মৃত্যুচেতনার ওপারে রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ | রঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়

জীবনচেতনার ওপারে মৃত্যুচেতনা খেলা করে। আসলে খেলা করে কথাটি যে অর্থে খেলা করা বলে তা নয়। খেলা মানে একটা নির্বিকারত্ব। কারণ তার কাছে আসতে হবে সবাইকে, হাত ধরবেই সবার। ‘নাচে জন্ম, নাচে মৃত্যু পাছে পাছে।’ মানুষ যত পৌঁছতে থাকে, জীবনের উপান্তে, তত মৃত্যু চেতনা তাকে ঘিরে ধরে, সে একা হয়ে যেতে থাকে। মৃত্যুচেতনা অন্ধকারের ডানা মেলতে থাকে জীবন চেতনার সীমান্তে। মৃত্যুর রহস্যময়তা তাকে ঘিরে ধরতে থাকে। মৃত্যু চিররহস্যময়। জীবিত মানুষ তার রহস্য ভেদ করতে পারে না, মৃত মানুষ জানাতেই পারেনা, মৃত কি, কেন। মানুষ ভুলে যায়, জীবন থাকলে, মৃত থাকবে। জগতে চিরস্থায়ী কিছু নয়। আসল জীবনকে মানুষ দেখতে পায় না, কেন সে দেখতে পায় না, কেমন সে দেখতে, সে কোথায় নিয়ে যায়, মৃত্যুর পর পরিণতি কি হয়, এইসব প্রশ্ন অসহায় মানুষকে জীবনচেতনা থেকে ধীরে ধীরে মৃত্যুচেতনার অন্ধকারে নিয়ে যায়। পথ কোথায় এই অন্ধকারে?

মহাপ্রজ্ঞাবান রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুচেতনার ওপারে দাঁড়িয়ে আছেন আলো হাতে, ‘ডাকঘর’ এর অমল হয়ে। অমল মৃত্যুকে তুচ্ছ করেছিল, তাই মৃত্যু তাঁকে ছুঁতে পারেনি। জাগতিক পৃথিবীতে জীবনের পূর্ণচ্ছেদ মানে মৃত্যু, আমরা এমনই জানি। এই মৃত্যু হয়তো অমলের হাত ধরেছিল, কিন্তু ‘জীবন – মরণের সীমানা ছাড়ায়ে বন্ধু হে আমার রয়েছ দাঁড়ায়ে’– সেই বন্ধু সব মৃত্যুর সীমার ওপারে অপেক্ষা করেছে অমলের জন্য। তাই জাগতিক মৃত্যু বা জীবনের পূর্ণচ্ছেদ এখানে মিথ্যা, সত্য সেই বন্ধু-র হাত ধরা বা সেই পূর্ণতার বা রাজার হাত ধরা। অমল সেই বন্ধুর হাত ধরেছিল, সেই পূর্ণতার পথে যাত্রা শুরু করেছিল। এই পথেই মৃত্যুচেতনা বা মৃত্যুভয় কে জয় করা যায়। জীবনের রঙ আর আলো দু-হাতে কুড়িয়ে ছিল অমল।

অমল বিশ্বলোকে মুক্তি খুঁজেছিল— ‘এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’ । এত এত পুঁথি পড়ে সে পণ্ডিত হতে চায়নি। দইওয়ালার কাছে সে দই বেচার সুর বা মন্ত্র শিখতে চেয়েছিল। প্রহরীকে সময়ের ঘন্টা বাজাতে বলেছিল, ক্রৌঞ্চদ্বীপের পাখিদের মতো রং-বেরংয়ের পাখি হতে চেয়েছিল।  সুধা মলিনীর কাছে সকালের ফুল চেয়েছিল আর অপেক্ষা করেছিল রাজার চিঠির জন্য। প্রাত্যহিক সংসারের লেনদেন, হিসাবে বন্দী ক্ষণকাল তাকে বাঁধতে পারেনি, সীমা বা শেষের সঙ্গে তার সংখ্যতা হয়নি। প্রতিনিয়ত দৈনিক জীবন প্রবাহের সঙ্গে ছন্দ মেলাতে চাওয়া, বা মিলিয়ে চলতে চাওয়া মানুষ, যতদিন অন্তরের অমলকে জাগাতে না পারবে, যতদিন ক্ষণিক এবং ক্ষণকালের গন্ডি ভাঙতে না পারবে , ততদিন মৃত্যুচেতনা বা মৃত্যুশঙ্কা থেকে মুক্তি নেই। ‘ডাকঘর’- এর অমল বা ‘ডাকঘর’-এর রবীন্দ্রনাথ সেই মৃত্যু চেতনার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা জীবন চেতনার মুঠো মুঠো আলো।

১৯৪২ সালের ১৮ জুলাই সভ্যতার ইতিহাসের এক বিশেষ দিন। ঐ দিন পোল্যান্ডে হিটলারের মৃত্যু পুরীতে ‘ডাকঘর’ অভিনীত হয়েছিল। জাতিতে ইহুদী ইয়ানুস কোর্চাক একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, রবীন্দ্র-অনুরাগ তাঁর অনাথ আশ্রমের শিশুদের দিয়ে ‘ডাকঘর’ অভিনয় করিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, মৃত্যুভয় জয় করে শিশুরা যাতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারে। মৃত্যুপুরীতে জীবনের জয়গান গাইলেন কোর্চাক এবং তাঁর শিশুরা। ‘ডাকঘর’- এর রবীন্দ্রনাথ বা রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ এমনিভাবেই মৃত্যুরচেতনা বা মৃত্যুভয় কে জয় করার উদ্দীপনা ভরে দেয় মানুষের মধ্যে, জাগতিক মৃত্যু তুচ্ছ হয়ে যায়।

অমল রয়েছে আমাদের সবার মধ্যে যাকে আমরা খুঁজে পাইনা সহজে। অন্তরে কারণ না খুঁজে বাহিরে মিথ্যে খুঁজে বেড়াই তাকে। অমলকে জাগাতে পারি না বলেই, মৃত্যুচেতনা আমাদের পিছু ছাড়ে না, আমরা রাজ কবিরাজকে চিনতে পারি না, ‘রাজার চিঠি’ আর আসে না, প্রহরী-র বাজানো ‘কালের ঘন্টা’ শুনতে পাই না, সুধা মালিনী প্রথম সকালের ফুল নিয়ে আর ফিরে আসে না।