অসীম দাস
এক.
‘ব্যারিকেড’— শুধু এই শব্দটাকে যদি ধরা যায় তা হলে তার অর্থ একমুখী নয়। ব্যারিকেডকে আমরা নির্দ্বিধায় মেটাফর বলতে পারি। সীমানা নির্দেশকারী ‘ব্যারিকেড’ হয়ে ওঠে প্রতিরোধের ভাষা। তবে ‘ব্যারিকেড’ শুধুই প্রতিরোধ নয়। উৎপল দত্তের ‘ব্যারিকেড’ নাটকের ৫০তম বর্ষের উদযাপন এ বছর। উৎপল দত্ত রচিত নির্দেশিত অভিনীত পি এল টি প্রযোজনা ১৯৭২ সালের ২৫ ডিসেম্বর প্রথম অভিনয় হয়েছিল। কেন আমরা ‘ব্যারিকেড’ পড়ব? এর একটাই উত্তর— প্রাসঙ্গিকতা। রাষ্ট্রকে যেখানে হাতে শিকল আর পায়ে বেড়ি পরিয়ে মানুষকে খেলার পুতুল করে রাখতে চায়, সেখানে অবশ্যই জরুরি হয়ে ওঠে কতগুলো শব্দ। মানুষের স্বাধীনতা, সাম্য এবং প্রতিরোধ। একটা আঙুলের চাইতে ক্ষমতা বেশি পাঁচ আঙুল জড়ো করে তৈরি হওয়া গোটা মুঠোর। হাতে হাত রেখে এই ‘ব্যারিকেড’ টলিয়ে দিতে পারে একটা গোটা ব্যবস্থা, সিস্টেমকে। উৎপল দত্তের ‘ব্যারিকেড’ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতর হয়েছে। কারণ আলাদা করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু এ কথা অবশ্যই বলা দরকার যে, উৎপল দত্তের ‘ব্যারিকেড’ শুধু প্রতিরোধে আটকে নেই। তা বলে যায় আরও অনেক কিছু। ‘ব্যারিকেড’ এবছর পঞ্চাশে পা রাখল।
দুই.
পুতুল নাটককে থিয়েটারের জগতে গুরুত্ব দেওয়া হলে, বিনোদনের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত সূচিত হত। এমনই মত প্রকাশ করলেন আন্তর্জাতিক পাপেটিয়ার সুদীপ গুপ্ত। বৃহস্পতিবার ২ জুন ইচ্ছেবাড়িতে শিলিগুড়ি থিয়েটার আড্ডা’র আয়োজনে বাংলা নাটক ও পুতুলনাচের হালহকিকত নিয়ে এক আলোচনাসভায় একথা বলেন তিনি। আলোচনাসভায় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট নাট্য গবেষক আশিস গোস্বামী, পাপেটিয়ার সুদীপ গুপ্ত, ভাবনা থিয়েটার পত্রিকার সম্পাদক অভীক ভট্টাচার্য এবং শিলিগুড়ির বিভিন্ন নাট্যদলের প্রতিনিধিরা।
এদিনের এই আলোচনাসভায় নাট্যপ্রেমীদের উপস্থিতি শিলিগুড়ির নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক হয়ে ওঠে। এই আলোচনাসভার সাফল্য নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন নাট্য পরিচালক পার্থ চৌধুরী। পার্থবাবু বলেন, ‘আশা করা যায়, আগামীতে থিয়েটার চর্চার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সেমিনারের আয়োজনও সফল ও সার্থক হয়ে উঠবে এই জনপদে।
এদিন আলোচনার শুরুতে থিয়েটার আড্ডার সঞ্চালক আনন্দ ভট্টাচার্য করোনাকালে নির্মিত থিয়েটার আড্ডার বৈশিষ্ট্য ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন। নাট্য গবেষক আশিস গোস্বামী শুরুতেই এই ধরনের আলোচনার গুরুত্বের কথা স্মরণ করান। অাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক পাপেটিয়ার সুদীপ গুপ্ত তুলে ধরেন পুতুল নাটকের বিভিন্ন বিষয়। তাঁর আক্ষেপ, পুতুল নাট্যকে এখনও পর্যন্ত থিয়েটারের আঙিনায় সেভাবে স্থান দেওয়া হয়নি। না হলে ডলস্ থিয়েটার বিনোদনের জগতে নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারত।
আলোচনায় বাংলা থিয়েটারের বিষয়ে আশিস গোস্বামী বলেন, সমগ্র বাংলার থিয়েটারের ডকুমেন্টেশনের অভাবে থিয়েটার শিল্প কলকাতা কেন্দ্রিক বলে পরিচিত হয়েই চলেছে। পরে ‘ভাবনা’ পত্রিকার সম্পাদক অভীক ভট্টাচার্য বিষয়টির উপর আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, ইদানীংকালে প্রসেনিয়ামের বাইরে যে সব স্পেসে থিয়েটার হচ্ছে সেগুলোও তো বাংলার থিয়েটারকে ধারণ করছে। তাই ডকুমেন্টেশনকে গুরুত্ব না দিলে এগুলো বাদ পড়ে যাবে। তিনি এতদঞ্চলের থিয়েটার বিষয়ক তথ্যাদি সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করার যে কাজ হাতে নিয়েছেন, তাতে সকলের সহযোগিতা চান। তাঁর মতে তিনিও একটা প্রসেসের মধ্যে দিয়ে পারফর্ম করেন বলেই পত্রিকা বেরোয়। তাই তিনিও পারফর্মার।
প্রাণবন্ত আলোচনা আরও জমে ওঠে প্রশ্নোত্তর পর্বে। দর্শক-শ্রোতাদের পক্ষে সঞ্জীবন দত্ত রায়, গৌতম চক্রবর্তী, বিষ্ণুজীবন রায়, পলক চক্রবর্তী, রতন নন্দী, পল্লব বসু এই পর্বে অংশগ্রহণ করেন।
তিন.
উত্তরবঙ্গের প্রথম মহিলা নাট্য নির্দেশকের নাম শেফালি রায়। সত্তরের দশকে শুধু মহিলাদের নিয়ে তিনি একটি থিয়েটারের দল তৈরী করেছিলেন। এই দলটির নাম ‘জাগরী সংঘ। জলপাইগুড়িতে প্রথম বার মঞ্চস্থ হওয়া রক্তকরবী নাটকের নন্দিনী শেফালিকে কালকাতায় তাঁর সঙ্গে অভিনয় করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু, শেফালি সম্মত হননি। সম্প্রতি জলপাইগুড়িতে আয়োজিত হল শেফালি রায় স্মারক বক্তৃতা। উদ্যোক্তা, সতী শেফালি ইন্ডিয়া পরিসর। সূচনায় মা অর্থাৎ, শেফালি রায় সম্পর্কে কথামুখ তৈরি করেন তাঁর মেয়ে মধুপর্ণা রায়। একজন ব্যক্তিত্ব হিসাবে শেফালিকে পর্যবেক্ষণ করে মধুপর্ণা দেখান যে, কতটা সং এবং দৃঢ় ভাবে তৎকালীন সময়ে একজন মানুষ শুধুমাত্র মেয়েদের থিয়েটার ফলে আবদ্ধ থেকে বহু মেয়েকে ঘরের বাইরে মুক্তির দিশা দেখিয়েছিলেন। তিনি জানান, জাগরী সংঘ সেই সময়ের একটি আন্দোলনেরও নাম। এই নাট্যদলের নাটক থেকে প্রাপ্ত লাভের অঙ্ক ব্যয় করা হত গরিব মেয়েদের উন্নতির কাছে। আমার থিয়েটার ভ্রমণে মেয়েদের আখ্যান শীর্ষক কথামালায় আশিস গোস্বামী তুলে আনেন সিরিয়া, পাকিস্তান, বাহারিন প্রভৃতি দেশের মেয়েদের প্রতিবাদী থিয়েটারের কাহিনি। শোনা যায় আমেরিকার ব্রডওয়ে থিয়েটারের একজন নারী চরিত্রর কথা। তিনি প্রচুর বেতন পান। কিন্তু তাঁর কাজ হল মূল নায়িকার বিকল্প হিসাবে প্রস্তুত থাকা। তাঁকে নিয়মমাফিক রিহার্সালও করতে হয়। কিন্তু, কোনওদিনই মঞ্চে অভিনয় করার সুযোগ পান না। আরেকটি গল্পে আশিস বলেন থিয়েটারের এমন একজন নারী চরিত্রকে নিয়ে যিনি, জীবনের অনেকটা সময় পেরিয়ে যাবার পর ভাবতে থাকেন যে, স্বামী সন্তান এবং পরিবারের বাইরে নিজের জন্যে কী করলেন? ভাবতে ভাবতে একটি দৃশ্যে তিনি নিজেই নিজের কফিনে শুয়ে পড়েন। ‘ভাবনা থিয়েটার পত্রিকা’র সম্পাদক অভীক ভট্টাচার্যের বক্তৃতার শিরোনাম ছিল, ‘মহানগরীর বাইরে থিয়েটারের মেয়েরা। লাইম লাইট থিয়েটারের বদলে তিনি বলেন গ্রামগঞ্জ এমনকী ধানখেতের থিয়েটারের কথাও। নটী বিনোদনী থেকে শুরু করে বিভিন্ন জেলার প্রান্তিক মেয়েদের থিয়েটারের গল্প অর্থাৎ, লড়াইয়ের কথা উঠে আসে তাঁর কথায়। বাদ পড়ে না মহিলা আলোকশিল্পীদের প্রসঙ্গও। শৈবাল বসু বলেন, “পৃথিবী জুড়ে এখন উচ্চাশার সময়। কিন্তু, উচ্চাশা আর স্বপ্নর মধ্যে পার্থক্য আছে। এই সব মেয়ের স্বপ্ন ছিল কিন্তু উচ্চাশা ছিল না। তাঁরা কেন্দ্র থেকে পরিধির দিকে হেঁটেছিলেন। শেফালিও তাঁদেরই একজন।
চার.
১৭ -১৯ জুন গোবরডাঙ্গা নকসা আয়োজিত নিজস্ব প্রেক্ষাগৃহে প্রযোজনা ভিত্তিক আবাসিক নাট্য কর্মশালা হয়। প্রশিক্ষক শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায়।
পাঁচ.
অশোকনগর অন্তহীন কলাক্ষেত্র আয়োজন করেছে নিজেদের অন্তহীন ইন্টিমেট স্পেসে সহজিয়া পার্বণ অন্তরঙ্গ নাট্য উৎসব ২০২২,
১৭ – ১৯ জুন, তিনদিনের এই উৎসবে নয়টি নাটক। উদ্বোধক স্থানীয় বিধায়ক নারায়ণ গোস্বামী সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির সদস্য অভি চক্রবর্তী এবং সাংবাদিক বিপ্লব কুমার ঘোষ। এছাড়া সম্মাননীয় অতিথি আশিস গোস্বামী, পল্লব পাল, অভীক ভট্টাচার্য, তমাল মুখোপাধ্যায়, সীমান্ত মৈত্র। যে নাটকগুলির মঞ্চস্থ হয়েছে — আয়োজক সংস্থার নিজস্ব দু’টি নাটক উল্কা, কালান্তক লাল ফিতে, নির্দেশনা পৃথা চৌধুরী। অশোকনগর নাট্যমুখ প্রযোজনা শিশু কিশোর নাট্য ভৌতিক পালঙ্ক, নির্দেশনা সঙ্গীতা চক্রবর্তী, নয়া রূপকথা প্রযোজনা পার্শ্বচরিত্র, নির্দেশনা উর্ণাবতী সেন। দুর্গাপুর ভীমরতি প্রযোজনা ভাঙনের পথে পরিচালনা ডি. সেন। শ্যামবাজার নাট্যচর্চা কেন্দ্রের প্রযোজনা দূর্গা টুনটুনি,নির্দেশনা মৃত্তিকা বসু।মছলী দলের গল্প কথা, প্রযোজনা চারুচর্যা হালিশহর, নির্দেশনা অনির্বান ঘোষ। শান্তিপুর সাংস্কৃতিক এর অপেক্ষার মুখ, নির্দেশনা কৌশিক চট্টোপাধ্যায়। এ এল টি প্রযোজনা কালার্স অফ লাভ, নির্দেশনা প্রবীর গুহ। এই উৎসবের প্রিন্ট মিডিয়া পার্টনার হিসেবে ছিল ভাবনা থিয়েটার পত্রিকা।
ছয়.
সম্প্রতি ১০ থেকে ১২ জুন কোন্ননগর রবীন্দ্র ভবনে হয়ে গেল অশনি নাট্যমেলা ২০২২
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছিলেন বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব দেবেশ চট্টোপাধ্যায় এছাড়া তিনদিনে মোট এগারোটি নাটক ভদ্রকালী আর্ট অ্যান্ড কালচারের আঁধার মুক্তি, যুগের যাত্রী, চন্দননগরের চাঁদ সওদাগর, নিফা, কোন্নগরের অনিকেত, নবগ্রাম কোন্নগরের
ঝিলপথ, অঙ্গণ নাট্য-কলকাতা নাট্যসেনার নাটক নয়,পান্ডুয়া চক্রবাক নাট্যপীঠের কঙ্ক ও লীলাবতী কথা, সৃষ্টি, সালকিয়ার দণ্ডপানীর দন্ড, রূপাঙ্গন মুম্বাই এর আমার মেয়েবেলা, নাট্যপ্রহরী হরিপালের নায়কের নাম খগেন, ফিনিক কাঁচরাপাড়ার বন্ধনহীন গ্রন্থি, স্বজন কলকাতার মৌমাছি এবং অশনির নিজস্ব নাটক শনিবার মঞ্চস্থ হয়।
১৮ জুন শনিবার ছিল অমল আলো উৎকর্ষ কেন্দ্রে অশোকনগর নাট্যমুখের নিজস্ব নাট্য কুহকিনী বীররাত্রির ১৭ তম অভিনয়। এদিন বর্ষাকে উপেক্ষা করে দর্শক ছিল প্রচুর। সৌমিত্র বিশ্বাসের দশরূপা উপ্যানাস থেকে নাট্যরূপ নির্দেশনা অভি চক্রবর্তী।