মনে মনে কথা, মনের কথা | অসীম দাস

২৯ মে ১৯৯২ স্বপ্নস্বন্ধানীর প্রতিষ্ঠা দিবস। এবছর ত্রিশে পা রাখলো। প্রধান প্রতিষ্ঠাতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কৌশিক সেনের বাবা শ্যামল সেন ( জন্ম. বাংলা ৪ জৈষ্ঠ্য ১৩৪৮ – মৃত্যু. ২৮ শ্রাবণ ১৪০০) একজন আদ্যপ্রান্ত থিয়েটারের মানুষ ছিলেন। রবীন্দ্রভারতী থেকে ডিপ্লোমা কোর্সে উত্তীর্ণ হওয়ার পর উৎপল দত্তের সুযোগ্য ছাত্র হয়ে ঋতু থিয়েটার গ্রুপে যোগদান। তাঁর নিজস্ব নাট্যদল চলাচল। একাধারে যাত্রা সিনেমা নাটক নির্দেশনার পাশাপাশি দক্ষতার সাথে অভিনয় করেছেন শ্যামল সেন। পাশাপাশি দূরদর্শনে ও নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন। থিয়েটার গিল্ডের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। ১৯৮৯ সালে নিউ থিয়েটারস গ্রুপ প্রযোজনা বড়কর্তা নাটকে তাঁর শেষ নির্দেশনা। উত্তরবঙ্গ থেকে যাত্রায় অভিনয় করে ফেরার পথে দূর্ঘটনা, মৃত্যুর শেষদিন পর্যন্ত পঙ্গু অবস্থায় শয্যাশায়ী হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর জীবনের লড়াইয়ের সহধর্মিণী চিত্রা সেন ছিলেন ছায়া সঙ্গী। শ্যামল সেনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে স্বপ্নস্বন্ধানীর ৩০ বছর পূর্তিতে এ বছরও ৩০ মে কোলকাতার জ্ঞানমঞ্চে শ্যামল সেন স্মৃতি সম্মান ২০২২ দেওয়া হয় লোকনাথ দে এবং ভূমিসূতা দাস কে। সম্মান তুলে দিয়েছেন প্রবীণ নাট্যব্যক্তিত্ব অশোক মুখোপাধ্যায়।
২.
বেলা পড়ে আসা বিকেলের কাছে বসে প্রায় প্রতিদিনই ভাবি সময় তো শেষ হয়ে এলো। শেষ বলে নাকি কিছু নেই! তা কি ঠিক! সম্পূর্ণ মিথ্যা নয় কি! এসব অঙ্গীকার করা কথার আজকাল বড় দাম দেয় না নিউ জেনারেশন। অথচ আমি তো পুরনো হয়ে আসা রঙচটা দেয়াল তবে কেন মনে হয় আমার কাছেও এসব অবান্তর! চোখ ভারী হয়ে আসছে পাওয়ারে। আলো কমে আসছে চোখে। একটার পর একটা পাওয়ার পাল্টে যাচ্ছে ডাক্তার। পাওয়ার যোগ না হলে সব ঝাপসা। পাওয়ার না থাকলে নিজেকে অবশ, অলস মনে হয়।পাওয়ার বড় সাংঘাতিক বস্তু। যখন যার হাতে তখন সেই-ই সর্বেসর্বা। বড় বিষন্ন লাগে আজকাল, কেন জানিবা শুধুই মনে হচ্ছে সারা বিশ্বেই পাওয়ারপন্থীরা ভিড় জমাচ্ছে ক্রমশ নাট্যগ্রামে।
৩.
শহরে বর্ষা আসবে বোঝা যাচ্ছে। আনাচে-কানাচে ড্রেন সাফাইয়ের অভিযান চলছে। নাটকের দলেও সাফাইয়ের কাজ করে চলেছে নাট্যকর্মীরা। আলমারিতে, সোকেশে পুরনো হয়ে আসা ফলকগুলো সরিয়ে নতুন ফলকের জন্য জায়গা করতে হবে। বর্ষা পেরোলেই উৎসবের মরসুম শুরু হবে।
ওদিকে স্তরের উপর স্তর জমে পাহাড় হয়েছে ড্রেন গুলোতে। একদল শ্রমিক কাঁধে কোদাল নিয়ে নেমে পড়েছে একশো দিনের কাজে। সেই স্তর কেটে কেটে পাহাড়ে তুলছে তারা। একদল নেমে আসছে। দেখা হচ্ছে, কথা বিনিময় হচ্ছে। সময় ফুরিয়ে আসছে। সপ্তাহ শেষে লাইনে দাঁড়িয়ে পারিশ্রমিকের আশায় শ্রমিক। হঠাৎই বৃষ্টি নেমে এলো ঝমঝম করে পাহাড়ে, সমতলে। বাঁধ ভাঙা জল। এক নাগাড়ে বৃষ্টি। মাটি ধুয়ে পুনরায় যেখানে ছিল সেখানেই নেমে এলো। যে যার ঘরে পালিয়ে গেল অস্থায়ী শ্রমিকরা। পরদিন শহরে বন্যা নেমে এলো। অথৈ জল। রোজরোজ শ্রমিকের লাইন লম্বা হচ্ছে। আবার ভেঙে যাচ্ছে। আজ না হয় কাল টাকা দেবে গৌরী সেন। অপেক্ষা বাড়ছে। জল বরং বাড়ছে। দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে, জল কমছে না। চারিদিকে অসুখ বাড়ছে। ওই দপ্তরের পারিষদও আসছেন না। বহুতলে দুপুরনিদ্রায় ঘুমে আচ্ছন্ন। আজ যাই কাল যাই করে দিন কাটাছে। ক্রমশ জল ঢুকছে গ্রাম ছাড়িয়ে শহরের অলিতে গলিতে। তারপর একতলা ছাড়িয়ে দোতলায়। শহর, গ্রাম বস্তি ভাসছে। নদী, খাল কানায় কানায় পরিপূর্ণ। ড্রেন জ্যাম হয়ে গেছে মাটিতে, প্লাস্টিকে, নোংরায়। বড় বড় দমকল এলো। হাজার হাজার টাকা চলে গেল জমে থাকা জল সরাতে। বর্ষা চলে গেলে এবার ঠিক নিকাশি ব্যবস্থায় লক্ষ্য দেবে সরকার! এভাবে প্রতিবারই প্রতিজ্ঞা করে সরকারি প্রতিনিধি। ভোট আসে ভোট যায়, তারপর আবার বর্ষা আসে। তারপর আবার …
৪.
নাট্যকারদের এখন নাওয়া- খাওয়ার সময় নেই। বর্ষা আর শরতের মধ্যেই শেষ করতে হবে লেখা। নাটক। ফরমায়েশি লেখা। আবদারি লেখা, বহুদিন পেছনে লেগে থেকে লিখিয়ে নেওয়া নাটক । কোথাও অঙ্ক ভাগ, কোথাও অর্থ ভাগ। হুড়োহুড়ি পড়ে যাবে কদিন পর। বাজেট তৈরি নিয়ে কড়চা। রেপার্টারি গ্র্যান্ট, প্রোডাকশন গ্র্যান্ট রেডি করা নিয়ে দলনেতার ঘুম যাওয়ার জোগার। খরচ বাড়ছে । অনুদানের মাত্রা বাড়ছে না। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। যাতায়াতে খরচ বেড়েছে। কনসেশন উঠে গেছে। ফ্রিল্যান্সার এবার বেশি টাকা দিতে হবে জানিয়েছে। ডেট পাওয়া নিয়েও সমস্যা। রাতের দিকে রিহার্সাল করতে হবে । সুতরাং অতিরিক্ত খরচ কমাবার রাস্তা নেই। এখন আর পারিশ্রমিক ছাড়া কেউ অভিনয় করেন না গ্রুপ থিয়েটারে। সবাই অভিনেতা। কখনো বা যাতায়াতের ভাড়া দিতে হয়। টিফিনে চপ মুড়ি চলে না। বড্ড সেকেলে খাবার। চাউমিন, এগরোল চাই। কোথাও কেক, বিস্কুটে চলে যায়। গ্রুপ থিয়েটারের সেসব দায়বদ্ধতার স্বপ্নকে আজ ‘ মারো গোলি’।
ফেসবুকে বিজ্ঞাপন, নতুন অভিনেতা প্রয়োজন। দলে, মহড়ায় আসছে নতুন ছেলেমেয়েরা। নতুন স্বপ্ন নিয়ে। টিভিতে মুখ দেখানোর আশা নিয়ে। নতুন বার্তা নিয়ে পৌঁছাতে হবে দর্শকের দরবারে। গতবারের থেকেও আরো ভালো করতে হবে প্রযোজনা। এবার আরো খরচ হবে। আরো বেশি বেশি শো করা চাই ।

2 thoughts on “মনে মনে কথা, মনের কথা | অসীম দাস

Comments are closed.