মনশিক্ষার গান | দীপা ব্রহ্ম, পর্ব – ২৪

আত্মজ্ঞান বিনে ভজন সাধন অসার হয়ে যায়। লালন সাঁই-এর এহেন মনোবিচার থেকেই আমরা অনেক অনেক কিছু শিখি বা শেখার চেষ্টা করি। আচ্ছা আত্মজ্ঞান লাভই কি ভজন সাধনার মূল বিন্দু ? শুধু কাঠের মালা জপলেই কি সাধনা হয়? পাশাপাশি মন বলতে চায় ঠিক-ঠিক যোগ সাধন করলে সাধনের জ্যান্ত অবস্থায় মরা রূপ হয়। এমনই হাজারো গুপ্ত জ্ঞান মনশিক্ষার ব্রতে আমাদের ভাবিত করে। লালনসাঁই বা তার গুরু সিরাজ সাঁই এভাবেই মনশিক্ষণ করেছেন। মনের মানুষের অ-পৃথিবীগত জ্যোতিষ্ক দেখতে গেলে কামকক্ষে কপাট দিতে হবে। কীভাবে তা সম্ভব? মনশিক্ষা গ্রহণ করেই কি এ বাঞ্ছার পূরণ হবে?

সাঁইজি বলেন, ধারাবাহিক প্রাণায়ামে নিজের মধ্যের চন্দ্র অগ্নিকে প্রতিহত করাই মন
শিক্ষার পরম কথা। এজন্য প্রয়োজন আত্মজ্ঞান-আত্মসমীক্ষা। এমনই এক মানুষের সঙ্গে কথা হল যিনি মনশিক্ষার গান করেন। মাটির মায়ার সেই চাহনি আমাকে লালন সাঁই-এর ভাবনার অন্তর্নিহিত অতলান্ত জীবনবোধকে স্পর্শ করালো। তার নাম রাজেন বর্মন। মনশিক্ষা গানের প্রচারক মানুষটি থাকেন উত্তরবঙ্গের মাটিগাড়া গ্রাম পঞ্চায়েত অঞ্চলে। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। এই পঞ্চ ব্যঞ্জন দিয়ে তাঁর রন্ধনশালায় মন-উপাদেয় খাদ্য সামগ্রীর জন্ম হয়। কনট্রাকটারির মতো বস্তুগত কাজে যুক্ত থাকা এই মানুষটি কোন রহস্যের বেড়ায় আটকে গেলেন এই মনশিক্ষার রহস্যময়তায়—তা তিনি নিজেও জানেন না।

প্রতীকে ভাস্বর মানুষটি শোনালেন তাঁর জীবনবোধ থেকে উঠে আসা কিছু ‘সুরচিন্তা’ যা মনকে শিক্ষা দেয়। গত চোদ্দ বছর এ রহস্য ভেদে মগ্ন তিনি। সংগীত তাঁর হৃদের খাদ্য। জীবনকে বোঝাবার দায়িত্ব নিজের কাঁধে চাপিয়েছেন। ‘গুরু কৃপাহি কেবলম।’ এই বোধে আচ্ছন্ন তিনি। পৃথিবীতে কীভাবে ‘প্রাণ’ জঠরযন্ত্রণা ভেদ করে এল, অত্যন্ত সুন্দর ব্যাখ্যায় শোনালেন রাজেন বর্মন। মানব শরীরে আঠারো মোকামের কোথায় কী, তার অনুসন্ধানই, তাঁর গানের মূল উপজীব্য। গানে সংগত করে খোল, খমক, দোতারা, হারমোনিয়ামের মতো যন্ত্র। যেন একশরীরে হরেক ইচ্ছার কেন্দ্রমণ্ডল।

‘পরম আত্মা বাইরে নয় আছে এই শরীরেই’—রাজেন বর্মন তাঁকে উপলব্ধি করতেই এই গান করেন এবং অত্যন্ত যত্ন ও ভালোবাসায় এই ভক্তি-সংগীত গীত হয়—
ভবে দুর্লভ জনম পেনো গুরুর চরণ কেন রইলাম ভুলে? দার্জিলিং হইতে দ্রুত গতি এসে জলপাইগুড়িতে রইলাম ভুলে? দার্জিলিং হইতে দ্রুত গতি এসে জলপাইগুড়িতে রইলাম ভেসে। করেছিলাম আশা, দিয়াছে ভরসা, গুরুর চরণ কেন রইলাম ভুলে? কলিকাতা হয়ে এলাম বাহির হয়ে ময়মনসিংহের কথা রইলাম ভুলে। মালদাহ হইতে মানবাতা লয়ে বরিশালে রইলাম বোকা সেজে।

স্থান রূপকের আড়ালে শরীরের অংশ ভাগের বর্ণনায় দড়ো রাজেন বর্মন। ময়মনসিং অর্থাৎ মন। মালদা অর্থে মায়ের গর্ভ। কলিকাতা মায়ের গর্ভ থেকে বের হওয়ার পথ। বরিশাল অর্থ এই ভবের হাট। রাজেন বর্মনের আক্ষেপ ‘তিনি’ যে কোথায় গেলেন তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। না, এ তাঁর পেশা নয়, শুধু মানুষ-প্রচারে বুঁদ হয়ে দেশান্তরে তাঁর ব্যাখ্যা পৌঁছে দেন সফরে। মানুষ রে তুই সমস্ত রাত জেগে নতুন করে পড় জন্মভূমির বর্ণ পরিচয়’—কবিতার এই মর্মে আবিষ্ট রাজেন বর্মন। বীজ মন্ত্রে দীক্ষিত তিনি। অজান খবর তাঁর চারপাশের মানুষকে জ্ঞাত করাতে চান। পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রে সবার ওপরে রয়েছে দার্জিলিং। মানচিত্রের চিত্রায়ণে এ জেলাকে ‘পিতার ইচ্ছা’ হিসেবে বর্ণনা করেন মনশিক্ষক রাজেন।

সেভাবেই অবিভক্ত বাংলার স্থান মানচিত্রে অঙ্কিত হয়েছে এ নশ্বর মানব শরীর –মাছ মারো, মাছ বেচো, মাছ খাও, কিন্তু জেলের নাম নিও না।’ দেহজমিন চাষ করতে হবে ঠিকই তবে তার মধ্যেও থাকবে সমজদারি। সংসার যেন না হয় বড়ো। ঈশ্বর চেতনা। বাদ দিয়ে শরীরকে শুধু আনন্দ দানে যেন মস্ত না হয়ে ওঠে মন। সংসার বৃদ্ধি মানে পুত্ৰ সংখ্যা বৃদ্ধি। ছয় পুত্র অর্থাৎ হয় রিপু। এই রিপু নানা দিকে টান দিলে গুরু চেতনায় পড়বে ছেদ। এই কলেবর তাই গুরুমুখী করতে নিজ সাধ্যের মধ্যে নিজের বাহনগুলোকে অর্থাৎ মনোবাসনা, কামনাকে বাগিয়ে রাখতে হবে। তবেই সেই পরমাত্মাকে স্পর্শ করার ক্ষণ উপস্থিত হবে। আর গুরুবস্তু না চিনলে এ ভব সাগরে জীবন অসাড়।

পরমাত্মার বিনাশ ঘটবে। বিপথগামী মন সব কিছু ধ্বংস করে বসবে। তখন এই দুর্লভ জনম’ তার সুগমতা হারিয়ে বিপথগামী হবে নানা কানা গলিতে। রাজেন বর্মন তাঁর কোনও শিষ্য তৈরি করতেও ইচ্ছুক নন। তিনি মনে করেন এই গুহা-জ্ঞান আত্মস্থ করার সময় এখনও তাঁর পরিপূর্ণ হয়নি। সেই ঘড়া ভরণেই তাঁর এই নির্দিষ্ট মনুষ্য জীবন অতিবাহিত হয়ে যাবে। নিজেই যদি না হতে পারেন পরিপূর্ণ, ধ্যান-ধারণা যদি স্পষ্ট না থাকে, কীভাবে অন্যকে সেই ভাবধারায় প্রতিস্থাপন করা যাবে? এ তাঁর অব্যর্থ প্রশ্ন। তাই মনশিক্ষার অনুগত ছাত্র তিনি। প্রতি ক্ষণে, প্রতি অনুষ্ঠানের রাতে আখরার প্রতিটি ব্যাখ্যা-সংগীতকে মনশিক্ষণের এক একটি অধ্যায় মনে করেন রাজেন বর্মন। এর মাধ্যমেই চলে তাঁর স্বশিক্ষণ। এভাবেই তিনি তাঁর পাশের মানুষটিকে নিজ আধারে জারিত করেন। এটাই হৃদ-শিক্ষা, হৃদ অনুভূতি, যার ব্যখ্যা চিরায়ত, যার খোঁজ-খনন অনিমেষ।

One thought on “মনশিক্ষার গান | দীপা ব্রহ্ম, পর্ব – ২৪

  1. দীপাদির এই লেখার মূল্য বাংলা থিয়েটার নিশ্চয়ই একদিন দেবে।
    অশেষ ধন্যবাদ।

Comments are closed.