নবমিতার কাছে থিয়েটার আসলে অক্সিজেন – বিজয়কুমার দাস

উত্তর কলকাতার দমদমে লেখাপড়া ও বেড়ে ওঠা নবমিতা ঘোষের। নবমিতা কয়াডাঙা সবুজ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের একজন দায়বদ্ধ অভিনেত্রী। শুধু অভিনেত্রী বললে ভুল হবে, দলের নানা কাজকর্ম সামাল দেয় নবমিতা। তরুণ পরিচালক রাজেশ দেবনাথের নেতৃত্বে সবুজ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থিয়েটারের মানচিত্রে উঠে আসা একটি উজ্জ্বল নাম। সেই দলই নবমিতার ধ্যানজ্ঞান। দমদমে গভর্নমেন্ট স্পনসর্ড গার্লস হাই স্কুলের ছাত্রী ছিল নবমিতা। তারপর কুমার আশুতোষ থেকে বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ। পরে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর। কিন্তু থিয়েটারকে ভালবেসে অবশেষে থিয়েটারেই জড়িয়ে যাওয়া। একসময় মনে হয়েছিল, নিজেকে প্রকাশ করা এবং নিজেকে আবিষ্কার করার সবচেয়ে ভাল মাধ্যম হল থিয়েটার। রবীন্দ্রভারতীতে পড়ার সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক বিভাগের কিছু বন্ধু জুটে গিয়েছিল নবমিতার। আর সেই অবকাশেই থিয়েটারের পোকা ঢুকে পড়েছিল তার মাথায়। সেইসব বন্ধুদের সূত্রেই নাটকের দলে যুক্ত হওয়া নবমিতার। অথচ বাড়িতে ছিল গানের চর্চা। ছোট থেকেই গান শিখতে শুরু করেছিল। স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান – নাটকে অংশগ্রহণ করেছে। পরবর্তীতে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সূত্রে নাট্যচর্চা বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়। “মঞ্চে নামা” অপেক্ষা “মঞ্চে ওঠা” শব্দটি তার কাছে বিশেষ জরুরী। সেই অর্থে ২০১০ সালে নবমিতা প্রথম সচেতনভাবে থিয়েটারে নিবেদিত প্রাণ হয়ে মঞ্চে উঠেছিল। সবুজ সাংস্কৃতিকের NO OR IT MAY BE নামে সেই নাটক থেকেই কার্যত নবমিতার থিয়েটার যাপন শুরু। পাভলভ দাস বৈরাগ্য ছিলেন এই নাটকের নাট্যকার।তবে পরবর্তীতে অভিনয়ের পাশাপাশি রিহারসাল শুরুর দিন থেকে নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার দিন পর্যন্ত সব কাজে হাত লাগানোকেই নবমিতা একজন থিয়েটারকর্মীর দায়বদ্ধতা বলে মনে করে। ব্যাকস্টেজ ম্যানেজমেন্ট, মিউজিক, মেকাপ, কস্টিউম, প্রপস সমস্ত কিছু সামলে নবমিতা অভিনয় করে বিভিন্ন নাটকে নিজের অভিনীত চরিত্রে। সব কাজটাই সে করে থিয়েটারকে ভালবেসে। কয়াডাঙা সবুজ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থেকেই থিয়েটার করা শুরু। সেই দলের এখন গুরুত্বপূর্ণ একজন নাট্যকর্মী নবমিতা।সবুজ সাংস্কৃতিকের কর্ণধার রাজেশ দেবনাথ নবমিতার পরিচালক, নাট্যগুরুও। থিয়েটার প্রশিক্ষণে কর্মশালাকে গুরুত্ব দেওয়ার পক্ষপাতী নবমিতা।নিজেদের দলে প্রতি বছর নাট্য কর্মশালার আয়োজন করা হয়। সেই সূত্রে গৌতম হালদার, অদ্রিজা দাশগুপ্ত, আশিস চট্টোপাধ্যায়, দেবাশিস দত্ত, শুভদীপ গুহ, তথাগত চৌধুরী, রণেন চক্রবর্তী, ওমপ্রকাশ কর্ণ, লাকীজি গুপ্তা প্রমুখ বিশিষ্ট নাট্যজনদের সান্নিধ্য এবং প্রশিক্ষণ নবমিতার নাট্যজীবনকে সমৃদ্ধ করেছে। অভিনয় ছাড়াও বিভিন্ন কর্মশালায় দেশ বিদেশের গুণী মার্শাল আর্ট শিল্পীদের কাছে ছৌ, কালারিপায়াত্তু, কাপুয়েওয়ারা ইত্যাদি প্রশিক্ষণের সুযোগও জুটেছে নবমিতার।২ ০১৭ সালে ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার একটি কর্মশালায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ মিলেছিল এবং সেখান থেকে ডিপ্লোমা ডিগ্রির কোর্সও করেছে নবমিতা। আবার থিয়েটারের বিস্তৃত পরিধিতে প্রবীর গুহ, শুভদীপ গুহ, অবন্তী চক্রবর্তী, অনীশ ঘোষ, ইন্দ্র মুখোপাধ্যায়, প্রমুখ থিয়েটার নির্মাতার সঙ্গেও কাজের সুযোগ মিলেছে। লকডাউন থিয়েটারে আঘাত হেনেছে। তবু নবমিতা এবং নবমিতার দল এই লকডাউন কালেও অনলাইনে দেশ বিদেশের থিয়েটার নিয়ে ফেস্টিভ্যালের পাশাপাশি নতুন নাটক নির্মাণ করেছে। থিয়েটারের মত একটা মাধ্যমকে পেশা হিসাবে বেছে নেওয়া ঝুঁকি জেনেও থিয়েটারকে ভালবেসেই থিয়েটারে থেকে যেতে চায় নবমিতা। কারণ থিয়েটার তার কাছে ভালবাসার ক্ষেত্র, আবার রুটিরুজির মাধ্যমও। লেডি ম্যাকবেথ চরিত্রে অভিনয় তার জীবনের সেরা সঞ্চয়। থিয়েটারে অভিনয় ছাড়াও সহ নির্দেশক, নির্দেশক হিসাবে চলচ্চিত্রের সাথে যেমন যুক্ত, তেমনি মডেলিং এর সাথেও যুক্ত। বাড়ির লোকজনের সীমাহীন প্রশ্রয় তার থিয়েটার জীবনের পাথেয়। রাজা অয়দিপাউস, লেডি ম্যাকবেথ,স্পার্টাকাস,স্পুকবুক, আন্তিগোনে, বৃষ্টি,ওয়েটিং ফর ইউ, গালি দিবেননি কাক্কা, মিরর প্রভৃতি নিজের দলের বাংলা ও হিন্দি নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি অন্য দলের হয়ে বিষাদকাল, কৃষ্ণকলি, ট্রয়, তাসের দেশ, কালিদাস চরিত প্রভৃতি নাটকেও অভিনয় করেছে। চেগু নামে একটি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ফিচার ফিল্ম পরিচালনাও করেছে সে। বিনয় পাঠক (মুম্বাই), চন্দন সেন, সুদীপ্তা চক্রবর্তী, শান্তিলাল মুখার্জী প্রমুখ অভিনয় করেছেন সেই ছবিতে। এভাবেই থিয়েটারের ও অভিনয়ের জন্য কাজ করে চলেছে কয়াডাঙা সবুজ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের অভিনেত্রী তথা থিয়েটারকর্মী নবমিতা ঘোষ। কারণ, থিয়েটার তাকে বেঁচে থাকার অক্সিজেন জোগায়।