মানুষের অবচেতন মনের ক্রূরতা, লোভ, রিরংসার গল্প ‘মিস্টার রাইট’ | মৌমিতা ঘোষ

মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের নাটক এর আগেও মঞ্চস্থ করেছেন অভির চক্রবর্তী দল অশোকনগর নাট্যমুখ। ছোট নাটক রূপে প্রায় পনেরো বছর আগে। এই সেই নাটক মিস্টার রাইট। তবে তা অভির পরিচালনা ছিলনা। অভি শুধু অভিনেতা ছিলেন সেখানে। যাহোক এই নাটকটি মঞ্চস্থ করার সময় এখনের অভি আরো অনেক পরিণত। নাট্যের ভাষা তার করতলগত, তার নির্দেশিত অন্যান্য নাট্যের মতোই। প্রতিটি মানুষের মধ্যে এক অন্ধকার দিক থাকে। যে অন্ধকার দিককে সে নিজেই চেনেনা। অবচেতনে সেই অন্ধকার চেহারা থাবা বসায়। আঁচড়ে ফালাফালা করে যা কিছু সুস্থ, যা কিছু সুন্দর। আমরা প্রত্যেকে জানি কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল। অথচ ভুলগুলোর প্রতি কী অনায়াসে হাত বাড়াই, বুক কাঁপে না, হাত সরে আসে না, অভীপ্সটি হাতিয়েই ছাড়ে। মিস্টার রাইট তেমনই একটি গল্প বলে। মানুষের অবচেতনে সযত্নে লালিত ক্রূরতা, লোভ, রিরংসার গল্প। টাকা চাই আমাদের, টাকার সঙ্গে আসে মদ, মাংস, নারী, কাম … সব কিছু লুটে নেওয়ার চাহিদা। মিস্টার রাইটের কেন্দ্রীয় চরিত্র রজতেরও তাই হয়। তার ডান হাত তার কালো দিকের মুখচ্ছবি। সে তার কন্ট্রোলে থাকে না, তার সব চাই। বীরভোগ্যা এ পৃথিবী, সেই মিথ্যে বীর হতে চায় সে। বারে বারে তার ডান হাতকে শাসন করে বাম হাত, তার শুভবুদ্ধি, সামলাতে পারে না।

এই জায়গাটি, এই নিজের মধ্যে শুভ অশুভের দ্বন্দ্বটি অভিনেতা অসাধারণভাবে তুলে ধরেছেন। যেভাবে প্রতিবারে ডান হাতকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া, প্রাণপণ অন্যায় না করতে চেয়ে শেষমেশ হেরে যাওয়া, এটির প্রকাশ ঘটিয়েছেন অভিনেতা তার শরীরি প্রকাশে, তার ফেসিয়াল এক্সপ্রেশনে তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। লোভ, রিরংসার সঙ্গে লাল আলোর ব্যবহার যেভাবে করেছেন অভি তা প্রশংসাযোগ্য শুধু নয়, আধুনিক এবং জরুরি প্রয়োগ। গুরুদেব (সুকান্ত পাল) জুটে যায় এদেশে যেখানেই অন্যায় থাকে, টাকা থাকে, আর আধুনিক সভ্যতায় গুরু, আশ্রম সবকিছুর সঙ্গে থাকে মানুষের আদিমতম ইচ্ছা, যৌনেচ্ছা। সেটিকে অভি, নিজের মতো করে দেখিয়েছেন, কেননা অভির পরিবেশনা বরাবর খুব আরবান, অভি আধুনিক চিত্রকল্প তৈরি করতে ভালোবাসেন। ‘নেমেসিস’ থেকে ‘আমি অনুকূল দা আর ওরা’ হয়ে অভি এই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন স্বচ্ছন্দে। যদিও আমার ব্যক্তিগতভাবে গুরুর সঙ্গে আসা মহিলাদের ঘনিষ্ঠ দৃশ্য একটু বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে মানে এসথেটিক্সের অভাব ছিল।অন্যভাবেও আমার মনে হয়েছে দৃশ্যটি পরিকল্পনা করা যেতো।‌

মঞ্চের মাঝখানটিতে পিছনের দিকে যে বড় একটি উঁচু আলোসহ রাস্তা বানানো হয়েছিল তা বিভিন্ন সময়ে নায়কের (সুমিত কুমার রায়) মনের মধ্যে চলা নানারকম অনুভূতিকে চমৎকারভাবে সঙ্গত করেছে। এক্ষেত্রে অভিকে দশে নয় দেওয়া যায়। বডি মুভমেন্ট,আলোর ব্যবহার চমৎকার। প্রাক্তন প্রেমিকা (সংগীতা চক্রবর্তী) না কি বান্ধবী! যার কাছে রজত একজন খুনি, তাদের দুজনের যুদ্ধ শুধু ফিজিকাল নয়, অনেক বেশিগুণে তা মানসিক। এই জায়গাটি আলো,অভিনয়, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন নির্দেশক। তন্দ্রার ভিতরে উত্তর খুঁজে চলা ক্লান্তি আর নায়কের অপরাধবোধ, একইসঙ্গে নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করতে না পারার অসহায়তা অসম্ভব মুন্সিয়ানার সঙ্গে প্রকাশ করেছেন দুই অভিজ্ঞ অভিনেতাই।

নায়কের বন্ধু ও সাইক্রিয়াটিস্টের ভূমিকায় অভিনয় করা অভি অভিনেতা হিসেবে যথেষ্ট জাস্টিফাই করেছেন নিজেকে, সামান্য সুযোগেই। যে দৃশ্যে আমি সর্বাপেক্ষা মুগ্ধ হয়েছি, তা হলো যেখানে শুধু মাত্র একটি নেটের ঘেরাটোপ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে রেস্টুরেন্ট টেবিলের প্রাইভেট কেবিন ও আমাদের কেন্দ্রীয় চরিত্র মিস্টার রাইটের মালিক লোভের বশে হারিয়ে ফেলছেন নিজেকে, শরীরী গন্ধে খালি করে ফেলছেন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, বিশ্বজোড়া লোভের ফাঁদ তাকে ঘিরে ফেলেছে ওই নেট দেওয়া, নীল আলোর মঞ্চের কেবিনে। দৃশ্যটি মনে রাখার মতো। এখানে অভির মঞ্চ ও আলোর ভাবনা দর্শককে অভিভূত করে দেয়। সঙ্গে ছোট চরিত্রে নিজের জাত চিনিয়ে দ্যান বাবি ওরফে জয় চক্রবর্তী।

ইতিমধ্যে তন্দ্রার বর্তমান প্রেমিক তথা রনেন যাকে গাড়ির তলায় পিষে মারার অভিযোগ ও অভিযোগকে অস্বীকার করার কনফিউশনের মধ্যে দিয়ে নাটকের শুরু, নাটকের চলন, সাবকনসাসের কনসাস মাইন্ডকে অধিগ্রহণ করে নেওয়া, প্রমাণিত হয় সে ছেলে নিজেই মুক্তি খুঁজছিল, সে নিজেই এ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মারণ রোগে আক্রান্ত ছিল যার নাম অবসাদ। যা চাইছি, যা পাচ্ছি, যা দেখছি, যে কনটেন্ট গিলছি, যা ঘিরে থাকছে সবকিছুর মধ্যে ভয়ঙ্কর ভারসাম্যহীনতা আজকের পৃথিবীতে। তাই নায়ক, তার প্রাক্তন প্রেমিকা, সেই প্রেমিকার নিহত প্রেমিক সকলেই আক্রান্ত এই ব্যাধিতে। তাই ডানহাত, কালো হাত সরে গিয়েও সরে না, সেরে গিয়েও থেকে যায় সে গভীর অসুখ। আমাদের কে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে রাখে, পৃথিবীর গভীরতম অসুখ কে সারাবে? সকলেই তো আক্রান্ত!

নিজের মধ্যে শুভবোধকে জাগিয়ে রাখার দাবিটি রাখে এ নাটক। নিজের সিদ্ধান্তকে প্রশ্ন করার সাহস যোগায় এ নাটক। “সব চলতা হ্যায় ” এর যুগে, কোথাও রাশ টানতেই হবে, নাহলে সমূহ সর্বনাশ, তার বার্তাটি দিয়ে যায় এই নাট্য। অত্যন্ত স্মার্টভাবে একটি সিরিয়াস গল্পকে দেখানোর জন্য আরেকবার ধন্যবাদ অশোকনগর নাট্যমুখকে।

5 thoughts on “মানুষের অবচেতন মনের ক্রূরতা, লোভ, রিরংসার গল্প ‘মিস্টার রাইট’ | মৌমিতা ঘোষ

Comments are closed.