কলকাতার বিভিন্ন নাট্যদলে তাকে দেখা যায় বিভিন্ন নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে। চরিত্র যেমনই হোক, সে নজর কাড়বেই। আসলে থিয়েটারটাকে মনে প্রাণে গ্রহণ করেছে বলেই সে এটা পারে। অবশ্য এর পাশাপাশি প্রতিনিয়ত অভিনীত চরিত্র নিয়ে চর্চা এবং নিজেকে সেই চরিত্রের জন্য তৈরি করার অদম্য প্রচেষ্টা তাকে আজ থিয়েটারের শক্ত মাটিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সেই অভিনেত্রীর নাম আম্রপালী মিত্র।
এক একটা নাটকে এক একটা চরিত্রে অভিনয় করার পর সে নিজেই ভাবে, আর কতটা পরিশ্রম করলে তবে অভিনীত চরিত্রকে আরো বেশি যথার্থ করে তোলা যায়। এই চেষ্টার গুণেই আম্রপালী অভিনেত্রী হিসাবে বিভিন্ন নাট্যদলের কাছে খুব জরুরী এবং অনিবার্য হয়ে ওঠে।
আসলে হাওড়া বেলুড়ের মেয়ে আম্রপালীর সঙ্গে অভিনয়ের গাঁটছড়া বাঁধা হয়েছিল ছোটবেলাতেই বাবা শ্যামল কুমার মিত্রর গড়ে তোলা নাট্যদল বিবেক সংঘের (পরে বিবেক বালি) সূত্রে। বাড়িতেই একটা থিয়েটারের পরিবেশ ছিল। অবশ্য এই আরম্ভের আগেও একটা আরম্ভ আছে। সেটা হল পাড়ার সখের থিয়েটার। পাড়ার বার্ষিক অনুষ্ঠানে ৩-৪ বছর বয়সেই “ভাড়াটে চাই” নাটকে প্রথম মঞ্চে নামা। সে নাটকের পরিচালক ছিলেন তার পিসতুতো দিদি। সেখানে বাবা, জেঠু, দিদি অভিনয় করতেন। যৌথ পরিবারে বড় হয়ে ওঠা তার। মা মহাশ্বেতা মিত্রর প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় তো ছিলই। তাই আম্রপালী নামের মেয়েটি তাঁদের সংলাপ মুখস্থ করে তাঁদের মত বলার চেষ্টা করত। পরে বাবার নাট্যদলে যুক্ত থাকতে থাকতে অভিনয়ে আগ্রহ বাড়ে।
বেলুড় গার্লস হাই স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে গোখেল মেমোরিয়াল গার্লসে ভূগোল বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেও মেয়েটি থিয়েটারের টানেই আর স্নাতকোত্তর পাঠের দিকে এগোয়নি। যদিও জিওগ্রাফিক্যাল ইনফর্মেশন সিস্টেম নিয়ে ডিপ্লোমা করেছিল।তারপর তো থিয়েটারের প্রেমে পড়ে আম্রপালীর ভূগোল – ইতিহাস সবই বদলে গেল।
থিয়েটারকে ভালবেসেই আম্রপালীর জীবনের নৌকা এসে পৌঁছে গেল মিনার্ভায়। তারপর আর পিছন ফিরে তাকানো নয়। মিনার্ভায় যুক্ত হয়ে আম্রপালী হয়ে উঠতে চাইল একজন পরিপূর্ণ অভিনেত্রী। তাই অভিনয়ের পাশাপাশি থিয়েটারের সব ধরণের কাজেই নিজেকে যুক্ত করে নিল। কখনো নাটকের পোশাক, কখনো মঞ্চ উপকরণ ইত্যাদি সব কিছু নিয়েই মিনার্ভার বিভিন্ন প্রযোজনায় এসব কাজ করেছে আম্রপালী। বিভিন্ন নাট্যদলেই অভিনয়ে যুক্ত হয়েছে পরবর্তীতে।রঙ্গপট নাট্যদলের “তথাগত” নাটকে সুজাতা চরিত্রে অভিনয় করে থিয়েটারের দুনিয়ায় নিজেকে চেনাল সে। এই দলের কমল ব্রহ্ম মাধ্যমে যোগাযোগের সূত্রে মোহিত নাট্য বিদ্যালয়ে বিজয়লক্ষ্মী বর্মণ, গৌতম হালদার, দেবকুমার পালের কাছে প্রশিক্ষণের সুযোগ।তারপর মিনার্ভায় কর্মশালাভিত্তিক নিয়োগে থিয়েটারকে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নেওয়ার এক আশ্চর্য সুযোগ এসে গেল আম্রপালীর জীবনে।
মিনার্ভা থেকে বেরিয়ে শুধু থিয়েটার আর থিয়েটার। নানা দলে নানা নাটকে নানা চরিত্রে অভিনয়। নাট্য পরিচালক পৃথ্বীশ রাণার মাধ্যমে হাওড়া ব্রাত্যজনের দেবাশিস বিশ্বাসের পরিচালনায় “আনন্দীবাঈ” নাটক দিয়ে শুরু ফ্রীল্যান্সিং অভিনয়ের জীবন।বিভিন্ন দলের জনপ্রিয় প্রযোজনাগুলিতে আম্রপালী নিজের অভিনয়ের জাত চেনাল।পূর্ব পশ্চিম নাট্যদলে সৌমিত্র মিত্রর পরিচালনায় হড়পা বান, এক মঞ্চ এক জীবন, পাইকপাড়া ইন্দ্ররঙ্গে ব্রাত্য বসুর পরিচালনায় অদ্য শেষ রজনী, দেবাশিস রায়ের থিয়েটার প্লাটফর্ম দলে ইলা গুঢ়ৈষা, হৃদিপাস, চন্দন সেনের হ য ব র ল দলে বিপজ্জনক, একনায়কের শেষ রাত, কথাকৃতি দলে সঞ্জীব রায় পরিচালিত ঘোড়ামুখো পালা (অভিনেত্রী বিন্দিয়া ঘোষের পরিবর্ত হিসাবে সাময়িক) অশোকনগর নাট্যমুখ দলে অভি চক্রবর্তীর পরিচালনায় রাতবিরেতের রক্তপিশাচ, বিল্বদল চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত কালিন্দী নাট্যসৃজন দলে দ্য মার্চেন্ট অফ ভেনিস, রূপকথা এখনও, শূদ্রক নাট্যদলে দেবাশিস মজুমদারের পরিচালনায় বৈজয়ন্তীকা প্রভৃতি দর্শক সমাদৃত নাটকে আম্রপালী যেন নিজেকেই অভিনেত্রী হিসাবে আবিষ্কার করেছে।
তালিকা এখানেই শেষ নয়। কালিন্দী নাট্যসৃজনেই শান্তনু দত্তের পরিচালনায় আষাঢ়ের প্রথম দিনে, ইন্দুদীপা সিনহার পরিচালনায় প্রজেক্ট প্রমিথিউসের যারা জেগে থাকে, বালি প্রভাত নাট্য সংস্থায় তিমির চক্রবর্তীর পরিচালনায় নহবত, না এবং ঐ দলেরই ইনু চক্রবর্তীর পরিচালনায় ভূতান্বেষী, দুলাল লাহিড়ির পরিচালনায় যোজক দলে তিন নেত্র, ঢাকুরিয়া ব্রাত্যজনে শুদ্ধায়ন ভট্টাচার্য পরিচালিত উলঙ্গ প্রজা পরিহিত রাজা, গড়িয়া কৃষ্টি দলে ড: সিতাংশু খাটুয়া পরিচালিত কালপুরুষ, গর্ভধারিণী।
এই তালিকা প্রমাণ করে বেলুড়ের সেই মেয়েটি কলকাতার থিয়েটার মানচিত্রে নিজেকে কীভাবে অনিবার্য করে তুলেছে।
এর পিছনে আছে তার অক্লান্ত শ্রম আর থিয়েটারের প্রতি সীমাহীন ভালবাসা।
থিয়েটারের সাজঘর, মঞ্চ, মঞ্চের পিছনের অন্ধকার পথ, মঞ্চের সামনে সারি সারি দর্শক তাকে এক অন্য ভালবাসার জগতে নিয়ে যায়। লড়াই করে থিয়েটারে যে জায়গাটা সে দখল করেছে সেই থিয়েটারই তার রুটিরুজির মাধ্যম হশে দাঁড়ায়। জীবনসঙ্গী শায়ক ঘোষের অকৃপণ সহযোগিতা তার অন্য প্রেরণা। শায়ক থিয়েটারপ্রেমী, লিটল ম্যাগাজিনে লেখালেখির সূত্রে আম্রপালীর সঙ্গে পরিচয়। ছোট বড় সব রকমের চরিত্রই তার প্রিয়।
অভিনীত চরিত্ররা তাকে যেন প্রতিনিয়ত হাতছানি দিয়ে ডাকে। নিজের অভিনয় জীবনের চরিত্রগুলির দিকে কখনো কোন অবসরের মুখে ফিরে তাকানোর সময় পেলে হৃদিপাস এর কুলসুম, বিপজ্জনক এর টিনা, মার্চেন্ট অফ ভেনিস এর জেসিকা, কালপুরুষ এর ঝিমলি, গর্ভধারিণী নাটকের লেপচা, উলঙ্গ প্রজা পরিহিত রাজা নাটকের বেশ্যা প্রভৃতি চরিত্রগুলির প্রতি তার একটা বিশেষ দরদ লেগে থাকে আজও ।
আম্রপালী তার অভিনয় জীবনে মিনার্ভার ভূমিকাকে কুর্নিশ জানায়। এখানে বিভিন্ন প্রযোজনায় অভিনয়, থিয়েটারের বিভিন্ন কাজ এবং সিনিয়র অভিনেতাদের আন্তরিক সহযোগিতা তার জীবনের সূবর্ণ সঞ্চয়।
আজ এই মঞ্চে একটা নাটক তো কাল আর একটা মঞ্চে অন্য একটা নাটক,পরশু আর একটা নাটকের মহলা, তার পরদিন আবার একটা নাটক… আজ ঝিমলি, তো কাল লেপচা,পরশু জেসিকা,পরদিন টিনা – এই হল আম্রপালীর দিনলিপি। এই জীবনটাকে সে বড় ভালবাসে। আসলে থিয়েটার যেন তার কাছে ভালবাসার পৃথিবী।
লড়াই লড়াই আর, লড়াই -ই শেষ কথা।
কাজই বাঁচিয়ে রাখবে একজন অভিনেতাকে।
আর বিজয়দার পরিশ্রমকে শ্রদ্ধা ছাড়া কিই বা দিতে পারি আমরা।
অভিনন্দন জানাই আম্রপালীকে। আমাদের এই পোস্টে গিয়ে অনুরোধ সবাইকে কমেন্ট, শেয়ার করতে বলতে হবে এইটুকু চাওয়া। ধন্যবাদ।
My heartiest thanks to Team Amol Alo and Mr. Bijoy Kumar Das.
একটি পরিশ্রমী কাজ শেষ করতে পারিনি আম্রপালির সঙ্গে। যেটুকু করেছি ভাল অভিজ্ঞতা। ধন্যবাদ।
আম্রপালীর কথা লিখতে পেরে ভাল লাগছে।সুদক্ষ অভিনেত্রী।বিভিন্ন দলে বিভিন্ন চরিত্রে নজরকাড়া অভিনয়।আমরা শুধু বলতে পারি, ফাইট আম্রপালী,ফাইট।চরৈবেতি।অমল আলোয় উদ্ভাসিত থিয়েটারের উজ্জ্বল মুখগুলি।নাট্যমেব জয়তে।
আম্রপালী আমার অত্যন্ত স্নেহের ও ভালোবাসার পাত্রী। এত তথ্যপূর্ণ বক্তব্যে সমৃদ্ধ হলাম,সেই সাথে ওর নামের যথার্থতা খুঁজে পেলাম। আরও অনেক বড় মাধ্যমে দেখার আগ্রহ বেড়ে গেল। অনেক স্নেহাশীষ ও শুভকামনা রইল। শ্রদ্ধা জানাই লেখক কে।
আম্রপালি দি’ র মতো অভিনেতা র বিপরীতে আমি কাজ করেছি। আমার নির্দেশনায় উনি কাজ করেছেন ভাবলেই বড়ো গর্ব হয়। আমি আপ্লুত, অভিভূত এমন মানুষ তথা শিল্পীকে এত কাছ থেকে পেয়েছি। ভালো থেকো শিল্পী, থিয়েটার যাপন অক্ষত হোক।