাবারে নাচের বিরুদ্ধে লেখক সরাসরি বলেন—‘এখন অকারণে ও নিতান্ত আচমকা লাস্যচটুল বিলোল ভঙ্গিমার নৃত্যের অবতারণা’ করা হচ্ছে এবং ‘নৃত্যকারিণীর বাসের স্বল্পতা’ যেকোনও দর্শকের কাছে লজ্জাজনক হয়ে উঠছে। এখনই যদি এই কুরুচির বন্যাকে আটকানো না যায় তবে ‘গোটা নাট্য ও যাত্রাপালার সংস্কৃতিই একদিন অপসংস্কৃতির আবিলতার বন্যায় ডুবে যেতে পারে’—নারায়ণবাবুর অভিমত এরকমই। আমাদের মনে পড়ে যাবে উনিশ শতকে বটতলা-সাহিত্য ও সংস্কৃতির তথাকথিত ‘অশ্লীলতা’-দূরীকরণে তৎকালীন এলিট-বাবু কেশবচন্দ্রের উদ্যোগে ‘স্যানিটাইজেশন-প্রকল্প’, যার মূল উদ্যোক্তা ছিল কেশববাবুর সম্পাদিত ‘সুলভ সমাচার’ পত্রিকা। সেই উনিশ শতক থেকে ‘বঙ্গীয় ভিক্টোরিয়ানা’ একটুও যে এগোয়নি, তা বামফ্রন্টের এই মাথামোটা নির্বোধ নীতিপুলিশি থেকেই বোঝা যায়। ১৯৭৭-১৯৭৮ সাল নাগাদ সিপিআইএমের মুখপত্র ‘গণশক্তি’-র পাতায় পাতায় এই ‘অপসংস্কৃতি-বিরোধী জেহাদ ধরা পড়ে। কনক মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘অপসংস্কৃতি রোধে নারীসমাজের দায়িত্ব’ প্রবন্ধে নারীর চটুল নৃত্য, নারীদেহের বিজ্ঞাপন, কুরুচিকর যৌনজীবনের প্রচার, গল্প-উপন্যাস-নাটকে সমাজবিরোধী এই ভ্রষ্ট বহিঃপ্রকাশকে ক্ষয়িষ্ণু সমাজের ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত করেন। এক্ষেত্রে আবার নারীবাদী দৃষ্টিকোণও ব্যবহৃত হয় তাঁর লেখায়। তিনি বলেন, মার্কিন সভ্যতার অনুকরণে এদেশের ক্ষয়িষ্ণু শাসকশ্রেণি ‘নারীদেহকে উৎকট লেনদেনের পণ্যে’ পরিণত করেছে। প্রায় একই সময়ে প্রকাশিত হয় মহম্মদ আবদুল রসুলের ‘সংস্কৃতির কথা’। সেই বইতেও লেখক সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতি, বুর্জোয়া ও প্রলেতারীয় সংস্কৃতি, মার্কিনি অবক্ষয়ী সংস্কৃতি ও সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতি নিয়ে বিস্তারিত তাত্ত্বিক আলোচনা করেন, বঙ্গীয় পরিসরে ‘অপসংস্কৃতির’ বিরুদ্ধে রাজনৈতিক জেহাদের ডাক দেন এবং সেই ‘অপসংস্কৃতি’-র কেন্দ্রে রাখেন ‘ক্যাবারে’ নাচকে।
এখন প্রশ্ন ওঠে, মিস শেফালিকে সংস্কৃতির কোন পাতে ফেলা যায়? বুর্জোয়া না প্রলেতারীয়? পুঁজিবাদী বা শ্রমজীবী—কোন শ্রেণিচরিত্র দিয়ে মাপা যায় শেফালির শরীর? যে শরীর খেটে খায়, যে শরীর নেশা ধরায়, যে শরীর যৌন বাসনার উৎসস্থল, যে শরীর প্রশিক্ষিত, সুন্দর, আকর্ষণীয় তবুও সে বিপজ্জনক, অশ্লীল ও অশালীন’। অর্থাৎ কোনও নির্দিষ্ট খোপ-কাটা বর্গে আমরা ধরতে পারি না মিস শেফালির শরীরকে। প্রাক্-বামফ্রন্ট কংগ্রেস সরকারের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের হাত থেকে ‘নৃত্যসম্রাজ্ঞী’ উপাধি নিয়েছিলেন শেফালি। কিন্তু বাঙালি সমাজ তাঁর নাচকে আদৌ কোনও শিল্পের বর্গেই এঁটে নিতে পারেনি। কারণ, ক্যাবারে আমাদের রক্ষণশীল মননে কোনও নাচ নয়। কিন্তু আজ তৃতীয় ধারার নারীবাদী পাঠে শেফালির অলজ্জ বয়ান এক প্রতিস্পর্ধার কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে। দ্বিতীয় স্রোতের নারীবাদে যে শরীর পিতৃতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শিকার, সেই শরীরই আজ স্ব-ইচ্ছা, যৌন আনন্দ, আত্মসুখ, বাসনার নিজস্ব স্বতশ্চল আনন্দে আত্মাভিলাষ ও ইচ্ছের স্বাধীনতাকে আজ মর্যাদা দিতেই হবে। ক্যাবারে কুইন মিস শেফালি বলেছিলেন—“যে চেহারা এতো যত্ন করে তৈরি করেছিলাম, সেটা দেখাতে আপত্তি থাকবে কেন? এ নিয়ে খামোখা লজ্জা পাওয়ারই বা কি আছে! নাচতে নেমে ঘোমটার ইজ্জত থাকে না, নাচটাও ভালো হয় না। সেই শরীরটা নিয়ে আমি যা করছি, তাতে আমার মন সায় দিচ্ছে কি না, সেটাই আসল কথা”। এই দর্পিত স্বাধীন কণ্ঠস্বরই আজ কলকাতা শহরের মেয়েদের স্বাধীন জীবনযাপনের অগ্রণী চেতনায় ফিরে ফিরে আসছে। সমস্ত খোলস আর আড়াল ভেঙে আজ কথা বলছে দেড়শ-দু’শ বছরের অর্গলবদ্ধ শরীর। এই শহর আস্তে আস্তে বড়ো হতে শিখছে আজ। তার ম্যাচিয়রিটি বাড়ছে। একইসঙ্গে শেগালি বলেছেন—“আমি হোটেলে ক্যাবারে করতাম ঠিকই, কিন্তু আমি না চাইলে কেউ আমার গায়ে হাত ছোঁয়াতে পারত না”—অর্থাৎ যৌনবুভুক্ষু অথবা যৌনশীতল কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক জ্যাঠামশাইরা যা কল্পনাও করতে পারতেন না, শেফালি ছিলেন তাই। তাঁর শরীর সহজলভ্য যৌনবস্তু ছিল না। তিনি একইসঙ্গে পিতৃতন্ত্রের নিয়ম ভাঙেন আবার তিনিই হয়ে ওঠেন পিতৃতান্ত্রিক খবরদারির নয়া আইকন—এই দুই শেফালির দ্বান্দ্বিক ইতিহাস আজও সমান আকর্ষণীয়।