মঞ্চের বন্ধনেই বেশি সুখ মৃত্তিকার | বিজয়কুমার দাস, পর্ব – ৩৬

বাংলা থিয়েটারে একটা নতুন প্রজন্ম উঠে আসছে। থিয়েটারটা জেনে, থিয়েটারটা শিখে এবং থিয়েটারে থাকবে বলেই এরা বাংলা থিয়েটারে আশার প্রদীপ হাতে নিয়ে এসেছে আগামীর জন্য। এদেরই একজন মৃত্তিকা বসু।একটা থিয়েটার পরিবারেই যার জন্ম, যে পরিবারে প্রতিটা দিন কাটে থিয়েটার নিয়ে সেই পরিবারের মেয়ে মৃত্তিকা তো থিয়েটার করবেই।

বাংলা থিয়েটারে অভিনেতা নির্দেশক সমরেশ বসু পরিচিত নাম। শ্যামবাজার নাট্যচর্চা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা। প্রতিনিয়ত থিয়েটারে নিবেদিত সমরেশের হাত ছুঁয়ে সৃষ্টি হয়েছে বহু থিয়েটারের কর্মী। সেই সমরেশের মেয়ে মৃত্তিকার কাছে মঞ্চের হাতছানি তো স্বাভাবিক। আবার মৃত্তিকার মা সমরেশের অর্ধাঙ্গিনী যোগমায়াও বাংলা থিয়েটারে দাপিয়ে অভিনয় করে চলেছে।
যোগমায়ার বাবা অর্থাৎ মৃত্তিকার দাদু দুলাল চট্টোপাধ্যায় ছিলেন চিৎপুরের যাত্রাজগতে অত্যন্ত দক্ষ অভিনেতা। তাই মৃত্তিকার জন্ম তো থিয়েটারের পরিবারে। থিয়েটার কর্মীর কোলেই তার বেড়ে ওঠা থিয়েটারের সংসারে।
সেই মৃত্তিকা এখন বাবা তথা নাট্যগুরু সমরেশ বসুর শ্যামবাজার নাট্যচর্চা কেন্দ্রের নিয়মিত অভিনেত্রী। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক বিভাগের ছাত্রী এবং থিয়েটারে নিবেদিতপ্রাণ অভিনেত্রী।

শ্যামবাজার এলাকার অন্তর্গত নর্থ ক্যালকাটা ইউনাইটেড স্কুলে কেজি টু পরে ডাফ হাই স্কুলে দশম শ্রেণি এরপর দ্য পার্ক ইন্সটিটিউশনে দ্বাদশ শ্রেণিতে উচ্চমাধ্যমিক পাশ এবং বর্তমানে রবীন্দ্রভারতীতে পড়াশোনা । বাগবাজারে মামার বাড়িতে থাকা মৃত্তিকার বেড়ে ওঠা কলকাতাতেই।

কীভাবে শুরু হয়েছিল মৃত্তিকার থিয়েটার?.. জানা গেল, ওর অন্নপ্রাশনের কয়েকদিন পরেই “বিসর্জন” নাটকের মঞ্চায়ন ছিল। সেই নাটকে এক গ্রামবাসী চরিত্রে এক অভিনেতার কোলে চেপেই মঞ্চে এসেছিল মৃত্তিকা। সেই জার্ণি এখনো চলছে।
থিয়েটার পরিবারে বেড়ে ওঠার সূত্রে থিয়েটারটা মৃত্তিকার দৈনন্দিন অভ্যাস হয়ে উঠেছে। নিজেদের দল শ্যামবাজার নাট্যচর্চা কেন্দ্রে অভিনয় তো আছেই। এছাড়া বিভিন্ন নাট্যদলে ফ্রীল্যান্সার হিসাবেও কাজ করে চলেছে মৃত্তিকা । প্রতি মুহূর্তের থিয়েটার প্রশিক্ষক অবশ্যই বাবা সমরেশ বসু। দলের সহশিল্পীদের সঙ্গে কাজ করতে করতে এবং বিভিন্ন কর্মশালায় থিয়েটারের পাঠ নিতে নিতে মৃত্তিকা বসু এখন থিয়েটারের সর্বক্ষণের কর্মী।

থিয়েটারকে গভীরভাবে জড়িয়ে নিয়েছে বলেই করোনার সময়ে বড় মন খারাপের মধ্যে কেটেছে দিনরাত। থিয়েটার করতে না পারার অসহ্য যন্ত্রণা কুড়ে কুড়ে খেয়েছে। তখনই অনুভব করেছে, থিয়েটারের সঙ্গে তার গভীর ভালবাসার সম্পর্ক।
মৃত্তিকা জানিয়েছে , থিয়েটার ছাড়া আর কিছু তো তেমন করে পারে না। অন্য কিছু করতেও ইচ্ছেও করে না। ছোটবেলা থেকেই থিয়েটারের সাথে সংসার করছে। এই বন্ধনেই সবচেয়ে বেশি সুখ।
এ পর্যন্ত অভিনীত সব চরিত্রের প্রতিই একটা আশ্চর্য মায়া ওর। তবু “দলছুট” নাটকে পারভেজ আর “টেলিস্কোপ” নাটকে শুকতারার প্রতি টান যেন একটু বেশিই। আর “বিসর্জন” এর জয়সিংহ তার বড় ভালবাসার চরিত্র।

থিয়েটারের অভ্যাসটা তো ছোট থেকে মা – বাবা এবং দলের সবার সান্নিধ্যে গড়ে উঠেছে, তবু পুঁথিগত শিক্ষার প্রয়োজনে রবীন্দ্র ভারতীর নাটক বিভাগের প্রশস্ত উঠোনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে মৃত্তিকা। থিয়েটারের জন্য অনুকূল পারিবারিক পরিবেশ পেয়েছে বলে সে অত্যন্ত খুশি। কারণ স্বচক্ষে দেখেছে, অনুকূল পারিবারিক পরিবেশ না পেয়ে অনেক থিয়েটারকর্মীকে বিপন্নতার মধ্যে দিন কাটাতে হয়। অন্তত সেই ক্ষেত্রে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করে মৃত্তিকা।

এই বয়সেই তার থিয়েটার জীবনে অনেক নাটকের অনেক চরিত্রের ভিড়। বিসর্জন নাটকে গ্রামবাসী, বোধ নাটকে স্বপ্নে দেখা শিশু, মা নাটকে লেনা, আত্মপক্ষ নাটকে কাউন্সিলারের মেয়ে, যেতে হবে নাটকে তানিয়া, ধৃতরাষ্ট্র নাটকে বাবু, ঋতম্ভরা নাটকে ঋতম্ভরা, বীরগাথা নাটকে ছোট মঙ্গল পাণ্ডে, সুধা তাকে ভোলেনি নাটকে সুধা, হরিপদর কীর্তি নাটকে মেথরাণী, বীরপুরুষ এর বীরপুরুষ এর পাশাপাশি অজস্র বিচিত্র সব চরিত্র হয়ে মঞ্চে নেমেছে মৃত্তিকা। ব্যারিকেড, মুক্তধারা, বিসর্জন, দখলনামা, দুর্গা টুনটুনি, জেগে ওঠো নবচেতনায়, অরূপকথা, গোধূলি আলোর রঙ প্রভৃতি নাটকের চরিত্রগুলো যেনো তার অভিনয় জীবনের অঙ্গণে প্রদীপ শিখার মত উজ্জ্বল।

অভিনয়ের পাশাপাশি আলোক প্রক্ষেপণ, আবহ ভাবনা, মঞ্চসজ্জা, রূপসজ্জা, সহ নির্দেশনা এবং নির্দেশনাতেও হাত লাগিয়েছে মৃত্তিকা। ভরতনাট্যম, রবীন্দ্রনৃত্যে পারদর্শী মৃত্তিকার লক্ষ্য একজন পরিপূর্ণ থিয়েটারকর্মী হয়ে ওঠা।
সমরেশ বসু ছাড়াও প্রসেনজিৎ বর্ধন, মোনালিসা চট্টোপাধ্যায়, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, নীলিমা চক্রবর্তী, গৌতম মুখোপাধ্যায় প্রমুখকেও নির্দেশক হিসাবে পেয়েছে।
মাছ যেমন বাঁচে না জল ছাড়া। মৃত্তিকা তেমন ভাবতে পারে না থিয়েটার ছাড়া বেঁচে থাকা যায়। মৃত্তিকা যেমন মঞ্চের অপেক্ষায় থাকে, মঞ্চও তেমন মৃত্তিকার মত অভিনেত্রীর অপেক্ষায় থাকে।

4 thoughts on “মঞ্চের বন্ধনেই বেশি সুখ মৃত্তিকার | বিজয়কুমার দাস, পর্ব – ৩৬

  1. মৃত্তিকার জয়যাত্রা অব্যাহত থাক।থিয়েটারের মঞ্চে উড়ুক মৃত্তিকার ভাল ভাল কাজের নিশান।

    1. আমার প্রণাম নেবেন বিজয় জেঠু। সবার সামনে আমার কথা গুলো মেলে ধরার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। 🙏🏻

  2. Tui onak onak boro hoo.ame chai sara jogotaa choriya poruk tor name.ae roilo parthana.

    1. আশীর্বাদ করবেন । আমার প্রণাম নেবেন। 🙏🏻

Comments are closed.