কুলহিতে কুলগুরু
উত্তরবঙ্গ বললেই কিছু ছবি চোখে ভেসে ওঠে। টিনে ঘেরা একতলা বাড়ি, উঁচু-নিচু চা বাগান, ছায়া গাছ, চোয়াল পোক্ত কিছু মানুষের মুখ, মিষ্টি মধুর আবহাওয়া। এই প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে এই অঞ্চলের জগজন তাঁদের ধ্যান-ধারণা, ভাবনা-চিন্তা শিকড় সন্ধান থেকে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ধারার সাংস্কৃতিক পর্যাবরণ। ইতিহাস এই সংস্কৃতির সঙ্গে বিশেষভাবে সংপৃক্ত। প্রায় সাড়ে চারশো বছর পুরানো এ অতীত ছবি। দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, দিনাজপুর, কোচবিহার জেলাগুলিকে ঘিরে সম্প্রদায়ের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। রাজবংশী শব্দের অর্থ ‘রাজ’ অর্থে রাজা ‘বংশী’ অর্থে তাঁর ‘বংশধর’। এই ইতিহাস খুবই পোক্ত, বলশালী। সাহিত্য, কৃষ্টি, ভাষার ক্ষেত্রে যেমন ইতিহাস সৃষ্টিকারী নিদর্শন এঁরা গড়েছেন, তেমনি নিজস্ব সামাজিক আচার-আচরণে এঁদের মধ্যে চরিত্রগত কিছু বৈশিষ্ট্য বারবারই একটি স্বতন্ত্র সমাজ চেতনা গড়ে তুলেছে।
স্বতন্ত্র ভাবনা, চেতনা এই মানুষগুলিকে নানা সময়ে চিহ্নিত করেছে। সমাজ পরিক্রমায় যুক্ত হয় এই মানুষগুলির কিছু বুদ্ধিদীপ্ত ভাবনা। কখনোই চাপিয়ে দেওয়া সমাজনীতি নয়। স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ সামাজিক নব্য ভাবনা সংযোজনে বিশেষ ভূমিকা নেয়। এই নব্য চেতনা গড়ে ওঠে ওই মানুষগুলির নানা আচরণবিধি রচনার মাধ্যমে। বড় অভিনব প্রাণবন্ত সে কার্য-কারণ। রাজবংশী সমাজে শাস্ত্রজ্ঞানসম্পন্ন ন্যায়নীতি, মূল্যবোধের শিক্ষায় মানুষকে সঠিক পথ নির্বাচনে সাহায্যকারী বেশ কিছু নজির স্থাপন করে চলেছেন যাঁরা, তাঁরা হলেন সেই রাজবংশী সমাজের কুল পুরোহিত বৃন্দ। এঁরা কুলগুরু নামেও পরিচিত। না, এঁদের নেই কোনও কেতাবি জ্ঞান। কিন্তু শাস্ত্রজ্ঞানে ঠিক-বেঠিকের বিধান দেন এঁরা। সমাজে এমনভাবেই এঁরা স্থাপিত যেন সঠিক প্রশ্নাবলীর সঠিক উত্তরমালায় সজ্জিত প্রাণ আধার। কার দ্বারা কোন কাজ সঠিকভাবে হবে, সমাজের কোনও রীতি-অনুষ্ঠানে একটি বৃহৎ অংশের মানুষের হৃতার্থে কুল পুরোহিতগণ সেই যোজকই স্থাপন করে চলেছেন।
কথা হল এমনই এক প্রাণবন্ত মানুষের সঙ্গে। কুল-শিষ্য ভক্ত-সমাজসেবা প্রতিষ্ঠানে এঁর মুখ থেকেই বেরিয়ে এল বেশ কিছু কথা হল এমনই এক প্রাণবন্ত মানুষের সঙ্গে। সমাজ সংস্কারে এমন অজানা সব মানুষগুলিকে নিয়েই মাটির মুখ উজ্জ্বল হল এই প্রতিবেদনে। গোপাল অধিকারী সরল, সাদাসিধা, একজন মানুষ। বললেন, তাঁদের দশটি কর্মের কথা — অন্নপ্রাশন, বিবাহ, অধিবাস ইত্যাদি। পৃথিবীতে মানুষজন্মই শ্রেষ্ঠ আর মানুষের ভক্তিতেই মুক্তি। ভক্তিহীন মানুষ জন্ম বেকার, ভক্তির পথে মজাইলে মন কিঞ্চিৎ পাবে রতন।
এই রত্ন খোঁজের উৎসমুখের সন্ধান দেন এই কুলপুরোহিত মানুষজন। বললেন – প্রকৃতির মানুষ হইলে, ধৈর্য ধরতে হয়, তারপরে মিলিবে, হবে সহ্য, হবে ভাবের উদয়। কত সহজভাবে কত বড় কথাগুলি তিনি শোনালেন, যা আজকের এই ব্যস্ততার সময়ে অতি প্রয়োজনীয় একটি মূল্যবান তথ্য। কুলপুরোহিত বলেন, ‘ভক্তির অনেক স্রোত আছে। গৃহস্থ পরিবারে সে স্রোত খানিক পৃথক। লোভ, লালসা নিয়ে থাকলে মানুষ হয়ে ওঠার সম্ভাবনার মৃত্যু অবধারিত।’
পাপাচারী মানুষের জন্মক্ষণে মুক্তি নেই। চৌর্যবৃত্তি, খুনখারাবি মানুষ জনমে পতন ঘটায়। নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর ছবি স্থাপনা করে সেবায়েত বাড়ি গিয়ে সঠিক পথ চালনায় এই রাজবংশী কুলপুরোহিত বা সমাজ সংস্কারক হিসেবে দীর্ঘকাল ধরে নিভৃতে কাজ করে চলেছেন। তাঁর মতো উত্তরবঙ্গে প্রায় চারশো পঁয়ষট্টি জন আছেন, যাঁরা পরোক্ষভাবে নিম্নগামী মূল্যবোধকে অনেকাংশে সদর্থক পথে আনার চেষ্টা করছেন। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি ধুতি পরনে থাকে এঁদের।
গোপাল অধিকারীর বয়স এখন বাহাত্তর। চার ছেলে তাঁর নানা কাজে নিযুক্ত। কিন্তু তিনি পরবর্তীতে কোনও এক ছেলেকে অবশ্যই কুল পুরোহিত পদে স্থাপন করবেন ঠিক যেভাবে তাঁর বাবা তাঁকে এ কাজে সংযুক্ত করেছেন। কুল পুরোহিত গোপাল অধিকারী এ কাজের পাশাপাশি কৃষিজমির দেখভালও করেন। আজকের এই গোলমেলে সময়ে যেখানে ভুরি ভুরি বৃদ্ধাশ্রমের জন্ম হচ্ছে ঠিক সেই সময়ে সুদূর উত্তরবঙ্গের অনামী গ্রামের এমন সব মানুষরা কর্তব্য নিষ্ঠায় সংযুক্ত করছেন একটি বড়ো অংশের মানুষজনকে। পিতা-মাতাকে বাধা ভক্তির আখ্যান শুনিয়ে সেই জনমনিষিকে বিপদগামী না হতে দিয়ে মহৎ কাজে নিজেদের নাম খোদাই করছেন।
এভাবেই গোপাল অধিকারীর মতো ফুলবাড়ির হরদেব অধিকারী, তেলাকোবার করুণাকান্ত অধিকারীরা সুস্থ সমাজ গঠনে নিজেদের সম্পৃক্ত করে চলেছেন। না, নেই কোনও পুঁথিগত পরিচয়, নেই কোনও নির্দিষ্ট শংসাপত্র, মানবতার মন্ত্র তাঁদের বহু বহু উচ্চমানের শংসাপত্রের অধিকারী করেছে। কী হবে তোতার মতো বুলি আওড়িয়ে? কি হবে ঠাট-বাট-অর্থ-যশের পিছনে হন্যে হয়ে দৌড়ে বেরিয়ে? মান্যবর মাননীয় হয়ে বাইরের অলংকারে চোখ ঝলসে যায় বটে কিন্তু তাতে খাদের ভাগ কতটা তা নির্ধারণের প্রয়োজন। সেই খাদহীন ধাতুর খোঁজ-এর সন্ধান দিয়ে উত্তরবঙ্গের রাজবংশী কুলপুরোহিত সমাজ তাই খুবই প্রাসঙ্গিক। তাঁদের আশীর্বাদের ফুলে ভক্তিরস থাকে, থাকে সেই বীজমন্ত্র যা আমৃত্যু মানুষ নামের কেতন উড়িয়ে বলে মানুষ হও, ভালো মানুষের বিকল্প আর কিছুই নেই।
আমার টুসু লক্ষ্মী মেয়ে
‘তোমার নাম কি?’ সস্তা মাহাতো। খুব ভয়ে ভয়ে অস্পষ্ট গলার আওয়াজ। নামের উচ্চারণেও সেই জড়তা। আমার বাংলার লক্ষ্মী রানির সঙ্গেই যেন কথা বললাম। তার বড়ো বড়ো চোখ দুটি আমার মনে-প্রাণে ততক্ষণে নানা ছবি এঁকেছে। নানা সাজে এক একটা ঝলক সেই মুহূর্তেই ওই তুনতা গ্রামের নমো পাড়ার সকালটায় আমাকে আবিষ্ট করল। মনে হলো যদি ছবি বানাতে পারতাম, তাহলে ওই মেয়েটিই হতো আমার ছবির নায়িকা। ‘হেঁই মেইয়্যা তুই জানিস না বঠে তুই কত্ত সোন্দর। তাই কি তুই এত্তো সোঁন্দর?’—এই আশা করি টুসু মায়ের চরণে। এভাবেই পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে একান্ত মেয়েদের উৎসব টুসুতে তাঁরাও তাদের নানা ইচ্ছা কামনার মানত দেন।
অবিবাহিতরা ভালো বর পাওয়ার, বিবাহিতরা আদুরে ছেলে মেয়ে পাওয়ার, বয়সী মহিলারা সন্তানের মঙ্গল কামনায় এই ব্রত করে থাকেন। জিজ্ঞেস করলাম, টুসুর ব্রত পালন কর?’ ‘হঁ করি।’ ‘গান কর?’ হুঁ।” “তা গান শোনাও না।’ সস্তা তখন আরো জড়ভরত। গলা দিয়ে গান বেরুবে কি ওই ডাগর চোখ দুটো দিয়ে জল প্রায় বেরিয়ে আসে। পাশ থেকে তীক্ষ্ণ গলায় রেবতী মাহাতো বলল ওদের এই উৎসব নিয়ে। শোনালো গান, ‘আলো চালে পাতি টুসু সকল ফুলে পুঁজি গো, বছর বছর আসবেন টুসু এই আর্তি তোমারি গো ‘।
অঘ্রাণ মাসের সংক্রান্তি থেকে শুরু করে শেষ হয় পৌষের সংক্রান্তিতে টুসু। চিড়া, গুড়, ফলমূল, চাল দিয়ে টুসুর পুজো হয়। কোথাও ঘট পাতা হয়। কোথাও টুসু দেবীর মূর্তি স্থাপনা করা হয়। টুসুকে যেমন মেয়েরা পুজো করেন আবার কখনো টুসুকে তাঁরা পরম আত্মীয় মনে করেন। তাঁর কাছে যাবতীয় আবদার, মনের ইচ্ছের কথাও জানায়। কখনো টুসুর যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, তার ভালো থাকার কামনায় গানও রচনা করেন এই মেয়েরা—
আমার টুসু দখিন যাবে, খিদা পেলে খাবে কি? আন গো টুসুর গায়ের গামছা বেঁধে দিই জিলাপি।
এই টুসু উৎসব, টুসু গান শোনা যায় অতীতে এক সময় একটি আন্দোলনে সামিল হয়েছিল। মানভূম থেকে জেলা পুরুলিয়ার নামকরণে টুসু গান করে প্রতিবাদী হয়েছিলেন এই অঞ্চলের মানুষজন। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এমনটা ঘটে। পুরুলিয়া জেলার রঘুনাথপুর অঞ্চলে টুসুগানের গায়কদের গ্রেফতার করা হয়। কেড়ে নেওয়া হয়েছিল মাদল। এমন নমনীয় টুসুও সেদিন রণরঙ্গিণী হয়েছিলেন। জায়গার নাম বদলের জন্য দুই হাতে দুটি পদ্ম ধারণকারী টুসুরানির কলিজার দম প্রমাণ করতে পেরেছেন আজকের পুরুলিয়া । সেদিনের সেই টুসুই আজকের সস্তা রেবর্তীদের মধ্যে বেঁচে আছে। ওরা অঘ্রাণ মাস এলেই সব ‘সঙ্গী ছেলেরা’ মিলে ‘গীত গান’ করে। ওদের দল আছে টুসু গানের। কলকাতাতেও গান শুনিয়ে গেছে। তবে এখন ‘পাড়া পাড়া’ দল হিসেবেই গান করে ওরা। টুসু পরবে বিবাহিত মেয়েরা বাপের বাড়ি আসে। উৎসব ঘিরে মেলাও বসে যায় জায়গায় জায়গায়। অবশেষে আসে ভাসানের দিন।
পৌষের সংক্রান্তিতে বড়ো বড়ো ‘চৌডল’ সাজিয়ে নদী, পুকুরে ভাসানো হয় টুসুমণির প্রতিরূপকে। পুরুলিয়ার গড়জয়পুর থানা এলাকার সকল ‘বিটি মেইয়া’রা নতুন নতুন পোশাক পরে কাঁসাই-এ চৌডল ভাসাতে যায়। শোলা, রঙিন কাগজ, পুথি দিয়ে তৈরি এই মাঙ্গলিক চৌডল। ভাসান যাত্রায় দুমদুম বাদ্যি বাজে, সঙ্গে চলে গান। কার চৌডল কত সুন্দর তার একটা প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতাও হয়ে যায় সেদিন। দেউল ঘাটার সুনসান পাথুরে নদী সেদিন প্রাণ পায়। কত কত মেয়ের ছপাৎ ছপাং আওয়াজ ওঠে জলে। রং বাহারি পোশাকে চোখে রঙ-এর মেলা বসায়। উৎসব আর উৎসব। কিশোরী থেকে সদ্য যুবতী, ঘর গেরস্থালির বয়স্ক মহিলা, আবার ছোট্ট ছোট্ট মেয়েদের নানা ‘গ্রামের’ কন্ঠস্বর শোনার জন্য কাসাই যেন উন্মুখ হয়ে থাকে। প্রসঙ্গত বলা যায়, পুষ্যা নক্ষত্রের মাস হল পৌষ মাস। এই মাস হল লক্ষ্মী মাস। ‘তুষ’ হল ধানের খোসা। শস্যের সঙ্গে টুসু মায়ের সম্পর্ক বাংলার ফসল তোলাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।
সেদিন পুরুলিয়া জেলার গড় জয়পুর থানার ওই গ্রামে দাঁড়িয়ে শুনলাম টুসুর নানা গল্প। দিন গড়িয়েছে, সাল পার হয়েছে। আধুনিক যুগ আমাদের পল্লি জীবনেও একটা প্রভাব ফেলছে। বলা যায়, ওই ব্রত পালনকারী মেয়েগুলোকেও স্পর্শ করেছে। ওরা কেউ অষ্টম শ্রেণি, কেউ দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী। ওদের শিক্ষা, ওদের সংস্কৃতিকে আরও বেশি করে বুঝতে শিখিয়েছে। জানতে শিখিয়েছে। শিক্ষা মানুষকে উদার করে। নতুন চেতনায় দীক্ষিত করে। কিন্তু সস্তা মাহাতো বা রেবর্তী মাহাতোরা এই যুগের সদ্য যুবা হয়েও ওদের কৃষ্টিকে ভোলেননি। বরং অঘ্রাণ-পৌষে টুসু উৎসব পালন করে ওরা ওদের পূর্বকালের মানুষজনকে সম্মান জানায়। শিকড় সন্ধানী ওই মেয়েগুলো তাই বোধ হয় এত দামি। ‘সস্তা’ নামটাকে ভুল প্রমাণিত করতে আমার টুসু মা তাই আরও উন্নততর জীবনের পথ বেছে নিয়েছে। আবার ওই চোখ দুটির টানে নিশ্চয় তোমার সাথে আমার দেখা হবে আমার টুসুমণি। তোমার উৎসব ভালো কাটুক।