দীপা ব্রহ্ম
ঘরের মাঝে অনেক আছে
কোন ঘরামি ঘর বেঁধেছে,
এক পাড়ে দুই থাম দিয়াছে
সে ঘরের ছাউনি আছে,
চামের এক বেড়া আছে
আর একটি বাতি আছে,
নিবায় বাতি কুবাতাসে।
এই কুবাতাস ভেদ করার মরমি সাধনার সন্ধান মেলে লোকশিল্পে। লোকমাহাত্ম্য, লোকভাষা বড়োই সরল। কিন্তু অবগাহনের প্রতিক্ষণে যুক্তির বোধ গড়ে তোলে। মানুষের প্রাথমিক সৃষ্টি সূত্রে দেয় টান। জটিল থেকে জটিলতর সমাজ দর্পণে ফুটে ওঠে আলো-আঁধারির কত শত মুখ। তারা মানেনা কোনো বিভেদ। জাতিসত্তা, উলম্বিত স্থান সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে একটাই আওয়াজ তোলে, আমরা মানুষ, মানুষই আমার পরিচয়। হিন্দু-মুসলমান উভয়ের সাথে পিরবাবাদের প্রভাব বলা যেতে পারে সম্প্রীতির বার্তা বহন করে। সরল, সাধাসিধা মাটির মানুষের জীবনে অন্য ভূমিকায় আবর্তিত হয়। মনে আছে, আমাদের ছোটোবেলায় হাতে কালো চামর নিয়ে সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে এক পিরবাবা আমাদের বাড়ি আসতেন। মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার প্রার্থনা জানিয়ে মাথায় চামর ছোঁয়াতেন। বাংলার অকৃত্রিম গ্রাম্য-লোকসংস্কৃতির সঙ্গে পাঁচ পিরের নাম জড়িয়ে রয়েছে। এঁরা হলেন—গাজিপির, সত্যপির, মানিকপির, দাতাপির, দরিয়াপির। এঁরা গ্রামের মানুষের মুখেমুখে ফেরেন অত্যন্ত অন্ধার সঙ্গে।
কথা হলো উত্তর ২৪ পরগণার হিঙ্গলগঞ্জ থানা এলাকার ৪নং সান্ডিল্যের বিল অঞ্চলের বাসিন্দা আহম্মদ গাজির সঙ্গে। ইনি মানিকপির বাবার গান করেন। তাঁর থেকেই শুনলাম মানিকপিরের কিসসা-কাহিনি।
আরব দেশের কোনো এক শহরে বাস করতেন বাদশা করমদিন ও তাঁর বিবি দুধবিবি। তাঁদের কোনো সন্তান ছিল না। একদিন নামাজ পরে অন্ধেয় আল্লার কাছে তাঁরা সন্তানের জন্য প্রার্থনা জানান। তখন আল্লা তাঁদের প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে মানিকপিরকে বলেন, “তুমি দুধবিবির গর্ভে জন্ম নাও।” এও বলেন, “তুমি অপুত্রকে পুত্র দেবে, কাঙালকে ধন দেবে, ব্যারাম হলে তার আরোগ্য কামনা করবে।”
এছাড়া সব রকম গবাদি পশুর শুভাকাঙ্ক্ষী-রক্ষক হয়ে তাঁকে এ পৃথিবীতে জন্ম নিতে আজ্ঞা দেন তিনি। মানিকপিরবাবা বিদায়কালে ফের আল্লার সঙ্গে একাত্ম্য হওয়ার বাসনা প্রকাশ করলে আল্লা তাঁকে অভয় দিয়ে বলেন, এই পৃথিবীর যেখানেই তিনি তাঁকে স্মরণ করবেন, সেখানেই তিনি তাঁকে পাবেন। আল্লার সত্য-অঙ্গীকার নিয়ে মানিকপির দুধবিবির গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। এরপর থেকে গরুর রোগবালাই সারানোর জন্য গ্রামের সরল মানুষজন মানিকপিরকে স্মরণ করেন। গোরুর রোগ সারানোর জন্য মানত করেন সেখানে মানিকপিরের পালাগান অনুষ্ঠিত হয়। আহম্মদ গাজি তাই জানান, মানিকপিরের সাতটি পালা তারা করে থাকেন। জন্মবৃত্তান্ত পালা, মানিকপিরের ফকির হওয়ার পালা, কামুখ্যার পালা, কানুঘোষের পালা, কাঠুরিয়ার পালা, ইসপ কাঠুরিয়ার বিবাহ পালা, মানিকপিরের বিদায় পালা। এছাড়াও গরুর কেন একপাটি দন্ত এ বিষয়েও অজানা খবর এই পালার মাধ্যমে প্রচলিত আছে।
প্রতিটি পালার সময়কাল প্রায় ৩০ মিনিট। পাঞ্চাবি, পাজামা, মাথায় পাগড়ি, হাতে কালো চামর নিয়ে এ পালা হয়। কখনও গৃহস্থের বাড়ির উঠোনেও এ পালা চলে। আহম্মদ গাজি ও তাঁর সম্প্রদায় এ পালা পরিবেশন করেন। তাঁর দলে আছেন মূলত পাঁচজন। খঞ্জনি, হারমোনিয়াম, দোতারা, ঢোল-বাদ্য সহযোগে চলে এ পালা। সংগঠক বা গৃহস্থের চাহিদা অনুসারে কোথাও তিন পালা, কোথায় পাঁচ পালা, আবার কোথাও সাত পালা করেন তাঁরা। মূল গায়েন ও দোহারিরা এ পালায় মানিকপিরের কথা ছন্দে-ভাষ্যে তুলে ধরেন।
আহম্মদ গাজি, তাঁর বাবা আতর আলি গাজির থেকে এ পালা শিখেছেন। এখন তাঁর ভাই আখতার আলি গাজিও এ পালায় অংশগ্রহণ করেন। পেশায় ইলেকট্রিক-এর নানা জিনিস মেরামতকারী এই মানুষটির শিল্পীসত্তা তাঁকে নাগরিক সভ্যতা থেকে অনেক দূরে রেখে জল-জঙ্গলের দেশে মহান একটি কাজে ব্রর্তী করেছেন। নানা প্রতিবন্ধকতাকে হেলায় হারিয়ে জাতিভেদকে অনায়াসে ভুলিয়ে তাঁর একান্ত ইচ্ছা এই মানিকপিরের গানকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া। তাই পারিশ্রমিক ছাড়াই তিনি গ্রামের বহু ছেলেকেই মানিকপিরের গান শেখান। পালার মর্ম আলোচনা করেন।
মানিকপিরের যাঁরা প্রচারক, তাঁরা মূলত গৃহপালিত পশুর নানা রোগ, মড়ক থেকে বিরত থাকার জন্য ওষুধের বিধান দেন, “চৌষটি বেয়টি গোরুর চৌষট্টি দাওয়াই”-এর প্রচারে মানিকপির সাহেবের ওষুধ প্রয়োগের কথা বলা হয়। “গোরুর জিহ্বাতে হইলে কাঁটা গলায় হইলে ফোলা, হাতেতে লবণ দিয়া দিবেন তাতে ডলা।” “ঔষুধি-ছড়া” থেকেই বোঝা যায় মানিকপির কেন গ্রাম-জনগণের এতো শ্রদ্ধার। অন্যদিকে ধর্মান্ধতাকে ভুলে সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে আহম্মদ গাজি ও তাঁর সম্প্রদায় তাঁদের যে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তা বর্তমানে এক অন্য বার্তা নিয়ে আসে। ভবিষ্যতে আগত সব কালোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বলে, ‘একই রক্ত বুকের তলে এক সে নাড়ির টান।’ সবাই ভালো থাকুন। “মানুষ” ধর্মের জন্য হোক।